Tyrion Lannister
Member
নরসিংদীর করিমপুরে গৃহবধূকে হত্যার দায়ে স্বামীকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করেছে আদালত। দন্ডপ্রাপ্ত আসামী আজ একটি চিঠি লিখেছে জজ এর কাছে। জজ একরাম চৌধূরী সপ্তাহখানেক আগে এই রায় প্রদান করে। আজ শুক্রবার, একরাম চৌধূরী তার বাড়ির ছাদে বসে বই পড়ছিলেন। জেলখানার জেলার মজিবুল হক ফোন করে একরাম চৌধূরীকে বললেন, "স্যার অনেক আকুতি মিনতি করে ২০৭ নং সেলের কয়েদী কয়েক পাতার একটি চিঠি পাঠিয়েছে আমার কাছে। অনুরোধ করে বলেছে আমি যেন চিঠিটা প্রাপকের ঠিকানায় পৌঁছে দেই। চিঠির প্রাপকের জায়গায় আপনার নাম লেখা। আমি কি চিঠিটা আপনার কাছে পাঠাবো স্যার?"
একরাম চৌধূরী কোনো কিছু না ভেবেই বলে দিলেন,"পাঠিয়ে দিন।"
একরাম চৌধূরী জানেন না চিঠিটা কে লিখেছে। এর আগেও কয়েকজনের কাছ থেকে তিনি চিঠি পেয়েছেন। একবার এক ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামী চিঠি লিখে বলেছিল, "স্যার আমার খুব শখ জেগেছে কচু শাক আর মালেঞ্চা শাক দিয়ে ভাত খাব। কবে জানি ফাঁসির ডাক এসে পড়ে। আমাকে খাওয়াবেন স্যার?"
একরাম চৌধূরী কচু শাক রান্না করে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে পারলেও মালেঞ্চা শাকের জোগাড় করতে পারেন নি। তবে এতে উনার মনে কোনো দুঃখ নেই। কারণ হাই কোর্টে আপিল করে সেই লোকের ফাঁসির পরিবর্তে বারো বছরের জেল হয়েছিল। বেঁচে যেহেতু গিয়েছে, নিশ্চয় মালেঞ্চা শাক খাওয়ার ইচ্ছেটাও পূরণ হবে। একরাম চৌধূরী আবারো বই পড়ায় মন দিলেন। বইয়ের নাম "দ্য ভিঞ্চি কোড"। ড্যান ব্রাউনের এই বইটি তিনি এই নিয়ে তিনবার পড়ছেন।
বাদল ফুল গাছের নিচে বসে ঘাস বেছে পরিষ্কার করছে। হঠাৎ হঠাৎ কিছু সময়ের জন্য থেমে যাচ্ছে। তার মেয়ে তুলি চোখের মধ্যে ভেসে উঠে। কে দেখবে মেয়েটাকে? জেলখানায় আসার পর থেকে বাদলের বাবা একবারও দেখতে আসেনি। তার মা এসেছিল দুই দিন। বাদল ছল ছল চোখে লোহার শিকের ঐ প্রান্ত থেকে বলেছিল, "মা আমি তো তোমার পেটে জন্মাইছি। তুমি তো জানো আমি কেমন? আমি কোনোদিন তোমাকে মিথ্যে বলিনি। বিশ্বাস করো মা, আমি শাহিদাকে খুন করিনি।"
বাদলের মা কাপড়ের আঁচলে চোখ মুছে বলেছিল, "তোর বাবা'কে আমি বিশ্বাস করাতে পারলাম না। কত করে বললাম, হাই কোর্টে আপিল করো। তোর বাবা আমাকে ধমক দিয়ে বলে, খুনি ছেলের পক্ষ নিও না। মান সম্মান যা যাবার গেছে।"
বাদলের তাতেও কোনো দুঃখ নেই। মেয়েটার জন্য মনটা কাঁদে। তুলির জন্য হলেও তার জেল থেকে বের হওয়া প্রয়োজন। দুই দিনে চিঠি লিখে শেষ করে জেলারের নিকটে পাঠিয়েছে। কয়েদি যারা আছে, সবাই জেলারের প্রশংসা করেছে। তিনি নিশ্চয় জজ সাহেবের কাছে চিঠিটা পাঠাবে। সে নির্দোষ। সে কেন মিথ্যে খুনের দায়ে জেল খাটবে? নিজের বউকে যদি মারার চিন্তা থাকতো, আরো আগেই সে খুন করতো। কিন্তু খুন না করে প্রতিনিয়ত বুঝিয়েছে। তখন যদি শাহিদা বুঝতো, তাহলে তাকে আর খুন হতে হতো না। বাদলকেও স্ত্রী হত্যার দায়ে জেল খাটতে হতো না।
একরাম চৌধূরীর হাতে চিঠি এসেছে সন্ধ্যার পর। দারোয়ার এসে চিঠি দিয়ে গেলেও তখন পড়া শুরু করেনি। একরাম চৌধূরী প্রতি শুক্রবার এমন সময় তার নাতনির সাথে ভিডিও কলে কথা বলেন। আমেরিকাতে তখন সবে মাত্র সকাল। কথা বলার উপযুক্ত সময়। চিঠি ড্রয়ারে রেখে আবারো তিনি কথায় মগ্ন ছিলেন। চিঠি পড়া শুরু করলেন রাতের খাবারের পর। নীল কালিতে লেখা চিঠি। জেলখানার ভিতর নীল কালির কলম কোথায় পাওয়া যায়, একরাম চৌধূরী জানেন না। হাতের লেখা তেমন খারাপ না। অন্তত ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন লেখার থেকে হাজারগুণ ভালো। একরাম চৌধূরী চিঠির প্রথমে সালাম দেখে খুশি হলেন। শুদ্ধভাবে লেখা, "আসসালামু আলাইকুম"। তিনি মনে মনে সালামের জবাব নিলেন। তারপর পড়া শুরু করলেন।
*আশা করি আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন। আমি ভালো নেই জজসাহেব। আপনি আমাকে যাবজ্জীবন দিলেন। আপনার কোনো দোষ নেই। আদালতে যা প্রমাণ হবে তার উপর ভিত্তি করেই আপনি রায় দিবেন। আমার আরো আপনাকে ধন্যবাদ দেয়ার কথা। চৈত্র বৈশাখ মাসে আমার মাথা কিছুটা খারাপ থাকে। অস্বাভাবিক আচরণ করি। শাহিদা খুন হলো চৈত্রের শেষের দিকে। আমার মানষিক সমস্যার ব্যাপারটা আমলে নিয়ে ফাঁসি না দিয়ে যাবজ্জীবন দিলেন। এজন্য আপনাকে ধন্যবাদ। অন্তত বেঁচে তো থাকব। কিন্তু জজ সাহেব এটাকে বাঁচা বলে না। আমার মেয়ে তুলি, মাত্র সাড়ে চার বছর বয়স। সে আমার সমস্ত পৃথিবী। তাকে ছাড়া দিনের পর দিন কীভাবে কাটবে আমার? জানেন? জেলখানায় আসার পর থেকে মেয়েটাকে একটা দিনের জন্য দেখতে পারিনি। আমার বাবা আসতে দেয়নি। কারণ আমার বাবা ধরেই নিয়েছে খুনটা আমি করেছি। কিন্তু জজ সাহেব বিশ্বাস করেন, খুনটা আমি করিনি। শাহিদা খুন হয়েছে পেঁপেঁ বাগানে। রাত একটার সময় আমি কেমন করে শাহিদাকে পেঁপেঁ বাগানে নিয়ে যাবো? একবারও চিন্তা করেছেন জজ সাহেব?
আমি যেমন খুন করিনি, তেমনি আমি নিজের চোখে দেখিনি কে খুন করেছে? কিন্তু আমি জানি খুনটা কে করেছে। আমার উকিলকেও বলেছিলাম কথাটা। কিন্তু কোনো প্রমাণ নেই আমার কাছে। খুন করেছে আমার একমাত্র বোনের স্বামী আমজাদ তালুকদার। আমার কাছে প্রমাণ না থাকলেও আপনি তদন্ত করার ব্যবস্থা করলে কিছুটা আলামত পাওয়া যাবে। আমি যখন সেদিন রাতে টর্চ লাইট নিয়ে শাহিদা'কে খুঁজতে বের হয়েছি, তখন পেঁপেঁ বাগানে ঢুকার আগে সিগারেটের প্যাকেট খুঁজে পেয়েছি। মালব্রো সিগারেট। আমজাদ বিদেশ থেকে ছুটিতে আসার সময় নিয়ে এসেছিল। আমাদের এলাকার কোথাও মালব্রো সিগারেট পাওয়া যায় না। সিগারেটের প্যাকেটটা আমার ঘরে এখনো আছে। টেবিলের ড্রয়ারে রেখেছি। আমি সিগারেট খাই না। এলাকাতেও এই সিগারেট পাওয়া যায় না। এগুলো আমজাদেরই সিগারেট।
একরাম চৌধূরী এই পর্যন্ত পড়েই ঘুমিয়ে পড়লেন। তার একটা সমস্যা হলো, যখন ঘুম পায় তখনই ঘুমাতে হবে। নয়তো পরে আর সারা রাতেও ঘুম ধরবে না। তাই চিঠিটা তোষকের নিচে রেখে ঘুমের জন্য চোখ বুজলেন। দেলোয়ারের চেহারাটা চোখে ভেসে উঠলো। রায় দেয়ার সময় মনে হয়েছিল, ছেলেটা নির্দোষ। কিন্তু আসামী পক্ষের উকিল সেটা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এখানে একরাম চৌধূরীর কিছুই করার নেই। কিন্তু বাদলকে সম্পূর্ণ নির্দোষ ভাবাটাও বোকামি। চৈত্র বৈশাখ মাসে লোকটার মাথা খারাপ থাকে। মানষিক বিকারগ্রস্থ মানুষ খুন করতেও পারে। তবে ছেলেটার একটা যুক্তি ভালো লেগেছে। রাত একটার সময় সে তার স্ত্রীকে পেঁপেঁ বাগানে নিবে কেন? আর তার স্ত্রী যাবেই কেন এতো রাতে? কোথাও একটা রহস্য রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। মিজানুর রহমান অনেক ভালো উকিল। তিনি