মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে পাঠিয়েছেন মানবতার উৎকর্ষের পূর্ণতা সাধনের জন্য। তিনি বলেন, ‘আমাকে পাঠানো হয়েছে সুন্দর চরিত্রের পূর্ণতা প্রদানের নিমিত্তে।’ (মুসলিম ও তিরমিজি)। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘(হে মুহাম্মদ) নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।’ (সুরা-৬৮ কলম, আয়াত: ৪)।
ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা শ্রেষ্ঠ মানবিক উত্তম গুণাবলির অন্যতম। পবিত্র কোরআনে স্থানে স্থানে মহান আল্লাহ নিজেকে ধৈর্যশীল ও পরম সহিষ্ণু হিসেবে পরিচয় প্রদান করেছেন। ধৈর্যের আরবি হলো ‘সবর’। সহিষ্ণুতার আরবি হলো ‘হিলম’। সবর ও হিলম শব্দ দুটির মধ্যে কিঞ্চিৎ তাত্ত্বিক তফাত আছে। সাধারণত সবর তথা ধৈর্য হলো অপারগ, অসমর্থ ও অসহায় অবস্থায় অন্যায়ের শিকার হয়ে প্রতিশোধস্পৃহাকে দমন করে রাখা। আর হিলম, অর্থাৎ সহিষ্ণুতা মানে হলো শক্তি-সামর্থ্য থাকার পরও প্রতিশোধ গ্রহণ না করা। সবর বা ধৈর্য অপেক্ষা হিলম তথা সহিষ্ণুতা উন্নততর। তবে এ উভয় শব্দ কখনো কখনো অভিন্ন অর্থে তথা উভয় অর্থে ও একে অন্যের স্থানে ব্যবহৃত হয়। হিলম তথা সহিষ্ণুতা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ তো সম্যক প্রজ্ঞাময়, পরম সহনশীল।’ (সুরা-২২ হজ, আয়াত: ৫৯)। সবর তথা ধৈর্য বিষয়ে হজরত আইয়ুব (আ.) সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি তো তাকে পেলাম ধৈর্যশীল। সে কত উত্তম বান্দা! সে ছিল আমার অভিমুখী।’ (সুরা-৩৮ সদ, আয়াত: ৪৪)। ‘নিশ্চয় ইহাতে তো নিদর্শন রয়েছে প্রত্যেক অতি ধৈর্যশীল ও পরম কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য।’ (সুরা-১৪ ইব্রাহিম, আয়াত: ৫)।
সামাজিক জীব মানুষ কখনো বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করতে পারে না। সমাজবদ্ধভাবে থাকতে গেলে ক্ষমা, দয়া-মায়া ও ভালোবাসা থাকতে হবে। শান্তির সমাজ, স্থিতিশীলতা ও সহাবস্থানের জন্য সহনশীলতা অপরিহার্য
সফলতা, শান্তি ও সহাবস্থানের জন্য প্রয়োজন ধৈর্য। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, ‘মহাকালের শপথ, মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তু তারা নয়, যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়।’ (সুরা-১০৩ আসর, আয়াত: ১-৩)। ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা ধৈর্য ধারণ করো, ধৈর্যের প্রতিযোগিতা করো এবং সুসম্পর্ক স্থাপনে আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামে অবিচল থাকো, আল্লাহকে ভয় করো যাতে তোমরা সফল হতে পারো।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ২০০)। ‘হে মুমিনগণ! ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৫৩)। ‘আমি তোমাদের অবশ্যই পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধনসম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতির দ্বারা। তুমি শুভ সংবাদ দাও ধৈর্যশীলগণকে যারা তাদের ওপর বিপদ আপতিত হলে বলে, “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” (আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী)।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৫৫-১৫৭)।
হজরত ইউনুস (আ.)-কে সামান্য অধৈর্য হওয়ার কারণে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাতের আঁধারে উত্তাল সমুদ্রবক্ষে হিংস্র মৎস্য উদরে যেতে হয়েছিল। এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে উদ্দেশ করে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতএব তুমি ধৈর্য ধারণ করো তোমার প্রতিপালকের নির্দেশের অপেক্ষায়, তুমি মৎস্য-সহচর (ইউনুস)-এর ন্যায় অধৈর্য হয়ো না, সে বিষাদাচ্ছন্ন অবস্থায় কাতর প্রার্থনা করেছিল।’ (সুরা-৬৮ কলম, আয়াত: ৪৮)। ধৈর্যের মূর্ত প্রতীক হজরত আইয়ুব (আ.) আঠারো বছর পর্যন্ত সহিষ্ণুতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে পরম সাফল্য লাভ করেছিলেন।
ধৈর্য তিন প্রকার, যথা ‘সবর আনিল মাসিয়াত’, অর্থাৎ অন্যায় অপরাধ হতে বিরত থাকা। ‘সবর আলাত তআত’, অর্থাৎ ইবাদত আল্লাহর আনুগত্য ও সৎকর্মে কষ্ট স্বীকার করা। ‘সবর আলাল মুসিবাত’, অর্থাৎ বিপদে অধীর না হওয়া। ধৈর্যাবলম্বনকারীর জীবনে পূর্ণতা ও সফলতা অবশ্যম্ভাবী। (তাফসিরে বায়জাবি)।
সামাজিক জীব মানুষ কখনো বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করতে পারে না। সমাজবদ্ধভাবে থাকতে গেলে ক্ষমা, দয়া-মায়া ও ভালোবাসা থাকতে হবে। শান্তির সমাজ, স্থিতিশীলতা ও সহাবস্থানের জন্য সহনশীলতা অপরিহার্য।
ক্ষমার চেয়ে উত্তম প্রতিশোধ আর নেই। যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণ করতে পারে না এবং ক্ষমা করতে পারে না, তার জীবনে সুখ-শান্তি বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে না। তার জীবন জাহান্নামে পরিণত হয়। দুনিয়াতেই সে নরকের অগ্নিতে জ্বলতে থাকে। এই অনল তার অন্তরকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। জীবন অতিষ্ঠ ও অসহনীয় হয়ে যায়। এই অগ্নিবলয়ে সে আমরণ ঘুরপাক খেতে থাকে। কোরআনের ভাষায়, ‘এ হলো আল্লাহর প্রজ্বলিত হুতাশন, যা অন্তরকে গ্রাস করবে; নিশ্চয় তা তাদের বেষ্টন করে রাখবে প্রলম্বিত স্তম্ভসমূহে।’ (সুরা-১০৪ হুমাজা, আয়াত: ৬-৯)। ‘তারা তাদের অপরাধে বিভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়ায়।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত-১৫)।
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম