‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে খান আতাউর রহমানের সঙ্গে রওশন জামিল
পরিবারের ওনার একচ্ছত্র আধিপত্য। স্বামী, দুই ভাই থেকে চাকর-চাকরানি পর্যন্ত তার ভয়ে তটস্থ থাকেন। ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমার প্রেক্ষাপট ছিল স্বাধীনতা পূর্ব আন্দোলন নিয়ে। প্রখ্যাত নির্মাতা জহির রায়হান এই চরিত্রটি দিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের একনায়কতন্ত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন। এখন পর্যন্ত বাংলা চলচ্চিত্রে এই চরিত্রটিই সবচেয়ে জনপ্রিয় নারী খল চরিত্র। সংসারে কর্তৃত্বকারী এই চরিত্রে অভিনয় করে কিংবদন্তি হয়ে আছেন আমাদের সবার প্রিয় অভিনেত্রী রওশন জামিল।
খল অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে স্বাতন্ত্র্য করেছিলেন, তবে নানা চরিত্রে তিনি নিজেকে বারবার প্রমাণ করেছিলেন কতটা দক্ষ অভিনেত্রী তিনি। ‘জীবন থেকে নেয়া’য় যেই খান আতার সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় দর্শকেরা উপভোগ করেছিলেন, তার ঠিক কয়েক বছর পরেই ‘সুজন সখি’তে খান আতার মায়ের চরিত্রে নিজেকে দারুণভাবে মানিয়ে নিয়েছিলেন। ‘সুজন সখি’ শুধু নায়ক-নায়িকার ছবি নয়,এর বাইরে যে দুইটি চরিত্র বেশ গুরুত্ব পেয়েছে তা হলো খান আতা ও রওশন জামিলের চরিত্র। ‘সুজন সখি’র দাদির চরিত্রে যে মায়াভরা অভিনয় করেছিলেন তা অতুলনীয়।
স্বামী নৃত্যশিল্পী গহর জামিলের সঙ্গে রওশন জামিল
‘নানি গো নানি বলি যে আমি,আমারে নিয়ে লইয়া যাবা ভাইসাবের বাড়ি’, আমজাদ হোসেনের বিখ্যাত ছবি ‘নয়ন মনি’তে ববিতার সেই নানি হচ্ছেন রওশন জামিল। ‘নয়ন মনি’তেও মূল অভিনয়শিল্পীর বাইরে বেশি গুরুত্বপূর্ণ পেয়েছিল এই নানি চরিত্রটি। দাদি- নানি চরিত্র শুধু নিছক মজার চরিত্র নয়, উনি সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। ‘নয়ন মণি’তে অভিনয় করেই প্রথম জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে যখন ‘রঙিন নয়ন মনি’ নির্মিত হয়, সেখানেও তিনি শাবনূরের নানি হয়েছিলেন যা বিরল অর্জন বটে। ‘নানি গো নানি’ গানটি আবার ব্যবহৃত হয়েছিল ‘গোলাপী এখন ঢাকা’য় ছবিতে, সেখানেও চম্পার নানি তিনি।
‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ সিনেমায় ববিতা, রওশন জামিল ও আনোয়ারা
আমজাদ হোসেনের আরেক যুগান্তকারী সিনেমা ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুকে এই সিনেমার একটি দৃশ্য বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। ‘লাভ হয় না দশ ট্যাকা,টিকিট কাটুম সাত ট্যাকা’, বিড়ি ফুঁকে সেই বয়স্কা দাদির চরিত্র রওশন জামিলই করেছিলেন। শুধু এইটুকু অংশই নয়,পুরো ছবিতে তিনি ববিতা ও আনোয়ারার দারুণ সঙ্গী হয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধের ছবি ‘ওরা ১১ জন’-এও অন্যতম অভিনেত্রী তিনি।
বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ল্যাসিক চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’, এই সিনেমায় শফির মা চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় ওনার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা অর্জন। ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, এ ছাড়া ‘দহন’, ‘পোকা মাকড়ের ঘর বসতি’, ‘পেনশন’, ‘টাকা আনা পাই’ এই সিনেমাগুলোতে যেমন মমতাময়ী মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তেমন চিরাচরিত বাণিজ্যিক ধারার ছবি ‘আমার সংসার’-এও খল চরিত্রে দর্শকদের আরেকবার চমক দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ব্যবসাসফল ছবি ‘বেদের মেয়ে জোছনা’য়ও তিনি অভিনয় করেন নানির চরিত্রে, ‘মিস লোলিতা’ ছবিতে মেথরানী চরিত্রে মুগ্ধ করেছিলেন। সিনেমার পাশাপাশি অনেক নাটকেই অভিনয় করেছিলেন, সেগুলোর মধ্যে কূল নাই কিনার নাই, সকাল সন্ধ্যা, ঢাকায় থাকি, তালা অন্যতম। খুব সম্ভবত সর্বশেষ মুক্তি পাওয়া সিনেমা ‘প্রেমের তাজমহল’।
মেয়ের সঙ্গে রওশন জামিল
বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে বহুমাত্রিক অভিনয় করেও জুরি বোর্ড সেভাবে সুবিচার করেননি। বেঁচে থাকাকালীন একটি মাত্র জাতীয় পুরস্কারই দেখে যেতে পেরেছিলেন, মৃত্যুর পর ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’ সিনেমার জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। এ সিনেমাতে বিধবা পিসির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, যিনি দেশভাগের করুণ যন্ত্রণার শিকার হয়ে মাতৃভূমি ছেড়েছিলেন।
‘চিত্রা নদীর পাড়ে’ ছবিতে আফসানা মিমি ও রওশন জামিল
অভিনেত্রীর বাইরে তিনি নৃত্যশিল্পী ছিলেন,স্বামী বিখ্যাত নৃত্য পরিচালক গওহর জামিল। দুজনই নৃত্য সংগঠক ছিলেন। নৃত্যে অবদানের জন্যই ১৯৯৫ সালে একুশে পদক পেয়েছিলেন তিনি। বেঁচে থাকাকালীন এই সম্মাননা পেয়েছিলেন, তা আমাদের দেশে সৌভাগ্যের ব্যাপার বটে। বিটিভির নাটকে অভিনয়ের সূচনা, প্রথম সিনেমা ছিল ‘আলীবাবা চল্লিশ চোর’।
বোন আল্পনার সঙ্গে রওশন জামিল
১৯৩১ সালের ৮ মে জন্মগ্রহণ করেছিলেন রওশন জামিল। সৃষ্টির নিয়মে ২০০২ সালের নিজের ৭১তম জন্মদিনের মাত্র ছয়দিন পরেই ১৪ মে তিনি পরলোকে পাড়ি জমান। কিংবদন্তি এই অভিনেত্রীর প্রতি রইলো শ্রদ্ধা, আত্বার শান্তি কামনা করি।