What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected জোনাকির আলো (1 Viewer)

dukhopakhi

Global Moderator
Staff member
Global Mod
Joined
Mar 3, 2018
Threads
102
Messages
11,932
Credits
110,928
Calculator
Mosque
Calculator
LittleRed Car
LittleRed Car
LittleRed Car
জোনাকির আলো

মূল লেখকঃ ডাঃআফতাব হোসেন।






আসসালাতু খায়রুম মিনান নাউম। কাছের, দূরের, অনেকগুলো মসজিদ হতে এক সাথে আজানের এই সুর ভেসে আসে। ঘুম হইতে নামাজ উত্তম। প্রতিদিনই এই শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ষোলো ফুট বাই বারো ফুট একটা ঘরে, গত সাত দিন ধরে শুয়ে আছি। একা। ঠিক খুলনা শহরে নয়। একটু শহরতলীতে বাসা আমার। সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে হলেও কংক্রিটের দেয়ালগুলো এখানে এখনও গা ঘেঁষাঘেঁষি করে মাথা তুলে দাড়ায়নি। বাড়ি ঘরের মাঝে মাঝে, এখানে, সেখানে এখনও অনেক গাছ গাছালি। উপর থেকে দেখলে বাড়িগুলোকে তাই সবুজের পটে আঁকা ছবির মতো মনে হয়।

আমার বাড়িটির সামনে অনেকখানি জায়গা ফাঁকা। সেখানেও নানা জাতের গাছ। আম, কাঁঠাল, পেয়ারা। আছে গোটা তিনেক মাথা উঁচু মেহগনি গাছ। এক পাশে বাড়ির বাউন্ডারি দেয়াল ঘেঁষে গুবাক তরুর সারি। অনেকটা নজরুলের সেই কবিতার মতো। তারই একটার পাতারা ছুঁয়ে থাকে আমার জানালার কার্নিশ। যখন বাতাস বয়, তখন সেই পাতাগুলো ঝালর দোলানো পাখার মত হাওয়া দেয়। আমার নিস্তেজ শরীরে ও মনে কী এক শিহরণ জাগে। কেমন শান্তির পরশ লাগে। জানালার গ্রিলের সাথে ওদের পাতার ঘর্ষণে এক ধরণের শব্দ হয়। যেন বলতে চাইছে, " মুসাফির জাগো, নিশি আর নাই বাকী"। আমার শুকনা ঠোঁটে ম্লান হাসি ফোটে। আমিও বিড়বিড় করে বলি,

"চমকিয়া জাগি, ললাটে আমার কাহার নিশাস লাগে?

কে করে বীজন তপ্ত ললাটে, কে মোর শিয়রে জাগে?

জেগে দেখি, মোর বাতায়ন-পাশে জাগিছে স্বপনচারী

নিশীথ রাতের বন্ধু আমার গুবাক-তরুর সারি!

আজানের শব্দে গাছে গাছে ঘুমিয়ে থাকা পাখিরাও ডানা ঝাপটে জেগে ওঠে। কত সব নাম নাম না জানা সে পাখি। তাদের কলরবে মুখরিত হয়ে ওঠে ভোরের বাতাস। একটা কোকিল অনবরত ডেকে চলে কুহু কুহু তানে। ওরাও কি এভাবে ঈশ্বর কিংবা প্রকৃতির বন্দনা করে ? হয়ত! পাখিদের ভাষা আমি বুঝতে পারি না। তবে বড় ভালো লাগে এই সব পাখিদের কোলাহল। আহা, কত সুন্দর হয় এই পৃথিবী। আমার খুব ইচ্ছে করে, উঠি। উঠে ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতায় অবনত হই।

কয়েক সপ্তাহ আগেও এমন সময় উঠে, ফ্রেস হয়ে, বন্ধুদের সাথে হাঁটতে বের হতাম। ঘণ্টা খানেক হেঁটে, পাড়ার মোড়ে বসে লাল চা আর বিস্কুট খেতে খেতে, জম্পেশ আড্ডায় মেতে উঠতাম। চায়ের কাপে ঝড় তুলে, রাজা উজির মেরে, দেশ ও জাতির কল্যাণ করে, যে যার ঘরে ফিরতাম।

কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল, সম্ভবত চেঙ্গিস খান, হালাকু খানদের জিন বহনকারী, এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণী, যাকে খালি চোখে দেখাও যায় না, আক্রমণ করে বসল এই পৃথিবী। শক্তিতে, হিংস্রতায় সে ছাড়িয়ে গেল তার পূর্বসূরিদের। মাত্র তিন মাসে দখল করে নিয়েছে তারা প্রায় দুই শতাধিক দেশ। প্রবল আক্রোশে হত্যা করে চলেছে হাজার হাজার মানব সন্তান। চেঙ্গিস খান, হালাকু খানদের তাও দেখা যেত, এদের তো দেখাও যায় না। অদৃশ্য শত্রুর সাথে কী ভাবে যুজবে মানুষ? ভয়ে, আতংকে ঘরের ভেতর আশ্রয় নিয়েছে আজ সবাই। সামান্য একটা ভাইরাস সামাজিক জীব এই আমাদের পুরা অসামাজিক করে দিল। বাইরে যাওয়া যাবে না। এক সাথে হাঁটা যাবে না। কাউকে ছোঁয়া যাবে না। কারও বাসায় যাওয়া যাবে না। কেউ বাসায় আসতে পারবে না। করোনার কারণে মানবতা আজ হয়ে গেছে গৃহবন্দি!

সেই থেকে আর দল বেঁধে হাঁটার উপায় নেই। কার নিশ্বাসে লুকিয়ে আছে প্রাণঘাতী করোনা, কেউ জানে না। তবু আমি বাইরে বের হতাম। অদৃশ্য সেই শত্রুর হাত থেকে বাঁচতে সুরক্ষা বর্মে নিজেকে আচ্ছাদিত করে বের হতাম। একা একাই হাঁটতাম। তবে শহরের দিকে যেতাম না। উলটো পথ ধরে, মাইল দেড়েক হাঁটলেই দক্ষিণ দেয়ানার বিল। সেই বিলে সারি সারি মাছের ঘের। সেই সব ঘেরের মাঝে মাটির আল। সরু মেঠো পথ। সে পথের দুধারে নানা রকম গাছ, ঝোপ, ঝাড়। জনশ্রুতি আছে, আগে দিনে দুপুরেও এই বিলে মানুষ খুন করে পুতে রাখা হত। ভয়ে এ পথ কেউ ভুলেও পা মাড়াত না। এখন সে সব ভয় নেই। তবু জনশূন্য এ পথ। কখনও সখনও দু একজন কামলা টাইপের মানুষ দেখা যেত। করোনার ভয়ে তারাও আর আসে না এখানে। আমার কেন জানি কোনো ভয় কাজ করত না। বিলের মধ্যে এলেই আমি মুখের মাস্কটা নামিয়ে দিতাম। লম্বা টানে বুকে ভরে নিতাম বিলের নির্মল বাতাস। ঘাসের ডগায় জমা শিশির বিন্দুগুলো আমার পা ভিজিয়ে দিত। গাছের পাতারা আমার গায়ে মমতার আলতো পরশ বুলিয়ে দিত। আমি একা একা হাঁটতাম আর পাখিদের গান শুনতাম। নিজের সাথেই নিজে কথা বলতাম। ঘণ্টা দুয়েক প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে থেকে ফিরে আসতাম আপন ডেরায়। তারপর সারাদিন সেই বন্দি কারাগারে।

সপ্তা দুই আগের কথা। চৈত্রের সকালেও সেদিন ঘন কুয়াশা। দশ হাত দুরেও দেখা যায় না। কুয়াশা আমার খুব ভালো লাগে। বাতাসে কেমন এক ভেজা ভেজা স্পর্শ। আমি আনমনে হাঁটছি বিলের আল ধরে। দেখি পথের ধারেই একটা ঝোপে ফুটে আছে অনেক নাম না জানা নানা রঙের জংলী ফুল। আমার যে কী হয়, এক থোকা ফুল ছিঁড়ে হাতে নিই। প্রেয়সী সাথে থাকলে পরিয়ে দিতাম তার খোঁপায়। হঠাৎ এক কিন্নরী কিশোরী কণ্ঠ বলে ওঠে,

- এটা কী করলে ?

