বৃষ্টি থামতে দেখে রঞ্জন সাহা যেন একটু স্বস্তি পেল। ক্যামেরা হাতে টপাটপ ছবি তুলতে শুরু করল সে। এতক্ষণ ভয়ে শক্ত হয়ে বসে ছিল। তার এই ভয়ের কারণ, হঠাৎ বৃষ্টি। জলভরা নদীতে স্পিডবোট ছুটছে, এরই মধ্যেই কালো মেঘে ছেয়ে গিয়েছিল আকাশ। তাই দেখে অন্ধকার হয়ে এসেছিল সাঁতার না পারা রঞ্জন সাহার মুখখানা!
ভোলার চরফ্যাশনের বেতুয়া লঞ্চঘাট থেকে রওনা হওয়ার সময় আকাশটা মেঘমুক্তই ছিল। কচ্ছপিয়া ঘাট থেকে স্পিডবোটে যাত্রা শুরুর পরই মেঘে ঢেকে যায়। শুরু হয় বৃষ্টি। স্পিডবোট কচ্ছপিয়া খাল অতিক্রম করে বুড়া গৌরাঙ্গ নদে পড়তেই বৃষ্টি উধাও। ঝকঝকে রোদে আমরা ছুটে চলি চর কুকরিমুকরির উদ্দেশে।
প্রতিবছর ইলিশ ধরার মৌসুমে এই চরে একবার আসার চেষ্টা করি আমি। সেই ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালের ২ অক্টোবর গিয়েছিলাম। তবে ভ্রমণসঙ্গী রঞ্জন এবারই প্রথম। সে পর্বতপ্রেমী। নদীপথে যাতায়াত কম। কুকরিমুকরির কথা শুনে সে চট্টগ্রাম থেকে ছুটে এসে আমার সঙ্গে যুক্ত হয়।
চর কুকরিমুকরির পথে দেখা মিলল এই জেলে নৌকার
ঢাকার সদরঘাট থেকে আমরা যাত্রা শুরু করি। এরপর ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা, পদ্মায় ভেসে ভেসে একসময় মেঘনায় এসে পড়ি। বিশাল মেঘনার ঘোলা পানি আর দূরের গ্রামের মিটিমিটি আলো দেখে ভাবছিলাম, বজ্রপাতসহ বৃষ্টি হলে জমত বেশ! কথাটি রঞ্জনকে বলতেই সে ভয়ে আঁতকে ওঠে। আমি মুচকি হেসে তাকে অভয় দিই। এরপর গল্পে গল্পে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। সেই ঘুম ভাঙে পন্টুনে লঞ্চের ধাক্কায়। আমরা তখন ভোলার চরফ্যাশনের বেতুয়া ঘাটে।
সকালের নাশতা সেরে এবার কচ্ছপিয়ায় ছুটে চলা। গাড়িতে চড়ে বসি। হেলেদুলে ৪০ মিনিটে কচ্ছপিয়ায় পৌঁছে যাই। সেখানে আগে থেকেই স্পিডবোট আমাদের অপেক্ষায়। স্পিডবোটে চড়ে বসতেই চলতে শুরু করে। যে গল্প শুরুতেই বলেছি। বুড়া গৌরাঙ্গ থেকে তেঁতুলিয়া হয়ে অনেক দূর এঁকেবেঁকে স্পিডবোট কুকরির খাল বা কুকরির ভারানীর ভেতর দিয়ে পৌঁছে দিল চর কুকরিমুকরি ঘাটে।
মেঘনা ও তেঁতুলিয়া যেখানে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে, সেখানেই একসময়ের নিরালা চর, বর্তমানে সরব চর কুকরিমুকরির অবস্থান। কুকরিমুকরির যেখানে দৃষ্টি পড়ে, সেখানেই সবুজ।
