পৃথিবীর সবকিছুরই দুটি দিক রয়েছে। কিছু কিছু দিক পূর্বনির্ধারিত যেমন আলো-অন্ধকার, ছেলে-মেয়ে, জীবন-মরণ ইত্যাদি। আবার কিছু কিছু দিক যেমন ভালো-মন্দ, হাসি-কান্না এগুলো পূর্বনির্ধারিত না, তবে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার (action-reaction) ফল। পূর্বনির্ধারিত দিকগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এবং সেগুলো মেনে নিয়েই চলতে হয়। তবে আমি ভালো না মন্দ হতে চাই এটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত চয়েজ। অবশ্য এখানে পারিপার্শ্বিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এখন যদি জীবনে মন্দ পারিপার্শ্বিকতা প্রভাব বিস্তার করে তবে ভালো হতে চাইলেও সেটা সম্ভব হয় না। এখন এ ধরনের পারিপার্শ্বিকতা থেকে দূরে থাকা বা একে নিয়ন্ত্রণে রাখতে দরকার হয় বিবেকের। কিন্তু বিবেকের যখন অধঃপতন হয় তখন বিবেক ভালোকে ছেড়ে মন্দের দিকটাই বেছে নেয়। তারপর সবাই সারাক্ষণ মন্দকে গালিগালাজ করি, যার ফলে সে আর কখনো ভালো হওয়ার চেষ্টা করে না। মন্দকে মন্দ বলতে বলতে সে সত্যিই মন্দ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে প্রায়ই বলা হয় ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’। ঠিক গোটা বিশ্বের যা কিছু আমাদের মনঃপূত নয় তার সবকিছুর জন্য দায়ী হচ্ছে মন্দ। দুঃখের বিষয়, জিনিসপত্র যদি কিছু নষ্ট হয় তা যেমন ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া সম্ভব নৈতিকতার অবক্ষয় হলে তাকে বর্জন করা বা ফেলে দেওয়া ভীষণ কঠিন হয়ে পড়ে। যার ফলে ভালো-মন্দ পাশাপাশি আমাদের মধ্যে অবস্থান করতে থাকে। জীবনের গতিতে দিকনির্দেশনায় বা সিদ্ধান্তে ভুল হলেই সেটা মন্দের খাতায় গিয়ে জমা হয়। সবাই তো সুখী হতে চায়, সবাই তো ভালো হতে চায়, তারপরও কেউ সেটা হয়, কেউ হয় না।
এই হতে চাওয়াটাকে পাওয়ায় পরিণত করা জীবনের একটি বড় চ্যালেঞ্জ, এ চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার নাম জীবন। যদি ভূপেন হাজারিকার মতো ‘আজ জীবন খুঁজে পাবি ছুটে ছুটে আয়’ গানের সুরে সহজ করে সেই জীবনটা খুঁজে পেতাম তাহলে সব লেঠাই চুকে যেত। কিন্তু না, তার শেষ শুধু সেদিনই হবে যেদিন সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। তার আগপর্যন্ত চলতে থাকবে সবকিছু তার নিজস্ব গতিতে।
