করোনাকালে এমনিতেই কোথাও বের হতে পারছিলাম না। তারপর এল লকডাউন। দীর্ঘদিন গৃহবন্দী। এর মধ্যেই সুযোগ এল কক্সবাজার ভ্রমণের। সুযোগ এল বটে, বিপত্তি বাধাল যাতায়াত। বাস চলাচল বন্ধ। অভ্যন্তরীণ রোডে বিমান চলছিল তখনো। তথ্যটা জেনে তড়িঘড়ি টিকিট কেটে ফেলি।
সিলেট থেকে সস্ত্রীক যাত্রা করেছি। মেঘের ভেলায় ভেসে সকাল সাড়ে ১০টায় আমরা কক্সবাজার বিমানবন্দরে পৌঁছালাম। রিসোর্টে থাকার বন্দোবস্ত আগে করেই এসেছি। তারাই গাড়ি পাঠিয়েছে আমাদের নিতে। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়েই গাড়িতে উঠে বসি। গাড়ি ছুটে চলল সৈকতঘেঁষা রিসোর্টের দিকে। এটুকু পথ যেতে যেতে সাগরপাড়ের এই শহরের বেহাল পথ তার জানান দিল, পর্যটকদের কথা ভেবে খারাপই লাগল।
তবে রিসোর্টে পা রেখে মনটা ভালো হয়ে গেল। হাতের ডানেই সমুদ্রের বেলাভূমি। মন চাইল নেমে পড়ি। কিন্তু আগে আনুষ্ঠানিকতা। তথ্যকেন্দ্রের আনুষ্ঠানিকতা শেষে জানাল, সরকারি বিধিনিষেধের জন্য সৈকত বন্ধ আছে, রুম থেকে সৈকত দেখতে হবে। ভাবলাম, করোনার কারণে যেহেতু সৈকতে নামতে দিচ্ছে না, তাই তাদের ইনফিনিটি সুইমিংপুল বেশি সময় ব্যবহার করা যাবে।
রুম থেকে সমুদ্রে কয়েক শ কদম দূরে। ব্যাগ রেখেই ঝুলবারান্দায় দাঁড়াই। আহা, কী বাতাস। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে সৈকতে। পূর্ণিমার সময় তখন। তাই সমুদ্র কিছুটা উত্তাল। সমুদ্রের অসাধারণ রূপ রুম থেকেই দেখতে পাচ্ছি। সৈকতে তখন গুটি কয়েক মানুষ। স্ত্রী সানন্দাকে বলি, যাক, রুমে বসেই সমুদ্র উপভোগ করতে পারব! সানন্দা বলে উঠে, সমুদ্রের জলে পা না ভেজালে মন ভিজবে না!
আমি কিছু না বলে চুপ করে রই। চোখজুড়ানো সমুদ্রের একদম কাছে দাঁড়িয়ে সাগরের ঘ্রাণমাখা নির্মল বাতাসে তৃপ্তির শ্বাস ফেলি। মনে হচ্ছে ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে’ কে যেন আসবে এখন। হৃদয়ের সব নির্মল বাতাস দিয়ে হয়তো বলবে, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন’। দৃষ্টি যত দূর যায়, আকাশ আর সমুদ্র মিশে একাকার।
সবাই বলে, শীতকাল কক্সবাজার ভ্রমণের আদর্শ সময়। গরমে নাকি সৈকতে যাওয়া যায় না, সমুদ্র উপভোগ তো দূরের কথা, বালুর উত্তাপে দাঁড়িয়ে থাকা দায়। আর বর্ষায় নাকি কক্সবাজারের অব সিজন! আমি অবশ্য সব মৌসুমেই কক্সবাজারের গিয়েছি। শীতের কক্সবাজারকে আমার কাছে মনে হয়েছে জনসমুদ্রের ভেতর নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়! মানুষের ভিড়ে হাঁটা যায় না, একদণ্ড কোথাও চুপচাপ বসা যায় না, মন খুলে ঘুরে বেড়ানো যায় না, চারদিকে মানুষ গিজগিজ করে। আর বর্ষায় কক্সবাজার?
সে অন্তত শীতের চেয়ে ভালো। লোকজন কম থাকে, হোটেল-মোটেল আর খাওয়ার খরচও কমে যায়। নির্দ্বিধায় আর নির্জনে সমুদ্র দেখা যায়। অনুভব করা যায় দূর থেকে সমুদ্রের শব্দ।
সেই সকালে সিলেটের বাসা থেকে বেরিয়েছি। এখন ঘড়ির কাঁটা বলছে ১১টা ২০ মিনিট। শুধু রিসোর্টে ঢোকার সময় আমের শরবত ছাড়া পেটে আর কিছুই পড়েনি। সানন্দা বলল, ‘চা বানিয়ে দিই।’ রুমে দেখলাম আগের থেকেই চকলেট, বিস্কুট, চিপস, কেক ইত্যাদি খাদ্যসামগ্রী রাখা আছে। রুম থেকে বসে সমুদ্র উপভোগের সঙ্গে চা পান করলাম।
এবার তৈরি হয়ে বের হলাম। ইচ্ছে, একটু সমুদ্রের জলে পা ভেজাব বলে। হোটেল থেকে বের হয়েই কয়েক পা দিয়েই সৈকতে পা দিলাম। মানুষজন নেই বললেই চলে, আছে শুধু সমুদ্রের সঙ্গে দিগন্ত নীল ওই আকাশ। ঢেউ, প্রেম, প্রকৃতি। অন্য সময়ের তুলনায় সৈকত বেশ পরিচ্ছন্ন। সানন্দা খুব উচ্ছ্বসিত সমুদ্রের জলে পা ভেজাতে পেরে। দুজনে ছবি তুললাম।
বেশ কিছু সময় সমুদ্রের কাছে থাকলাম আমরা। এদিকে পেটে রাম–রাবণের যুদ্ধ শুরু হয়েছে। তাই পেটে কিছু দেওয়া প্রয়োজন। সৈকত থেকে বের হয়ে টমটম নিয়ে গেলাম পাশের একটি হোটেলে। দুপুরে সেখানে খাওয়ার জন্য রুপচাঁদা মাছ, কোরাল মাছ, ভর্তা, সবজি অর্ডার দিলাম। করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি মেনেই খাদ্যসামগ্রী পরিবেশন করা হলো। খাওয়াদাওয়া শেষে হোটেলের রুমে চলে গেলাম।
করোনার কারণে সবকিছুই বন্ধ। আমরাও ভেবেছিলাম, কোথাও বের হব না। কিন্তু হিমছড়ি, ইনানীতে একচক্কর না দিলে হয়? টমটমে এগিয়ে চললাম। এক পাশে বিশাল বঙ্গোপসাগর, অন্য পাশে উঁচু পাহাড়। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে কক্সবাজার থেকে টেকনাফে যাওয়ার মেরিন ড্রাইভ সড়ক। চলতি পথে সব সময়ের মতো ঝাউবনের সঙ্গে সমুদ্রের মিতালি মুগ্ধ করল। হিমছড়ি নেমে জানলাম, করোনাকালের জন্য তা বন্ধ। সেখানে থেকে গেলাম ইনানীর দিকে। পথে আমাদের টমটম চালকের কাছে ইনানী সৈকত খোলা আছে কি না জানতে চাইলে সে বলল, খোলা আছে। মেরিন ড্রাইভ রোড দিয়ে টমটম করে ভ্রমণ খারাপ লাগছিল না। আমরা এলাম ইনানী সৈকতে। এটাও বন্ধ। তাই আর দেরি করে ফিরে চললাম শহরের দিকে।
চলে এলাম কলাতলী মোড়ে। আমাদের রিসোর্ট লাগোয়া সৈকতে। অপেক্ষা, হেলে পড়া সূর্যের জন্য। রোদের উত্তাপ কমে এল, চলে গেলাম সমুদ্রের একদম কাছে। ধীরে ধীরে আঁধার ঘনিয়ে এল। সূর্যাস্ত দেখলাম নীরব দাঁড়িয়ে।
পরদিন ঘুম ভাঙল ভোরে। পূর্ণিমার চাঁদটা তখন পশ্চিম আকাশে। অপার্থিব একটি দৃশ্য। চাঁদের আলোয় পুরো সৈকত চিক চিক করছে। আমি আর সানন্দা অপেক্ষা করতে লাগলাম সূর্যোদয়ের। একসময় বিপরীত দিক থেকে সূর্যোদয়ের আভাস দিল। ঝাপসা হতে শুরু করল চাঁদের আলো। জেগে উঠল পাখির দল। সেই কলতানে মুখরিত হতে থাকল রিসোর্টের চারপাশ।
কিছু সময় পরই আকাশ কালো হয়ে এল। মেঘের সঙ্গে ঝিরঝির বৃষ্টি পড়তে থাকল। বৃষ্টির সঙ্গে একটু ঝোড়ো হাওয়ার আভাস মিলতেই সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠল। ঝোড়ো হাওয়ায় সমুদ্রের ভয়াল গর্জন মনে ভয় জাগাল ঠিকই, কিন্তু সে রূপও মুগ্ধতায় অগ্রাহ্য করা গেল না। আমাদের আটকে রাখল চুম্বকের মতো। পরিবেশের মুহূর্তের রূপ বদল শিহরণ জাগাল সমস্ত সত্তায়। তখনই স্ত্রীর প্রস্তাব রিসোর্টের সুইমিংপুলে যাওয়ার। গেলাম সুইমিংপুলে। পুল থেকে সমুদ্র খুব কাছে মনে হচ্ছিল। সেখানে কিছু সময় থেকে আবার গেলাম সমুদ্রের কাছে। সমুদ্রের কাছে এই আসাটা বিদায়ের জন্য।
২৫ ঘণ্টার সমুদ্রযাপন শেষে আমরা আবার উঠে পড়লাম সিলেটে ফেরার উড়োজাহাজে।
* সুমন্ত গুপ্ত