পঞ্চদশ শতাব্দীর ইউরোপ। নবজাগরণ বা রেনেসাঁস এর হাওয়া লেগেছে ইউরোপের শিক্ষা সংস্কৃতি সাহিত্য এবং শিল্পে।
এই নবজাগরণের পুরোধা নিঃসন্দেহে বলা যায় ইতালিকে
এবং
এই রেনেসাঁস আন্দোলন এর একজন মূল অন্যতম কারিগর ছিলেন বিখ্যাত শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি।
সারা জীবনে প্রচুর ছবি এঁকেছিলেন লিওনার্দো , তার মধ্যেদুটি ছবি ছিল সবচেয়ে বিখ্যাত 'মোনালিসা' অ্যান্ড 'দ্য লাস্ট সাপার'।
লিওনার্দোর প্রত্যেকটি ছবির পেছনে আছে অনেক রহস্য এবং আশ্চর্য ঘটনা। 'মোনালিসা' ছবির পেছনের রহস্যের কথা অনেকেরই জানা।
কিন্তু,
'দ্য লাস্ট সাপার' ছবির পেছনে লুকিয়ে আছে যে আশ্চর্য ঘটনা তা লিপিবদ্ধ করব আজ এখানে।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে রাজা ফ্রান্সিস লিওনার্দো দা ভিঞ্চিকে অনুরোধ করেন ইতালীর মিলান শহরের সানটা মারিয়া ডেল গির্জার ডাইনিং রুমের দেয়ালে একটি ছবি আঁকার জন্য।
গির্জার দেয়ালের আঁকা ছবি মূলত বাইবেল এবং যীশুর জীবনী ভিত্তিক ঘটনা হয়ে থাকে।
লিওনার্দো স্থির করলেন যেহেতু ডাইনিং রুমের জন্য আঁকা সেহেতু তিনি যিশুখ্রিস্টের শেষ ভোজন বা 'দ্য লাস্ট সাপার 'ছবিটি আঁকবেন।
ছবিটি আঁকার জন্য তিনি ভ্যাটিকানে গেলেন পোপের অনুমতি নিতে।
অনুমতি দিলেন পোপ কিন্তু শর্ত দিলেন ছবিটি শুরু করতে হবে যীশু খ্রীষ্ট কে দিয়ে এবং শেষ করতে হবে জুডাস কে দিয়ে।
জুডাস ছিলেন সেই মানুষ যিনি যিশুখ্রিস্টের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন।কাজ শুরু করলেন লিওনার্দো। লিওনার্দোর ছবির বিশেষত্ব হলো তিনি যখন কোন চরিত্রের ছবি আঁকেন তা কখনোই মন থেকে আঁকেন না তার প্রত্যেকটি চরিত্রের জন্য একটি মডেল এর প্রয়োজন হয়। শুরু হলো যীশু চরিত্র আঁকার জন্য একটি মডেলের খোঁজ । সারা ইটালি জুড়ে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলো, অনেক মডেলকে দেখলেন লিওনার্দো ,কিন্তু কাউকেই তার পছন্দ হলো না। লিওনার্দো চাইছিলেন যীশুর জন্য এমন একটি মডেল যার চোখে মুখে থাকবে একটি স্বর্গীয় দেবত্ব।
অবশেষে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে ১৯ বছরের এক তরুণ বেহালাবাদক কে দেখলেন লিওনার্দো ধবধবে ফর্সা রং ,ঘাড় অব্দি নেমে আসা ব্রাউন চুলের রাশি, নিল রংয়ের চোখে সে ছিল যেন লিওনার্দোর কল্পনার জেসাস। শুরু হলো ছবি আঁকা। জেসাস সমেত মোট 12 টি চরিত্র ছিল 'দ্য লাস্ট সাপার 'ছবিটিতে। জেসাস ,বার্থোলোমিউ, জেমস , অ্যান্ড্রু , জুডাস, পিটার ,জন ,থমাস, জেমস, ফিলিপস এবং জুড।
অন্যান্য চরিত্র গুলির মডেল পেতে সেরকম অসুবিধা হলো না লিওনার্দোর ,এগিয়ে চলল ছবি আঁকার কাজ। এইভাবে কেটে গেল প্রায় তিনটি বছর।
কিন্তু,
মুশকিল হল জুডাস ছবি আঁকার সময় ,কারন এই চরিত্রের মডেল হবার জন্য কেউই রাজি ছিল না আর তাছাড়া লিওনার্দোর চেয়েছিলেন' জুডাস এর জন্য এমন একজন মডেল যার চোখে-মুখে ফুটে বেরোবে ক্রুরতা, হিংস্রতা এবং নারকীয়তা তিনি জানতেন ইটালির জনগণের মধ্যে এই রকম মডেল পাওয়া সম্ভব নয় তাই রাজা ফ্রান্সিসের অনুমতি নিয়ে তিনি খোঁজ করতে লাগলেন ইটালির বিভিন্ন কারাগার এবং কয়েদখানায়।
অনেক মডেল দেখলেন লিওনার্দো কিন্তু কাউকেই তার পছন্দ হলো না। অবশেষে তিনি গেলেন মিলানের এমন এক কয়েদখানায় যেখানে কয়েদ করে রাখা হতো কুখ্যাত অপরাধীদের এরা সকলেই ছিল মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।
এদের বন্দি করে রাখা হতো মাটির নিচের কুঠুরিতে সূর্যের আলো দেখার অনুমতি ছিল না তাদের। কিন্তু লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মত একজন বিখ্যাত শিল্পীর জন্য রাজা অনুমতি দিলেন তাদের সকলকে লিওনার্দোর সামনে নিয়ে আসার জন্য তাদের মধ্যে একজনকে দেখে চমকে উঠলেন লিওনার্দো আরে এইতো তার কল্পনার জুডাস!