এতক্ষণে যা বলতে চেয়েছি, এবার তার ওপর একটি কেস স্টাডি করি। করোনার কারণে গোটা বিশ্ব লকডাউন করা হলো। প্রযুক্তির লকডাউন হয়নি বরং সেখানে সব ধরনের চাহিদাভিত্তিক জিনিসপত্র এনে গুদামজাত করা হয়েছে। এমন কোনো বিনোদন গুগলে নেই, যা ছোট-বড় সবাই পছন্দ করে না, তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সমাজব্যবস্থা এমনিতেই প্রথম থেকে ভালো না, বিবেকের অধঃপতন ঘটেছে লকডাউনের আগেই। লকডাউনে সবাই ঘরে বসে কী করবে? শেষে শুরু হলো গুগল সার্চ, কী চাই, যা দরকার সবই আছে। প্রাপ্ত, অপ্রাপ্তবয়স্ক, তরুণ প্রজন্মের হাতে বইয়ের পরিবর্তে রয়েছে স্মার্টফোন, ঘরে বসেই শুরু হলো ভালো-মন্দের বিনোদনমূলক খেলা। যার ফলে বর্তমান এবং আগামীর দিনগুলো ভয়ংকর হয়ে উঠতে শুরু করেছে।
প্রায় দুই বছর ধরে চলছে তুমুল লড়াই। হার–জিতের লড়াই, কে হারে আর কে জেতে। এ প্রসঙ্গে নানাজনের নানা মত রয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের কিছু অভিভাবকের মতামত তুলে ধরছি এখানে।
অনেকে বলছেন মুঠোফোনে ফ্রি ফায়ার ও পাবজি গেমস খেলা বন্ধ করতে। কেউ বলছেন নিজ নিজ পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকা শিশু–কিশোরদের সচেতন করতে।
কেউ বলছেন আমরা তাদের হাতে বই তুলে দিই, সুস্থ বিনোদনের সুব্যবস্থা করি, খেলাধুলার প্রতি আকৃষ্ট করি ইত্যাদি।
কেউ প্রশ্ন রেখে বলছেন পাবজি এবং ফ্রি ফায়ার বন্ধ করে কোনো সুফল আসবে কি? যেসব বাবা-মা বাচ্চাদের কন্ট্রোল করতে পারে না তাদের ছেলেমেয়ে পাবজি বন্ধ হলে অন্য কিছুতে আকৃষ্ট হবে৷
গেম বিনোদনের একটা অংশ, অন্যান্য দেশে যেটার অনেক ভ্যালু আছে। কেউ বলছেন অন্তত পাবজি খেলে টিকটকের মতো গ্রুপিং করে কেউ মেয়েদের হয়রানি করবে না। বন্ধ করতে হলে দ্রুত টিকটক ও লাইকি বন্ধ করা উচিত।
কেউ বলছেন কথাগুলো হয়তো বাস্তব। তবে ফ্রি ফায়ার ও পাবজি গেমের ভেতর অনেকটা পার্থক্য আছে। ফ্রি ফায়ারের ডাউনলোড সারা বিশ্বে ৫০০ মিলিয়ন প্লাস আর পাবজি ১০০ মিলিয়ন প্লাস। আর ৮০ শতাংশের বেশি পাবজি খেলোয়াড়দের বয়স ২০–এর বেশি। তারপর পাবজি খুব ব্যয়বহুল গেম, তাই বাচ্চারা এটা খেলে না। শুরু করলেও অল্প দিনে শেষ করে ফেলে ইত্যাদি।
কারও মতে, সন্তানদের মা–বাবার যথেষ্ট আহ্লাদ দেওয়া এর পেছনে দায়ী। হেসে হেসে বলে যে নিষেধ করলেও শোনে না। কিন্তু তাদের কি এটা ভেবে খারাপ লাগে না যে তারা অভিভাবক হিসেবে ব্যর্থ? বাচ্চাদের হাত পর্যন্ত ফোন কেন যাবে? অনেকে এটাও বলছেন বাচ্চাদের মারা নাকি ঠিক না, কিন্তু না মারলেও এরা পেয়ে বসে। ‘আব্বু একটা কথা বলে মাইরের ওপরে কোনো ওষুধ নাই’ আসলেই তাই। গেম বানানো হয় বিনোদনের জন্য। আর আমরা তাকে জীবনের সর্বপ্রধান অঙ্গ হিসেবে বানিয়ে ফেলেছি।
ছোটবেলায় যেটা নিয়ে একটু বেশি সময় নষ্ট করেছি, আব্বু সেটাই ভেঙে ফেলছে। টর্চলাইট, আয়না এমন কত কিছু। বাটন মোবাইলে সাপের গেম ছিল, তা–ও খেলতে দিতেন না। আজও ফোন চালানো নিয়ে কত বাধানিষেধ দেওয়া হয়!
