‘প্রতিপক্ষ মৃত্যু/ অতিপ্রাকৃত চশমাটা চোখে লাগিয়ে একটু এদিক ওদিক তাকালে দেখা যায় মৃত্যুর অসংখ্য পদচিহ্ন/ সে এসেছে এখানে বারবার/ দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে অপেক্ষায়…/ কখন মুমূর্ষু যোদ্ধা ক্লান্ত হয়ে একটু বিরতি নেয়/ অমনি পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে যাবে এই পৃথিবীর বাইরে/ আর তাই এখানে কখনও ছাদ থেকে ঝুলে থাকে/ কখনও খাটের নিচে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ায়/ কখনও সেবিকার শুভ্র পোশাকের ভাঁজে ভাঁজে উঁকি দেয় মৃত্যু।’ কৃষ্ণপক্ষের রাত। সারাদিন ধরে রোদেপোড়া নগরী চৈতি হাওয়ায় জুড়িয়ে আসছিল। দিন শেষে এলো রাত। ব্যস্ত শহর ঢাকা প্রস্তুতি নিচ্ছে ঘুমের। ঘরে ঘরে অনেকে তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। ‘অপারেশন সার্চলাইট।’ এ নামে মৃত্যুক্ষুধা নিয়ে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক নামল ঢাকায়। অকস্মাৎ যেন খুলে গেল নরকের সব দরজা। বিভীষিকা ছড়িয়ে দিকে দিকে ছুটে গেল সাঁজোয়া গাড়ির বহর। রাতের স্তব্ধতা গুঁড়িয়ে গর্জে উঠল বন্দুক, কামান আর ট্যাঙ্ক। নিরীহ মানুষের আর্তনাদে ভারি হলো রাতের বাতাস। মানব ইতিহাসের পাতায় রচিত হলো কালিমালিপ্ত আরেকটি অধ্যায়। নিরস্ত্র, ঘুমন্ত মানুষকে বর্বরোচিতভাবে হত্যার ঘটনায় স্তম্ভিত হলো বিশ্ববিবেক।
আজ সেই ভয়াল ও বীভৎস ২৫ মার্চ। মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত দিন। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক নৃশংস, ভয়ঙ্কর ও বিভীষিকাময় কালোরাত্রি। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক কলঙ্কিত দিন। স্বাধীনতার ৪৭ বছরে পর এবারই প্রথম জাতীয়ভাবে পালিত হচ্ছে গণহত্যা দিবস। ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালনের প্রস্তাব গত বছর ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হলে তা সর্বসম্মতভাবে পাস হয়। পরে সে বছরই ২০ মার্চ মন্ত্রিসভায় ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। বাঙালির ইতিহাসের কালোরাত্রিকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব পাঠানোরও সিদ্ধান্ত হয়।
যে রাতে খুলে গিয়েছিল নরকের দরজা : উত্তাল দিন শেষে নেমেছে সন্ধ্যা। গভীর হতে শুরু করেছে রাত। তখনো কেউ জানে না কী ভয়ঙ্কর, নৃশংস ও বিভীষিকাময় রাত আসছে বাঙালির জীবনে। রক্তাক্ত রাতে আগুনের শিখা আকাশকে বিদ্ধ করেছিল। এক সময় অগ্নিবর্ণের শোকার্ত ধূম্রকুণ্ডলী ছড়িয়ে পড়ল, কিন্তু পর মুহূর্তেই সেটাকে ছাপিয়ে উঠল আগুনের লকলকে শিখা। রাত সাড়ে ১১টায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হলো হনন-উদ্যত নরঘাতক পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ছড়িয়ে পড়ল শহরময়। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে গর্জে উঠল অত্যাধুনিক রাইফেল, মেশিনগান ও মর্টার। হতচকিত বাঙালি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে।
’৭১ এর গণহত্যার প্রথম শিকার হন বাংলা ও বাঙালির আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারীরা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, গণহত্যার রাতে ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করা হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কয়েকটি সুসজ্জিত দল ঢাকার রাস্তায় নেমে প্রথমে ঢুকে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল ১৮নং পাঞ্জাব, ২২নং বেলুচ, ৩২নং পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এবং কিছু সহযোগী ব্যাটেলিয়ান। এই বাহিনীগুলোর অস্ত্রসম্ভারের মাঝে ছিল ট্যাংক, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, রকেট নিক্ষেপক, ভারী মর্টার ও মেশিনগান। ইউনিট নং ৪১ পূর্ব দিক থেকে, ইউনিট নং ৮৮ দক্ষিণ দিক থেকে এবং ইউনিট নং ২৬ উত্তর দিকে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘিরে ফেলে। ওই রাতেই ১০ জন শিক্ষক, ১২ কর্মচারী ও প্রায় ৩০০ ছাত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
মৃত্যু উপত্যকা : মধ্যরাতে ঢাকা পরিণত হলো লাশের শহরে। ঢাকা শহরের রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, নীলক্ষেতসহ বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে তারা বাঙালি নিধন শুরু করে। ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানে মাত্র এক রাতেই হানাদাররা নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল অর্ধ লক্ষাধিক বাঙালিকে।
শুধু নিষ্ঠুর ও বীভৎস হত্যাকাণ্ডই নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকা গণমাধ্যমও সেদিন রেহাই পায়নি জল্লাদ ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা থেকে। পাক হানাদাররা সেই রাতে অগ্নিসংযোগ, মর্টার সেল ছুড়ে একে একে দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, জাতীয় প্রেসক্লাব ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত করে। এ হামলায় জীবন দিতে হয় বেশ কয়েকজন গণমাধ্যম কর্মীকেও। তাদের এই সশস্ত্র অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল একটিই। আর তা হলো বাঙালির মুক্তির আকাক্সক্ষাকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করা।
ইতিহাসের খেরোখাতা : ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে। তারা বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে গোপনে গোপনে সামরিক প্রস্তুতি নিতে থাকে। মুক্তিকামী বাঙালি তখন স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বেলিত। আলোচনার নামে শাসকগোষ্ঠীর সময়ক্ষেপণকে বাঙালিরা সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। ক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলার মানুষ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার একটি দিক-নির্দেশনামূলক রূপরেখা পেশ করেন। যা ছিল প্রকৃতপক্ষে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের মূলমন্ত্র। এদিকে সামরিক প্রস্তুতির অংশ হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জাহাজ বোঝাই করে সৈন্য ও গোলাবারুদ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আনা হয়। বিষয়টি বাঙালিদের অজানা ছিল না। ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে তারা। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অসহযোগ আন্দোলন।
২৫ মার্চ রাত সোয়া ১টার দিকে এক দল সৈন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে অবস্থিত বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। তখন বঙ্গবন্ধু বীরের মতো দোতলার ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়ান। রাত ১টা ২৫ মিনিটের দিকে এ বাড়ির টেলিফোনের লাইন কেটে দেয়া হয়। এ সময় বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে চিরতরে নস্যাতের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় হায়েনার দল। অবশ্য গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেন। আর এই ওয়্যারলেস বার্তা চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দপ্তরে পৌঁছে। চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙর করা একটি বিদেশি জাহাজও এ বার্তা গ্রহণ করে। তখন চট্টগ্রামে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের সাবেক শ্রমবিষয়ক সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সেই রাতেই সাইক্লোস্টাইল করে শহরবাসীর মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ঘোষণার ভিত্তিতেই ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়।