রুবেল মানেই কৈশোরের এক সুপার হিরোর গল্প। তার নিজের একটা অধ্যায় আছে আমাদের চলচ্চিত্রে। রুবেল ছাড়া দেশীয় চলচ্চিত্রের সম্পূর্ণ আলোচনা সম্ভব নয়।
আমরা যারা নব্বই দশকে বেড়ে ওঠা সিনেমাপ্রেমী তাদের আগে থেকেও নায়ক রুবেলের আরেকটা দর্শকশ্রেণি গড়ে উঠেছিল আশির দশক থেকে। রুবেলের ব্যস্ততা ঐ সময় থেকেই।
মূলনাম মাসুম পারভেজ। জন্ম ৩মে, ১৯৬২, বরিশাল। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বড়ভাই দেশের চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা অভিনেতা সোহেল রানা। স্ত্রী সুলতানা পারভেজ নীলা, ছেলে নিলয় পারভেজ। ঢাবির তৎকালীন ব্যাডমিন্টনে দুইবার রানার্স আপ ছিল। জাতীয় কারাতে চ্যাম্পিয়নশিপে ১৯৮২ ও ১৯৮৩ সালে স্বর্ণপদক লাভ করে। কারাতের দেশীয় আয়োজনে তার পুরস্কারই সর্বোচ্চ। ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলমের কাছ থেকে মার্শাল আর্ট শেখা এবং জনপ্রিয়তায় তাঁকে ছাড়িয়ে যায়। চলচ্চিত্রে আসার আগে প্রথম প্লেব্যাক ‘জীবননৌকা’ ছবিতে ‘মেঘ যদি সরে যায়’ গানে। ‘সুইড বাংলাদেশ’ নামে মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে তার।
কৈশোরের সুপার হিরো রুবেলকে অ্যাকশন ছবিতে দেখেই তার একটা ভক্তশ্রেণি তৈরি হয়। মনে আছে আমাদের বড়ভাই, চাচা, মামারা সিনেমাহলে রুবেলের ছবি দেখে এসে ভীষণ গল্পের হাট বসাত। রুবেল কিভাবে ফাইট করে, ফাইটের সাথে শব্দ হয় কিভাবে, কি কি কসরত দেখায় এসব। রুবেলের অ্যাকশন ছিল মার্শাল আর্টের। তার এ ধরনের ছবিগুলো যখন টিভিতেও দিত খুশি হয়ে যেত মানুষ। শুক্রবারের পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবির সময়টাতেও রুবেলের ছবির আকর্ষণ ছিল আলাদা। কারণ একটাই তার ছবি অন্যদের থেকে অ্যাকশনে আলাদা। একটা সময় ছিল রুবেলের ছবিগুলো দেখে দেখে ছেলেরা মার্শাল আর্টের প্র্যাকটিস করত মাঠে-ঘাটে। অনেকটা বিগ ফাইট শো-এর মতো মার্শাল আর্টের ছবি দেখা যাবে কিন্তু নিজেদের চেষ্টা করার সময় মনে রাখতে হবে ‘don’t try this at home.’
প্রথম ছবি – লড়াকু। উল্লেখযোগ্য অন্যান্য ছবি :বজ্রমুষ্টি, ডন, মুর্খ মানব, মৃত্যুদণ্ড, আজকের হিটলার, সেয়ানা পাগল, মানুষ, উল্কা, শ্রদ্ধা, রাগী, পরাধীন, আর্তনাদ, চোখের পানি, নীল সাগরের তীরে, বীর বিক্রম, হুংকার, ঘরের শত্রু, শত্রু সাবধান, বীরযোদ্ধা, বজ্রপাত, লাওয়ারিশ, দেশ দুশমন, রুবেল আমার নাম, গোলামির জিঞ্জির, সুখের আশায়, বেঈমানির শাস্তি, আমিই শাহেনশাহ, মায়ের কান্না, ইনকিলাব, শত্রু ঘায়েল, মিথ্যার রাজা, গোলাবারুদ, অধিনায়ক, আজাদ, আন, ট্রাক ড্রাইভার, পলাতক আসামী, ফেরারী আসামী, বাবা কেন আসামী, ভাংচুর, রক্ত নিশান, কালো চশমা, অর্জন, মা মাটি