সহজে কোনো কেইস হেরে যান না। কিন্তু এই কেইসটা তিনি ঠিকমত লড়তেই পারলেন না প্রমাণের অভাবে। একরাম চৌধূরী ভাবলেন, মিজানুর রহমানের সাথে কথা বলে মামলাটি আরেকবার কোর্টে তোলার ব্যবস্থা করবেন। তাঁর কারণে একজন নির্দোষ মানুষ সাজা ভোগ করবে, এটা তিনি মানতে পারবেন না। অবশ্য তাঁর কোনো দোষ নেই, মামলার প্রমাণাদি যেদিকে, রায়ও সেদিকে। তবুও চেষ্টা করতে দোষ কী? যদি লোকটা নির্দোষ প্রমাণিত হয়। ভাবতে ভাবতে একরাম চৌধূরী ঘুমিয়ে পড়লেন।
বাদলের একমাত্র বোনের নাম বর্ষা। সবার খুব আদরের। নরসিংদী সরকারী কলেজ থেকে ইন্টার কমপ্লিট করে সবে মাত্র অনার্সে ভর্তি হয়েছিল। তখন তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসে। ছেলে দুবাই প্রবাসী। কাঁচা পয়সার মালিক। দেখতে রাজপুত্রের মতো। এমনটাই বর্ণনা করেছিল উত্তর পাড়ার ঘটক সুলতান মিয়া। আমজাদ তালুকদার দেখতে রাজপুত্রের মতো না হলেও সুদর্শন। উচ্চতা ছয় ফুটের কাছাকাছি। কাঁচা হলুদের মতো গায়ের রং। বাদলের কাছেই প্রথম পাত্রের কথা জানিয়েছিল ঘটক সুলতান মিয়া। বাদল জানিয়েছে তারা বাবা আনোয়ার হোসেনকে। দুই পক্ষের দেখাদেখির পর বিয়ে না হবার মতো কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া গেল না। আমজাদ তালুকদার তিন মাসের ছুটিতে বাড়ি এসেছে। বিয়ে করে তিনমাস পর দুবাইয়ের কর্মস্থলে ফিরে যাবে। বর্ষা বাবা আর ভাইয়ের কথায় নদীতে ঝাঁপ দিতেও রাজী। তার নিজস্ব কোনো পছন্দ নেই। এই নিয়ে আনোয়ার হোসেন প্রায়ই মানুষের কাছে গর্ব করে বলে, আমার ছেলে-মেয়ে দুটো আমার কথা ছাড়া কোথাও পা বাড়ায় না।
ছেলে পক্ষের কোনো কিছু চাওয়ার না থাকলেও আনোয়ার হোসেন সমস্ত গহনা বানিয়ে দিলেন। একটা মাত্র মেয়ে তার, কিছু না চাইলেও বাবার নীকটে তাঁর প্রাপ্য।
একরাম চৌধূরীর ঘুম ভেঙ্গে গেল খুব সকাল বেলা। বিছানার পাশে টেবিল থেকে চশমা নিয়ে বিছানায় বসলেন। তার মনে পড়লো, রাতে বাদলের চিঠিটা তোষকের নিচে রেখেছিলেন। চিঠিটা পড়া হয়নি। তিনি হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হলেন। সপ্তাহের দুইটা দিন বেশ আরাম করেন একরাম চৌধূরী। এই বয়সে ডায়াবেটিস নিয়ে ছুটাছুটির চেয়ে বিশ্রাম ভালো। প্রতিদিন মামলা-মোকাদ্দমা, জেল, ফাঁসি আর ভালো লাগে না। তিনি চিঠিটা বের করলেন তোষকের নিচ থেকে। ভাবতে লাগলেন, তিন পাতার চিঠিটা নিশ্চয় বাদল একদিনে লিখেনি।
*জজ সাহেব, চৈত্র-বৈশাখ মাসে আমার মাথা কিছুটা অস্বাভাবিক থাকে। কিন্তু সেটা প্রতিদিন না, হঠাৎ হঠাৎ। ধরুন হঠাৎ রোদের তাপমাত্রা অনেক বেড়ে গেল। বা বৈশাখ মাসের তুফান শুরু হলো। কিন্তু রাত একটা দেড়টার দিকে মাথা নিশ্চয় খারাপ হয়নি। তবে হবার কথা ছিল। আমার বউ যখন অন্য পরপুরুষের সাথে প্রেম ভালোবাসায় হাবুডুবু খায়। সে কথা শোনার পর অবশ্যই আমার মাথা খারাপ হবার দরকার ছিল। সেই মাথা খারাপ নিয়ে শাহিদাকে মাটির নিচে পুতে ফেলা দরকার ছিল। কিন্তু আমি তা করিনি। আমাদের মেয়ে তুলির মাথায় শাহিদার হাত রেখে বলেছিলাম, "আমাদের মেয়েটার ভবিষ্যত নষ্ট করো না। ভয়ংকর অভিজ্ঞতা নিয়ে মেয়েটা বড় হোক, আমি চাই না। লোকমুখে যা শুনেছি, তাতে তোমার সাথে ঘর করারই কথা না। সংসারটা টিকে আছে আমাদের মেয়েটার জন্য। ঘরের বউ রাত-বিরেতে বাড়ির বাইরে পরপুরুষের সাথে দেখা করবে, এটা কেমন কথা?"