কারও মতে, এখনকার মা–বাবাও মডার্ন হয়েছে। বাচ্চারা বিরক্ত করলেই মুঠোফোন দিয়ে শান্ত করে। ঠিকমতো খায় না বলে ফোন দিয়ে খাওয়াতে হয়। না খেলে না খাবে, ক্ষুধা যখন খুব লাগবে ফোনও লাগবে না, নিজেই খাবে।
কারও মতে বাবা–মা একটু কঠোর না হলে এসব বন্ধ করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।
আর যেসব বাচ্চা গেম খেলাকে কেন্দ্র করে মারা যায়, তাদের আসলে বাঁচাই উচিত না। বেঁচে থাকলে বাবা-মাকে আরও কত যে পীড়া দেবে তার ঠিক নেই।
অনেকে বলছেন, নেই পরিবেশ, নেই মাঠ, বাচ্চাদের বাবা–মায়েরা অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মিশতে দেয় না, কারণ নেই নিরাপত্তা, পড়ার মধ্যে নেই কোনো মজা, শিক্ষকেরা শুধু শিট ধরিয়ে দেয় হাতে, পড়াকে কঠিন করে তুলে ধরা হচ্ছে বিদ্যালয় থেকে। এটা পড়ো, ওটা পড়ো, এ প্লাস পেতে হবে। না বুঝে মুখস্থ। সময় নেই তাদের ঘুরতে যাওয়ার। বিকেলে কোচিং, কিংবা বাসায় স্যার। কী করবে ওরা, সুযোগ পেলেই মোবাইল, এই মোবাইল হলো বড় ছোট সবার বন্ধু, কিংবা টাইম পাস করার মেশিন, কখনোবা মন ভালো করার বাক্স। আমি ভাই আমার মেয়ে নিয়ে নিরুপায় হয়ে পড়েছি।
একজন বললেন, এই ফোনের অপব্যবহার আজ মানুষের ঘর ভাঙছে, মানুষকে ঘরছাড়া করে দুর্দশায় পতিত করছে, লেখাপড়ার বারোটা বাজাচ্ছে, মানুষকে কর্মবিমুখতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সর্বোপরি মানুষের চরিত্রের ওপরও আঘাত হানছে ইত্যাদি।
এতক্ষণ বাংলাদেশের অভিভাবকদের কথা হলো, আমি থাকি পাশ্চাতে সেখানকার কী অবস্থা? এমনটি প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। অভিভাবকদের চিন্তাভাবনায় বেশ মিল রয়েছে। মারধর করা বা বকাঝকা দেওয়া এমনকি অভিভাবকেরা নিজেরা কিছুটা দায়ী বা সরকারের দোষ, এমন করে এখানে ঘটনার আলোচনা হয় না। তবে এরা চেষ্টা করছে কীভাবে সবকিছু ম্যানেজ করা সম্ভব। এখানে কোনো কিছুতেই তেমন বাধা নেই। দেখা যাচ্ছে পরীক্ষার ফলাফল মনঃপূত হয়নি, তা সত্ত্বেও আকাশ ভেঙে মাথায় পড়ছে না। সব সময় একটু মিউচুয়াল কমিউনিকেশন কাজ করছে। এক বন্ধুর মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম কলেজ শেষে কী করবে? উত্তরে বলল, আমার সামনে সারা জীবন পড়ে আছে, তাড়াহুড়োর কোনো ব্যাপার নেই।
এখানকার সমাজব্যবস্থা থেকে শুরু করে দেশের সর্বাঙ্গীণ পরিকাঠামো এত উন্নত যে কেউ কারও ওপর চেপে বসে নেই। যার ফলে সবকিছু যেভাবে ম্যানেজ হচ্ছে ঠিক সেভাবে বাংলাদেশে হচ্ছে না, হওয়ার কথাও নয়। সে ক্ষেত্রে অভিভাবকের ওপরই সন্তানের পুরো দায়িত্ব। এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে অনেকেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় দেশের পরিবেশ, অবকাঠামোর উন্নতিতে সরকারকে সঠিক, দ্রুত এবং সুপরিকল্পিতভাবে এগোতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা থেকে শুরু করে সেই মোতাবেক কাজ করতে হবে। কারণ, কোনো একসময় অভিভাবকের দায়িত্ব সরকারের তথা দেশের ঘাড়ে পড়বে।
এখন যদি বিশ্বের ধনী দেশগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হয় তাহলে অ্যাডজাস্ট করে চলা শিখতে হবে। কারণ, পরিবর্তনের যুগে কোনো কিছু থামিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। বিবেকের সচেতনতাকে প্রসারিত করতে হবে, শুধু নিজের নয় অন্যের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে, যদি সৃজনশীল সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে হয়।