শুনে চমকে উঠি আমি। দিনে দুপুরে যেখানে পুরুষ মানুষও আসে না, সেখানে, এই সাত সকালে, কিশোরী এলো কোথা থেকে ? ঘন কুয়াশার চাদরে তখনও ঢেকে আছে বিলের বুক, গাছের মাথা, ঝোপ ঝাড়ের মুখ। কেমন এক গা ছমছমে সুনসান নীরবতায় ডুবে আছে চারিদিক। আমি ভালো করে এদিক সেদিক দেখি। কেউ নেই। কিছু নেই। শুধু একটা কোকিল এই নৈশব্দের মাঝেও কণ্ঠে সেধে চলেছে এক বিরহের সুর। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,

- কে ? কে কথা কয় ?

- আমি কাজল রাণী।

- কাজল রাণী ? কোথায় তুমি ? আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?

- আমাকে যে দিনের আলোয় দেখা যায় না ডাক্তার।

শুনে আমি এবার সত্যি সত্যি আমি ভয় পেয়ে গেলাম। দিনের আলোয় দেখা যায় না মানে কী ? আবার আমি যে ডাক্তার, তাও জানে দেখছি। বয়াতী বাড়ির পোলা আমি। ছেলেবেলায় বৈরাগী বাড়ির ভূতের দাবড়ের কথা এখনও স্মৃতিতে অম্লান। ভূত প্রেত নয় তো ? আমার গায়ে কাঁটা দেয়। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় জানতে চাইলাম,

- কী বলছ তুমি ? দিনের আলোয় দেখা যাবে না কেন?

হঠাৎ রিনঝিন শব্দে হেসে ওঠে অদৃশ্য কিশোরী। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার মতো হাসতেই থাকে রিনিঝিনিয়ে। তার হাসিতে যেন গাছের পাতারাও দুলে দুলে ওঠে। কেঁপে কেঁপে ওঠে ঝোপ ঝাড়। অদৃশ্য করোনার ভয়ে আমার কি শ্রুতি বিভ্রম হচ্ছে? নাকি সত্যি সত্যি অশরীরী কেউ আছে এখানে ? ছেলে বেলায় দেয়া কলিম বয়াতীর উপদেশ মনে পড়ে। এমন অবস্থায় একমাত্র করণীয়, ঘুরে ভোঁ দৌড়। যেই দৌড় দিতে যাব, অমনি শুনি,

- আমার ডাক্তার কি ভয় পেলে ?

আমার ডাক্তার ? কী শুনছি এ সব ? আমার পা অবশ হয়ে যায়। দৌড় তো দূরের কথা, এক পা নড়ারও যেন শক্তি নেই আর। কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম,

- কেন এই বুড়ো মানুষটাকে মিছেমিছি ভয় দেখাচ্ছ ? যেই তুমি হও, আমার সামনে এসো।

- আমি তো তোমার সামনেই আছি।

- কেন হেয়ালী করছ? সামনে থাকলে আমি দেখতে পাচ্ছি না কেন ?

- আরে বোকা, আমি তো জোনাকি পোকা। দিনের বেলায় আমাকে দেখবে কেমন করে ?

- যাহ, জোনাকিরা আবার কথা বলতে পারে নাকি?

- কেন পারবে না ? মানুষেরা কথা বলতে পারলে জোনাকিরা পারবে না কেন?

- তা পারে। কিন্তু পোকাদের কথা তো মানুষের বোঝার কথা নয়।

- তা ঠিক। তবে আমি চাইলে পারে।

- কেন ? তুমি কি বিশেষ কেউ?

- তা বলতে পারো। আমি হলাম এই জোনাক রাজ্যের রাজকন্যা। সবাই আমাকে আদর করে কাজল রাণী বলে ডাকে।

শুনে আমার কেন জানি ভয় কেটে যায়। কাজল রাণী যেই হোক, জোনাক রাজ্যের রাজকন্যা কিংবা কোনো এক অশরীরী আত্মা, আমার ক্ষতি যে করবে না, তা বুঝে গেছি। হেসে জিজ্ঞেস করলাম,

- তা, কাজল রাণী, আমাকে থামালে কেন? আমি কি তোমার রাজ্যের কোনো ক্ষতি করেছি ?

- করেছই তো।

অনেকটা অভিমানী শোনায় কাজল রাণীর কণ্ঠ।

- আমি আবার কী ক্ষতি করলাম ?

- তোমার হাতের দিকে দেখো?

আমি আমার হাতের দিকে তাকাই। সে হাতে ধরা একটু আগে ছেড়া এক গুচ্ছ জংলী ফুল।

- তোমরা মানুষগুলো এমন কেন ? তোমাদের বাগানে ফোটে কত রঙ বেরঙ্গের ফুল। কত তাদের ঘ্রাণ। সেই ফুল তুলে তোমরা ড্রইং রুমে ফুলদানীতে সাজিয়ে রাখো, প্রিয়ের খোঁপায় গুঁজে দাও, নেতাদের গলায় পড়িয়ে দাও, বাসর রাতে বিছানা সাজাও। এই নামহীন, গন্ধহীন ফুলগুলো না ছিঁড়লেই কি হত না ? যে জীবন তোমরা দিতে পারো না, তা নিতে যাও কেন?

আমি আবার আমার হাতের দিকে তাকাই। এই অল্প সময়ের মধ্যেই কেমন নেতিয়ে পড়েছে ফুলগুলো। পথে যেতে যেতে একটু পরে হয়ত পথের ধুলায় ফেলে দিতাম এদের। অথচ গাছে থাকলে আরও কিছুদিন ফুটে থাকত অন্যদের মতো। আমি লজ্জা পেয়ে বলি,

- স্যরি।

- এই এক দোষ তোমাদের। একটা ভুল করে বলো স্যরি। একটা অন্যায় করে বলো স্যরি। এমনকি খুন করেও বলো স্যরি। স্যরি বললেই কি সব ভুল শুধরে যায় ? সব অন্যায় ন্যায় হয়ে যায়। সব জীবন ফিরে পায় ?

হিসহিস করে ওঠে জোনাক রাজ্যের রাজকুমারী। তাই তো। প্রতিদিন জেনে, না জেনে, স্বেচ্ছায়, অনিচ্ছায়, কত ভুল আমরা করি, কত অন্যায় করি। আমাদের সে ভুলে, আমাদের সে অন্যায় কাজে কত মানুষের কত ক্ষতি হয়, আমরা শুধু স্যরি বলে পার পেয়ে যাই। আবারও সে ভুল করি, আবারও সে অন্যায় করি। আমরা মানুষেরা আসলে কখনওই শুধরাই না। ঝোপের কাছেই একটা বাঁশের বেঞ্চি। হয়ত ঘেরে কাজ করতে আসা কামলাদের বসার জন্য। আমি অবনত মস্তকে সে বেঞ্চিতে বসে পড়ি। মুখে কোনো কথা সরে না। আমার অনুতাপ দেখে বুঝি মায়া হয় কাজল রাণীর। মোলায়েম কণ্ঠে বলে,

- থাক। অত লজ্জা পেতে হবে না। এর চাইতেও খারাপ কাজ কত মানুষ করে। মনিষীদের কথা তারা শোনে না। আইনের শাসন তারা মানে না। আমার মতো পোকা মাকড়ের কথায় কী আসে যায়?

- তাহলে আমাকে বললে কেন?