শাহিদা আমার সব কথাকে অস্বীকার করে নিজের সাফাই গাইতো। জজ সাহেব আমি তখনো জানতাম না, সেই পরপুরুষ আমারই একমাত্র বোনের জামাই। আমজাদ তালুকদার বিয়ের এক বছর পর আবারো ছুটিতে বাড়ি এসেছিল। তখন থেকেই শাহিদার সাথে গোপন সম্পর্ক তৈরী হয়। যা আমি জানতাম না। আমজাদ তালুকদার নরসিংদী থেকে নাগরিয়াকান্দি ব্রীজ পেরিয়ে চলে আসতো আমাদের এলাকায়। আগেই শাহিদার সাথে ফোনে যোগাযোগ করে আসতো। আমি যখন গঞ্জে গঞ্জে নৌকা বুঝাই করে মালামাল নিয়ে যেতাম। আমার বাড়িতে না থাকার সুযোগে আমজাদ তালুকদার আমাদের এলাকায় আসতো। আমাদের বাড়ি আসতো না। দেখা করতো ঐ পেঁপেঁ বাগানে। আমার বন্ধু রফিক বিষয়টা আমাকে জানিয়েছিল। কিন্তু রফিকও রাতের অন্ধকারে চিনতে পারেনি যে, সে পুরুষটা আমারই বোনের স্বামী।আমজাদ তালুকদারের ছুটি শেষ হলে সে আবারো দুবাই চলে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তখনো ফোনে তাদের যোগাযোগ ছিল। আমি বুঝতে পেরে শাহিদার কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু শাহিদা গোপনে কোথা থেকে মোবাইল জোগাড় করেছিল, আমার জানা নেই। লোক লজ্জার ভয়ে কত কিছুই গোপন ছিল। বাবা-মা'কে বলতে পারিনি সে কথা। নিজের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আমার চোখ ছল ছল করতো।
দারোয়ান গেইটের কাছ থেকে টেলিফোন করে একরাম চৌধূরীকে জানালো একজন উকিল তার সাথে দেখা করতে এসেছে। একরাম চৌধূরী রাতে মিজানুর রহমানকে একটা মেসেজ করেছিলেন আসার জন্য। আজ শনিবার হওয়ায় মিজানুর রহমানের আসতে অসুবিধা হয়নি। একরাম চৌধূরী চিঠিটা টেবিলের উপরই রাখলেন। আবার কী মনে করে টেবিল থেকে সরিয়ে তোষকের নিচে রেখে দিলেন। তিনি আগেই মিজানুর রহমানকে চিঠিটা দেখাতে চান না। আগে মামলাটি আপিল আর তদন্ত করার একটি ব্যবস্থা করতে হবে।
আমজাদ তালুকদার বর্ষাকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে এলেন। বর্ষা তাঁর মা'কে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদলো। তাঁর ভাইয়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে। বর্ষার ইচ্ছে ছিল, বাদলকে গিয়ে একবার দেখে আসবে। কিন্তু তাঁর বাবার কড়া নিষেধ, ভুল করেও যেন ঐ খুনিটার সাথে দেখা করতে না যায়।
তুলি তখন পাশের বাড়ির সমবয়সী মেয়ের সাথে ছোট ছোট পাতিলে পুতুল বিয়ে খেলছে। এবার তাঁর বয়স পাঁচ বছর পূর্ণ হবে। স্কুলে ভর্তি হয়নি এখনো। এবারই ভর্তি হবার কথা ছিল। কেন ভর্তি হতে পারেনি, ছোট্ট তুলি কিছুই জানে না। সে জানে তার মা মারা গেছে। বাবা গঞ্জে গেছে, কয়েকদিন পরই ফিরে আসবে। আমজাদ তালুকদার পটেটো চিপসের একটি মালা নিয়ে এসেছিল। বারোটি চিপস একসাথে। তুলির কাছে গিয়ে বলল, "মামনি দেখো, তোমার জন্য কতো চিপস এনেছি।"
তুলি মাথা তুলে তাকিয়ে বলল, "চকলেট আনোনি?"
আমজাদ তালুকদার চকলেট আনেনি। সে আমতা আমতা করে বলল, "একটু পরেই দোকান থেকে তোমাকে চকলেট এনে দেব।"
তুলি খেলা ছেড়ে উঠেনি। সে জানে তাঁর জন্য আনা চিপস ঘরেই থাকবে। আমজাদ তালুকদার তুলির সাথের মেয়েটাকে একটা চিপস ছিঁড়ে দিলো।
আনোয়ার হোসেন দোকান থেকে ফিরছিলেন। পথে এক ভিক্ষুকের সাথে দেখা। পরনে ছেঁড়া সেন্টু গেঞ্জি আর সেলাই দেয়া লুঙ্গি। একটা পা টেনে টেনে হাঁটে। বয়স ত্রিশের বেশি হবে না। পায়ে সমস্যা না থাকলে এই ছেলে সারাদিন কঠিন পরিশ্রম করতে পারতো বলে আনোয়ার হোসেনের ধারণা। ছেলেটি আনোয়ার হোসেনের সামনে এসে বলল, "চাচা আমারে একটা কাম কাইজ দেন। ভিক্ষা করতে ভাল্লাগে না। মাইনষে ভিক্ষা দেয় না।"
আনোয়ার হোসেন মুচকি হেসে বললেন, "শরীরে তো অনেক শক্তি বুঝাই যাচ্ছে। তরতাজা যুবক, তোমাকে ভিক্ষা দিবে কে?"
ভিক্ষুক মাথা নিচু করে বলল, "হের লাইগ্যাই চাচা কাম কাইজ খুঁজতাছি। দয়া কইরা আমারে একখান কাম দেন। পেটে ভাতে রাখলেই হইবো। বাড়ির টুকটাক কাম কইরা দিমু। গোরু-বাছুর থাকলে ঘাস কাইটা দিমু।"
আনোয়ার হোসেন কী যেন ভাবলেন। বাদল জেলে যাবার পর থেকে বাড়ির গোরু-বাছুরগুলো খড় ছাড়া আর ঘাসের মুখ দেখে না। বাড়িতে তাঁর একজন কাজের লোক দরকারই। শেষে তিনি ভিক্ষুককে বললেন, "নাম কী তোমার?"
