পবিত্র আল-কোরআনে সুরা বাকারায় মুসলমানদের জন্য সাওম ফরজ (২:১৮৩) করার সময় পূর্ববর্তী জাতিগুলোর ওপর সাওম ফরজ হওয়ার ঐতিহাসিক বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। সব ধর্মেই সাওম তথা উপবাসকে আধ্যাত্মিকতার বিশেষ পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার মাধ্যম বলা হয়েছে। ইসলাম ধর্ম পালনে সাওমের গুরুত্ব এবং এর প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমরা ভালোভাবেই অবগত আছি। প্রথম দিকে আহলে কিতাব তথা ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের সাওমের প্রক্রিয়া কেমন ছিল, তা তেমন জানা যায় না। তবে সবারই ধর্ম পালন তথা আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো সাওম। হিব্রু ভাষায় সাওমকে তানিদ বলে। বর্তমানে ইহুদিরা বছরে ৬ (ছয়) দিন তানিদ বা উপবাস পালন করে। তাদের উপবাস ঐতিহাসিকভাবে পূর্বের একেশ্বরবাদী ধর্মের সঙ্গে সংযুক্ত।
তানিদের দিনগুলোতে তারা ‘ওস্টারিসি’ বা কঠিন সাধনা পালন করে। তাদের উপবাসের সময় মোট ২৫ ঘণ্টা। এক সন্ধ্যা থেকে অপর দিনের সন্ধ্যা পর্যন্ত। এ সময় কঠিনভাবে নিষিদ্ধের তালিকায় আছে ঘুম, যেকোনো ধরনের খাবার, পানীয়, জৈবিক কর্ম, গোসল, কাপড় পরিবর্তন, সুগন্ধী ব্যবহার, দাঁত ব্রাশ, যেকোনো ধরনের কর্ম এবং জুতা পরিধান।
এ সময় কেবলই প্রার্থনায় নিয়োজিত থাকতে হবে। তাদের বিশ্বাসে সবচে গুরুত্বপূর্ণ উপবাসের দিন ইয়াওমুল গুফরান বা ইয়ুম কাপুর। এ উপবাস আগস্টের ৯ তারিখ অথবা সেপ্টেম্বরে হয়ে থাকে। এদিন ইহুদি পুরুষ ও মহিলা সাদা পোশাক পরে বায়তুল মাকদাসে সোলেমান টেম্পলের ইবাদতের স্থান ধ্বংসের জন্য অনুশোচনা করেন এবং ইহুদি জাতির ঐক্যবদ্ধের শপথ নেন। নভেম্বরে সাওমে জাদালিয়া বা 'জেদালিয়া ফাস্টিং' পালন করেন। এ উপবাসের মাধ্যমে জেরুজালেম ধ্বংসের সময় এর তত্ত্বাবধায়ক হত্যার ব্যাপারে অনুশোচনা করেন। জুলাই মাসের ৭ তারিখে আরেকটি সাওম পালন করা হয় ইহুদি ক্যালেন্ডার তিবিদ অনুযায়ী। এ সময় ব্যাবিলন সম্রাট জেরুজালেম ধ্বংস করেছিলেন। মার্চের ১০ তারিখে সাওমে ইস্টার বা 'ইস্টার ফাস্টিং' নামে উপবাস করা হয়। এটা মূলত হামান ম্যাসেকার থেকে ইহুদিদের মুক্তির দিন। এ ছাড়াও তারা বিশেষ সময়ে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক উপবাস পালন করে থাকে। ব্যক্তিগত সাওমকে সাওমে উসরা বলে, যেখানে ব্যক্তিগত হতাশা ও প্রায়শ্চিত্তের কথা বলা হয়। আবার জাতিগত প্রায়শ্চিত্ত মূলত বার্ষিক ফলন, বৃষ্টি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও যুদ্ধে বিজয়ের জন্য করা হয়। আমার সংক্ষিপ্ত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, তাদের সংস্কৃতি ও ধর্মে ‘স্মার্টনেস’ নির্ধারিত হয় ব্যক্তি কতটুকু ধার্মিক ও সামাজিক, এর ওপর ভিত্তি করে। সাধারণভাবে সময়ের প্রয়োজনে তারা চি’সাভাব, সেভেনটিথ অব টামুজ, টেনথ অব টিবিট উপবাস পালন করে থাকে। তানিদ তথা উপবাস পালনে রক্ষণশীলেরা অত্যন্ত কঠোর, তবে উদারপন্থীরাও এসব উপবাসের ব্যাপারে সহনশীল।
ইহুদিদের মতো নাসারা তথা খ্রিষ্টানদের মধ্যেও সাওম বা উপবাসের প্রচলন আছে। তবে এ উপবাস ইহুদিদের মতো এত কঠোর নয়। চার্চের ধর্মীয় ক্যালেন্ডার অর্থাৎ লিটারজিক্যাল ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তাদের একাধারে ৪০ দিনের উপবাস শুরু হয় 'এস উইডনেসডে'তে এবং শেষ হয় 'গুড ফ্রাইডে'তে। মার্চের শুরুতে এ উপবাস শুরু হয় এবং এপ্রিলের ১০ তারিখ গুড ফ্রাইডেতে শেষ। উল্লেখ্য, গুড ফ্রাইডে যিশুখ্রিষ্টের ক্রুসবিদ্ধ হওয়ার দিন। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, সব অনুসারীর মুক্তির জন্য তিনি ক্রুসবিদ্ধ হয়েছিলেন। খ্রিষ্টানদের উপবাস মূলত শুরু হয় রাত ১২টা থেকে এবং শেষ হয় বেলা ৩ টায়। এ সময়ের মধ্যে প্রয়োজনে তারা পানি বা ফল জাতীয় জিনিস খেতে পারে। তবে মাছ-মাংস জাতীয় খাবার পরিহারের চেষ্টা করে। উপবাসের সময় খাদ্য গ্রহণের মাত্রা কমে যাওয়ায় যে অর্থ সাশ্রয় হয়, তারা ক্ষুধার্ত ও দরিদ্রদের মধ্যে এ অর্থ দান করে দেয়। কিছু বিতর্ক ছাড়া ক্যাথলিক চার্চ, লুথারিয়ান চার্চ, ম্যাথডিস্ট চার্চ, রিফর্মড চার্চ, এঞ্জেলিকান কমিউনিয়ন এবং ওয়েস্টার্ন অর্থডক্স চার্চসমূহ এ ধারণাই পোষণ করে। উপবাস পালনের ক্ষেত্রে ইস্টার্ন চার্চ তুলনামূলক একটু বেশি সাবধানতা অবলম্বন করে।