- তোমাকে দেখে আমার একজন ভালো মানুষ মনে হয়েছে। তাই বললাম। এ পথে তেমন কেউ আসে না। গত এক সপ্তাহ ধরে দেখছি, তুমি এই পথ ধরে, রোজ সকালে আনমনে হেঁটে যাও। নিজের সাথেই নিজে কী সব গুনগুন করে কথা কও। গাছের পাতাদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে আদর কর। তোমাকে দেখে আমার অন্যরকম মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল, মানুষের মাঝে এখনও কেউ কেউ আছে, যারা আজও প্রকৃতিকে ভালোবাসে। তোমাকে আমার খুব ভালো লেগে গেল। সেই তুমি যখন ফুলগুলো ছিঁড়লে, তখন বড় কষ্ট লাগল আমার। তুমি না ডাক্তার? প্রাণ বাঁচানোই তো তোমার কাজ। প্রাণ নেয়া তো নয়। হোক সে মানুষের, ফুল, পাতা কিংবা পোকা মাকড়ের।

- আমাকে আর লজ্জা দিও না কাজল রাণী। আমার সত্যি বড় ভুল হয়ে গেছে। আসলে আমার মনটা ভালো নেই।

- কেন ? তোমার মনের আবার কী হল ? তোমাকে দেখে তো একজন সুখী, সফল মানুষ বলেই মনে হয়। তোমার তো কোনো কষ্ট থাকার কথা নয় ?

এবার আমি হেসে ফেলি। তবে সে হাসিতে খুশির চেয়ে কান্না ঝরে বেশি। ম্লান কণ্ঠে বলি,

- তোমাদের আর আমাদের মধ্যে পার্থক্য কি জানো? আমারা মানুষেরা খুব বর্ণচোরা প্রাণী। আমাদের মনটাকে আমরা বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখি। আর মুখে একটা মুখোশ পরে থাকি। আমাদের মুখ দেখে মন বোঝা যায় না।

- সে আর আমাদের চেয়ে ভালো কে জানে? তোমরা ঘুমিয়ে গেলে, রাতের আঁধারে আলো জ্বেলে আমরা দেখতে পাই তোমাদের আসল রূপ। আচ্ছা, বাদ দাও। তার চেয়ে বলো কেন তোমার মন খারাপ?

- কেন, শোনোনি ? করোনা পৃথিবী আক্রমণ করেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। মরছে মানুষ হাজারে হাজার।

- বলো কী ? ওরা কি ভিন গ্রহ থেকে এসেছে ? ঐ যে তোমদের বৈজ্ঞানিকরা এলিয়েন না ফেলিয়েন কী বলে।

- না না, ভিন গ্রহ থেকে নয়। ওরা এই গ্রহেরই।

- তাহলে কি ওরা ডাইনোসর জাতীয় কেউ? শুনেছি, ওরা নাকি মিলিয়ন মিলিয়ন বছর আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

- আরে নানা, ডাইনোসর নয়। ওরা তোমার চেয়েও কয়েক হাজার গুন ছোট।

এবার খিলখিল করে হেসে ওঠে জোনাক রাজ্যের রাজকুমারী। সে হাসি যেন থামতেই চায় না। যেন দুপাশে বেণী দুলিয়ে হাসছে এক বালিকা সার্কাসের কোনো ক্লাউনের কথা শুনে। হাসতে হাসতেই বলল,

- হাসালে ডাক্তার। প্রকৃতি তোমাদের সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে তৈরি করেছেন। দিয়েছেন অনেক শক্তি। তোমাদের শক্তি আর বুদ্ধির কাছে হেরে গেছে তোমাদের চেয়েও কয়েকশো গুন বড় ও শক্তিশালী ডাইনোসরেরা। হারিয়ে গেছে কত হিংস্র প্রাণী। তোমাদের শক্তি এখন এতটাই প্রবল, এমন মারণাস্ত্র তোমরা তৈরি করে রেখেছ, যেই পৃথিবীতে তোমার বাস করো, সেই পৃথিবীকেই কয়েকবার ধ্বংস করে দিতে পারো। সেই তোমরা এখন ধূলিকণার চেয়েও ছোট এক দল পোকার ভয়ে ঘরের কোনে মুখ লুকিয়েছ?

- মুশকিল তো সেখানেই কাজল রাণী। ওদের দেখা যায় না বলেই তো ওদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারছি না। ওরা মিশে থাকে মানুষের নিশ্বাসে। কার নিশ্বাস থেকে বেরিয়ে কাকে আক্রমণ করবে কেউ জানে না। সামাজিক জীব হিসেবে গর্ব করা এই মানব জাতি আজ অসামাজিক হয়ে গেছে। কেউ কারও কাছে আসে না। কেউ কারও বাড়িতে যায় না। মিল কারখানা বন্ধ, দোকান-পাট বন্ধ। মানুষ নিজের ঘরেই নিজে বন্দি হয়ে আছে।

- এর জন্যও কিন্তু তোমরাই দায়ী। প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সন্তান তোমরা। অথচ তোমরা ভুলে গেছ, তোমরাই প্রকৃতির একমাত্র সন্তান নও। এই পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ প্রজাতির সন্তান আছে প্রকৃতির। হতে পারে তারা তোমাদের চেয়ে শক্তিতে দুর্বল, বুদ্ধিতে কম। আর সেই সুযোগে তোমরা দখল করে নিচ্ছ তাদের আবাসস্থল, উজাড় করে দিচ্ছ অভয়ারণ্য, কেটে সমান করছ পাহাড়, সে পাহাড়ের মাটি, পাথর দিয়ে ভরাট করে দিচ্ছ নদী, নালা, খাল, বিল। সেখানে উঠছে তোমাদের আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকা। গড়ে উঠছে কল কারখানা। তার বিষাক্ত নিশ্বাসে দুষিত হয়ে উঠছে পৃথিবীর বাতাস। তার বর্জ্যে দুষিত হচ্ছে নদীর পানি। তোমাদের জন্যই ভারসাম্য হারাচ্ছে প্রকৃতি। তোমাদের হাতেই বিপন্ন আজ পৃথিবী। সেই জন্যই হয়ত প্রকৃতির রোষে তৈরি হয়েছে করোনা।

- এত কিছু তুমি জানো কেমন করে ?

- জানতে হয় ডাক্তার। আমাদেরও যে তোমাদের বিরুদ্ধে অস্তিত্বের লড়াইয়ে টিকে থাকতে হয়। তবে চিন্তা করো না। বরাবরের মতো এই যুদ্ধেও যে কোনো মূল্যে তোমরাই জয়ী হবে। অন্তত ইতিহাস তাই বলে। হয়ত সময় লাগবে। এখন ঘরে ফিরে যাও ডাক্তার। অনেক বেলা হল। মানুষ বাইরে বের হচ্ছে। সেই সাথে অদৃশ্য করোনা। তোমার ঘরের মানুষেরা চিন্তা করবে।

একটা সামান্য জোনাক পোকার জীবন বোধ দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। কাজল রাণীর কথা আমার চিন্তা চেতনার ভীত ধরে নাড়িয়ে দেয়। আমি অবাক হয়ে ভাবি, তাই তো, শক্তিতে, বুদ্ধিতে বড় বলে আমাদের হাতে প্রতিদিন ধ্বংস হচ্ছে কত অযুত কোটি প্রাণী। অথচ সব প্রাণীরই তো এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সমান অধিকার আছে। আমরা শুধু আমাদের স্বার্থের কথাটাই ভাবি। অন্যদের কথা ভাবি না। একটা জোনাক পোকা আমার মনে এক অপার্থিব নীলাভ আলো জ্বালিয়ে দেয়। সে আলোয় নিজেকে একটা পোকার চেয়েও নিকৃষ্ট মনে হয়। এক অদ্ভুত নির্লিপ্ততা ভর করে মনের ভেতর। জীবনটাকে কেমন অর্থহীন মনে হয়। আমার যেন কোথাও আর যাবার নেই। ঘরে ফেরার কোনো তাড়া নেই। সেই তো স্বার্থের টানাপোড়ন। সেই তো মুখ ঢাকা মুখোশের দুনিয়া। সেই তো ভালো থাকার, ভালো মানুষীর অভিনয়। জীবনের প্রতি কেমন এক বৈরাগ্যের ভাব চলে আসে।