-জে, রমজান আলী।
-তো রমজান, কাজে ফাঁকি দিবা না তো?
-না চাচা, আমি কাম কইরাই খামু, হারাম খাওনের চিন্তা নাই।
-তো আসো আমার সাথে।
রমজান আলী আনোয়ার হোসেনের পেছন পেছন হাঁটছে।
একরাম চৌধূরী কোনো কিছু না ভেবেই বলে দিলেন,"পাঠিয়ে দিন।"
একরাম চৌধূরী জানেন না চিঠিটা কে লিখেছে। এর আগেও কয়েকজনের কাছ থেকে তিনি চিঠি পেয়েছেন। একবার এক ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামী চিঠি লিখে বলেছিল, "স্যার আমার খুব শখ জেগেছে কচু শাক আর মালেঞ্চা শাক দিয়ে ভাত খাব। কবে জানি ফাঁসির ডাক এসে পড়ে। আমাকে খাওয়াবেন স্যার?"
একরাম চৌধূরী কচু শাক রান্না করে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে পারলেও মালেঞ্চা শাকের জোগাড় করতে পারেন নি। তবে এতে উনার মনে কোনো দুঃখ নেই। কারণ হাই কোর্টে আপিল করে সেই লোকের ফাঁসির পরিবর্তে বারো বছরের জেল হয়েছিল। বেঁচে যেহেতু গিয়েছে, নিশ্চয় মালেঞ্চা শাক খাওয়ার ইচ্ছেটাও পূরণ হবে। একরাম চৌধূরী আবারো বই পড়ায় মন দিলেন। বইয়ের নাম "দ্য ভিঞ্চি কোড"। ড্যান ব্রাউনের এই বইটি তিনি এই নিয়ে তিনবার পড়ছেন।
বাদল ফুল গাছের নিচে বসে ঘাস বেছে পরিষ্কার করছে। হঠাৎ হঠাৎ কিছু সময়ের জন্য থেমে যাচ্ছে। তার মেয়ে তুলি চোখের মধ্যে ভেসে উঠে। কে দেখবে মেয়েটাকে? জেলখানায় আসার পর থেকে বাদলের বাবা একবারও দেখতে আসেনি। তার মা এসেছিল দুই দিন। বাদল ছল ছল চোখে লোহার শিকের ঐ প্রান্ত থেকে বলেছিল, "মা আমি তো তোমার পেটে জন্মাইছি। তুমি তো জানো আমি কেমন? আমি কোনোদিন তোমাকে মিথ্যে বলিনি। বিশ্বাস করো মা, আমি শাহিদাকে খুন করিনি।"
বাদলের মা কাপড়ের আঁচলে চোখ মুছে বলেছিল, "তোর বাবা'কে আমি বিশ্বাস করাতে পারলাম না। কত করে বললাম, হাই কোর্টে আপিল করো। তোর বাবা আমাকে ধমক দিয়ে বলে, খুনি ছেলের পক্ষ নিও না। মান সম্মান যা যাবার গেছে।"
বাদলের তাতেও কোনো দুঃখ নেই। মেয়েটার জন্য মনটা কাঁদে। তুলির জন্য হলেও তার জেল থেকে বের হওয়া প্রয়োজন। দুই দিনে চিঠি লিখে শেষ করে জেলারের নিকটে পাঠিয়েছে। কয়েদি যারা আছে, সবাই জেলারের প্রশংসা করেছে। তিনি নিশ্চয় জজ সাহেবের কাছে চিঠিটা পাঠাবে। সে নির্দোষ। সে কেন মিথ্যে খুনের দায়ে জেল খাটবে? নিজের বউকে যদি মারার চিন্তা থাকতো, আরো আগেই সে খুন করতো। কিন্তু খুন না করে প্রতিনিয়ত বুঝিয়েছে। তখন যদি শাহিদা বুঝতো, তাহলে তাকে আর খুন হতে হতো না। বাদলকেও স্ত্রী হত্যার দায়ে জেল খাটতে হতো না।
একরাম চৌধূরীর হাতে চিঠি এসেছে সন্ধ্যার পর। দারোয়ার এসে চিঠি দিয়ে গেলেও তখন পড়া শুরু করেনি। একরাম চৌধূরী প্রতি শুক্রবার এমন সময় তার নাতনির সাথে ভিডিও কলে কথা বলেন। আমেরিকাতে তখন সবে মাত্র সকাল। কথা বলার উপযুক্ত সময়। চিঠি ড্রয়ারে রেখে আবারো তিনি কথায় মগ্ন ছিলেন। চিঠি পড়া শুরু করলেন রাতের খাবারের পর। নীল কালিতে লেখা চিঠি। জেলখানার ভিতর নীল কালির কলম কোথায় পাওয়া যায়, একরাম চৌধূরী জানেন না। হাতের লেখা তেমন খারাপ না। অন্তত ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন লেখার থেকে হাজারগুণ ভালো। একরাম চৌধূরী চিঠির প্রথমে সালাম দেখে খুশি হলেন। শুদ্ধভাবে লেখা, "আসসালামু আলাইকুম"। তিনি মনে মনে সালামের জবাব নিলেন। তারপর পড়া শুরু করলেন।
*আশা করি আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন। আমি ভালো নেই জজসাহেব। আপনি আমাকে যাবজ্জীবন দিলেন। আপনার কোনো দোষ নেই। আদালতে যা প্রমাণ হবে তার উপর ভিত্তি করেই আপনি রায় দিবেন। আমার আরো আপনাকে ধন্যবাদ দেয়ার কথা। চৈত্র বৈশাখ মাসে আমার মাথা কিছুটা খারাপ থাকে। অস্বাভাবিক আচরণ করি। শাহিদা খুন হলো চৈত্রের শেষের দিকে। আমার মানষিক সমস্যার ব্যাপারটা আমলে নিয়ে ফাঁসি না দিয়ে যাবজ্জীবন দিলেন। এজন্য আপনাকে ধন্যবাদ। অন্তত বেঁচে তো থাকব। কিন্তু জজ সাহেব এটাকে বাঁচা বলে না। আমার মেয়ে তুলি, মাত্র সাড়ে চার বছর বয়স। সে আমার সমস্ত পৃথিবী। তাকে ছাড়া দিনের পর দিন কীভাবে কাটবে আমার? জানেন? জেলখানায় আসার পর থেকে মেয়েটাকে একটা দিনের জন্য দেখতে পারিনি। আমার বাবা আসতে দেয়নি। কারণ আমার বাবা ধরেই নিয়েছে খুনটা আমি করেছি। কিন্তু জজ সাহেব বিশ্বাস করেন, খুনটা আমি করিনি। শাহিদা খুন হয়েছে পেঁপেঁ বাগানে। রাত একটার সময় আমি কেমন করে শাহিদাকে পেঁপেঁ বাগানে নিয়ে যাবো? একবারও চিন্তা করেছেন জজ সাহেব?
আমি যেমন খুন করিনি, তেমনি আমি নিজের চোখে দেখিনি কে খুন করেছে? কিন্তু আমি জানি খুনটা কে করেছে। আমার উকিলকেও বলেছিলাম কথাটা। কিন্তু কোনো প্রমাণ নেই আমার কাছে। খুন করেছে আমার একমাত্র বোনের স্বামী আমজাদ তালুকদার। আমার কাছে প্রমাণ না থাকলেও আপনি তদন্ত করার ব্যবস্থা করলে কিছুটা আলামত পাওয়া যাবে। আমি যখন সেদিন রাতে টর্চ লাইট নিয়ে শাহিদা'কে খুঁজতে বের হয়েছি, তখন পেঁপেঁ বাগানে ঢুকার আগে সিগারেটের প্যাকেট খুঁজে পেয়েছি। মালব্রো সিগারেট। আমজাদ বিদেশ থেকে ছুটিতে আসার সময় নিয়ে এসেছিল। আমাদের এলাকার কোথাও মালব্রো সিগারেট পাওয়া যায় না। সিগারেটের প্যাকেটটা আমার ঘরে এখনো আছে। টেবিলের ড্রয়ারে রেখেছি। আমি সিগারেট খাই না। এলাকাতেও এই সিগারেট পাওয়া যায় না। এগুলো আমজাদেরই সিগারেট।
একরাম চৌধূরী এই পর্যন্ত পড়েই ঘুমিয়ে পড়লেন। তার একটা সমস্যা হলো, যখন ঘুম পায় তখনই ঘুমাতে হবে। নয়তো পরে আর সারা রাতেও ঘুম ধরবে না। তাই চিঠিটা তোষকের নিচে রেখে ঘুমের জন্য চোখ বুজলেন। দেলোয়ারের চেহারাটা চোখে ভেসে উঠলো। রায় দেয়ার সময় মনে হয়েছিল, ছেলেটা নির্দোষ। কিন্তু আসামী পক্ষের উকিল সেটা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এখানে একরাম চৌধূরীর কিছুই করার নেই। কিন্তু বাদলকে সম্পূর্ণ নির্দোষ ভাবাটাও বোকামি। চৈত্র বৈশাখ মাসে লোকটার মাথা খারাপ থাকে। মানষিক বিকারগ্রস্থ মানুষ খুন করতেও পারে। তবে ছেলেটার একটা যুক্তি ভালো লেগেছে। রাত একটার সময় সে তার স্ত্রীকে পেঁপেঁ বাগানে নিবে কেন? আর তার স্ত্রী যাবেই কেন এতো রাতে? কোথাও একটা রহস্য রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। মিজানুর রহমান অনেক ভালো উকিল। তিনি সহজে কোনো কেইস হেরে যান না। কিন্তু এই কেইসটা তিনি ঠিকমত লড়তেই পারলেন না প্রমাণের অভাবে। একরাম চৌধূরী ভাবলেন, মিজানুর রহমানের সাথে কথা বলে মামলাটি আরেকবার কোর্টে তোলার ব্যবস্থা করবেন। তাঁর কারণে একজন নির্দোষ মানুষ সাজা ভোগ করবে, এটা তিনি মানতে পারবেন না। অবশ্য তাঁর কোনো দোষ নেই, মামলার প্রমাণাদি যেদিকে, রায়ও সেদিকে। তবুও চেষ্টা করতে দোষ কী? যদি লোকটা নির্দোষ প্রমাণিত হয়। ভাবতে ভাবতে একরাম চৌধূরী ঘুমিয়ে পড়লেন।