লিওনার্দো অনুমতি চাইলেন সেই কয়েদিকে তার ছবির জুডাস বানানোর জন্য।
অনুমতি দিলেন রাজা কিন্তু শর্ত দিলেন যতদিন লিওনার্দো ছবি আঁকবেন ওই কয়েদিকে রাখা হবে একটি কাচের ঘরে বাইরে থেকে লিওনার্দো তাকে দেখে ছবি আঁকবেন
এবং কাচের ঘরের পাশে থাকবে দুজন সশস্ত্র প্রহরী যাতে ওই কুখ্যাত কয়েদি লিওনার্দোর কোন ক্ষতি করতে না পারে কারণ লোকটি ইতিমধ্যেই 17 জন মানুষকে খুন করেছিল।
শুরু হলো ছবি আঁকা এবং তা ক্রমে শেষের পথে এগিয়ে গেল ।কিছুদিন ধরেই লিওনার্দো লক্ষ্য করছিলেন কাচের ঘরের মধ্যে লোকটি তাকে দেখে অঝোরে কাঁদছে।
প্রথমে লিওনার্দোর মনে হয়েছিল হয়তো কয়েদির মনে তার কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা হচ্ছে তাই তিনি ব্যাপারটাকে বিশেষ পাত্তা দেননি ।
একসময় শেষ হয়ে যায় ছবি, পুনরায় লোকটিকে জেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হয় কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লেওনার্দো দেখেন লোকটি পাগলের মত আচরণ করছে
এবং
তার দিকে ইঙ্গিত করে কিছু বলতে চাইছে।
লিওনার্দো বুঝতে পারলেন লোকটি তাকে কিছু বলতে চায়।
রাজার অনুমতিক্রমে লোকটিকে নিয়ে আসা হল লিওনার্দোর সামনে। লোকটি লিওনার্দোর পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে বলল:--
"হে দা ভিঞ্চি তুমি কি আমায় চিনতে পারছো না?"
অবাক হলেন লিওনার্দো তার মত মহান শিল্পী কি করে এক কুখ্যাত অপরাধীকে চিনবেন ?
লোকটি ভেঙে পড়ল কান্নায় ,কাঁদতে কাঁদতে বলল হে ভগবান আমি কি এতই নেমে নিচে নেমে গেছি ?
দা ভিঞ্চি ভালো করে দেখুন আমি হলাম সেই তরুণ বেহালাবাদক যাকে দেখে আজ থেকে তিন বছর আগে আপনি জেসাস এর ছবিটি এঁকেছিলেন!
চমকে উঠলেন লিওনার্দো, কি বলছে লোকটি!
ভালো করে দেখে বুঝতে পারলেন কয়েদিটি সত্যি কথাই বলেছে!
ভগ্নহৃদয়ে ফিরে এলেন লিওনার্দো, তিনি সেদিন উপলব্ধি করলেন:--
বাহ্যিক চেহারা নয় মন ই মানুষকে নিয়ে যেতে পারে স্বর্গ কিংবা নরকে।
তিনি আরো উপলব্ধি করলেন মানুষের মনে একই সাথে পাশাপাশি বাস করে
দেবতা এবং দানব
অর্থাৎ,
লিওনার্দোর বিখ্যাত ছবি 'দ্য লাস্ট সাপারে
'যীশু ও জুডাসের এর মডেল'
এক জন মানুষ!