- কী ভাবছ এত ? যাও, ঘরে ফিরে যাও। তোমার মহারানী তোমার পথ চেয়ে বসে আছে।

জোনাকির কথায় ধ্যান ভাঙ্গে আমার। খুব ইচ্ছে করে বলি, এই পৃথিবীতে কেউ কারও জন্য বসে থাকে না। সবাই যে যার প্রয়োজনে বসে থাকে। মানুষগুলো আকাশের তারার মতই। দূর থেকে দেখে কাছাকাছি মনে হলেও আসলে যোজন যোজন দূরে। যে যার মতো একান্তই একা। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। কী লাভ এ সব বলে? আমার কেন জানি মনে হয়, পোকারাও জানে, কত স্বার্থপর এই মানব জাতি। কতটা নিঃসঙ্গ! প্রকৃতির হাতে কতটা অসহায়! তবে আমার খুব ভালো লেগে যায় জোনাক রাজ্যের এই অদেখা রাজকুমারীকে। বললাম,

- আর একটু বসি? খুব ভালো লাগছে তোমার সাথে কথা বলতে। খুব ভালো লাগছে, তোমার আলোয় নিজেকে আবার নতুন করে চিনতে।

- এই কথাটা খুব ভালো বলেছ ডাক্তার। আসলে আমরা, জোনাকিরা, এক অন্যকে আলো দিয়েই চিনি। সে আলোয় কোনো ভণিতা থাকে না। এখন আমাদের স্বয়ম্বরা চলছে। জোনাকের আলো দেখে জোনাকিদের পতি পছন্দ করতে হয়। এখন আমার দিবা নিদ্রার সময়। তুমি তোমার প্রিয়জনদের কাছে ফিরে যাও ডাক্তার।

আহা, কত সুন্দর, আলোকিত জোনাকিদের জীবন। অথচ এমন কোনো আলো নেই পৃথিবীতে, যা দিয়ে মানুষের মন দেখতে পারা যায়। প্রিয়জন চিনতে পারা যায়। অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। আমার খুব ইচ্ছে করে বলি, আমি যদি আজ রাতে জোনাক পোকা হয়ে আসি, তুমি কি আমায় পতি হিসেবে নির্বাচিত করবে রাজকুমারী ? ভাবতেই আনমনে হেসে উঠি। একজন মানুষ হয়ে একটা পোকাকে এ সব কথা বলা যায় না। হাসতে হাসতে জীবনের প্রতি উদাসীন আমি বাড়ির পথ ধরি।
 
সে রাতে আমার ঘুম আসছিল না কিছুতেই। রাত্রি গভীর থেকে গভীর হয় আরও। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সম্ভবত কৃষ্ণপক্ষ চলছে। চাঁদ নেই আকাশে। শুধু দূর আকাশে, এখানে, সেখানে, দু'একটা তারা মিটিমিটি জ্বলে। তার আলো আসে না পৃথিবীতে। রাস্তার নিয়ন বাতিগুলো রাত দশটার মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বাড়ি ঘরের বাইরের বাতি জ্বালানো। দীর্ঘ দিন ধরে বন্ধ হয়ে আছে দেশের অর্থনীতির চাকা। বন্ধ হয়ে আছে প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার রেমিট্যান্স। ক্রমেই নেমে আসছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। শুধু করোনা আতংকে নয়, অর্থ কষ্টেও ধুঁকছে গরীব এই দেশ। তাই এই কৃচ্ছতা সাধন।

রাজকুমারী কাজল রানীকে মাথা থেকে তাড়াতে পারছিলাম না কিছুতেই। জোনাকি পোকাটা যেন আমার মগজের মধ্যে ঢুকে গেছে। আসলেই কি জোনাক রাজ্য বলে কিছু আছে ? আছে কি সে দেশে কোনো রাজকুমারী, যে কিনা মানুষের মতো কথা কয় ? নাকি পুরাটাই আমার মতিভ্রম ? মেডিকেলের ভাষায় একে আডিটরি হালুসিনেশন বলে। আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি ? করোনা কোনো এক ফাঁকে নিঃশব্দে ঢুকে পড়েনি তো আমার শরীরে ? করোনা সংক্রামণের যে কয়টি লক্ষণ আমি জানি, তার মধ্যে এমন কোনো পাগলামির লক্ষণ তো নেই! আমার নিজেকেও পাগল মনে হচ্ছে না কিছুতেই। চিন্তা, চেতনা, যুক্তি, ভাবনা, সব পরিষ্কার। যেন জোনাকির আলোয় আলোকিত হয়ে আছে আমার মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ। সেই সকাল থেকেই মনে হচ্ছে, এ আমাদেরই কর্মফল। এ যেন প্রকৃতির পক্ষ থেকে আমাদের অহংকার, আমাদের ঔদ্ধত্যের প্রতিদান।

এদিকে প্রতিদিন আরও হিংস্র, আরও নৃশংস হয়ে উঠছে করোনা। পুনপৌনিক হারে বাড়ছে এদের সংখ্যা, বাড়ছে এদের শক্তি। কোনো এক দুর্ভেদ্য কারণে এবার চেঙ্গিস খানের দল চায়না জয় করার পর, এশিয়ার গরীব দেশগুলোকে উপেক্ষা করে, প্রথমেই আক্রমণ করে বসেছিল উন্নত বিশ্ব বলে খ্যাত বিশাল শক্তিধর ইউরোপ ও আমেরিকাকে। শ্বৈর্যে, বীর্যে, শক্তিতে, সম্পদে, শিক্ষায়, দীক্ষায়, চিকিৎসা ব্যবস্থায় সর্বশ্রেষ্ঠ দুটি দাম্ভিক মহাদেশ অসহায় চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল মানবতার পরাজয়। বড় বড় রাঘব বোয়ালদের শায়েস্তা করার পর এবার করোনার নজর পড়েছে চুনোপুঁটিদের উপর। প্রবল পরাক্রমশালী দেশগুলিই যেখানে নাস্তানাবুদ হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ তো করোনার তাণ্ডবে এক ফুঁৎকারেই উড়ে যাবে। ভাবতেই একটা অনুভূতি ঠাণ্ডা সাপের মতো আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নীচে নেমে যায়।

সে রাতে ছিল চৈত্রের গুমোট গরম। এক ফোটা বাতাস নেই কোথাও। স্থির হয়ে আছে গাছের পাতা। থমকে দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকার সময়। চারিদিকে কবরের নিস্তব্ধতা। আমি দুচোখ বন্ধ করি। যেন দূরে লাশ বাহি ট্রেনের হুইসল শুনতে পাই। বিড়বিড় করে বলি,

রাতের নিস্তব্ধতায় আমি কান পেতে রই,

মৃত্যুর পদধ্বনি বুঝি শোনা যায় ওই।

চাই না বাঁচতে এমন বন্দি মানব জীবন,

কখন আসে হাতে অকাল মৃত্যুর সমন!

পরদিন সকালে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। আমার কপালে, চোখে, ঠোঁটে, এক উষ্ণ নরম আলতো ছোঁয়া অনুভব করি। যেন প্রেয়সীর পরম মমতার চুম্বন, ভিজিয়ে দিচ্ছে আমার সমস্ত মুখমণ্ডল। শেষ কবে এমন আদরে সিক্ত হয়েছি, মনে পড়ে না। আমি কি স্বপ্ন দেখছি? ভয়ে আমি চোখ খুলি না। পাছে স্বপ্নটা ভেঙ্গে যায়। এমন সময় ফিসফিস করে কানের কাছে কেউ বলে ওঠে,

- ডাক্তার, ও ডাক্তার। ওঠো, আর কত ঘুমাবে?