বাদলের একমাত্র বোনের নাম বর্ষা। সবার খুব আদরের। নরসিংদী সরকারী কলেজ থেকে ইন্টার কমপ্লিট করে সবে মাত্র অনার্সে ভর্তি হয়েছিল। তখন তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসে। ছেলে দুবাই প্রবাসী। কাঁচা পয়সার মালিক। দেখতে রাজপুত্রের মতো। এমনটাই বর্ণনা করেছিল উত্তর পাড়ার ঘটক সুলতান মিয়া। আমজাদ তালুকদার দেখতে রাজপুত্রের মতো না হলেও সুদর্শন। উচ্চতা ছয় ফুটের কাছাকাছি। কাঁচা হলুদের মতো গায়ের রং। বাদলের কাছেই প্রথম পাত্রের কথা জানিয়েছিল ঘটক সুলতান মিয়া। বাদল জানিয়েছে তারা বাবা আনোয়ার হোসেনকে। দুই পক্ষের দেখাদেখির পর বিয়ে না হবার মতো কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া গেল না। আমজাদ তালুকদার তিন মাসের ছুটিতে বাড়ি এসেছে। বিয়ে করে তিনমাস পর দুবাইয়ের কর্মস্থলে ফিরে যাবে। বর্ষা বাবা আর ভাইয়ের কথায় নদীতে ঝাঁপ দিতেও রাজী। তার নিজস্ব কোনো পছন্দ নেই। এই নিয়ে আনোয়ার হোসেন প্রায়ই মানুষের কাছে গর্ব করে বলে, আমার ছেলে-মেয়ে দুটো আমার কথা ছাড়া কোথাও পা বাড়ায় না।
ছেলে পক্ষের কোনো কিছু চাওয়ার না থাকলেও আনোয়ার হোসেন সমস্ত গহনা বানিয়ে দিলেন। একটা মাত্র মেয়ে তার, কিছু না চাইলেও বাবার নীকটে তাঁর প্রাপ্য।
একরাম চৌধূরীর ঘুম ভেঙ্গে গেল খুব সকাল বেলা। বিছানার পাশে টেবিল থেকে চশমা নিয়ে বিছানায় বসলেন। তার মনে পড়লো, রাতে বাদলের চিঠিটা তোষকের নিচে রেখেছিলেন। চিঠিটা পড়া হয়নি। তিনি হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হলেন। সপ্তাহের দুইটা দিন বেশ আরাম করেন একরাম চৌধূরী। এই বয়সে ডায়াবেটিস নিয়ে ছুটাছুটির চেয়ে বিশ্রাম ভালো। প্রতিদিন মামলা-মোকাদ্দমা, জেল, ফাঁসি আর ভালো লাগে না। তিনি চিঠিটা বের করলেন তোষকের নিচ থেকে। ভাবতে লাগলেন, তিন পাতার চিঠিটা নিশ্চয় বাদল একদিনে লিখেনি।
*জজ সাহেব, চৈত্র-বৈশাখ মাসে আমার মাথা কিছুটা অস্বাভাবিক থাকে। কিন্তু সেটা প্রতিদিন না, হঠাৎ হঠাৎ। ধরুন হঠাৎ রোদের তাপমাত্রা অনেক বেড়ে গেল। বা বৈশাখ মাসের তুফান শুরু হলো। কিন্তু রাত একটা দেড়টার দিকে মাথা নিশ্চয় খারাপ হয়নি। তবে হবার কথা ছিল। আমার বউ যখন অন্য পরপুরুষের সাথে প্রেম ভালোবাসায় হাবুডুবু খায়। সে কথা শোনার পর অবশ্যই আমার মাথা খারাপ হবার দরকার ছিল। সেই মাথা খারাপ নিয়ে শাহিদাকে মাটির নিচে পুতে ফেলা দরকার ছিল। কিন্তু আমি তা করিনি। আমাদের মেয়ে তুলির মাথায় শাহিদার হাত রেখে বলেছিলাম, "আমাদের মেয়েটার ভবিষ্যত নষ্ট করো না। ভয়ংকর অভিজ্ঞতা নিয়ে মেয়েটা বড় হোক, আমি চাই না। লোকমুখে যা শুনেছি, তাতে তোমার সাথে ঘর করারই কথা না। সংসারটা টিকে আছে আমাদের মেয়েটার জন্য। ঘরের বউ রাত-বিরেতে বাড়ির বাইরে পরপুরুষের সাথে দেখা করবে, এটা কেমন কথা?"