আমরা সবকিছুরই সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি, যা কিছু পৃথিবীর ধনী দেশের মানুষ তৈরি করছে। এখন সেই ব্যবহারটাই যদি সঠিকভাবে না শিখতে পারি, সেটা হবে জাতি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতা।
ইদানীং একটি বিষয় লক্ষণীয়, বলা হচ্ছে ইহুদিরা স্মার্ট, বহুবার বহু বিষয়ে নোবেল পুরস্কার পেয়েছে, যা অন্য কোনো জাতি পায়নি। সবই ঠিক আছে, আমার প্রশ্ন এত কিছুর পরও জাতি হিসেবে ইসরায়েলের ইহুদিরা কি নিজেদের উন্নত করতে পেরেছে? না পারেনি। যদি পারত তাহলে তারা তাদের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী ফিলিস্তিনিদের সুখ-দুঃখের কথা ভাবত। তাদের নিশ্চিহ্ন করার কথা ভাবত না। প্রতিবেশীর দুঃখের কারণ হওয়া কোনো ব্যক্তি, পরিবার বা জাতিকে আমি উন্নত বলব না, সমৃদ্ধ বলব না। প্রতিবেশীকে বাদ দিয়ে হাজারটা নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির ওপরও ভালো থাকা নির্ভর করে না। এ থেকে আমি এটাই বোঝাতে চাচ্ছি, ভালো থাকা বা মন্দ থাকার বিষয়টি অনেকখানি পারিপার্শ্বিকতার ওপর নির্ভর করে। অর্থাৎ ভালো থাকতে হলে অবশ্যই পারিপার্শ্বিকতাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
বাংলাদেশ কারও ব্যক্তি বা পরিবারের নয়, এটা ১৭ কোটি মানুষের দেশ। সবাই যাতে ভালো থাকে, সেই ব্যবস্থা করতে পারলে মন্দ দেশ ছেড়ে পালাবে, নইলে যেমন চলছে ঠিক সেইভাবেই চলতে থাকবে। এখনকার অভিভাবকদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, শুধু সরকারকে দায়ী না করে বরং বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটান। বাচ্চারা কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে, মুঠোফোনে কী করছে তার দিকে কড়া নজর রাখেন। সবাই মিলে সুস্থ পরিবেশ গড়ে তোলার মন্ত্রে এগিয়ে আসুন। বাচ্চাগুলোকে একরকম ‘পোলট্রি ফার্মে’র মতো ঘরবন্দী না রেখে তাদের সামাজিক মূল্যবোধ চর্চা, সৃজনশীল পরিবার গঠন, স্বার্থপরতা বর্জন এবং নৈতিকতা কী, সে বিষয়ে শিক্ষা দিন। জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমরা আমাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হতে পারি, গড়ে তুলতে পারি উন্নততর ভবিষ্যৎ। চলুন, সবাই মিলে বাচ্চাদের জন্য বাসযোগ্য সুন্দর পরিবেশ গড়ি। বাচ্চাগুলোর মানসিক গঠনে সাহায্য করি। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের কথা না ভেবে পরিবার, সমাজ তথা দেশের জন্য ভাবি। দেশকে ভালোবাসি। জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হলো কল্পনা। কল্পনা থেকেই তৈরি হয় নতুন পণ্যের ধারণা। পাবজি এবং ফ্রি ফায়ার বন্ধ করার কথা না ভেবে বরং প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারি। একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে খেলাধুলা ছাড়া কল্পনার ব্যাপ্তি বা গভীরতা—কোনোটাই বাড়ে না। খেলাধুলা মানুষকে করে তোলে মানবিক আর সহনশীল। জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির এই নতুন বিশ্বে টিকে থাকতে হলে পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে খেলাধুলার অভ্যাসটা বাড়াতে হবে। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চেষ্টা করে গেলে সফলতা আসবেই।
* লেখক: রহমান মৃধা, সুইডেন