কাজল রাণীর কণ্ঠ ? এমন আদর করে আমাকে ডাক্তার বলে যে একমাত্র জোনাক রাজ্যের রাজকুমারী, কাজল রাণীই ডেকেছিল ! আমি ঝট করে চোখ খুলি। বিছানায় আমি একা। কেউ নেই। গিন্নী হয়ত উঠে গেছেন অনেক আগেই। ততোক্ষণে সূর্যদেব আমার জানালায় উঁকি দিয়েছেন। তারই কৃষ্ণচূড়া রোদের উষ্ণতা আমার চোখে, মুখে, কপালে। এত বেলা করে ঘুমিয়েছি ? আজ মুয়াজ্জিনের আযান, পাখিদের কলরব, কোকিলের কুহুতান, কিছুই কানে যায়নি। আমি উঠে বসতে যাই। অনুভব করি সমস্ত শরীরে ব্যথা, অবসাদ। ভারি হয়ে আছে মুখ, চোখ, নাক। আমি আবার শুয়ে পড়ি। এবার মাথার ভেতর কাজল রাণীর কণ্ঠ,

- কী হলো ডাক্তার? আসবে না? আমি যে পথ চেয়ে বসে আছি!

শুনে আমি শিউরে উঠি। ইনফেকশন কিংবা সিজোফ্রেনিয়ার একটা লক্ষণ। আমার হাতের পিঠ দিয়ে কপাল স্পর্শ করি। না জ্বর নেই। তবে কি সিজোফ্রেনিয়া ? মস্তিষ্ক বিকৃতি ? আমি ঘরের চারিদিকে চোখ বুলাই। না, অস্বাভাবিক কিছু দেখছি না। মানে ভিজুয়াল হালুসিনেশন বা দৃষ্টি বিভ্রম নেই।

- কই, ওঠো, তৈরি হয়ে নাও আমার ডাক্তার।

আবার মাথার ভেতর থেকে অহ্লাদী গলায় বলে কাজল রাণী। সব কেমন এলোমেলো লাগে। শুধু মনে হয়, ডাকছে আমাকে জোনাক রাজ্যের রাজকুমারী। আমাকে যেতে হবে। আমি শরীরটাকে বিছানে হতে টেনে তুলি। ওয়াশ রুমে যেয়ে ফ্রেস হই। মন্ত্রমুগ্ধের মতো কাপড় বদলাই। সবাই ব্যস্ত কিচেনে নাস্তা বানাতে। আমি কাউকে না বলে চুপিচুপি বেরিয়ে পড়ি।

আমি এলোমেলো পায়ে চেনা পথে অচেনা মানুষের মতো হেঁটে চলি। বুকের ভেতর জোনাকির আলোর উষ্ণতা। কানের ভেতর জোনাকি পোকার গুনগুন পাখার শব্দ। আর কোনো শব্দ আমার কানে যায় না। পাখিদের কোলাহল, রিক্সার টিংটিং, অটো কিংবা মটর সাইকেলের হর্ন, কিছুই আমি শুনতে পাই না। রাস্তার পাশে শুয়ে বসে থাকা কুকুরগুলো নিত্য দিনের চেনা মানুষটার এমন অচেনা আচরণে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। কেউ কেউ দু কদম পাশে পাশে হাঁটে। তার পর ফিরে যায় আপনজনদের কাছে। আমার কেবলই মনে হয়ে, এই পৃথিবীতে সবাই একা। স্বার্থের প্রয়োজনে হয়ত কিছুক্ষণ পথের সাথী হয়। তারপর যে যার পথে চলে যায়। আমি আপন মনে আবৃত্তি করি,

"হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে…"

বেশ কড়া রোদ আজ। কুয়াশার আশা আজ দুরাশা। জোনাক রাজ্যে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমি ঘেমে জবজবে হয়ে যাই। হাঁপিয়ে পড়ি। ক্লান্ত শরীরে বসে পড়ি ঝোপের পাশের বেঞ্চিতে। প্রথমেই চারিদিক ভালো করে দেখে নেই। কেউ নেই কিছু নেই। নাহ, দৃষ্টি বিভ্রম শুরু হয়নি এখনো। মাথা পরিষ্কার। আমি আর একবার এদিক ওদিক দেখে নিয়ে ফিসফিস করে ডাকি,

- কাজল, ও কাজল রাণী, আমি এসেছি।

- "এতদিন পরে এলে? আমি যে হেথায় পথ পানে চেয়ে কেঁদে মরি আঁখি জলে…"।

বাহ! জোনাকিদের স্কুলে জসীম উদ্দিনও পড়ানো হয় নাকি? তবে এবার মথার মধ্যে থেকে নয়, সামনের জংলী ফুলে ঢাকা ঝোপের মধ্য থেকে বলে ওঠে কাজল রাণী। হেসে বলি,

- এতদিন কোথায়? কালও তো এসেছিলাম!

- চব্বিশ ঘণ্টায় কত মিনিট হয় জানো ডাক্তার ? তোমাদের এক একটা মিনিট আমাদের এক একটা দিনের সমান। তার উপর সে সময়টা যদি হয় প্রতীক্ষার, তাহলে তো আরও দীর্ঘ মনে হয়।

কী শুনছি এ সব? একটা জোনাকি পোকা, হোক সে তার রাজ্যের রাজকন্যা, কেন সে আমার জন্য, একজন মানুষের জন্য অপেক্ষা করবে ? আমি মাথাটায় একটা ঝাঁকি দিই। তারপর ভালো করে চারিদিকে দেখি। সব ফকফকে, পরিষ্কার। প্রসঙ্গ পাল্টাতে আমি জিজ্ঞেস করি,

- কাল রাতে না তোমার স্বয়ম্বর ছিল? পছন্দ করতে পারলে তোমার পতি ?

- কী করে পারব? তুমি তো কাল এলে না ? আমি সারা রাত তোমার প্রতীক্ষায় থেকেছি।

অভিমানী কণ্ঠ জোনাকির। অবাক কণ্ঠে বলি,

- মানে কী ? তুমি কেন একটা জোনাকি পোকা হয়ে একটা মানুষের জন্য অপেক্ষা করবে ?

- বাহ ! ভুলে গেলে ? কাল তুমি মনে মনে বললে না, যদি রাতে জোনাক পোকা হয়ে আসো, আমি তোমাকে পতি হিসেবে গ্রহণ করব কিনা? আমি যে তোমার কথা বিশ্বাস করেছিলাম ডাক্তার। আমি যে এখনও মানুষের মতো মানুষকে অবিশ্বাস করতে শিখিনি।

কান্না ভেজা কণ্ঠ জোনাকির। আমার বিস্ময় এবার আকাশ ছুঁয়ে যায়। কাজল রাণী আমার মনের কথাও শুনতে পেরেছে ? তাহলে তো তার এটাও জানার কথা, কাল সারা রাত আমি জোনাকির কথাই ভেবেছি। আমার মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে। তাড়াতাড়ি একটা সিগারেট ধরাই। লম্বা টান দিতেই পুড়ে ওঠে গলা, খক খক করে কেশে উঠি। বিস্বাদ লাগে সিগারেটের ধোঁয়া। ছ্যাঁত করে ওঠে বুকের ভেতর। আমি চেইন স্মোকার। তার উপর একজন ডাক্তার। আমি জানি এটা কিসের লক্ষণ। ইনফেকশন!

- কী ভাবে বাধালে ডাক্তার ? তুমি না অবসরপ্রাপ্ত, বেকার? রুগী দেখার বালাই নেই। এই বিলে আসা ছাড়া গত এক সপ্তাহ বাইরেও যাও না। তারপরও…

কথা শেষ করতে পারে না কাজল রাণী। গলা ধরে আসে। বুঝলাম, লুকিয়ে লাভ নেই। সব জানে রাজকুমারী। বললাম,

- কী করব বলো ? আমার সব স্বকার প্রফেশনাল বন্ধুরা চেম্বারের ঝাপ বন্ধ করে সেলফ আইসোলেশনে গিয়েছেন। প্রাইভেট হাসপাতালগুলো রুগী দেখা বন্ধ করে দিয়েছে। মানুষ সরকারি হাসপাতালে যেতে ভয় পায়। গেলেও হয়রানির শিকার হতে হয়। আমি ডাক্তারি ছাড়লেও ডাক্তারি যে আমাকে ছেড়ে যায়নি। তাই, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী কেউ আমার দরজায় কড়া নাড়লে আমি কী ভাবে দরজা বন্ধ করে থাকি বলো ?

- এতদিন তো দেখতাম, ডাক্তাররা রাত দুটো পর্যন্ত রুগী দেখে। তাও অনেক ডাক্তারের সিরিয়াল দুই তিন সপ্তাহেও পাওয়া যায় না। আর এখন যখন পুরো মানবতা বিপর্যয়ের মুখে, যখন ডাক্তারদেরই সব চেয়ে বেশি প্রয়োজন, তখন দেখি, তারা ঘরে বসে, তথাকথিত আইসোলেশনে থেকে, পরিবারকে নিয়ে লুডু খেলে, শরীর চর্চা করে। আবার তার ছবি ফেসবুকেও পোস্ট দেয়।

- ওভাবে বলছ কেন? ডাক্তাররাও তো মানুষ। তাঁদেরও তো মৃত্যু ভয় আছে। তাঁদেরও পরিবার পরিজন আছে। আছে তাদেরও সংক্রামিত হবার ভয়। প্রাইভেট প্রাকটিস করবে কিনা, এটা তাদের একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। এ জন্য তাদের দোষ দেয়া যায় না।

- বাহ, দারুণ খোঁড়া যুক্তি দেখালে ডাক্তার। এই যুক্তি কি সৈনিকদের বেলায়ও খাটাবে ? তারাও তো সারা বছর ব্যারাকে শুয়ে বসে থাকে। কিন্তু যুদ্ধ বাধলে কি বলবে, আমাদেরও জীবন আছে, আমাদেরও পরিবার পরিজন আছে? কখন বুলেট আঘাত হানবে, আমরা যুদ্ধে যাব না।

- তুলনাটা কিন্তু এক হল না কাজল রাণী। সৈনিকদের আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র থাকে, সুরক্ষা বর্ম থাকে। তারা জানে, কাদের সাথে যুদ্ধ করছে। কিন্তু করোনা তো অদৃশ্য। লক্ষণ না থাকলেও একজন সংক্রামিত রুগী এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। তাতে শুধু ডাক্তারই নয়, অন্য রুগীরাও ইনফেকটেড হতে পারে। ডাক্তারদের পর্যাপ্ত পরিমাণে পারসোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট দেয়া হয়নি। তারা কেন প্রাইভেট প্রাকটিস করে নিজেকে, নিজের পরিবার কে, সর্বোপরি অন্যান্য রুগীদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে?

- দেখো, আমাকে রাগিও না ডাক্তার। কী ভাবো তোমরা আমাদের? পোকা মাকড় বলে আমরা কোনো খবরই রাখি না ? প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক, সরকারি ডাক্তার যারা প্রাইভেট প্রাকটিস করতেন, তারা রুগীর কাছ থেকে এতদিন হাজার হাজার টাকা কামিয়েছেন। এখন সেই টাকা থেকে একটু খরচ করে নিজেদের সুরক্ষা নিজেরা করতে পারেন না? সবই সরকারকে করতে হবে কেন ? তারা এ দেশের নাগরিক নয় ? শুনলাম, ইংল্যান্ডের আড়াই লক্ষ অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্য কর্মী স্বেচ্ছায় কাজে যোগ দিয়েছে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। তাদের জীবনের মায়া নেই? ইটালিতে তো ৬৬ জন ডাক্তারই করোনায় মারা গিয়েছে। তাই বলে কি ডাক্তাররা কাজ বন্ধ করে দিয়েছে? বিদেশের কথা বাদই দাও, এই দেশেও পুলিশ, আর্মি, শুধু একটা মাস্ক পড়ে মানুষের কাছে যেয়ে যেয়ে সচেতন করছে। তারা যে অচেনা মানুষটির কাছে যেয়ে কথা বলছে, তাদের কাছ থেকে ইনফেকটেড হতে পারে না? তাদের জীবনের মায়া নেই?

বলে গোখরো সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে হাঁপায় জোনাক রাজ্যের রাজকন্যা। তার যুক্তি আমি একেবারে খণ্ডাতে পারি না। আবার মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করাকে সমর্থনও করতে পারি না। মনে পড়ে, সেদিন এক ফেসবুক বোন তার এক বছরের সন্তানকে নিয়ে শ্বাস কষ্টের জন্য ক্লিনিকে ক্লিনিকে ঘুরেছে, কেউ নেয়নি। লক্ষণ শুনে মনে হল ব্রংকিউলাইটিস অথবা নিউমোনিয়া। তাকে অক্সিজেন দেয়া দরকার। অসহায় এই মাকে আমি কোনো অনলাইন চিকিৎসা দিতে পারিনি। আমি চুপ করে থাকি। কাজল রাণী আবার শুরু করে,

- চুপ করে আছ কেন? কেন ভুলে যাচ্ছ, প্রতিদিন করোনায় যত রুগী আক্রান্ত হচ্ছে কিংবা মরছে, তার চেয়ে কয়েকশো গুন বেশি মানুষ অন্য রোগে ভোগে, মারা যায়। তাদের সেই সব রোগের চিকিৎসা পাবার অধিকার নেই? আর সৈনিকদের যুদ্ধে যাবার উপমাই যখন দিলে, তুমি কি ভুলে গিয়েছ, তোমরা এমন এক জাতি, যারা আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত এক বিশাল সুশৃঙ্খল আর্মির বিরুদ্ধে থ্রিনটথ্রি রাইফেল আর লাঠি সোটা নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মাত্র তিন মাসের ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধ করে ঐ বিশাল বাহিনীকে পরাস্ত করে স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে এনেছিল। সেই জাতির সন্তান হয়ে তোমরা কী ভাবে এতটা কাপুরুষ হলে ?

কাজল রাণীর কথার জবাব না দিতে পেরে আমি জোরে জোরে সিগারেটে টান দেই। অমনি বেদম ভাবে কেশে উঠি। চিরে চিরে ওঠে আমার বুক, গলা। হঠাৎ খুব শীত করে ওঠে। কেঁপে কেঁপে ওঠে শরীর। ঘোলাটে হয়ে আসে দৃষ্টি। হাহাকার করে ওঠে আমার কাজল রাণী,

- ডাক্তার, আমার ডাক্তার, কী হলো তোমার ? শীঘ্র বাসায় যাও, ডাক্তার দেখাও।

এত কষ্টের মাঝেও হাসি পায় আমার। হেসে বলি,

- পাগলি ! আমি নিজেই তো ডাক্তার।

- তা জানি। তুমি অনেক বড় ডাক্তার। যাকে বলে একেবারে বিলেত ফেরত। কিন্তু নিজের চিকিৎসা কি নিজে করতে পারবে ?

- এ রোগের তেমন চিকিৎসা নেই রে জোনাকি। যে চিকিৎসা হাসপাতালে গেলে পাব, সে চিকিৎসা আমি ঘরে বসে বসেই নিতে পারব। শুধু আমাকে আলাদা থাকতে হবে। আর যদি খুব খারাপ হয়, তাহলে হাসপাতালে যেতে হবে। আইসিইউতে ভেন্টিলেটরের সাপোর্ট নিতে হবে।

বলে আমি চুপ করে থাকি। চুপ করে ভাবি, কাজল রাণী কি জানে আমি শুধু স্মোকই করি না, আমার এজমাও আছে। সাধারণ ভাইরাস আক্রমণ করলেও আমাকে সহজে মুক্তি দেয় না। আর এ তো চেঙ্গিস খানের নাতি। খুব শীত করেছে। আমাকে এখনই ফিরতে হবে। অনেকগুলি জরুরী কাজ করতে হবে। আমার কাছে এখন কেউ নিরাপদ নয়, হয়ত অদেখা এই ছোট্ট পোকাটিও নয়। অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, চুপ করে আছে জোনাকি। অনেকক্ষণ ধরে। আমার ভেতরে বাসায় ফেরার তাড়া। শেষে আমিই নিস্তেজ গলায় বলি,

- কাজল, ও কাজল রাণী। আমি চলে যাচ্ছি। জানিনা, আবার দেখা হবে কিনা। যাবার আগে একবার আমাকে বিদায় দেবে না?