দেশ, অন্যায় অত্যাচার, মীরজাফর, অন্ধ আইন, ওমর আকবর, সম্পর্ক, জ্বলন্ত আগুন, কুংফু নায়ক, প্রেমিক রংবাজ, জীবন মানেই যুদ্ধ, বেয়াদব, স্বজন, ফুটপাতের শাহেনশাহ, লৌহ মানব, ক্ষমতার লড়াই, সন্ত্রাসী নায়ক, লড়াই, চুরমার, ঘৃণা, উত্তর দক্ষিণ, মালামাল, মৃত্যুর সাথে পাণ্জা, মুক্তি চাই, মাস্তান সম্রাট, বিক্রম, দমকা, জজ সাহেব, জজের রায়ে ফাঁসি, আত্মপ্রকাশ, অন্যায়ের প্রতিশোধ, লিনজা, লড়াকু, বীরপুরুষ, উদ্ধার, বিষদাঁত, অকর্মা, বিপ্লব, উত্থান পতন, নরপিশাচ, সন্ত্রাস, টপ রংবাজ, অপহরণ, শত্রু ভয়ঙ্কর, সতর্ক শয়তান, ঘাতক, দুঃসাহস, বিশ্বপ্রেমিক, রাক্ষস, লম্পট, গৃহযুদ্ধ, চারিদিকে শত্রু, দিন মজুর, ভণ্ড, পাগলা ঘণ্টা, যোদ্ধা, অন্ধকারে চিতা, টর্নেডো কামাল, মুখোশধারী, চাই ক্ষমতা।
কিছু কিছু ছবিতে রুবেলকে দেখে খুব আনকমন লেগেছে। যেমন – অকর্মা। চোখের সামনে যখন ভাসে বোকা রুবেলের গোঁফবিহীন গোবেচারা টাইপের লুক হাসি থামে না। দুনিয়ার সবচেয়ে নিরীহ মনে হয় তাকে। সুচরিতাকে ভালোবাসে। সুচরিতাকে নিয়ে তার অনেক আদরের ডাক ‘মেমসাহেব।’ মেমসাহেবকে বিয়ে করার জন্য নিজেই উদ্যোগী হয়ে প্রস্তাব নিয়ে যায় তার ভাই কবির খাঁর কাছে। নিষ্ঠুর কবির খাঁ কি মারটাই না মারল বেচারা রুবেলকে! মুখ দিয়ে লালা ঝরল লাগাতার। সে কি কান্না রুবেলের! তারপর প্রতিজ্ঞা করল শহরে গিয়ে টাকা উপার্জন করে কবির খাঁর কাছে আনবে এবং মেমসাহেবকে বিয়ে করবে। পুরো ছবিতে তার ডাকনাম নিয়ে গোলোযোগ বাঁধে। সবাই ‘কাদের’ ডাকে প্রথমে রুবেল অভিমান করে বলে ‘আব্দুল কাদের।’ ‘মুর্খ মানব’ ছবিতেও রুবেলকে গোবেচারা টাইপের দেখা গেছে প্রথমে কিন্তু পরে জানা যায় একজন ডিটেক্টিভ পুলিশ ছিল। ‘চারিদিকে শত্রু’ ছবিটা খুব ভালোভাবে মনে গেঁথে গিয়েছিল। এ ছবিতে রুবেলের কয়েকটা লুক ছিল। গোঁফহীন, গোঁফযুক্ত, লম্বা চুল এভাবে। সত্যি বলতে গোঁফ ছাড়া রুবেলকে একদম মানতে পারতাম না। তার সৌন্দর্যই ছিল গোঁফ। রুবেলের একদম ব্যতিক্রমী ছবি ছিল ‘বেয়াদব।’ ছবিটা বাণিজ্যিক হয়েও অন্যরকম ছিল। গল্পে গ্রাম-শহর মিলিয়ে সমাজের প্রচলিত অপরাধের বিরুদ্ধে মেসেজ ছিল। স্যাক্রিফাইসিং ক্যারেক্টারে ‘মানুষ’ ছবিটিতে রুবেলকে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। কমেডিতে ‘অপহরণ।’ নেগেটিভ রোলে ‘উল্কা’ ছবিতে রুবেল ছিল অবাক করার মতো। এ ছবিতে তার অভিনয় দেখে মনে হবে রুবেল নেগেটিভ রোলে কাজ করলেও দুর্দান্ত পারফর্ম করত।
রুবেল দেশের চলচ্চিত্রে সবচেয়ে বেশি নায়িকার বিপরীতে অভিনয় করেছে। সেই আশির দশক থেকে ২০০০ পরবর্তী সময় পর্যন্ত অনেক নায়িকার বিপরীতে ছবি করেছে। জুটি ছিল কবিতা, লিমা, অরুণা বিশ্বাস, মৌসুমী, পপি-দের বিপরীতে।
