১. শোনা যায় ‘খায়রুন সুন্দরী’ চলচ্চিত্রটি পুরোপুরি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত, যদিও মূল চলচ্চিত্রে এরকম কোনো কিছু উল্লেখ করা হয়নি। কথিত আছে, ৪০-এর দশকে জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার মেরুরচর গ্রামে আজগর মাস্টারের মেয়ে খায়রন-কে দেখেই প্রেমে পড়ে একই জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বরখালী গ্রামের বিড়ির ব্যবসা করা ফজল হক। পারিবারিকভাবেই তাদের বিয়ে হয়। পরবর্তীতে সুখের সংসারে আগুন লাগায় খায়রনের ছোট ভাই, মতান্তরে ফজল হকের বন্ধু। মিথ্যা ধারণার বশবর্তী হয়ে ফজল খায়রনকে হত্যা করতে গিয়ে প্রথমবার হত্যা করে ফেলে নিজ পুত্রকে। এতে ফজল ক্ষান্ত হননি, পরে আবারো সে খায়রনকে হত্যার প্রচেষ্টা চালায়, এবার সে ডাকাতদের সহায়তায় খায়রনকে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। পরের দিন নদীতে ভেসে উঠে খায়রনের লাশ। এককান-দুকান থেকে জানাজানি হয়ে যায় ফজলের হত্যার কথা। খায়রনের লাশ শনাক্ত হয়, পড়শীরা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। অবশেষে ফজল ধরা পড়ে পুলিশের হাতে। তিনি কারাবন্দী হন। বেশ ক’বছর পর বিশেষ বিবেচনায় তিনি জেল থেকে মুক্তি পান এবং পরবর্তীতে তিনি আবার বিয়ে করেন।
২. জনপ্রিয় অভিনেতা দিলদারের মৃত্যুর প্রায় এক বছর পর ‘খায়রুন সুন্দরী’ মুক্তি পায়। জীবদ্দশায় তিনি তার অংশটুকু সম্পূর্ণ করে যেতে পারলেও এ চলচ্চিত্রের ডাবিং করে যেতে পারেননি। পরবর্তীতে তার চরিত্রে কণ্ঠ দেন জনপ্রিয় ডাবিং শিল্পী আনোয়ার শাহী। তাকে চেনার সবথেকে সহজ উপায় হলো, জনপ্রিয় বিদেশী ইসলামিক টেলিভিশন চ্যানেল ‘Peace TV’ তে তার দেওয়া Dr. Zakir Naik এর বাংলা কণ্ঠ! বাংলা ভাষায় এই ডাবিংটিতে তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন।
আমাদের চলচ্চিত্রে তিনি এর আগেও কাজ করেছেন। ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম অভিনীত সবগুলো চরিত্রের ডাবিং তার করা। জনপ্রিয় অভিনেতা রাজীব, দিলদার এবং নাসির খান জীবদ্দশায় যেসব চলচ্চিত্রের ডাবিং করে যেতে পারেননি তার প্রায় সবগুলোই পরবর্তীতে তিনি ডাবিং করেছেন।
৩. ‘খায়রুন সুন্দরী’ র তুমুল জনপ্রিয়তার পেছনে সবথেকে বড় অবদান হলো এর সংগীত অর্থাৎ গানগুলোর। ‘খায়রুন লো.. তোর লম্বা মাথার কেশ, চিরল দাঁতের হাসি দিয়া পাগল করলি দেশ’ এই গান তৎকালীন সময়ে শুনে বিমোহিত হননি এমন শ্রোতা খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। সেসময় এই চলচ্চিত্রের এ্যালবাম রেকর্ড সংখ্যক পরিমাণে বিক্রি হয়। ক্রেতার চাপ সামলাতে না পেরে অডিও প্রতিষ্ঠান চিত্রগীতি তাদের অ্যালবামের কভার ছাড়াই শুধু ডিভিডি আলাদাভাবে বিক্রয় করে, এমনটা শোনা যায়। ‘খায়রুন সুন্দরী’ চলচ্চিত্রের গীতিকার ছিলেন ওয়াদুদ রঙ্গিলা ও এ.কে সোহেল, সুরকার ছিলেন ইমন সাহা। ওয়াদুদ রঙ্গিলা উক্ত চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছেন।
‘খায়রুন সুন্দরী’ চলচ্চিত্রের সবগুলো গানই মূলত জারি গান। আবহমান বাংলায় যুগ যুগ ধরে এই গানগুলোর সুর মানুষের মুখেমুখে ভিন্নভিন্ন কথায় ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলার এই প্রাচীন ঘরানার লোকগান এখনকার দর্শকের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছিল ‘খায়রুন সুন্দরী’ র মাধ্যমে।
পরিচালক এ কে সোহেল ও মৌসুমী
৪. চলচ্চিত্রটি যখন মুক্তি পায় তখন পুরো দেশ বন্যার পানিতে নিমজ্জিত। এছাড়া কম বাজেটে নির্মিত অশ্লীল চলচ্চিত্রের ব্যাপক চাহিদা ছিল সেসময়। এরকম পরিস্থিতিতে মুক্তি পেয়েও চলচ্চিত্রটি সেবছরের সেরা ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র হয়। উক্ত চলচ্চিত্রটি সফল হওয়ার পেছনে সিনেমাহলে উপস্থিত নারী দর্শকের ভুমিকা সবথেকে বেশি। এতো পরিমাণ নারী দর্শকের ঢল ‘খায়রুন সুন্দরী’ পরবর্তী সময়ে আর দেখা যায়নি।
৫. পরিচালক এ.কে সোহেলের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান মেঘালয় চলচ্চিত্র ‘খায়রুন সুন্দরী’ প্রযোজনা এবং পরিবেশন করে। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে আমাদেরই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আনন্দমেলা চলচ্চিত্র উক্ত চলচ্চিত্রটিকে ‘প্রাণের স্বামী’ নামে ভারতে বাংলা ভাষায় রিমেক করে। পরিচালক যথারীতি মূল চলচ্চিত্রের পরিচালক এ.কে সোহেল, এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে মূল চলচ্চিত্রের অভিনেতা ফেরদৌস ও এ.টি.এম শামসুজ্জামান অভিনয় করেন।
কলকাতার রিমেকের সেটে পরিচালকের সঙ্গে ফেরদৌস ও রচনা ব্যানার্জি
মূল চরিত্রে অভিনয় করেন রচনা ব্যানার্জি, দিলদারের রূপদান করা চরিত্রটি করেন শুভাশিস মুখার্জি। আনন্দমেলা চলচ্চিত্র আমাদের দেশের অন্যতম সফল প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘মনের মাঝে তুমি’, ‘মোল্লাবাড়ীর বউ’ এর মতো বেশকিছু বাণিজ্যিক সফল চলচ্চিত্র তাদের ঘর থেকে নির্মিত হয়েছে। ‘প্রাণের স্বামী’ ছিল টালিগঞ্জে প্রযোজিত তাদের প্রথম চলচ্চিত্র।