বলতে যেয়ে গলা কেঁপে যায় আমার। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক কষ্ট। এক চিনচিনে ব্যথা। যেন খুব প্রিয় কাউকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। এমনও কি হয়? একজন প্রায় বৃদ্ধ মানুষ কোনো পোকার প্রেমেও পড়ে? বড় রহস্যময় এই পৃথিবী। যার অনেক কিছুর ব্যাখ্যাই আমাদের কাছে অজানা রয়ে যায়। এখনও কথা বলছে না জোনাকি। বোধহয় দিবা নিদ্রায় চলে গেছে জোনাক রাজ্যের রাজকন্যা। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাড়াই। ক্লান্ত পায়ে বাসার পথ ধরতেই শুনি, পেছন হতে বলছে জোনাকি,

- "মাথার কসম, আবার এসো"।

বলতে যেয়ে একবার কান্নার হেঁচকি তুলল রাজকুমারী। ও কী হেলাল হাফিজ কোট করল? আহা, কতদিন একলা ঘরে এই কবিতা আবৃত্তি করেছি, " যুগল চোখে জলের ভাষায় আসার সময় কেউ বলেনি, মাথার কসম, আবার এসো"। কতদিন ভেবেছি, এমন কেউ কি আসবে আমার জীবনে, যে এমন করে জলের ভাষায় আমাকে আবার আসার কসম দেবে? শেষ পর্যন্ত কেউ তো এলো এই জীবনে, হোক সে একটা জোনাকি পোকা। বেলা শেষে আমার বুকে নীলাভ আলোর উষ্ণতা দিতে। আমার খুব ইচ্ছে করে, বলি,

"ক্যাঙ্গারু তার শাবক নিয়ে যেমন করে বিপদ পেরোয়, আমিও ঠিক তেমনই করে, সভ্যতা আর শুভ্রতাকে বুকে নিয়েই দুঃসময়ে এতোটা পথ একলা এলাম, শুশ্রূষা-হীন। কেউ ডাকেনি, তবুও এলাম, বলতে এলাম, ভালোবাসি"।

বলতে পারি না। কী লাভ মায়া বাড়িয়ে। পোকাদেরও হয়ত মন আছে ! আমি নীরবে বাসার পথ ধরি। পোকাদের চোখ হতে জল ঝরে কিনা আমি জানি না। তবে আমার দুচোখ বেয়ে জলের ধারা নামে। নির্জন বিলের মেঠো পথে কেউ তা দেখতে পায় না।

এর পরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটে যায়। আসার সময় ফার্মেসী হতে প্রয়োজনীয় সব ঔষধ-পত্র কিনে নেই। কিনলাম নেই বেশ কিছু মাস্ক, গ্লাভস, ফেসিয়াল টিস্যু, হ্যান্ড সেনিটাইজার, ডিসপোজাবল প্লেট, গ্লাস, বাটি, চামচ, ইত্যাদি। বাসায় এসে জিনিষগুলো আমার স্টাডিতে রেখে দ্রুত শাওয়ার নিতে ঢুকে যাই। প্রতিদিনই যাই। কেউ কোনো ব্যতিক্রম লক্ষ্য করে না। গায়ে জ্বর বুঝতে পারছি, তবুও অনেকক্ষণ ধরে শাওয়ার নিলাম। কে জানে আবার কবে নিতে পারব!

ফ্রেস হয়ে রুমে ঢুকে প্রথমেই মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপ্যালকে ফোন করলাম, আমার ক্লাসমেট। জিজ্ঞেস করি, কী অবস্থা করোনা পরিস্থিতির? ও যা বলল, শুনে আমার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। করোনা রুগীর স্রোত ঠেকাতে হিমসিম খাচ্ছে। খুলনা বিভাগের দেড় কোটি মানুষের জন্য মাত্র পনেরোটা সরকারী এবং পনেরোটা বেসরকারি ভেন্টিলেটর। সবগুলো অকুপাইড। অথচ সিরিয়াস করোনা রুগীকে একমাত্র ভেন্টিলেটরই বাঁচিয়ে রাখতে পারে। ইউরোপ আমেরিকাই যেখানে পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা করতে পারেনি। সেখানে আমার দেশের গরীব সরকার এত মানুষের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক ভেন্টিলেটর, আইসিইউ সেটআপ এত অল্প সময়ে ব্যবস্থা করবে কোথা থেকে? ওকে সাবধানে থাকতে বলে ফোন কেটে দিলাম। করোনার কথা ওকে বললাম না। কী লাভ শুধু শুধু লোক জানাজানি করে ?

ফোন রেখে, নতুন মাস্ক পড়ে, আমার স্টাডির দরজায় দাঁড়িয়ে সবাইকে ড্রইং রুমে জড়ো হতে বললাম। সবাই কী হলো, কী হলো বলে তাড়াহুড়া করে ড্রইংরুমে জড়ো হলো। স্টাডির দরজায় দাঁড়িয়ে অনেকটা বক্তৃতা দেয়ার মতো বললাম,

- শোনো, তোমরা কেউ ভয় পেও না। আমাকে সম্ভবত করোনা আক্রমণ করেছে। আজ থেকে ভালো না হওয়া পর্যন্ত আমি এই রুমেই থাকব। এখানেই খাওয়া দাওয়া, এখানেই গোসল, এখানেই ঘুম। এখন থেকে তোমাদের সাথে কথাবার্তা সব মোবাইলে হবে। আমার প্রয়োজনীয় সব জিনিষপত্র এই রুমের সামনে রেখে আমাকে ফোনে জানিয়ে তোমরা দূরে সরে যাবে। আমি নিয়ে নেব। আমার কাপড় চোপড় আমিই ধোবো। আমার সব খাবার দাবার এখন থেকে ডিসপোজাবল প্লেটে দেবে।

শুনে সবাই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কেউ এম্বুলেন্স ডাকতে চাইল। কেউ হাসপাতালে যেতে বলল। গিন্নী আমার সাথে আমার রুমেই থাকতে চাইলেন। আমি ঠাণ্ডা গলায় বললাম,

- এত চিন্তা করো না। হাসপাতালের চেয়ে ঘরেই আমি ভালো থাকব। ডাক্তারদের সাথে আমার যোগাযোগ থাকবে। প্রয়োজন হলে হাসপাতালে যাওয়া যাবে। এখনই লোক জানাজানি করে প্যানিক সৃষ্টি করার দরকার নেই।

বলেই স্টাডির দরজা বন্ধ করে দিলাম। বাইরে তখনও প্রিয়জনদের চিৎকার, কান্না। আমি আর এ সব শুনতে চাই না। আমি আর এই পৃথিবীর কারও সাথে মায়ায় জড়াতে চাই না। এটা এখন আমার একার যুদ্ধ। আমি একাই লড়তে চাই। মৃত্যু যদি আসেই, আমি একাই তার মুখোমুখি হতে চাই।

সেই থেকে এক সপ্তাহ এই আইসোলেসেন সেলে বন্দি আছি। প্রয়োজন ছাড়া কারও সাথে কথা বলি না। শুধু গোপনে স্থানীয় করোনা সেন্টারে ফোন করেছিলাম। ওরা স্যাম্পল পরীক্ষা করে পজিটিভ বলেছে। আমার বাড়ীর সামনে লাল পতাকা টানানো হয়েছে। আমি কাউকে ফোন করি না। কারও ফোন রিসিভ করি না। শুধু পরিবারের লোকজন ফোন করলে বলে দেই ভালো আছি। সুস্থ হবার পর স্যাম্পল করোনা নেগেটিভ হলে বাইরে বেরিয়ে আসব।

