রমজান মাস বিশেষভাবে ইবাদত–বন্দেগি করার মাস। বছরজুড়ে সৎ ও সংযমী জীবনযাপনের প্রশিক্ষণের মাস এটি। স্বাভাবিক অবস্থায় হালাল, এমন কয়েকটি জিনিস মুসলমানদের জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত করা এ মাসে হারাম। খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ এবং স্বামী-স্ত্রীর জৈবিক আচরণ বছরের অন্য দিনগুলোতে বৈধ—এমনকি পুণ্যের কাজ। অথচ এসবই রমজান মাসে দিনের বেলা সম্পূর্ণ অবৈধ।
এ মাসের শেষ দশকে ইতিকাফ করা মুসলমানদের জন্য একটি অত্যন্ত পুণ্যের কাজ। ইতিকাফ শব্দের অর্থ হলো অবস্থান করা। ইসলামি পরিভাষায় ইবাদতের নিয়তে রমজানের শেষ দশকে মসজিদে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলা হয়। নিষ্ঠার সঙ্গে ধর্মের বিধিবিধান পালন ও ইবাদত করার জন্য ইতিকাফকারী নিজের ঘর ছেড়ে আল্লাহর ঘরে অবস্থান নেন। একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদত করার জন্য বাইরের সবকিছু থেকে বান্দার এই ‘বিচ্ছিন্ন’ অবস্থান। ইতিকাফের মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে সার্বক্ষণিক পুণ্য অর্জনের চিন্তা কাজ করে। ফলে কোরআন তিলাওয়াত, আল্লাহর স্মরণ ও অন্যান্য ইবাদতের মান এবং পরিমাণ বৃদ্ধি ঘটে। পবিত্র কোরআনের সুরা আল-বাকারার ১৮৭ নম্বর আয়াতে ইতিকাফের উল্লেখ করা হয়েছে। এই ইতিকাফ শারীরিক। ইসলামে এই ইতিকাফের মতো আরও একটি ইবাদত রয়েছে। ধর্মতাত্ত্বিকেরা একে বলেছেন ‘চিন্তার ইতিকাফ’।
চিন্তার ইতিকাফ হলো খোদার সৃষ্টির ব্যাপারে গভীর চিন্তা ও ধ্যানমগ্ন হয়ে তাঁর পরিচয় বা মারিফত লাভ করা। শারীরিক ইতিকাফ কয়েক দিনের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকলেও এই ইতিকাফের বাঁধাধরা কোনো সময় বা স্থান নেই। সারা জীবনই খোদার সৃষ্টিরহস্য নিয়ে চিন্তামগ্ন থাকাই এর কাজ। এই ইতিকাফে ব্যক্তি সারাক্ষণ আল্লাহর সৃষ্টিজগৎ নিয়ে চিন্তাভাবনা করবেন। খোদার কালাম নিয়ে গভীরভাবে ভাবনায় নিবিষ্ট হবেন। চারপাশ থেকে শিক্ষা গ্রহণে সচেষ্ট হবেন। এককথায় আত্মিক ও চিন্তাগত ইতিকাফে মশগুল থাকবেন।
এ ধরনের ইতিকাফের কথা পবিত্র কোরআনে বারবার এসেছে। উদাহরণত সুরা আলে ইমরানের ১৯০ ও ১৯১তম আয়াত দুটি দেখা যাক। আল্লাহ বলেছেন: নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিবস ও রাত্রির পরিবর্তনে নিদর্শনাবলি রয়েছে বোধশক্তিসম্পন্ন লোকের জন্য। যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে ও বলে, ‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি এসব নিরর্থক সৃষ্টি করোনি, তুমি পবিত্র, তুমি আমাদেরকে দোজখের শাস্তি থেকে রক্ষা করো।’ এই আয়াতে স্পষ্টভাবে ‘আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা’ করার কথা বলা হয়েছে।
পবিত্র কোরআনের মতো একাধিক হাদিসেও খোদার সৃষ্টিরহস্য নিয়ে চিন্তাভাবনার কথা বলা হয়েছে। ওপরে উল্লেখ করা আয়াত দুটির ব্যাপারে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যারা এই আয়াতগুলো পড়ে, তাদের উচিত এই নিয়ে চিন্তাভাবনা করা।’ (তাবরানি, আল-মুজামুল কাবির, হাদিস নম্বর: ১২৩২২)
একইভাবে নবীজি (সা.) অন্যত্র (ইবনে হিব্বান, সহিহ, হাদিস নম্বর: ৬২০) বলেছেন, ‘ওয়াইলুন লিমান কারাআ হা-জাল আয়াহ, ছুম্মা লাম এয়াতাফাক্কার ফিহা’ অর্থাৎ সেই ব্যক্তির জন্য অমঙ্গল রয়েছে, যে এই আয়াতগুলো পড়ল অথচ চিন্তাভাবনা করল না।’
এই চিন্তা করা ছিল রাসুল (সা.)–এর একটি বড় গুণ। ইমাম তিরমিজি তাঁর শামাইল গ্রন্থে (হাদিস নম্বর ২১৫) রাসুলের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন এভাবে, ‘রাসুল (সা.) সর্বদা চিন্তা ও ভাবনার মাঝে ডুবে থাকতেন।’ এটাই হলো ‘চিন্তার ইতিকাফ’। নীরবে গভীর ভাবনায় মজে থাকা।
রাসুল (সা.) তাঁর সাহাবিদের এই চিন্তার প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছেন। ফলে দেখা গেছে সাহাবিদের মধ্যে এর ব্যাপক প্রচলন ছিল। সাহাবিরা ভাবনায় ডুবে থাকতেন। এ চিন্তাভাবনা তাঁদের আত্মিক পরিশুদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেত।
নবীজির একজন বিখ্যাত সাহাবি ছিলেন হজরত আবুদ্দারদা আবদুল্লাহ (রা.)। আবুদ্দারদার মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীকে আবুদ্দারদার বিশেষ ইবাদত বা পুণ্যকাজ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি সংক্ষেপে বলেন, ‘আততাফাক্কুর ওয়াল ই’তিবার।’ আরবি তাফাক্কুর শব্দের অর্থ চিন্তা করা, আর ই’তিবার মানে উপদেশ গ্রহণ। অর্থাৎ এই বিখ্যাত সাহাবির দুটি বিশেষ আমল বা কাজ ছিল চিন্তা করা আর উপদেশ গ্রহণ করা।
পবিত্র কোরআনেও ‘তাফাক্কুর’, ‘তাদাব্বুর’, ‘তাজাক্কুর’, ‘তায়াক্কুল’ ইত্যাদি শব্দের মাধ্যমে বারবার চিন্তার গুরুত্বের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। চিন্তার এই পুণ্যময় কাজের গুরুত্ব তাই মুসলমানদের জন্য অনেক বেশি। এ চিন্তার মাধ্যমেই মানুষের মধ্যে সব উৎকৃষ্ট গুণাবলির সমাহার ঘটে। এর মাধ্যমে মানুষ প্রজ্ঞাবান হয়, আল্লাহর মারেফত লাভ করে, ইমান বৃদ্ধি পায়। তাই একজন বিশ্বাসীর জন্য এই চিন্তার ইতিকাফের গুরুত্ব সীমাহীন।