ঐতিহাসিক কলকাতা শহরকে নিয়ে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে গেছে হাজারো কাহিনী। আর এ সমস্ত কাহিনীর মধ্যে বেশ কিছু আছে যা শুনলে ভয়ে গা শিউড়ে ওঠে। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস- কলকাতা শহরে বেশ কিছু ভুতুড়ে যায়গা রয়েছে। ঐতিহাসিকগণ এসব ঘটনার বেশিরভাগকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তবে কিছু যায়গা আছে- যেখানেই সত্যিই নানান ব্যাখ্যাহীন ঘটনা ঘটেছে এবং এখনও ঘটে চলেছে। এসব স্থানের মধ্যে একটি স্থানের কথা আলাদা করে না বললেই নয়। তা হচ্ছে- কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং । দীর্ঘদিন যাবত কলকাতায় বসবাস করছেন এমন মানুষের মুখে এই বিল্ডিং সম্পর্কে নানান কথা প্রচলিত আছে। অনেকেই নাকি নিজ চোখে এখানে ভুত দেখেছেন। তবে এখানে ভুত আছে কি নেই- সেই প্রশ্নে আমরা যাব না। শুধুমাত্র বিভিন্ন সময়ে যেসব অতিপ্রাকৃত এবং ব্যাখ্যাহীন ঘটনা ঘটেছে এখানে, তা আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করবো...সাথেই থাকুন…
রাইটার্স বিল্ডিং কেন বানানো হয়েছিল?
মূলত কলকাতার স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মচারীদের জন্য ব্রিটিশ আমলে বানানো হয় এই রাইটার্স বিল্ডিং। কিন্তু বিল্ডিংটি ছিল কর্মচারীদের তুলনায় অনেক বেশি বড়। এমনকি জানা যায় যে- এখানে এমন বহু ঘর হয়েছে যেগুলি কখনও খোলা হয়নি, খোলার প্রয়োজনও হয়নি। অনেকের ভাষ্যমতে, প্রশাসনিক কার্যক্রমের পাশাপাশি অনেক অনৈতিক কাজও হতো এখানে। ব্রিটিশরা সে সময়কার প্রতিবাদী স্থানীয় ব্যাক্তিদের এখানে ধরে এনে অত্যাচার করতো। এমনকি মেরে ফেলতো। কথায় আছে, ব্রিটিশদের এসব অত্যাচারের কাহিনী নাকি মহাকরণের দেওয়ালে দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হতো।
কখন থেকে ভুতুড়ে কর্মকান্ড শুরু হল?
ব্রিটিশদের নিপীড়নে মৃত্যুবরণ করা ব্যক্তিদের আত্মা নাকি স্থানটি ছেড়ে কখনও যায়নি। ফলে প্রশাসনিক ভবন হিসেবে চালু করার পর থেকেই এখানে নানান অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটতে থাকে। বিশেষ করে নবান্ন শুরু হওয়ার ঠিক আগে প্রতিবছর এই ভবনে শুরু হয়ে যেত নানান রহস্যজনক ঘটনা। হঠাৎ করেই চিৎকার ভেসে আসা, হঠাৎ করে বিল্ডিং এর সব লাইট এক সাথে নিভে যাওয়া আবার জ্বলে ওঠা, বিল্ডিং জুড়ে গমগম শব্দ হওয়া, হঠাৎ করে প্রচন্ড শীত অনুভূত হওয়া- এমন নানান ঘটনা ঘটতো এই বিল্ডিং এ। এসকল কারণে সন্ধ্যার পর থেকে এখানে আর কেউই কাজ করতে চাইতেন না। এই ভবনের আশেপাশে যাদের বাড়ি, তাঁরা বলেন, এখনও মাঝেমধ্যেই নাকি রায়টার্স বিল্ডিং থেকে হাড় হিম করা শব্দ শোনা যায়।
এই স্থানে দীর্ঘদিন দায়িত্বে থাকা একজন নৈশপ্রহরী জানিয়েছেন-
“রাত নামলে রাইটার্স বিল্ডিং এর জনশূন্য অলিন্দ যেন হয়ে ওঠে অশরীরীদের আখড়া। এই রাইটার্স বিল্ডিংয়ের পাঁচ নম্বর ব্লকটি মোটেই সুবিধার স্থান নয়। রাত নামতেই এখানকার বারান্দা দিয়ে কারা যেন হেঁটে বেড়ায়। দৌড়ে গিয়েও দেখা যায় না কাউকেই। এখানকার ঘরগুলো থেকে শোনা যায় একটানা টাইপের আওয়াজ। দোতলায় কারা যেন ভেসে উঠে মুহূর্তেই মিলিয়ে যায়”।
কিভাবে রাইটার্স বিল্ডিং ভুতুড়ে স্থানে পরিণত হল?
১৮ শতকের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে, এখানেই একসময় ছিল কুখ্যাত সেই কলাগাছের জঙ্গল যেখানে ব্রিটিশরা অনেক সাধারণ মানুষকে মেরে পুতে রেখেছিল। একবার বেশ কয়েকজন ইংরেজকে এখানেই কবর দেওয়া হয়েছিল বলেও জানা যায়। লর্ড ভ্যালেনটিনের তথ্য মতে, ওয়েস্টার্ন অঞ্চলের মতো ঘোড়ায় টানা গাড়ির খেলা বা ডুয়েল (বন্দুকযুদ্ধ) চলত এই এলাকায়। হর হামেশা লেগে থাকত খুন-জখমের মত ঘটনা। এমন বহু ঘটনার কথা আজও এই এলাকায় মানুষের মুখে মুখে ফেরে। আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল এখানে- বৃটিশদ বিরোধী আন্দোলনের সময় বিনয়-বাদল-দীনেশের মত স্বাধীনতাকামী সৈনিকদের হাতে কর্নেল সিমসন খুন হয়েছিলেন। সব মিলিয়ে খোদ এই সরকারি দপ্তরটিতে অশরীরীদের অস্তিত্ব আজও অস্বীকার করতে পারেন না কেউই।
রাইটার্স বিল্ডিং এর বর্তমান হালচাল
ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে দীর্ঘদিন ধরে রাইটার্স বিল্ডিং ছিল রাজ্যের প্রধান প্রশাসনিক কার্যালয়। তবে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য প্রশাসনিক দপ্তর হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে এটি। আগামী দিনে এই রাইটার্স বিল্ডিং যে আবার তার স্বমহিমায় ফিরে আসতে চলেছে, তার ইঙ্গিত দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনেক দিন যাবত সংস্কারের কাজ চলছে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে। আমরা আশা করবো এই আধুনিকায়নের মাধ্যমে ভবন থেকে চিরতরে বিদায় নেবে ইতিহাসের কালো অধ্যায়।
| রাইটার্স বিল্ডিং সম্পর্কে আরও জানুন উইকিপিডিয়া থেকে |
ইতিহাসের এই গল্পটি এখানেই শেষ হয়ে গেলেও, এর রেশ কিন্তু থেকেই যায়! অন্যরুপে, অন্য কোথাও! জানা যায় যে, বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলেও রয়টার্স বিল্ডিং এর মতো একটি বিল্ডিং রয়েছে যেখানে ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের উপর খেয়াল খুশি মতো অত্যাচার চালাতো। বর্তমানে সেই ভবন সরকারি কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু সেখানেও প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে নানান ভুতুড়ে কর্মকাণ্ড। আগামীতে সেই ভবনের ভিডিও হাজির হবো আপনাদের সামনে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন সবাই।