শাহিদা আমার সব কথাকে অস্বীকার করে নিজের সাফাই গাইতো। জজ সাহেব আমি তখনো জানতাম না, সেই পরপুরুষ আমারই একমাত্র বোনের জামাই। আমজাদ তালুকদার বিয়ের এক বছর পর আবারো ছুটিতে বাড়ি এসেছিল। তখন থেকেই শাহিদার সাথে গোপন সম্পর্ক তৈরী হয়। যা আমি জানতাম না। আমজাদ তালুকদার নরসিংদী থেকে নাগরিয়াকান্দি ব্রীজ পেরিয়ে চলে আসতো আমাদের এলাকায়। আগেই শাহিদার সাথে ফোনে যোগাযোগ করে আসতো। আমি যখন গঞ্জে গঞ্জে নৌকা বুঝাই করে মালামাল নিয়ে যেতাম। আমার বাড়িতে না থাকার সুযোগে আমজাদ তালুকদার আমাদের এলাকায় আসতো। আমাদের বাড়ি আসতো না। দেখা করতো ঐ পেঁপেঁ বাগানে। আমার বন্ধু রফিক বিষয়টা আমাকে জানিয়েছিল। কিন্তু রফিকও রাতের অন্ধকারে চিনতে পারেনি যে, সে পুরুষটা আমারই বোনের স্বামী।আমজাদ তালুকদারের ছুটি শেষ হলে সে আবারো দুবাই চলে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তখনো ফোনে তাদের যোগাযোগ ছিল। আমি বুঝতে পেরে শাহিদার কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু শাহিদা গোপনে কোথা থেকে মোবাইল জোগাড় করেছিল, আমার জানা নেই। লোক লজ্জার ভয়ে কত কিছুই গোপন ছিল। বাবা-মা'কে বলতে পারিনি সে কথা। নিজের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আমার চোখ ছল ছল করতো।
দারোয়ান গেইটের কাছ থেকে টেলিফোন করে একরাম চৌধূরীকে জানালো একজন উকিল তার সাথে দেখা করতে এসেছে। একরাম চৌধূরী রাতে মিজানুর রহমানকে একটা মেসেজ করেছিলেন আসার জন্য। আজ শনিবার হওয়ায় মিজানুর রহমানের আসতে অসুবিধা হয়নি। একরাম চৌধূরী চিঠিটা টেবিলের উপরই রাখলেন। আবার কী মনে করে টেবিল থেকে সরিয়ে তোষকের নিচে রেখে দিলেন। তিনি আগেই মিজানুর রহমানকে চিঠিটা দেখাতে চান না। আগে মামলাটি আপিল আর তদন্ত করার একটি ব্যবস্থা করতে হবে।
আমজাদ তালুকদার বর্ষাকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে এলেন। বর্ষা তাঁর মা'কে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদলো। তাঁর ভাইয়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে। বর্ষার ইচ্ছে ছিল, বাদলকে গিয়ে একবার দেখে আসবে। কিন্তু তাঁর বাবার কড়া নিষেধ, ভুল করেও যেন ঐ খুনিটার সাথে দেখা করতে না যায়।
তুলি তখন পাশের বাড়ির সমবয়সী মেয়ের সাথে ছোট ছোট পাতিলে পুতুল বিয়ে খেলছে। এবার তাঁর বয়স পাঁচ বছর পূর্ণ হবে। স্কুলে ভর্তি হয়নি এখনো। এবারই ভর্তি হবার কথা ছিল। কেন ভর্তি হতে পারেনি, ছোট্ট তুলি কিছুই জানে না। সে জানে তার মা মারা গেছে। বাবা গঞ্জে গেছে, কয়েকদিন পরই ফিরে আসবে। আমজাদ তালুকদার পটেটো চিপসের একটি মালা নিয়ে এসেছিল। বারোটি চিপস একসাথে। তুলির কাছে গিয়ে বলল, "মামনি দেখো, তোমার জন্য কতো চিপস এনেছি।"
তুলি মাথা তুলে তাকিয়ে বলল, "চকলেট আনোনি?"
আমজাদ তালুকদার চকলেট আনেনি। সে আমতা আমতা করে বলল, "একটু পরেই দোকান থেকে তোমাকে চকলেট এনে দেব।"
তুলি খেলা ছেড়ে উঠেনি। সে জানে তাঁর জন্য আনা চিপস ঘরেই থাকবে। আমজাদ তালুকদার তুলির সাথের মেয়েটাকে একটা চিপস ছিঁড়ে দিলো।
আনোয়ার হোসেন দোকান থেকে ফিরছিলেন। পথে এক ভিক্ষুকের সাথে দেখা। পরনে ছেঁড়া সেন্টু গেঞ্জি আর সেলাই দেয়া লুঙ্গি। একটা পা টেনে টেনে হাঁটে। বয়স ত্রিশের বেশি হবে না। পায়ে সমস্যা না থাকলে এই ছেলে সারাদিন কঠিন পরিশ্রম করতে পারতো বলে আনোয়ার হোসেনের ধারণা। ছেলেটি আনোয়ার হোসেনের সামনে এসে বলল, "চাচা আমারে একটা কাম কাইজ দেন। ভিক্ষা করতে ভাল্লাগে না। মাইনষে ভিক্ষা দেয় না।"
আনোয়ার হোসেন মুচকি হেসে বললেন, "শরীরে তো অনেক শক্তি বুঝাই যাচ্ছে। তরতাজা যুবক, তোমাকে ভিক্ষা দিবে কে?"
ভিক্ষুক মাথা নিচু করে বলল, "হের লাইগ্যাই চাচা কাম কাইজ খুঁজতাছি। দয়া কইরা আমারে একখান কাম দেন। পেটে ভাতে রাখলেই হইবো। বাড়ির টুকটাক কাম কইরা দিমু। গোরু-বাছুর থাকলে ঘাস কাইটা দিমু।"
আনোয়ার হোসেন কী যেন ভাবলেন। বাদল জেলে যাবার পর থেকে বাড়ির গোরু-বাছুরগুলো খড় ছাড়া আর ঘাসের মুখ দেখে না। বাড়িতে তাঁর একজন কাজের লোক দরকারই। শেষে তিনি ভিক্ষুককে বললেন, "নাম কী তোমার?"
-জে, রমজান আলী।
-তো রমজান, কাজে ফাঁকি দিবা না তো?
-না চাচা, আমি কাম কইরাই খামু, হারাম খাওনের চিন্তা নাই।
-তো আসো আমার সাথে।
রমজান আলী আনোয়ার হোসেনের পেছন পেছন হাঁটছে।