ভিউকার্ডের যুগে রুবেলের কুংফু স্টাইলের ভিউকার্ড পাওয়া যেত। ছেলেদের বইয়ের ভেতর পাওয়া যেত ‘অপহরণ, বিশ্বপ্রেমিক, লড়াকু, নরপিশাচ, সন্ত্রাস’ এরকম আরো ছবির ভিউকার্ড।
বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে পরিচালক-নায়ক কম্বিনেশনে যে কয়েকটি ধারা ছিল তার মধ্যে অন্যতম সেরা শহীদুল ইসলাম খোকন ও রুবেল জুটি। নির্মাতা-শিল্পীর এমন অনবদ্য জুটি ঢালিউডে কমই এসেছে। শহীদুল ইসলাম খোকন যে ধরনের ছবি নির্মাণ করতেন ছবিগুলো ছিল তাঁর নিজের চলচ্চিত্রকেন্দ্রিক ভাষাকে তুলে ধরার প্রয়াস। ছবিগুলোর মধ্যে অ্যাকশন, রোমান্টিক, ফ্যামিলি ড্রামা, কমেডি আছে। তবে মোটের উপর হিশাব কষলে তাঁর ছবিগুলোকে অ্যাকশনই বলতে হয়। রুবেল ছিল তাঁর ছবির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য শিল্পী। খলনায়ক হিশাবে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। এই ত্রয়ের যোগফলে দেশীয় ব বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র সমৃদ্ধি পেয়েছে। সামাজিক দায়বদ্ধতার যে ভাষায় প্রতিবাদী চলচ্চিত্র নির্মাণ করতেন কাজী হায়াৎ তার পাশাপাশি খোকনও ছিলেন প্রতিবাদী ভাষার পরিচালক।
খোকন-রুবেল কম্বিনেশনের ছবিগুলো: লড়াকু, বীরপুরুষ, উদ্ধার, বিষদাঁত, অকর্মা, বিপ্লব, উত্থান পতন, নরপিশাচ, সন্ত্রাস, টপ রংবাজ, অপহরণ, শত্রু ভয়ঙ্কর, সতর্ক শয়তান, ঘাতক, দুঃসাহস, বিশ্বপ্রেমিক, রাক্ষস, লম্পট, গৃহযুদ্ধ, চারিদিকে শত্রু, দিন মজুর, ভণ্ড, পাগলা ঘণ্টা, যোদ্ধা, মুখোশধারী, চাই ক্ষমতা।
রোমান্টিক ঘরানা বললে ‘বিশ্বপ্রেমিক’ ছবিটি সবার আগে আসবে। রোমান্টিকের ভেতরেও খোকন সাইকোপ্যাথ কিলিং-কে এনেছেন। রুবেল-মৌসুমীর চমৎকার রসায়ন ছবিটিকে অসাধারণ করেছে। কমেডি ছবির মধ্যে ‘অপহরণ, ভণ্ড’ এ দুটি অসাধারণ। ‘অপহরণ’ এগিয়ে থাকবে কারণ এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিখাদ কমেডি আছে। নায়ক, খলনায়ক এবং অন্যান্য সব চরিত্রেই কমেডি ছিল। অ্যাকশন ছবি বলতে গেলে বাকি সবগুলোই। ‘লড়াকু’ দিয়ে মার্শাল আর্টের যে ধারা শুরু হয়েছিল তার ধারাবাহিক ব্যবহার ছিল পরের ছবিগুলোতেও। ‘বীরপুরুষ, বিষদাঁত, অকর্মা, বিপ্লব, উত্থান পতন, টপ রংবাজ, ঘাতক, সতর্ক শয়তান, লম্পট, রাক্ষস, চারিদিকে শত্রু, শত্রু ভয়ঙ্কর, যোদ্ধা’ এগুলো টোটালি ফুল প্যাকেজ অ্যাকশন ছবি ছিল। মার্শাল আর্টের ইতিহাস, ঐতিহ্যের ক্লাসিক পরিবেশনা ছিল ‘বজ্রমুষ্টি’ ছবিতে এদিক থেকে এ ছবিটির বিশেষ গুরুত্ব আছে। ফ্যামিলি ড্রামায় ‘গৃহযুদ্ধ, দুঃসাহস, দিনমজুর’ এ ছবিগুলো উপভোগ্য। রুবেলকে নানা ধরনের ক্যারেক্টারাইজেশনে খোকন দেখিয়েছেন। এভাবে বিভিন্ন ধরনের ছবিতে খোকন-রুবেল কম্বিনেশন আছে।
রুবেলের জনপ্রিয় কিছু গান –
রংচটা জিন্সের প্যান্ট পরা – উত্থান পতন
