মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। জ্ঞানের জন্যই মানুষ এই শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে। মানুষ প্রকৃতিরই অংশ। প্রকৃতির নিয়ম উন্মোচন এবং তার গতিবিধি বুঝে তাকে ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ করা মানুষের জ্ঞানের কাজ। এ জন্য আল্লাহ তাআলা মানুষকে জ্ঞান দান করেছেন এবং তা ব্যবহার করে জীবনযাপনে সেটি প্রয়োগের নির্দেশনা দিয়েছেন।
ইসলামি শরিয়ার মৌলিক উদ্দেশ্যাবলি বা মাকাসিদুশ শরিয়াহ হলো পাঁচটি—যথা: জীবন রক্ষা, সম্পদ রক্ষা, জ্ঞান রক্ষা, বংশগতি রক্ষা ও ধর্ম রক্ষা। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘তোমার শরীরেরও হক বা পাওনা রয়েছে তোমার ওপর।’ (মুসলিম ও তিরমিজি)। শরীরের হক হলো স্বাস্থ্যসুরক্ষা, এ জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা।
রাসুলুল্লাহ (সা.) অত্যন্ত স্বাস্থ্যসচেতন ছিলেন। তিনি মানবজাতির জন্য সর্বকালের সর্বোত্তম আদর্শ। স্বাস্থ্যসুরক্ষার অন্যতম প্রধান অবলম্বন হলো পবিত্রতা এবং পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা। ইবাদতগুলোর মধ্যে প্রধান ইবাদত হলো সালাত বা নামাজ। নামাজের জন্য পবিত্রতা প্রথম এবং প্রধান শর্ত।
কপাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ ও পাঁচ ওয়াক্ত নফল নামাজ আদায় করতে হলে ১০ বার অজু করা হয়। এ ছাড়া খাওয়ার আগে–পরে এবং ঘুমের আগে–পরে অজু করে আমরা পবিত্র হই। ঘর থেকে বের হওয়ার আগে ও ঘরে ফেরার পরও অজু করা সুন্নত। আমাদের নামাজের জন্য আমরা মসজিদগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বা পরিপাটি রাখি।
যেহেতু সুন্নত নামাজ ঘরে আদায় করা সুন্নত, তাই আমাদের ঘরদোরও আমরা পরিষ্কার ও পবিত্র রাখি; সর্বোপরি পুরো দুনিয়াটা আখেরি নবীর উম্মতের জন্য বৃহৎ মসজিদরূপে পরিগণিত, তাই আমরা আমাদের আঙিনা, আশপাশ ও পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখি।
স্বাস্থ্য আল্লাহর এক অশেষ দান ও অনুগ্রহ। মানুষকে সুস্থ থাকতে হলে তাকে অবশ্যই শরীর ও স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। সব সময় নিয়মিতভাবে শরীর ও স্বাস্থ্যের পরিচর্যা করতে হবে। ইচ্ছাকৃতভাবে বা উদাসীনতা ও অবহেলার কারণে অসুস্থ হলে অবশ্যই তাকে কিয়ামতের দিন এ জন্য শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। তা ছাড়া অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা গ্রহণের চেয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে সুস্থ থাকাকে ইসলাম অধিক উৎসাহিত করেছে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন বান্দাকে নিয়ামত সম্পর্কে প্রথম যে প্রশ্নটি করা হবে, সেটা হলো তার সুস্থতাবিষয়ক। তাকে বলা হবে, আমি কি তোমাকে শারীরিক সুস্থতা দিইনি?’ (তিরমিজি)।
প্রত্যেক মোমিনের কর্তব্য হলো, সর্বদা শরীর ও স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতন ও সতর্ক থাকা। একজন মোমিন প্রথমত খেয়াল রাখবেন, তিনি যেন শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে না পড়েন এবং কখনো অসুস্থ হলে দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করবেন। এ বিষয়ে কোনো অলসতা বা শৈথিল্য প্রদর্শন করা যাবে না। নবী করিম (সা.) সাহাবিদের দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণে উৎসাহিত করেছেন এবং তিনি নিজে অসুস্থ হলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন। প্রিয় নবীজি (সা.) বলেন, ‘হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ করো, কেননা মহান আল্লাহ এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি, যার প্রতিষেধক তিনি সৃষ্টি করেননি। তবে একটি রোগ আছে, যার কোনো প্রতিষেধক নেই, তা হলো বার্ধক্য।’ (আবু দাউদ)। অসুস্থ হলে চিকিৎসা গ্রহণ করা ইবাদত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা রোগ দেন, রোগের প্রতিষেধকও নাজিল করেন। প্রতিটি রোগের চিকিৎসা রয়েছে।’ (জাদুল মাআদ)।
আল্লাহর রহমতে ইতিমধ্যে কোভিড-১৯–এর ভ্যাকসিন বা টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। বিশ্বের আলেম–উলামারা এই টিকা গ্রহণে সম্মতি ও উৎসাহব্যঞ্জক পরামর্শ দিয়েছেন। পবিত্র রমজান মাসে দিনের বেলায় রোজা অবস্থায় টিকা নেওয়া যাবে কি না, সেই প্রশ্ন অনেকের মনে রয়েছে। এ বিষয়ে সংশয় ও সন্দেহ দূর করে বিশ্বের বরেণ্য উলামায়ে কিরাম এবং ওআইসির ফিকাহ একাডেমি জানিয়েছে, রমজান মাসে দিনের বেলায় রোজা অবস্থায় টিকা বা ভ্যাকসিন গ্রহণ করলে রোজাদারের রোজার কোনো প্রকার ক্ষতি হবে না। বাংলাদেশ সরকারের ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গবেষক আলেমরাও অনুরূপ সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন।
আসুন, আমরা নিজেদের স্বার্থে, পরিবারের স্বার্থে, দেশ-জাতি ও জনগণের স্বার্থে ইবাদত ও কর্তব্য হিসেবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি। অপ্রয়োজনীয় জনসমাগম এড়িয়ে চলি, প্রয়োজনে বাইরে গেলে মাস্ক ব্যবহার করি এবং ঘরে ফিরলে হাত ধোয়া ও অজুর সুন্নত আমল করি।
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী | যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম