আজ থেকে ৩৫ বছর আগে, ১৯৮৬ সালের ১৬ আগস্ট পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে মুক্তি পেয়েছিল ঢাকার এক মাইলফলক চলচ্চিত্র ‘লড়াকু- the fighter’, ছবিটির প্রযোজক ছিলেন সবার প্রিয় অভিনেতা মাসুদ পারভেজ, যিনি সোহেল রানা নামে দর্শকদের অতি প্রিয় মুখ, পরিচালক ছিলেন শহীদুল ইসলাম খোকন।
অভিনয়ে ছিলেন সোহেল রানা, জুলিয়া, পাপড়ি (নতুন মুখ) খলিল, দিলদার, মতি, জ্যাকি আলমগীর (নতুন মুখ), ড্যানি সিডাক (নতুন মুখ) ও নায়ক চরিত্রে ছিলেন মাসুম পারভেজ রুবেল নামের ২৬ বছরের টগবগে যুবক, যিনি পরপর দুইবার (১৯৮২ ও ১৯৮৩) বাংলাদেশ ন্যাশনাল কারাতে চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণপদক লাভ করেছিলেন!
বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্র উপকূলের জেলে সম্প্রদায় নিয়ে জমজমাট মৌলিক গল্পের সঙ্গে বাংলা চলচ্চিত্রের নতুন ধরনের অ্যাকশন মার্শাল আর্টের চমক ‘লড়াকু’— ছবিটি যেন তখনকার সময়ের দর্শকদের মনের ক্ষুধা মেটাতে এসেছিল, যেন এমন একটি ছবির জন্যই অপেক্ষা করছিলেন তারা। যা দেখার জন্য দর্শকেরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল প্রেক্ষাগৃহে। মাত্র ১৭টি হলে মুক্তি পেলেও তুমুল জনপ্রিয়তা আর দর্শকের চরম আগ্রহের কারণে এক সময় ছবিটির রিল নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে গেল। এমন কোন হল খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে ‘লড়াকু’ হাউসফুল যায়নি।
ওই সময়ে দর্শকের ছবিটি যেন একবার দেখে তৃপ্তি মিটে না, বহু দর্শক বারবার ছুটে গেছে সিনেমা হলে। আমি নিজেও একবার দেখে তৃপ্তি মেটাতে পারিনি, পরবর্তীতে এক-দুবার করে করে মোট ১০বার দেখেছিলাম, যখনই যেভাবে সুযোগ পেয়েছিলাম।
আরও পড়ুন: এক যুগে কোনো ফ্লপ ছিল না রুবেলের
এবার ছবিটির নির্মাণের পেছনের দিকে আসি। অভিনেতা-প্রযোজক সোহেল রানার সহযোগী পরিচালক শহীদুল ইসলাম খোকন তখন অলরেডি দুটি চলচ্চিত্র (পদ্ম গোখরা ও রক্তের বন্দি) তৈরি করে ফেলেছেন, কিন্তু সফলতার নামের স্বাদটি গ্রহণ করতে পারেননি, পারেননি নিজের ভেতরের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতেও। এই যখন অবস্থা, ঠিক তখনই তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন গুরু সোহেল রানা। একদিন গাড়িতে বসে খোকন সোহেল রানাকে ভিন্ন কিছু করার কথা শোনালেন, যেখানে গল্প থেকে অ্যাকশনে সব ক্ষেত্রেই থাকবে ভিন্নতা। সেই হিসেবে বেছে নিলেন উপকূলীয় জেলে সম্প্রদায়কে, সঙ্গে মার্শাল আর্ট। সোহেল রানা তখন ছোট ভাই রুবেলের জন্য একটি ছবি নির্মাণের কথা ভাবছিলেন, সেই হিসেবে খোকন সাহেবের চমকপ্রদ প্রস্তাবে ছবিটি নির্মাণে আগ্রহী হলেন। এবং রুবেলকে নায়ক করে পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দিলেন শিষ্য শহীদুল ইসলাম খোকনের হাতে। শিষ্যও ওস্তাদের দেওয়া দায়িত্ব ঠিকই কাজে লাগালেন, ফলশ্রুতিতে ওস্তাদ-শাগরেদ মিলে বাংলা চলচ্চিত্রে উপহার দিলেন মার্শাল আর্ট সংবলিত এক নতুন ধারার চলচ্চিত্র ‘লড়াকু-দ্য ফাইটার’। মূলত এ ছবিটির কল্যাণেই বাংলা চলচ্চিত্রে মার্শাল আর্টের পরিপূর্ণতা পায়।
এখানে একটু বলি— বর্তমানে যারা ছবি বলতেই বোম্বে (মুম্বাই), তামিল-তেলেগু আর কলকাতাকে বোঝেন, তখন কিন্তু বোম্বে-কলকাতা ‘লড়াকু’-র মতো ছবি বানানোর কথা ভাবতেই পারতো না। সোজা করে বললে, এ রকম ছবি বানানোর নির্মাতা থেকে কলাকুশলীও তাদের ছিল না। মার্শাল আর্ট চলচ্চিত্র বলতেই যখন আমরা বুঝতাম হংকং ও চাইনিজ ছবিকে। ঠিক তখনই তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেই কঠিন কাজটিই সফলভাবে উপস্থাপন করেছিলেন অত্যন্ত মেধা সম্পূর্ণ পরিচালক খোকন!
এবার আসা যাক নবাগত রুবেল প্রসঙ্গে। যিনি সোহেল রানার ছোট ভাই হিসেবেই পরাচিত ছিলেন, তবে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের আগে সাধারণ দর্শকদের কাছে ছিলেন অচেনা। তিনি ছোটবেলা থেকেই অ্যাথলেট ও ফুটবল খেলায় দারুণ পারদর্শী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পড়াকালে বিশ্ববিদ্যালয় দলের হয়ে ফুটবলও খেলেছেন। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে তিনি মার্শাল আর্টের প্রতি উৎসাহিত হন এবং নিয়মিত চর্চা করতে থাকেন। ফলশ্রুতিতে তিনি মাত্র ২২ ও ২৩ বছর বয়সে পরপর দুইবার কারাতে চ্যাম্পিয়ন হন, তবে তখনো চলচ্চিত্রে পা রাখেননি!
যাই হোক, সদ্য কারাতে স্বর্ণপদক প্রাপ্ত রুবেল প্রথম ছবি থেকেই নিজের চরিত্র নিয়ে সিরিয়াস ছিলেন। প্রতিটি ছবিকেই খুবই গুরুত্ব সহকারে নিতেন। উদাহরণ হিসেবে ‘লড়াকু’র একটি গানের কথা বলা যায়— একটি জনপ্রিয় গানের দৃশ্য বাস্তবসম্মতভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে খুবই ঝুঁকি নিয়েছিলেন। দৃশ্যটা এ রকম— ‘চলরে চল সাগরে…ভাসিরে ভাসি জোয়ারে। মাছের ও রাজা রানীরে… দুহাতে ধরে আনিরে? সকলে হাসি মুখে ঘরে ফিরিরে…’ জনপ্রিয় গানটির শুটিং হয় কক্সবাজার সৈকতে তিনটি ট্রলার দিয়ে। যার একটি ট্রলারের মাথায় দড়ি দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় ট্রলারের একেবারে নিচের দিকে ঝুঁকে পানির সঙ্গে নিজের শরীরকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে এই কঠিন দৃশ্যটি করেছিলেন, যা পর্দায় দেখলে বোঝা যায় কতটা ঝুঁকি আর সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে তার নিত্য নতুন মার্শাল আর্টের অ্যাকশনে যেন দর্শকদের চোখের পলক ফেলাই দায়। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দর্শক দেখেছে তরুণ নায়কের চোখ ধাঁধানো অ্যাকশন, যেন ভিসিআরে দেখা ব্রুসলিকে খুঁজে পেলেন তারা রুবেলের মাঝে। যার প্রেক্ষিতে রুবেল পেয়েছিলেন দেশের অগণিত দর্শকদের ভালোবাসা, সঙ্গে একের পর এক হিট ছবির তকমা। রুবেল ছিলেন সেই নায়ক যার প্রায় দেড় যুগ ফ্লপ বলতে কোন ছবি ছিল না, তার যে ছবিটি সর্বনিম্ন আয় করতো সেটাতেও প্রযোজকেরা তাদের লগ্নি তুলে আনতে পারতেন।
রুবেলের জনপ্রিয়তা তখন এমন পর্যায়ে ছিল যে, প্রিয় নায়ককে ভালোবেসে অনেকেই তাদের নবজাতক সন্তানের নাম রুবেল রাখতেন। কারাতে চ্যাম্পিয়নশিপ ছাড়াও রুবেলের অভিনেতা হওয়ার আগের আরও দুটি তথ্য অনেকেই জানেন না। পরিচালক বড় ভাই সোহেল রানার সহকারী হয়ে কাজ করেন এবং নায়ক হওয়ার আগে ও পরে চারটি চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দেন। গানগুলো হলো— সোহেল রানা-সুচরিতা অভিনীত ‘জীবন নৌকা’ ছবিতে ‘মেঘ যদি সরে যায়’, ‘যুবরাজ’ ছবিতে সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে ‘দুই দিনের দুনিয়া’, ‘বীর পুরুষ’ ছবিতে রুনা লায়লার সঙ্গে ‘হাবাগোবা পাগলারে’ ও ‘মহা তাণ্ডব’ ছবিতে ডলি সায়ন্তনী সঙ্গে ‘সেই মেয়ে যে হাসলেই ফুল ঝরে’ গানটিতে যেখানে পর্দার তার সঙ্গে ছিলেন পপি।
‘লড়াকু’তে আরেক নতুন মুখ হিসেবে খোকন হাজির করেছিলেন মন্দ চরিত্রে ড্যানি সিডাক নামের তরুণকে, যিনিও ছিলেন ক্যারাটে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। মূলত নায়ক রুবেলের মার্শাল আর্টের অ্যাকশনের যোগ্য
প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে একজন মার্শাল আর্ট জানা অভিনেতার প্রয়োজন ছিল, সেই হিসেবে ড্যানি সিডাক ছিলেন পারফেক্ট। বাস্তবেও তারা একই প্রতিষ্ঠান থেকে কুংফু শিখেছিলেন। সুঠোম দেহ ও ভরাট কণ্ঠস্বরের কারণে ড্যানিকে দারুণ মানিয়ে যায় ছবিটির চরিত্রে। দর্শকও মন ভরে উপভোগ করেন রুবেল-ড্যানির চমকপ্রদ সব অ্যাকশন। একটা সময় এমন হতো তাদের অ্যাকশন দেখার জন্য নতুন ছবির অপেক্ষায় থাকতো দর্শক। ‘লড়াকু’র কারণে যেমন মনের মতো একজন নায়ক হিসেবে পেয়েছিল সিনেমা পাগলেরা, তেমনই পেয়েছিল মন্দ চরিত্রের একজনকেকেও!
এবার ছবিটির শ্রুতিমধুর গানের দিকে আসি। বাংলা চলচ্চিত্রে গান একেবারে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। চলচ্চিত্র হবে আর সেখানে গান থাকবে না তা হবে না। বাংলা সংগীতে অনেক জনপ্রিয় গান আছে যা শুধুমাত্র সিনেমা থেকে এসেছে। এমন বহু চলচ্চিত্র আছে যেখানে দর্শকেরা হয়তো চলচ্চিত্রের নামই ভুলে গেছে, কিন্তু পর্দায় দেখা অসংখ্য জনপ্রিয় গানকে ঠিকই মনে রেখেছেন, যা মাঝে মধ্যেই মনের অজান্তে গুন গুন করে উঠেন। সেই হিসেবে ‘লড়াকু’র সবগুলো গানই হয়েছিল জনপ্রিয়, যা এখনো দর্শক-শ্রোতামহলে সমান জনপ্রিয়। গুণী সুরকার আলম খানের অসাধারণ সব সুরের জাদুতে তৈরি হয়েছিল চমৎকার কয়েকটি গান। যেখানে ছিল ‘বুকে আছে মন, মনে আছে আশা, আশা থেকে হয় বুঝি ভালোবাসা’, ‘মন যারে চায় তারে প্রেম শিখাবো, ছল করে বল করে পোষ মানাবো’, ‘চলরে চল সাগরে… ভাসিরে হাসি জোয়ারে, ‘সুন্দর এই পৃথিবী, ভালো লাগে না তোমাকে কাছে না পেলে’-এর মতো জনপ্রিয় গান।
এক নজরে: লড়াকু-the fighter, ফরম্যাট ৩৫ মিমি, সাদা-কালো, মুক্তি ১৬ আগস্ট ১৯৮৬ ঈদুল আজহা, প্রযোজক মাসুদ পারভেজ (সোহেল রানা), বিশ্ব পরিবেশনা পারভেজ ফিল্ম, পরিচালক শহীদুল ইসলাম খোকন, সংগীত পরিচালক আলম খান, কণ্ঠ শিল্পী অ্যান্ড্রু কিশোর, রুনা লায়লা ও সাবিনা ইয়াসমিন, ফাইট ডিরেক্টর ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম, অভিনেতা-অভিনেত্রী সোহেল রানা, জুলিয়া, পাপড়ি, খলিল, দিলদার, কবির খাঁ, মায়া হাজারিকা, মতি, ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম, ড্যানি সিডাক ও মাসুম পারভেজ রুবেল।
‘লড়াকু’ ঈদুল আজহার দিন একযোগে ১৭টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। এর মধ্যে রাজধানীর মিরপুরের সনি সিনেমা হলের প্রথম রিলিজ ছিল এটি। বাকি হল হলো— ঢাকার মধুমিতা, শ্যামলী, রাজমণি, মুন, মানসী, তাজমহল, নাজ, জ্যোতি, পর্বত, গ্যারিসন (ক্যান্ট), নিউ গুলশান (জিঞ্জিরা), যমুনা (পোস্তগোলা), নারায়ণগঞ্জের হংস, গুলশান, টঙ্গীর আনারকলি ও জয়দেবপুরের ঝুমুর।
আরও পড়ুন: রুবেলের সেরা দশ সিনেমা
ছবির দুটি বিষয় উল্লেখ্য না করলেই নয়। ‘লড়াকু’ চিত্রনাট্যে কমেডিয়ান দিলদারের জন্য কোন চরিত্র ছিল না। ছবির শুটিং শুরু হওয়ার মাত্র দুদিন আগে তাকে মাথায় রেখে চরিত্র তৈরি করা হয় এবং দিলদার যুক্ত হন।
দ্বিতীয় বিষয়টি ছিল রিলিজ নিয়ে। আশির দশক হতে মধ্য নব্বই দশক পর্যন্ত বেশির ভাগ সময়ই ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলো নিয়ে লটারি করা হতো, অর্থাৎ জমা দেওয়া ছবিগুলো থেকে যে নাম লটারিতে উঠবে সেগুলোই ঈদে মুক্তি পাবে। আসলে ওই সময় এত এত ছবি নির্মাণ হতো যে, ঈদের মতো বড় আসরে মুক্তি নিয়ে আয়োজকদের রীতিমতো হিমশিম খেতে হতো। সেই হিসেবে লটারিকে তারা যোগ্য সমাধান হিসেবে নিয়েছিলেন। মজার ব্যাপার হলো ‘লড়াকু’ জমাকৃত ছবির একেবারে শেষে ছিল, অর্থাৎ শেষ লটারি হিসেবে ছবিটির নাম ওঠে।
শেষে একটি কথা না বললেই নয়। তা হলো, ‘লড়াকু’ সেই ছবি, যার অ্যাকশন দেখে তখনকার শহর, মফস্বল, গ্রাম, গঞ্জের তরুণদের মাঝে মার্শাল আর্ট শেখার ধুম পড়ে যায়, দেশের অনাচেকানাচে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য মার্শাল আর্ট স্কুল। ‘লড়াকু’র আকাশচুম্বী সাফল্যের কারণে পরিচালক শহীদুল ইসলাম খোকন ও নায়ক রুবেলকে আর কখনই পেছনে তাকাতে হয়নি।