খ্রিষ্টান সম্প্রদায় মনে করে, যিশুখ্রিষ্ট নিজে উপবাস করেছেন এবং তাঁর অনুসারীদের উপবাস করতে উৎসাহিত করেছেন। তবে তা একান্তই আত্মিক উন্নতি ও আধ্যাত্মিকতার জন্য। এ জন্য উপবাসের সামাজিকায়নের কোনো প্রয়োজন নেই। মনের উপবাস, দয়াপরবশ হওয়া, সহিষ্ণুতা ও আত্মিক সংযমই প্রকৃত উপবাস (মেথিও ৬: ১৬)। কেননা সামাজিকায়নের মাধ্যমে আত্মার উন্নতির চেয়ে প্রকাশভঙ্গি অনেকটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। সুতরাং আধ্যাত্মিকতা অর্জনের জন্য নিশ্চয়ই যতটা নিবৃতে এ উপবাস করা যায়, ততটাই মঙ্গল। তাদের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপবাস রয়েছে। এদিন প্রায় সবাই উপবাসের চেষ্টা করে থাকে। তা ছাড়া ব্যক্তির আত্মিক উন্নতি, কোনো প্রয়োজন, অসুস্থতা ও ঈশ্বরের উদ্দেশেও উপবাস পালন করা হয়। আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন ফাদার ও রেভারেন্টের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তাঁরা উপবাস করেন এবং এর মাধ্যমে আধ্যাত্মিক উন্নতির চেষ্টা করে থাকেন। মূলত ১০টি বিষয়কে সামনে নিয়ে খ্রিষ্টান সম্প্রদায় উপবাস করে থাকে। ১. প্রার্থনার যোগ্যতা বৃদ্ধি (ইজরা ৮:২৩) ২. ঐশ্বরিক নির্দেশনা প্রাপ্তি (জাজেস ২০:২৬) ৩. মনোযন্ত্রণা ও কষ্ট প্রকাশ (স্যামুয়েল ৩১:১৩), ৪. বিপদ-মুক্তি বা উদ্ধার (ক্রনিকল ২০:৩-৪) ৫. অনুশোচনা (স্যামুয়েল ৭:৬) ৬. ঈশ্বরের কর্মে নিবিষ্ট থাকা ৭. ঈশ্বরের প্রতি বিনয় প্রদর্শন (কিংস ২১: ২৭) ৮. সহযোগিতার সুযোগ (ইসাইয়াহ ৫৮-৩) ৯. প্রলোভন মুক্তি (ম্যাথিও ৪:১) ১০. ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা (লুক: ২:৩৭)। সব ধরনের উপবাসে পারস্পরিক ভালোবাসা ও সৌহার্দ্যের মাধ্যমে ঈশ্বরের কৃপা কামনা করা হয়।
ইসলাম ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ আব্রাহামিক ধর্ম। এ ধর্মে সাওমের ব্যাপারে সুরা বাকারার ১৮৩-৮৫ নম্বর আয়াতে বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে। সাওম ইসলামের মৌল স্তম্ভের একটি। রমজানের সাওম ফরজ বা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অবশ্য কর্তব্য। এ রমজানকে শাহরুল কোরআনও বলা হয়েছে। এ সাওম অত্যন্ত কল্যাণীয় বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, ‘সাওম আমার জন্য এবং আমিই এর পুরস্কার প্রদান করব।’ এ ছাড়া সারা বছরই বিভিন্ন ধরনের সাওমের কথা আছে। রাসুল (স.) প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার সাওম পালন করতেন। তা ছাড়া প্রতি মাসের মধ্যসময়ে সাওম পালনের কথা আছে। তবে এসব সাওম বাধ্যতামূলক নয়। সাওমকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য সব ধর্ম অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করেছে।
আধুনিক বিজ্ঞান সাওম বা উপবাসের বৈজ্ঞানিক ও প্রামাণিক ব্যাখ্যাও পেয়েছে। জাপানের বিজ্ঞানী ইউশোনরি উশহামি অটোফেজির ওপর গবেষণা করে ২০১৬ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। জীবদেহ কেমন করে ত্রুটিপূর্ণ কোষ ধ্বংস করে নিজের সুরক্ষা করে এবং কোষ কীভাবে নিজের আবর্জনা প্রক্রিয়াজাত করে সুস্থ থাকে, সেই রহস্য বের করার কারণে নোবেল পুরস্কার পেলেন এ বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানের ভাষায় এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় অটোফেজি। মূলত সাওম তথা উপবাসের মাধ্যমে অটোফেজি প্রক্রিয়াটি হয়ে থাকে।
* মুহাম্মদ ইকবাল হোছাইন: অধ্যাপক, দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।