কামরূপ নিয়ে বাঙালির মধ্যে একটা রোমাঞ্চকর কৌতুহল। কথিত আছে, এখানে ডাকিনী-যোগিনী আছে যারা জাদুবিদ্যায় পারদর্শী। অনেক নারী আশঙ্কায় থাকেন, তার স্বামী, ভাই কিংবা ছেলে যদি কোনোভাবে কামরূপ-কামাখ্যায় চলে যান, তবে সেখানকার নারীরা 'ভেড়া' বানিয়ে রাখবেন। এই কারণে কামরূপ-কামাখ্যা নিয়ে একটা ভয় সবার মধ্যেই কাজ করে। আসামের গুয়াহাটি শহর থেকে পশ্চিমে নীলাচল পাহাড়ের চূড়ায় আছে কামরূপ-কামাখ্যা মন্দির। সনাতন বিশ্বাস অনুযায়ী এই মন্দির অত্যন্ত পবিত্র একটি শক্তিপীঠ। মন্দিরটিকে ৫১ সতীপীঠের একটি বলে বিশ্বাস করা হয় এবং মনে করা হয়, শিব যখন প্রলয়নৃত্য করেছিলেন, তখন মা পার্বতীর যোনির অংশটি এই স্থানে পড়েছিল।
গর্ভ এবং যোনির অংশ পড়ার কারণে এই স্থান বিশেষভাবে পূজিত হয়ে থাকে। সন্তান লাভের আকাঙ্ক্ষায় কিংবা অন্য কোনো মনোস্কামনায় নিঃসন্তান দম্পতিকে এখানে আসতে দেখা যায়।
ধারণা করা হয়, কামরূপে একসময় কালো জাদুর প্রচলন ছিল। কিন্তু দেবী কামাখ্যা প্রকট হয়ে ওঠার পর আসামের এই জেলা হয়ে ওঠে তন্ত্র সাধনার পীঠস্থান। তখন থেকেই তান্ত্রিকদের অভয়ারণ্য হয়ে ওঠে কামরূপ-কামাখ্যা। কামরূপ-কামাখ্যা বলতে কামরূপ জেলায় দেবী কামাখ্যার মন্দিরকেই বোঝানো হয়। আর মন্দিরের সঙ্গে অবধারিতভাবেই তান্ত্রিকদের সাধনার বিষয়টি চলে আসে।
ধরনীকান্ত দেবশর্মা কামাখ্যা মন্দিরের সবচেয়ে বড় পুরোহিত হিসেবে উপমহাদেশে পরিচিত। তার রচিত 'কামাখ্যা-দর্শন' বইয়ে লেখা হয়েছে, 'ভারতবর্ষে আর্যধর্মের অগণিত তীর্থস্থান আছে। পুরাণ তন্ত্রাদি মতে, ৫১টি মহাপীঠের মধ্যে যুগ যুগ ধরে কামাখ্যা মহাপীঠই সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনার জাগ্রত ও পুণ্যতম শক্তিপীঠরূপে বিদিত।'
অনেকে মনে করেন, শুধু কামরূপ-কামাখ্যায়ই তন্ত্র শেখানো হয়। কিন্তু এই ধারণা সঠিক নয়। কারণ তন্ত্র শেখাতে গুরুর প্রয়োজন। আর সেটা কামরূপ ছাড়াও ভারতবর্ষ তথা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছে।
'কিংবদন্তী কামরূপ কামাখ্যা' শিরোনামে লেখা এক নিবন্ধে ইসমে আজম কামরূপ-কামাখ্যা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে গিয়ে লিখেছেন, 'গাড়িতে করে পাহাড়চূড়ায় যাওয়ার সময় ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম ছোটবেলার সেই জাদুকরের মুখে শোনা কিংবদন্তির কথা। ড্রাইভার জানালেন, এই জাদুর রাজ্য এখানে নয়, সে অন্য অঞ্চল। তবে এখানেও নাকি বহু আগে মহাশক্তিধর তান্ত্রিক ছিলেন। তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারতেন। এখন আর নেই। তবে উৎসবের সময় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তান্ত্রিকসাধুরা জমায়েত হন কামাখ্যায়। নিজেদের শক্তি-ক্ষমতা বাড়াতে। বিশেষ দিনের একটু লালপানি সংগ্রহের আশায়। যে তান্ত্রিকের কাছে এই পানি আছে, তিনি মহাশক্তির অধিকারী। প্রাচীনকাল থেকেই সাধু-সন্ন্যাসী আর তান্ত্রিকদের সাধনালয়ের জন্যই হয়তো কামাখ্যার এত কিংবদন্তি' (২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, প্রথম আলো)।
পুরাণ থেকে জানা যায়, সত্য যুগে সতী মা পার্বতী তার বাবা দক্ষ রাজার অমতে মহাদেব শিবকে বিয়ে করেন। এ ঘটনায় ভীষণ ক্রুদ্ধ হন দক্ষ রাজা। প্রতিশোধস্পৃহায় শিব ও মা পার্বতীকে না ডেকেই বৃহস্পতি নামে একটি যজ্ঞের আয়োজন করেন তিনি। মহাদেবের অনিচ্ছাসত্ত্বেও মা পার্বতী সেই শিবহীন যজ্ঞে উপস্থিত হন। দক্ষ রাজা এ সময় মহাদেবকে নিয়ে কটূক্তি করেন। অভিমানাহত হয়ে সতী মা যোগবলে আত্মাহুতি দেন।
এ ঘটনা শিবের কানে পৌঁছালে রাগান্বিত হয়ে দক্ষ রাজার যজ্ঞানুষ্ঠান ভণ্ডুল করে দেন। সতী মায়ের মরদেহ কাঁধে নিয়ে শুরু করেন প্রলয়নৃত্য। ফলে পুরো বিশ্বে শুরু হলো প্রলয়। দেবতাদের অনুরোধে মহাদেবকে নিবৃত্ত করতে যান বিষ্ণু। কিন্তু শত চেষ্টার পরেও মহাদেব না থামলে বিষ্ণ দেব তার সুদর্শন চক্র দিয়ে সতী দেবীর মরদেহ ছেদন করেন। এতে মহাদেব নিরস্ত্র হন। এই দেহখণ্ডগুলো ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে পড়ে। যা পরবর্তীতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পীঠস্থান বা শক্তিপীঠ হিসেবে পূজিত হতে থাকে। শিবের তরুণী স্ত্রী ও মোক্ষদাত্রীশক্তিই 'কামাখ্যা' নামে সমধিক পরিচিত।
তথ্যসূত্র:
১. ধরনীকান্ত দেবশর্মা, 'কামাখ্যা-দর্শন';
২. ইসমে আজম, 'কিংবদন্তি কামরূপ কামাখ্যা' (প্রথম আলো);
৩. লেখকের এ-সংশ্লিষ্ট আরেকটি নিবন্ধ।