What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

জাহাঙ্গীরনগরের দেয়ালগুলো যেভাবে রঙিন হলো (1 Viewer)

ESKwucM.jpg


যাত্রীছাউনিকে মনে হতে পারে কোনো অদ্ভুত প্রাণী, ছবি: সংগৃহীত

চারদিক সবুজে ঢাকা, তার মধ্যেই উঁকিঝুঁকি মারে লাল ইটের দালান। ঠিক মাঝ বরাবর কালো পিচের রাস্তার আশপাশে কালচে পানির লেক। লেক ভরা শাপলা, পদ্ম। কখনোবা ইতিউতি নেচে বেড়ানো অতিথি পাখির দল। জায়গাটার নাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

আমি যখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি তখন এখানের প্রাকৃতিক নিসর্গের সঙ্গে লাল ইটের দালানেও কেমন যেন একটা প্রাণ ছিল ৷ সবুজের মাঝে লাল যেন চিকমিক করে উঠত, সবুজ টিয়া পাখির গলার লাল মালার মতোই।

প্রাঙ্গণ ভরা সবুজের মধ্যে লাল দেয়ালগুলো দেখতে বেশ লাগত ৷ কোনো কোনো দেয়ালে রাজনৈতিক স্লোগান চোখে পড়ত, যাকে বলে ‘চিকা মারা’। এ ছাড়া দেয়ালগুলোতে আর তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু বছর না ঘুরতেই খেয়াল করলাম 'চিকা'র পাশাপাশি দেয়ালগুলো বিসিএস কোচিং, লোকাল হেকিমি দাওয়াখানা, পড়াইতে চাই, ‘মেছ’ ভাড়া হবেসহ নানা বিজ্ঞাপন-পোস্টারে ছেয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হলো আরেকটা বাজে চর্চা—দেয়ালে দেয়ালে স্প্রে রং দিয়ে ব্যাচের নাম, নিজের নাম লিখে দেয়াল নষ্ট করা।

75n3Ryk.jpg


দেয়াল যখন ক্যানভাস, ছবি: সংগৃহীত

ঝকঝকে লাল ইটের দেয়ালগুলো চোখের সামনেই আস্তে আস্তে নোংরা হয়ে যেতে দেখলাম। প্রশাসনিকভাবে ক্যাম্পাসের দেয়ালে কিছু লেখা-আঁকার নিয়ম নেই। তারপরও যখন দেয়ালগুলো এভাবে দৃষ্টিকটু বানিয়ে ফেলা হচ্ছে, ভাবলাম কিছু তো একটা করা দরকার—যেগুলো অন্তত চিকা মারা, পোস্টার সাঁটানো, কিংবা স্প্রে রং দিয়ে ব্যাচের নাম লিখে দেয়াল নোংরা করার চেয়ে ভালো!

আমি চারুকলার শিক্ষার্থী। তাই ভাবলাম, লাল দেয়ালে ছবি আঁকলে তো মন্দ হয় না! এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে দু-চারটা ছবি অবশ্য এঁকেছিলাম আমরা। কিন্তু সেগুলোর পরিমাণ খুব বেশি নয়।

S1n753P.jpg


এক যাত্রীছাউনিতে ঢুকে পড়েছে আস্ত ছায়াপথ! ছবি: সংগৃহীত

অতএব আর অন্য কোনো চিন্তা না করেই শুরু করলাম দেয়াল রাঙানোর কাজ। সঙ্গে জুটে গেল আমার বিভাগেরই জুনিয়র অপর্ণ অধিকারি। প্রথম ছবিটা আঁকলাম ক্যাম্পাসের চৌরঙ্গীর যাত্রীছাউনিতে। সেটা আঁকা হলো সম্পূর্ণ নিজের পকেটের খরচ থেকে পয়সা বাঁচিয়ে রং কিনে। এরপর আরও কয়েকটা আঁকলাম নিজেদের পকেট থেকে খরচ করে। কিন্তু এভাবে তো আর বেশি দিন সম্ভব নয়। তাই কয়েকটা ছবি আঁকার পর রং কিংবা অর্থ সংকটে কাজ বন্ধ হয়ে গেল।

বাইরে থেকে কোনো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সহায়তা (স্পনসর) নিলে রঙের জোগান হয়ে যেত নিমেষেই। কিন্তু শুরু থেকেই আমি গোঁ ধরে বসে থাকলাম, নিজেদের দেয়াল রাঙানোর জন্য বাইরে থেকে কোনো রকম স্পনসর নেব না। পারলে নিজেরাই করব, নইলে না।

আমাদের দেয়াল রাঙানোর এই উদ্যোগটা ক্যাম্পাসের প্রায় সবাই-ই খুব সুন্দরভাবে নিয়েছিল। তার ফলাফলটা দেয়ালগুলোর জন্য কল্যাণকর হলো। বিশ্ববিদ্যালয়েরই কিছু বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী স্বেচ্ছায় দেয়াল রাঙানোর জন্য রং কিনে দিতে রাজি হয়ে গেলেন।

JWblcsW.jpg


অ্যানিমেশন ছবির জন্যও বরাদ্দ ছিল কিছু দেয়াল। ছবি: সংগৃহীত

আমরা আবার একটা একটা করে রঙিন করতে শুরু করলাম দেয়াল। ছবি আঁকার দলেও লোক বাড়তে শুরু করল। চারুকলার আবির আর্য, থিন জো মং, বিপিন চাকমা, ফারজাদ দিহান, জাকিয়া রহমান ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ও অন্যান্য বিভাগের অনেকেই দেয়াল রাঙানোর এই কাজে জুটে গেল স্বেচ্ছায়।

প্রথম দু-চারটা দেয়ালে আঁকার পর ভাবলাম কিছু একটা থিম ধরে এগোনো দরকার। সেই ভাবনা থেকে একটা যাত্রীছাউনিতে ছবি আঁকলাম আমাদের লোকজ নকশার আদলে। আরেকটা যাত্রীছাউনির থিম হয়ে গেল পুরো ছায়াপথ!

একটা যাত্রীছাউনির থিম ঠিক করলাম ‘বাংলা সাহিত্য’। বাংলা সাহিত্যের ভালোবাসার তিন দাদা 'ঘনাদা' 'টেনিদা' আর 'ফেলুদা'র জন্য জায়গা করে দিলাম যাত্রীছাউনির দেয়ালের সবচেয়ে বড় অংশটায়।

C5HIWA2.jpg


ফেলুদা, ঘনাদা আর টেনিদা...ছবি: সংগৃহীত

CEG2p9w.jpg


ছাত্র–শিক্ষকের পাশাপাশি দর্শনার্থীদেরও মুগ্ধ করে এসব ছবি, ছবি: সংগৃহীত

ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের ভেতরের একপাশটা রাখলাম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রের জন্য। আইরিশ সিনেমা 'সং অব দ্য সী' এবং জাপানি সিনেমা ‘মাই নেইবর তোতোরো'কে অবলম্বন করে এঁকে ফেললাম দেয়ালচিত্র। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে যে ছবি দুটো দেশ ছাড়িয়ে বাইরেও বেশ প্রশংসিত হয়ে গেল।

এ ছাড়া আমাদের রঙের ছোঁয়ায় জাকসু ভবনের ভেতরের পুরোটা হয়ে গেল ঝলমলে।

হুমায়ুন ফরিদী, এটিএম শামসুজ্জামানের প্রতিকৃতি আঁকার মাধ্যমে বাংলা চলচিত্রকেও জুড়ে দিলাম আমাদের এই দেয়াল রাঙানোর কার্যক্রমে। বাংলা চলচিত্র নিয়ে আরও আঁকার ইচ্ছে অবশ্য আছে পরবর্তীতে। মহীনের ঘোড়াগুলি এবং আজম খানকে উৎসর্গ করে আগেই আঁকা হয়েছিল তিনটি দেয়ালচিত্র। বাংলা গান নিয়ে সামনে আরও কাজ করার ইচ্ছে আছে আমাদের।

এ ছাড়া সারা ক্যাম্পাস জুড়ে গাছ এবং দেয়ালে আরও অসংখ্য ছবি এঁকেছি আমরা, যা চোখে শান্তি দিয়েছে সবারই। প্রথম দিকে অনিয়মিতভাবে একটা-দুটো করে আঁকা হলেও এখন নিয়মিতই দেয়াল রাঙানোর কাজটা করতে পারছি। যদিও করোনা-লকডাউন মিলে কিছুটা থমকে গেছি। সামনে আরও অসংখ্য ছবি আঁকার পরিকল্পনা আছে।

IlOsoEM.jpg


আঁকা হচ্ছে এটিএম শামসুজ্জামানের প্রতিকৃতি, ছবি: সংগৃহীত

gkngReJ.jpg


দেয়ালের শুধু কান নয়, পাখাও আছে! ছবি: সংগৃহীত

এ পর্যন্ত আমরা চল্লিশটার বেশি দেয়ালচিত্র এঁকেছি ক্যাম্পাসের দেয়ালে। তার মধ্যে কিছু মুছে দেওয়া হয়েছে। দু-একটা নষ্টও যে হয়নি তাও নয়। তবে আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো চোখের শান্তি। নোংরা দেয়ালগুলো রাতারাতি রঙিন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার পাশাপাশি বাইরে থেকে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের চোখেও যে মুগ্ধতা দেখেছি, সেটাই আনন্দের।

দেয়ালে ছবি আঁকাট আমার কাছে ছোটখাটো একটা উৎসবের মতো হয়ে গেছে। রাতভর আঁকার মাধ্যমে সে উৎসব পালন করি—কখনো মশার কামড় খেয়ে, কখনোবা আলোর অভাবে ঝরা পাতা জোগাড় করে তাতে আগুন জ্বালিয়ে। আঁকাআঁকির এই রাতগুলোতে কখনো ভেসে আসে ডাহুক, প্যাঁচা আর অতিথি পাখির কলরব। পরক্ষণেই হয়তো আশপাশের কোনো ঝোপ থেকে রব তুলে শোরগোল করে ক্যাম্পাসে ঘর বাধা শেয়ালের পাল। আঁকতে আঁকতে এই অসম্ভব সুন্দর মুহূর্তগুলো আমরা যেভাবে যাপন করে আসছি, সেটার তুলনা আসলে অন্য কিছুতে হয় না।

আমার ইচ্ছে, ছোট পরিসরে শুরু করা আমাদের এই দেয়াল রাঙানোর কাজটা ছড়িয়ে পড়ুক সারা দেশে। আশপাশের বিবর্ণ দেয়ালগুলো ফুঁড়ে বেরিয়ে আসুক রঙিন সব স্বপ্নিল ছবির দল। সারাক্ষণ ধ্বংসের ছাই দেখা চোখেরা চলতে ফিরতে দেখুক দেয়াল ভরা রঙিন সুখবাস্তব।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top