কুকরিমুকরির যেখানে দৃষ্টি পড়ে, সেখানেই সবুজ
চর কুকরিমুকরিতে নেমে ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের কাছে চলে আসি। এখানকার গাছে গাছে মাটির হাঁড়ি আলাদা দৃষ্টি কাড়ে। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হাশেম মহাজনের উদ্যোগ এটি। প্রতিটি গাছ পাখির বসবাসযোগ্য করে তুলতেই এই ব্যবস্থা করেছেন।
মাছ হাতে একজন জেলে
ইউনিয়ন পরিষদ ভবন থেকে আমাদের জায়গা হয় বন বিভাগের রেস্টহাউসে। পরিচ্ছন্ন হয়ে আবার বেরিয়ে পড়ি। আবুল হাশেম মহাজন আগেই দক্ষিণ কুকরির মনুরাঘাট চলে গেছেন। আমরাও একটা মোটরবাইক নিয়ে মনুরাঘাট রওনা হই। রাস্তা একদম ছবির মতো। দিন দিন কুকরিমুকরির যোগাযোগব্যবস্থা সুন্দর হচ্ছে বোঝা গেল।
আধঘণ্টার কম সময় লাগল মনুরাঘাট পৌঁছাতে। দেখলাম ১৫ থেকে ২০টি সাম্পান সমুদ্র ও নদী থেকে তখনই ফিরেছে। সাম্পান ভরে ইলিশ এনেছে। সেই ইলিশ নিলামে বিক্রি হচ্ছে। রঞ্জন ইলিশের নিলাম কখনো দেখেনি, সে প্রক্রিয়া দেখে অবাক হয়।
ডাকাতিয়া খালকে স্থানীয়রা বলেন ডাকাইত্তা খাল
ততক্ষণে জোয়ারের সময় হয়। আমরা দেরি না করে নারকেল বাগানের উদ্দেশে ডাকাতিয়া খালের দিকে এগিয়ে চলি। চলতি পথে দেখা মেলে মহিষের পাল।
খালের নাম ডাকাতিয়া (স্থানীয়রা বলেন ডাকাইত্তা) কেন হলো, তা নামে পরিষ্কার। বছর পঞ্চাশেক আগেও কুকরিমুকরির চর ও এর আশপাশের এলাকায় তেমন জনবসতি ছিল না। সে সময় ডাকাতেরা আশপাশের এলাকায় ডাকাতি শেষে এই খালের নির্জন এলাকায় এসে আশ্রয় নিত। ডাকাত দল এখানে নিরাপদে বসবাস করত। ডাকাতদের কারণেই খালটির নাম হয় ডাকাতিয়া খাল। এসব তথ্য জেনেছি স্থানীয়দের কাছে।
ডাকাতিয়া খালে পৌঁছে দেখি, মাছ ধরার অনেক নৌকা। প্রতিটি নৌকাই মাছে ভরপুর। কিছুক্ষণের মধ্যে সব ইলিশ খালাস হবে। মাছের আড়তে আমরা বসি। পরিবার উন্নয়ন সংস্থা বা এফডিএ ইকো ট্যুরিজমের ডিঙিনৌকা চলে এলে উঠে পড়ি। মাঝির নাম রফিক। বয়স বারো থেকে চৌদ্দ হবে। নৌকায় ওঠার আগেই তার সঙ্গে আমাদের ভাব হয়ে যায়। প্রথমত, সে ভালো গান জানে। দ্বিতীয়ত, রফিকের নৌকায় চড়ার আগে সে মাছ ধরার জালে আটকে পড়া একটা সাপ অবমুক্ত করেছিল, এমন সাহসী রফিককে পছন্দ না করে উপায় ছিল না!
ডাকাতিয়া খাল
গোলপাতা, কেওড়া, বাইন, গর্জন, কাঁকড়া, নারকেলগাছ, বাঁশ ও বেতবন মিলে চর কুকরিমুকরির শ্বাসমূলীয় বন। ডাকাইত্তার খালের সৌন্দর্য বর্ণনা করার আগে একটি শব্দই মনে ধরল—অনন্য, অসাধারণ। আমরা দুপাশে বন আর তার মধ্যখানে ডাকাইত্তার খালে ভেসে ভেসে নারকেল বাগানের দিকে এগিয়ে চলি। এই যে ভেসে চলা, এমন হয়তো অনেক চলেছি। কিন্তু একবার ডাকাতিয়া খালে যে চলবে, সেই স্মৃতি কখনো ভোলার নয়। নীরবতা আর খালের দুপাশের সবুজ ডাকাতিয়াকে অনন্যতা দান করেছে। সেই সবুজের বুকে দৃষ্টিনন্দন কাঁকড়া ফুল ফুটে আছে, অনেক গাছ বেঁকে আছে কাঁকড়া ফলে। কেমন ছায়াঘেরা চারদিক সবুজময়।
সে সবুজ থেকে আরেক সবুজে গিয়ে যখন পড়লাম, যখন নৌকা থেকে নামলাম। কাঁকড়া বনের সে সবুজ পার হতেই দুচোখ ছানাবড়া। নিস্তব্ধ কাঁকড়া বন পেরিয়ে সমুদ্রের গর্জনে আমরা চমকে উঠি, অভিভূত হই। পলকহীন চেয়ে থাকি প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য পানে।
গরুর পাল নিয়ে বাড়ি ফিরছেন স্থানীয় একজন
প্রয়োজনীয় তথ্য
শীতকাল চর কুকরিমুকরি বেড়ানোর উপযুক্ত সময়। সে সময় কুকরিমুকরি ও তার আশপাশে প্রচুর পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটে। অবশ্য এবার আমরা বর্ষা মৌসুমে ইলিশের টানে চর কুকরিমুকরি গিয়েছিলাম, সেখানে দুদিন ছিলাম। ঢালচর, চর পাতিলা ঘুরেছি ইলিশের নৌকায়। কুকরিমুকরির দক্ষিণ ও উত্তরের ম্যানগ্রোভ বনে গিয়েছি। বৃষ্টিভেজা কাদামাটির বনভূমিতে অনেক বানর চোখে পড়লেও হরিণের দেখা মেলেনি।
চর কুকরিমুকরি নৌপথেই যেতে হয়। ঢাকার সদরঘাট থেকে ভোলার চরফ্যাশন সরাসরি লঞ্চ চলে। বেতুয়া কিংবা ঘোষের হাট নামিয়ে দেবে। সেখান থেকে মোটরসাইকেল কিংবা অটোরিকশায় যেতে হবে চরকচ্ছপিয়া। এরপর ট্রলার কিংবা স্পিডবোটে চর কুকরিমুকরি। চর কুকরিমুকরিতে হোমস্টে সার্ভিস চালু হয়েছে। সেখানে থাকা যাবে। বন বিভাগের রেস্টহাউসে থাকতে চাইলে আগে থেকে বুকিং করে যেতে হবে। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষেরা চাইলে তাঁবুতে রাত্রিযাপন করতে পারবেন।
চর কুকরিমুকরিতে তখন জোয়ারের সময়
চর কুকরিমুকরির নারকেল বাগান ক্যাম্পিংয়ের জন্য নিরাপদ ও জনপ্রিয়। এখানে খাওয়াদাওয়া মানে টাটকা মাছ। বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পেলেও ইলিশের প্রাচুর্য বেশি। বাবুগঞ্জ বাজারে কয়েকটা খাবারের হোটেল রয়েছে। আগে থেকে বলে রাখতে হবে।
সতর্কতা
জলপথে যাত্রা বলে সঙ্গে লাইফ জ্যাকেট রাখলে ভালো। খাওয়ার স্যালাইন, বিশুদ্ধ পানি, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও শুকনা খাবার সঙ্গে নেবেন। পরিবেশ হুমকিতে পড়ে এমন কিছু থেকে বিরত থাকুন।
[FA]pen[/FA] লেখক: ফারুখ আহমেদ