গত এক থেকে দেড় বছরে বহুবার ভোল পাল্টেছে করোনাভাইরাস। প্রথম দিকে যেসব উপসর্গ ও সমস্যা বেশি দেখা দিয়েছিল, পরবর্তী সময়ে তার অনেকগুলোই বদলে গেছে। যেমন প্রথম দিকে খাবারের স্বাদ আর গন্ধ একেবারেই হারিয়ে যাওয়া, গলাব্যথা, কাশি—এগুলো ছিল কোভিডের অন্যতম উপসর্গ। কারও কারও চোখ লাল, কনজাংটিভাইটিস হতে দেখা গিয়েছিল। একসময় বেশ কিছু মানুষের কেবল পেটব্যথা আর ডায়রিয়ার মতো উপসর্গ হয়েই কোভিড হতে দেখা গেছে।
সম্প্রতি করোনার ঢেউয়ে আমরা লক্ষ করছি, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে আগের উপসর্গগুলো অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। বরং জ্বরের সঙ্গে ঠান্ডা–সর্দি, মাথাব্যথা, শরীরব্যথা, নাক দিয়ে পানি পড়ার মতো উপসর্গ দেখা দিচ্ছে প্রাথমিক পর্যায়ে। অনেকটাই সিজনাল বা মৌসুমি ফ্লুর মতো যেন। কিন্তু কেন এই পরিবর্তন?
বারবার উপসর্গ পাল্টানোর কারণ দুটি। প্রথমত, যেকোনো পরিবেশে একটা ভাইরাস দীর্ঘদিন থাকার কারণে কিছু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। একে বলা হয় মিউটেশন। ভাইরাসের জিনগত মিউটেশন ঘটে আর তা নতুন নতুন ধরনে আবির্ভূত হয়। আমরা এর মধ্যে নানা ধরনের মিউটেশনের কথা শুনেছি। সম্প্রতি দেশের ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় ডেলটা ধরন সংক্রমিত করছে বেশি, এ সংবাদও আমরা পেয়েছি। তাই ধরন বদলের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে আক্রমণের গতিপ্রকৃতিও।
দ্বিতীয়ত, সংক্রমণ দীর্ঘদিন থাকার কারণে সংক্রমিত এলাকার মানুষের মধ্যেও একধরনের ইমিউনিটি গড়ে ওঠে। এই ইমিউনিটি সংক্রমণ–পরবর্তী বা টিকা গ্রহণ—দুই কারণেই গড়ে উঠতে থাকে। তাই ভাইরাসে সংক্রমণের উপসর্গগুলোও রূপ বদলাতে থাকে।
তবে প্রাথমিক উপসর্গ যা–ই থাক, কোভিড হলে কারও কারও যে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যেতে পারে, রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা বাড়ে আর তা থেকে নানা জটিলতা এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে—সে কথা সব সময়ই মনে রাখতে হবে।
সব মিলিয়ে সাম্প্রতিক সংক্রমণে চার ধরনের প্রবণতা লক্ষণীয়
১. এই ভেরিয়েন্ট বা নতুন ধরনের সংক্রমণে অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সীরাও ব্যাপক হারে আক্রান্ত হচ্ছেন, যা আগে দেখা যায়নি। এমনকি শিশু-কিশোরদেরও আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে অনেক। আর আগের সঙ্গে একটা বড় পার্থক্য হলো কেবল বৃদ্ধ ও অসুস্থরা নন, যুবক ও মধ্যবয়সীদেরও হঠাৎ অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে বা অক্সিজেন দরকার হচ্ছে।
২. এই ধরন আগের তুলনায় অনেক বেশি সংক্রামক, মানে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বলে আগেই প্রমাণিত হয়েছে বিভিন্ন গবেষণায়। একই পরিবার বা পাড়া, জায়গা বা কর্মক্ষেত্রের অনেক বেশিসংখ্যক মানুষ একসঙ্গে আক্রান্ত হচ্ছেন। এর ফলে একেকটি এলাকার চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর একসঙ্গে বেশি চাপ পড়ছে।
৩. এই ধরনে আক্রান্ত ব্যক্তিরা আগের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম সময়ের মধ্যে জটিল পরিস্থিতিতে পড়ছেন। মানে সাধারণ জ্বর, সর্দি, ফ্লুর মতো মনে হলেও অনেক সময় কোভিড টেস্টের রিপোর্ট পাওয়ার আগেই অক্সিজেন কমে যাচ্ছে বা জটিলতা দেখা দিচ্ছে। আগে জ্বরের প্রথম দিন থেকে সাত–আট দিনের মাথায় রোগীর জটিলতা হতে দেখা যেত। এখন তা তিন থেকে চার দিনের মাথায়ও দেখা যাচ্ছে। সে কারণে রোগী বা পরিবার আকস্মিক বিপদে পড়ছে কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই।
৪. যাঁরা আগে সংক্রমিত হয়ে সুস্থ হয়েছেন, যাঁরা ইতিমধ্যেই করোনার টিকার দুই ডোজ নিয়েছেন—তাঁদেরও কেউ কেউ কোভিডে আক্রান্ত হচ্ছেন নতুন করে। তবে তাঁদের বেশির ভাগেরই মৃদু বা মাইল্ড ধরনের সংক্রমণ হচ্ছে আর বড় ধরনের জটিলতা ছাড়াই সেরে উঠছেন।
যা করবেন
বর্তমান অতিমারি অতিক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত জ্বর আছে, এমন যেকোনো পরিস্থিতিতেই সচেতন হতে হবে। সবার সব ধরনের উপসর্গ থাকবে, তা আশা করলে চলবে না। এমনকি এ সময়ের মৌসুমি ফ্লু, সাধারণ জ্বর, সর্দি–কাশি, গা–ব্যথা, মাথাব্যথার মতো উপসর্গ থাকলেও চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া এবং কোভিড টেস্ট করিয়ে নেওয়া উচিত।
কোভিড নয়, এটা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত যেকোনো ধরনের জ্বর বা ভাইরাস সংক্রমণের উপসর্গে নিজেকে আইসোলেশন করে ফেলা উচিত, যাতে রোগটা আরও বেশি না ছড়াতে পারে। বর্তমানে অনেকেই শরীরব্যথা, মাথাব্যথা, সামান্য জ্বর বা নাকে পানি নিয়েও বাইরে যাচ্ছেন, অফিস করছেন—তা কমিউনিটি সংক্রমণ আরও ছড়াতে সাহায্য করছে।
বাড়িতে আইসোলেটেড থাকাকালে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন, বিশ্রাম নিন, নিজেকে সাবধানে পর্যবেক্ষণ করুন। নিজে নিজে কোনো ওষুধ সেবন করবেন না। এমন হতে পারে, কোনো চিকিৎসা ছাড়াই সেরে উঠবেন। অকারণে অ্যান্টিবায়োটিক, স্টেরয়েড বা অন্যান্য ওষুধ সেবন বরং আরও বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। চিকিৎসক মনে করলে কোভিড টেস্টের পাশাপাশি অন্যান্য টেস্ট করতে দিতে পারেন, আবার তা না–ও লাগতে পারে।
প্রতিরোধ সবচেয়ে ভালো
যে ধরনই হোক, করোনা প্রতিরোধ করতে এখনো যে তিনটি পদ্ধতি সমানভাবে সব ধরনের বিরুদ্ধে কার্যকর, তা হলো মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা আর টিকা গ্রহণ।
ইতিমধ্যেই এটা প্রমাণিত যে করোনার বিদ্যমান টিকা ডেলটা ও অন্যান্য ভেরিয়েন্টের বিপরীতেও কার্যকর। টিকা নেওয়ার পর করোনা হবে না, ব্যাপারটা তেমন নয়। তবে এটি মৃত্যুঝুঁকি কমিয়ে দিতে সক্ষম। তাই যাঁরা এখনো টিকা নেননি, তাঁরা দ্রুতই নিবন্ধন করুন।
যাঁরা টিকা নিয়েছেন বা আগে সংক্রমিত হয়েছেন, তাঁরাও মাস্ক পরবেন আর সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন। কারণ, একটি জনপদের ৭০ শতাংশ মানুষ টিকার আওতায় না আসা পর্যন্ত সেই জনপদে স্বাস্থ্যবিধি মানায় কোনো ছাড় দেওয়া চলবে না। এখন পর্যন্ত মাত্র ৩ শতাংশ মানুষ টিকা পেয়েছেন। তাই এখনই মাস্ক খোলা, ভিড় বা জনসমাগমে চলাফেরা করা উচিত হবে না। প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাবেন না। সামাজিক উৎসব, বেড়ানো, নিমন্ত্রণ রক্ষা করার সময় এখনো আসেনি। প্রতিদিনই করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এই সংখ্যায় নিজেকে বা নিজের আপনজনকে যুক্ত করতে নিশ্চয় আমরা কেউ চাই না। তাই সচেতনতায় কোনো ছাড় নয়।
* ডা. আবদুস শাকুর খান | বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ এবং কোষাধ্যক্ষ, বাংলাদেশ লাং ফাউন্ডেশন