বুকে আছে মন – লড়াকু
কাছে আসতে আসতে এত কাছে এসেছি – অর্জন
শিখা আমার শিখা – বিশ্বপ্রেমিক
কত ভালোবাসি আমি তোমাকে – বিশ্বপ্রেমিক
ও সাথীরে আমারই জীবন শুধু তুমি – ভণ্ড
বুড়ো খোকার জন্মদিনে – সতর্ক শয়তান
আমি পথকে করেছি সাথী – পাগলা ঘণ্টা
আমি একশো বছর – পাগলা ঘণ্টা
যোদ্ধা আসবে – যোদ্ধা
বুড়ো খোকার জন্মদিনে – সতর্ক শয়তান
এ কি কথা শুনাইলি রে – বিশ্বপ্রেমিক
দেখেছি প্রথমবার – স্বজন
অনেক ভালোবেসেছে হয়েছি তোমার – স্বজন
আমার ইচ্ছে করে কাছে যাই – স্বজন
এইতো প্রথম দেখলাম – স্বজন
দুচোখে তুমি যে স্বপ্ন – কালো চশমা
আমি পথকে করেছি সাথী – পাগলা ঘণ্টা
ও সাথীরে আমারই জীবন শুধু তুমি – পাগলা ঘণ্টা
বলোতো আমি তোমার কে – পাগলা ঘণ্টা
আমি প্রেমের একখান ঘর বানাইয়া – অকর্মা
মাটি কাটা কন্দেকদার – আজকের হিটলার
দিনগুলো যায় চলে যায় – কালো চশমা
আমি একশো বছর তোমারই অপেক্ষাতে আছি – পাগলা ঘণ্টা
আমারে তুই প্রেম শিখাইয়া – বেয়াদব
রুবেল ছবিও পরিচালনা করেছিল। তার পরিচালিত ছবিগুলো হচ্ছে – মায়ের জন্য যুদ্ধ, বিচ্ছু বাহিনী, প্রবেশ নিষেধ, অন্ধকারে চিতা, খুনের পরিণাম, বাঘে বাঘে লড়াই, টর্নেডো কামাল, বিষাক্ত চোখ, সিটি রংবাজ, রক্ত পিপাসা, চারিদিকে অন্ধকার।
রুবেল পরিচালকের পাশাপাশি তার ছবির নায়কও। পরিচালক হিসেবে তার সাফল্য আছে যেমন ‘বিচ্ছু বাহিনী’ যে বছর মুক্তি পায় সেরা দশ ছবির একটি ছিল ব্যবসাসফলতার দিক থেকে। ছবিটি ব্লকবাস্টার হয়েছিল। অন্যান্য ছবিগুলোও ব্যবসাসফল ও অ্যাভারেজ। কিন্তু পরিচালক রুবেলের ছবির বিষয়বস্তু বিশেষ কিছু হতে পারেনি। তার ছবিগুলো টিপিক্যাল বিষয়ভিত্তিক ছিল। ‘বিচ্ছু বাহিনী’ ছোটদের মার্শাল আর্ট নিয়ে বিনোদনমূলক ভিন্নতা দিয়েছে এছাড়া ‘টর্নেডো কামাল’-এর গল্পে মেসেজ ছিল ধর্ষণবিরোধী প্রতিবাদের দিক থেকে এবং ‘অন্ধকারে চিতা’ ছবিটিতে রুবেলের লুক ব্যতিক্রমী ছিল। কিন্তু তার পরিচালিত ছবি অশ্লীলতার দোষে দুষ্ট ছিল মোটাদাগে। সেজন্য বিশেষ কিছু হতে পারেনি। নিজের পরিচালিত ছবি বাদেও রুবেল অনেক অশ্লীল ছবিতে অভিনয় করেছে সেজন্য সমালোচিত হয়েছে।
সিনেমাহলে রুবেলের ছবির উত্তাপ ছিল দেখার মতো। তার স্টারডম আজকের যে কোনো নায়কের থেকে অনেকগুণ বেশি ছিল। অ্যাকশনে বিশেষত্ব কিংবা মার্শাল আর্টের জনপ্রিয়তার কারণেই সেটা হয়েছিল।
ডিজিটাল সময়ে এসে বেশকিছু কারণে রুবেল ট্রলের পাত্র হয়েছে। পূর্বের অসাধারণ ইমেজের বিপরীতে একটা প্রজন্ম তাকে নিয়ে যাচ্ছেতাই ট্রল করেছে যার জন্য রুবেলও পরোক্ষভাবে কিছুটা দায়ী।
রুবেল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বড় একটা অংশ হয়েই থাকবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।