বুঝতে পারছি, আমার অবস্থা দিনে দিনে খারাপের দিকে যাচ্ছে। বুকের ভেতর করোনার দল দলে ভারি হচ্ছে। বুঝতে পারছি, আমার হাসপাতালে যাওয়া দরকার। ভেন্টিলেশন লাগতে পারে। চাইলে ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে হয়ত একটা আইসিইউ বেড ম্যানেজ করতে পারি। খুব কি জরুরী তা ? একা একা এ নিয়ে অনেক ভেবেছি আমি। আমার চাইতে দশ বছর ছোট বয়সে আমার বাবা চলে গিয়েছেন অনেকটা বিনা চিকিৎসায়। কারণ তখনও লিভার সিরোসিসের কোনো চিকিৎসা আবিষ্কার হয়নি। আমার বয়স এখন আটান্ন। বাবার রেখে যাওয়া সব দায়িত্ব তার বড় সন্তান হিসাবে আমি পালন করেছি। ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করেছি। স্বামীর দায়িত্ব পালন করেছি। পিতার দায়িত্ব পালন করেছি। আমার আর কোনো দায় দায়িত্ব নেই। এক জীবনে অর্জনের পাল্লাও কম ভারি নয়। একজন সফল কর্মকর্তার চাকরি থেকে অবসর নিলে যেমন সেই অফিসের কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হয় না। একজন সফল মানুষ হিসেবে এখন জীবন থেকে অবসর নিলে এই পৃথিবীর তেমন কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না। কাছের ও দূরের প্রিয় মানুষগুলো হয়ত কিছুদিন উহু আহা করবে, কান্নাকাটি করবে, তারপর একদিন সবাই ভুলে যাবে, এই পৃথিবীতে আফতাব হোসেন নামে কেউ ছিল একদিন। পৃথিবী চলবে তার আপন নিয়মে।

অথচ যাদের এখনও অনেক দায়িত্ব পালন করা বাকি, যাদের বেঁচে থাকার উপর নির্ভর করছে অনেকগুলো মানুষের বেঁচে থাকা, সেই সব করোনা আক্রান্ত রুগীদের জন্য আইসিইউ ইউনিটে একটি ভেন্টিলেটর সাপোর্ট আমার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি। আমি স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, অবস্থা যত খারাপই হোক, হাসপাতালে যাব না আমি।

কাল রাত থেকে শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। চিন্তা চেতনা ভোঁতা হয়ে আসছে। বুঝতে পারছি, শরীরে অক্সিজেনের অভাব দেখা দিয়েছে। বাড়ছে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ। মৃত্যুর আগে কী মানুষ বুঝতে পারে, সময় আর নেই বাকি? তাহলে আমি কেন বুঝতে পারছি, আজই আমার জীবনের শেষ রাত? হুমায়ুন আহমেদের খুব শখ ছিল, কোনো এক চাঁদনী পসর রাতে, প্রিয় মানুষটির কোলে মাথা রেখে তিনি চলে যাবেন এই প্রিয় পৃথিবী ছেড়ে। অথচ তিনি মারা গিয়েছিলেন বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে, আমেরিকার এক হাসপাতালের বদ্ধ কুঠুরিতে। আমারও স্বপ্ন ছিল, কোনো এক চাঁদনী রাতে, খোলা আকাশের নীচে, প্রিয় মানুষটির বুকে মাথা রেখে পাড়ি দেব আকাশের পথে। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস, প্রকৃতির প্রেমী এই আমি, কত মানুষের ভালোবাসায় ধন্য এই আমি, ষোলো ফুট বাই বারো ফুট একটা রুমে শুয়ে থেকে, একাকী রাতে, নীরবে, নিভৃতে, চলে যাব দূর অজানায়। মানুষের স্বপ্নগুলো বুঝি এভাবেই অপূর্ণ থেকে যায় !

রাতের খাবগুলো অভুক্ত পড়ে আছে। খেতে ইচ্ছে করছে না। যাবার আগে পেট ভারি করে কী লাভ? ভীষণ দুর্বল লাগছে। একটা চিঠি লেখা দরকার। বহুদিন হাতে লিখি না। আজ ইচ্ছে করছে। আমার হাতের ছোঁয়া প্রিয় মানুষগুলোর জন্য আমি রেখে যেতে চাই। অনেক কষ্টে একটা প্যাড নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে লিখি,

আমার প্রিয় মানুষেরা,

যদি আমি ফোন না ধরি, যদি দরজা না খুলি, তোমরা ফায়ার সার্ভিস ও করোনা ইউনিটকে ফোন করবে। ওরাই এসে দরজা ভেঙ্গে আমাকে বের করবে। আমার শরীরের সৎকার যেন করোনা প্রোটোকল মেনে করা হয়। আমার শরীরের দুই মিটারের মধ্যে যেন আমার পরিবারের কেউ না আসে। এটাই তোমাদের প্রতি আমার শেষ নির্দেশ।

আমাকে ক্ষমা করে দিও।

আর লিখতে পারি না। শক্তিতে কুলায় না। কাগজটা ভাঁজ করে দরজার নীচ দিয়ে বাইরে ঠেলে দিই। তারপর এলিয়ে পড়ি সাত দিনের পুরনো বিছানায়।

আজান থেমে গেছে অনেক আগেই। পাখিরা এখনো ডেকে চলেছে। ডাকছে এক নিঃসঙ্গ কোকিল। আমার মুখটা হা হয়ে আছে। গলাটা শুকনা। পিপাসায় শুকিয়ে কাঠ। পানি খেতে ইচ্ছে করছে। বিছানার পাশেই গ্লাসে পানি। আমি হাত বাড়িয়ে নিতে যাই। হাত নাড়াতে পারি না। ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটা চুলকাচ্ছে। অথচ আমি পাটাও নারাতে পারছি না। যেন পাথর হয়ে গেছে সমস্ত শরীর। আমি মি মারা গেছি? কিন্তু টের পেলাম না কেন? শুনেছি মৃত্যুর সময় অনেক যন্ত্রণা হয়? অথচ চোখ খুলতে পারছি। নাকি আগে থেকেই খোলা ছিল? দেখি ঘরময় নীলাভ আলো। অনেকগুলো জোনাকি পোকা আমার ঘরময় উড়ে বেড়াচ্ছে। তাদের লেজের কাছে জ্বলছে, নীল, হলুদ, সোনালী আলো। হঠাৎ সেই পরিচিত কণ্ঠ,

- ডাক্তার, ও ডাক্তার, আমরা তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।

- কে? কাজল ? তুমি এসেছ? কোথায় তুমি?

অবাক কাণ্ড! আমি কথা বলতে পারছি! জোনাকির আলো আমি দেখতে পাচ্ছি!

- এই তো আমি, তোমার চোখের সামনে।

দেখি অপূর্ব সুন্দরী এক যুবতি বসল আমার বিছানায়। কালো মেয়েরাও এত রূপবতী হয়? তার পিঠে গাঁড় সবুজ পাখা। পেটের কাছ থেকে ঠিকরে বের হচ্ছে স্বপ্নিল নীলাভ জোছনা। আমি ফিসফিস করে জানতে চাই,

- কোথায় নিয়ে যাবে আমাকে?

- জোনাক রাজ্যে। যেখানে হিংসা নেই, হানাহানি নেই। ছলনা নেই, অভিনয় নেই,। আছে শুধু বিশ্বাসের আলো। সে বিশ্বাসে থাকবে তুমি আমার হয়ে।

- তুমি কি আমাকে পতি হিসেবে গ্রহণ করেছ কাজল রাণী?

- হ্যাঁ। তবে একটা শর্ত আছে?

- কী শর্ত?

- কাজল রাণী নয়, তুমি ডাকবে আমাকে জোনাক বউ বলে।

- আচ্ছা তাই হবে জোনাক বউ।

শুনে জোনাক বউ আমার কপালে তার ওষ্ঠ ছুঁয়ে দেয়। অমনি আমার সব কষ্ট দূর হয়ে যায়। জোনাক বউ আমাকে দুহাতে তুলে নেয়। আমার শরীরটা যেন পাখির পালকের মতো হালকা মনে হয়। জোনাক বউ আমাকে নিয়ে আকাশের দিকে উড়ে চলে। সাথে তার সখিরা আলো জ্বালিয়ে পথ দেখিয়ে চলে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top