সব প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য। তিনি অতি পবিত্র, সব ধরনের দোষত্রুটিমুক্ত। মানুষের মধ্যে ভালো ও মন্দের উভয় সম্ভাবনা বিদ্যমান। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘শপথ মানুষের এবং তাঁর, যিনি তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অতঃপর তাকে সৎ কর্ম ও অসৎ কর্মের জ্ঞান দান করেছেন। সে-ই সফল হবে, যে নিজেকে পবিত্র করবে। আর সে-ই ব্যর্থ হবে, যে নিজেকে কলুষিত করবে।’ (সুরা-৯১ শামস, আয়াত: ৭-১০)।
গুণের প্রশংসা ও দোষের সমালোচনা স্বাভাবিক একটি বিষয়। ইসলাম মানুষের প্রশংসা বা সমালোচনা উভয় ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষার নির্দেশনা দিয়েছে। যেকোনো সময়, স্থান, বস্তু বা ব্যক্তির সঠিক প্রশংসা করা হলে তা বাস্তবে আল্লাহ তাআলারই প্রশংসা হয়। কারণ, এসবেরই স্রষ্টা তিনি। (তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন)।
গুণীর গুণের প্রশংসা করা সততা ও নৈতিকতার দাবি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিজেই অনেকের প্রশংসা করেছেন। ইয়াহইয়া (আ.)-এর ব্যাপারে বলেছেন, ‘সে হবে আল্লাহর বাণীর সমর্থক, নেতা, সংসারবিবাগি এবং অন্যতম পুণ্যবান নবী।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ৩৯)। রাসুলুল্লাহ (সা.)-ও সাহাবিগণের প্রশংসা করেছেন। হজরত উমর (রা.) সম্পর্কে বলেছেন, ‘তুমি যে পথে চলো শয়তান কখনো সে পথে চলে না, বরং সে তোমার পথ ছেড়ে অন্য পথে চলে।’ (বুখারি, হাদিস: ৩২৯৪)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মানুষের মধ্যে ভালো লোক আবু বকর, ভালো লোক উমর, ভালো লোক আবু উবাইদা, ভালো লোক উসআদ ইবনে উজাইর, ভালো লোক সাবিত ইবনু কায়স, ভালো লোক আমর ইবনুল জামুহ ও ভালো লোক মুআজ ইবনু জাবাল!’ (আদাবুল মুফরাদ)।
প্রশংসায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যারা মানুষের কৃতজ্ঞতা আদায় করে না, সে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করতে পারে না।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ২১৩৩১)। প্রশংসায় ভালো কাজে উৎসাহিত করা হয়। নবীজি (সা.) বলেছিলেন, ‘আবদুল্লাহ কতই না উত্তম ব্যক্তি যদি সে তাহাজ্জুদ আদায় করত।’ (বুখারি, হাদিস: ১১৫৬)। প্রশংসায় অধিকার লাভ করা যায়। হজরত শোয়াইব (আ.)-এর কন্যা মুসা (আ.) সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘হে পিতা! আপনি একে কর্মে নিযুক্ত করুন। কেননা আপনার কর্মী হিসেবে উত্তম হবে সেই ব্যক্তি, যে শক্তিশালী, বিশ্বস্ত।’ (সুরা-২৮ কাসাস, আয়াত: ২৬)।
আত্মপ্রশংসা দোষের। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতএব তোমরা আত্মপ্রশংসা কোরো না, তিনিই সম্যক জানেন কে আল্লাহভীরু।’ (সুরা-৫৩ নাজম, আয়াত: ৩২)। অপরাধী, পাপাচারী ও অসৎ লোকের প্রশংসা করা নিষিদ্ধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা মুনাফিককে “আমাদের নেতা” বলে সম্বোধন কোরো না। কেননা, সে যদি নেতা হয়, তবে তোমরা তোমাদের মহামহিম আল্লাহকে ক্রোধান্বিত করলে।’ (আবুদাউদ, হাদিস: ৪৯৭৭)। প্রশংসাপ্রত্যাশীদের প্রশংসা থেকে বিরত থাকতে হবে। পবিত্র কোরআনে এদের নিন্দা করে বলা হয়েছে, ‘যারা নিজেরা যা করেছে, তাতে আনন্দ প্রকাশ করে এবং যা নিজেরা করেনি এমন কাজের জন্য প্রশংসিত হতে ভালোবাসে, “তারা শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে” তুমি কখনো এমন মনে কোরো না। তাদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি রয়েছে।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ১৮৮)।
প্রশংসার মুখোমুখি হলে করণীয় হলো নিজের গোপন ত্রুটির জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া। সাহাবিগণের প্রশংসা করা হলে তাঁরা বলতেন, ‘হে আল্লাহ! তারা যা জানে না, সে বিষয়ে আমাকে ক্ষমা করুন, তারা যা বলেছে সে ব্যাপারে আমাকে পাকড়াও করবেন না এবং তারা যেমন ধারণা করে, আমাকে তার চেয়ে উত্তম বানিয়ে দিন।’ (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস: ৭৬১)।
কখনো কখনো অতি প্রশংসা তোষামোদে পরিণত হয়। কেউ সুবিধা আদায়ের জন্য, কেউ পরিস্থিতির শিকার হয়ে কিংবা অসুবিধায় পড়ে অযাচিত প্রশংসায় লিপ্ত হয়। একদিকে চলে পেছনে পেছনে চরম পরচর্চা, অন্যদিকে চলে মুখোমুখি অতি প্রশংসা। পরচর্চা ও অতি প্রশংসা মানুষের ব্যক্তিত্বকে ক্ষুণ্ন করে, সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। ইসলাম এমন বাড়াবাড়িমূলক কাজকে খুবই নিন্দনীয় ও হারাম ঘোষণা করেছে।
পরচর্চা বা সমালোচনা শিষ্টাচারবিরোধী এবং অসামাজিক কার্যকলাপের অন্তর্ভুক্ত। (সুরা-১০৪ হুমাজা, আয়াত: ১০৯)। কারও সমালোচনা করা একটি ভয়ংকর অপরাধ ও কবিরা গুনাহ। পবিত্র কোরআনে গিবত করাকে আপন মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। (সুরা-৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১২)। হাদিসের কিতাবগুলোতে গিবত ও সমালোচনার ভয়াবহতা ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে।
সমালোচনা করার প্রথম ও প্রধান এবং উত্তম বিষয় হলো আত্মসমালোচনা করা। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সে–ই সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান, যে নিজের সমালোচনা করে।’ (আবুদাউদ)।
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম