বাংলা চলচ্চিত্রে যে কজন গুণী মেধাবী পরিচালক ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন জনাব আমজাদ হোসেন সাহেব, যিনি একাধারে লেখক, চিত্রনাট্যকার, কাহিনিকার, গীতিকার, অভিনেতা ও চিত্র পরিচালক।
তার পরিচালিত চলচ্চিত্র মানেই একেবারে মনের গভীরে ছুঁয়ে যাওয়া, অনুভূতিকে নাড়িয়ে দেওয়ার গল্প। যার চলচ্চিত্রে থাকে মা-মাটি আর আবহমান গ্রাম বাংলার মানুষদের সুখ-দুঃখ ও জীবনসংগ্রামের মানুষদের কথা। আর ঠিক এমনই জীবন সংগ্রামী এক দুঃখী নারীর গল্পই বলা হয়েছিল তার বিখ্যাত ‘ভাত দে’ ছবিতে।
মূলত গ্রাম-বাংলার কিছু বাজে মন মানসিকতার মানুষের বঞ্চনা ও নিপীড়নের শিকার এক অসহায় নারীর জীবনসংগ্রামের কথাই বলা হয়েছে ছবিটিতে, ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ২৮ ডিসেম্বর ১৯৮৪ সালে। মজার ব্যাপার হলো, একই দিনে মুক্তি পায় আলমগীর-শাবানা অভিনীত আমজাদ সাহেবের আরেকটি চলচ্চিত্র ‘সখিনার যুদ্ধ’, যে ছবিটিও ছিল নারী সংগ্রামের গল্প।
যাই হোক… এই ‘ভাত দে’ ছবিটিতে অভিনয়ে ছিলেন শাবানা, আলমগীর, আনোয়ার হোসেন, আনোয়ারা, টেলি সামাদ, রাজীব ও শিশু শিল্পী আঁখি আলমগীর। শিশু আঁখি অভিনেতা আলমগীরের মেয়ে এবং প্রথম ছবিতেই চমৎকার অভিনয় গুনে শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পীর বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
পোস্টার: এবার মূল বিষয়ে আসি, ‘পোস্টারের নান্দনিকতা’। একটি চলচ্চিত্রের সফলতার পেছনে পোস্টারের গুরুত্ব কতখানি তা অনেক বলেছি আমার আগের লেখাগুলোতে। এ ছবিটির সাফল্যের সঙ্গে পোস্টারের অবদান অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। পোস্টার ডিজাইন করেছিলেন লুৎফর রহমান, যিনি আমজাদ সাহেবের বেশির ভাগ চলচ্চিত্রের পোস্টার ডিজাইন করতেন।
আরও পড়ুন: স্বর্ণালি সময়ের নান্দনিক পোস্টার
জীবনঘনিষ্ঠ ‘ভাত দে’র পোস্টারটি কিন্তু বেশ সাদামাটা। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এর ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক অসহায় নারীর জীবন বাঁচানোর ভাষা। যে ভাষাতে ফুটে উঠেছে এক ক্ষুধার্ত নারীর ‘ভাত দে’ বলে চিৎকার, যে চিৎকারের মাধ্যমে তার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, এবং এটা তার মৌলিক দাবি। তার ‘ভাত দে’ বলে চিৎকার বা দাবির স্থিরচিত্রটি ছবির প্রতিচ্ছবি হিসেবে পোস্টারে ব্যবহার করা হয়েছে, মূলত এখানেই প্রকাশ পেয়েছে পোস্টারের নান্দনিকতা।
কাহিনি সংক্ষেপ: ‘ভাত দে’র হৃদয় বিদারক কাহিনি মোটামুটি সবারই জানা। তারপরও সংক্ষেপে কিছুটা তুলে ধরছি— হতদরিদ্র এক গরিব বাউল (আনোয়ার হোসেন), যার স্ত্রী (আনোয়ারা) ভাতের অভাবে ছোট্ট মেয়ে জরি (আঁখি আলমগীর)-কে ফেলে এক নৌকার মহাজনের সঙ্গে পালিয়ে যায়। অভাব-অনটনের সংসার আর অন্ধ বাউল বাবাকে নিয়ে ছোট্ট জরির শুরু হয় জীবনসংগ্রাম। এক সময় ছোট্ট জরি (শাবানা) বড় হয়, চালের আড়তের মহাজন (রাজিবের) চোখ পড়ে তার ওপর।
একদিন আড়তে দুমুঠো চাল জোগাড় করতে গিয়ে মারা যায় আনোয়ার হোসেন। অন্ধ বাবাকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়ে শাবানা। এদিকে ওস্তাদের মৃত্যুর খবর পেয়ে ছুটে আসে শিষ্য আলমগীর, দায়িত্ব নেয় অসহায় জরির, সুখের অবলম্বন খুঁজে পায় জরি আলমগীরের মাঝে। কিন্তু কুচক্রী রাজিবের চালে আবারও অসহায় আর বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে জরি। শুরু হয় সহায়-সম্বলহীন অসহায় ‘জরি’র করুণ কাহিনি। যার চিত্ররূপ অত্যন্ত করুণভাবে সেলুলয়েডের ফিতায় তুলে ধরেছিলেন আমজাদ হোসেন!
শুটিং: ‘ভাত দে’র শুটিং হয়েছিল মানিকগঞ্জের বেউথা নদীর ঘাট, আন্ধার মানিক ও তার আশপাশের এলাকায়। তবে বেশির ভাগ শুটিং ছিল বেউথা নদীর পাশ দিয়েই। অবশ্য আমজাদ হোসেনের বেশির ভাগ চলচ্চিত্রের শুটিং হতো এই মানিকগঞ্জেই। শুধু আমজাদ সাহেবই না বেশির ভাগ গ্রাম ভিত্তিক চলচ্চিত্রের শুটিং হতো মানিকগঞ্জসহ আশপাশের এলাকায়, যা এখনো হচ্ছে।
আমার বাড়ি যখন মানিকগঞ্জে তখন আমারও বহু ছবির শুটিং দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল, যার মধ্যে এই ‘ভাত-দে’ ছবিটিও ছিল। আর শুটিং দেখার দারুণ এক স্মৃতিও মনে পড়ছে আজ। আমার বয়স তখন ৮ কি ৯ বছর হবে, মামার সঙ্গে গিয়েছি ছবিটির শুটিং দেখতে। তখন গানের শুটিং চলছিল, গানটি ছিল ‘গাছের একটা পাতা ঝরলে, কাছের একটা মানুষ মরলে, খবর তো কেউ রাখে না, দেখে না কেউ দেখে না…’ অভিনয় করছিলেন আলমগীর। দৃশ্যটি এ রকম ছিল— আলমগীর গান গাইবে আর বহু দর্শক তা গোল হয়ে দেখবে। এখানে একটু উল্লেখ্য করি, গানটির একপর্যায়ে যখন আলমগীরের সঙ্গে পাগল টাইপের একজনকে দেখা যায় সে কিন্তু সত্যি সত্যি বেউথা বাজারে থাকা পাগল। সাদা গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরা আলমগীরের করা এই গানের শুটিং এখনো মনের মধ্যে গেঁথে আছে।
আরও পড়ুন: স্বর্ণালি যুগের পোস্টার নিয়ে বাকি কথা
আরেকটি গান ছিল শাবানা-আলমগীরের, ‘চিনেছি তোমারে আকারে প্রকারে, দিনের আলোয় রাতের আঁধারে’। এই গানের দৃশ্যায়ন হয়েছিল বেউথা নদীর ঘাটে আর তা ছিল একেবারে কনকনে শীতের সকালে। সদ্য বিয়ে হওয়া দুই নর-নারীর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ছিল মূলত গানটির চিত্রায়ণে।
শুটিংয়ে আরেকটি ঘটনা ছিল তা হলো— হত-দরিদ্র অসহায় শাবানার চরিত্র অনুযায়ী যে শাড়ি তিনি ব্যবহার করছিলেন তা আসলে সেই চরিত্র অনুযায়ী মানাচ্ছিল না। এদিকে শুটিং বন্ধ করার উপায়ও ছিল না, শেষে স্থানীয় এক গরিব মহিলার শাড়ি পড়ে শাবানাকে শুটিং করতে হয়েছিল।
যাই হোক, ঢাকার বর্ণিল সব চলচ্চিত্রের মধ্যে যদি সেরা পাঁচটি ছবি নির্বাচিত করতে বলা হয় তাহলে ‘ভাত দে’কে রাখবো একেবারেই প্রথম দিকে। তাই তো, অসাধারণ নির্মাণের কঠিন বাস্তবতার চিত্ররূপ ‘ভাত দে’ সে বছরের (১৯৮৪) জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ মোট দশটি শাখায় পুরস্কার লাভ করে, আর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) দেয় চারটি বিভাগে পুরস্কার৷ এ ছাড়া ছবিটি আন্তর্জাতিকভাবে ‘কান’ চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিয়েছিল।
পুরস্কারে: জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার— শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী (শাবানা), শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী (আঁখি আলমগীর), শ্রেষ্ঠ পরিচালক (আমজাদ হোসেন), শ্রেষ্ঠ প্রযোজক (আবু জাফর খান), শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার, শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা (আমজাদ হোসেন), শ্রেষ্ঠ শব্দগ্রাহক (এমএ বাসেত), শ্রেষ্ঠ চিত্র সম্পাদক (মুজিবুর রহমান দুলু) ও শ্রেষ্ঠ শিল্প নির্দেশক (অঞ্জন বণিক)। বাচসাস পুরস্কার— শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার, শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা (আমজাদ হোসেন), শ্রেষ্ঠ অভিনেতা (আলমগীর) ও শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক/রঙিন (রফিকুল বারী চৌধুরী)।
গান: গল্প, নির্মাণ আর অভিনয় যদি প্রাণ হয়ে থাকে তাহলে সে ছবির সুমধুর গানও থাকবে সেই প্রাণের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে। সে ক্ষেত্রে মেলোডি কিং আলাউদ্দিন আলীর করা মনে দাগ কাটা কিছু গান এসেছিল। ‘ভাত দে’ চলচ্চিত্রের গানের মন কাড়া সব সুর আপনাকে নিয়ে যাবে এক অন্যরকম রাজ্যে, ভালো লাগার এক আবেশ ছড়াবে আপনার মন প্রাণ জুড়ে।
ছবির সেই সব গান হলো— কত কাঁদলাম কত সাধলাম আইলা (সৈয়দ আবদুল হাদী ও তপন চৌধুরীর দুটি ভার্সন), গাছের একটা পাতা ঝরলে,কাছের একটা মানুষ মরলে খবর তো কেউ রাখে না (সৈয়দ আবদুল হাদী), চিনেছি তোমারে আকারে-প্রকারে দিনের আলো রাতের আধারে (সৈয়দ আবদুল হাদী ও সাবিনা ইয়াসমিন) ও তিলে তিলে মইরা যামু তবু তোরে ডাকবো না (সাবিনা ইয়াসমিন)।
অবশেষে: ‘ভাত দে’ একটি অসহায় নারীর বাঁচার আকুতি চিৎকার, যে চিৎকারে আকাশে-বাতাসে শুধু হাহাকার আর হাহাকার!