কিংবদন্তি, ক্ষণজন্মা নাকি কালজয়ী ! অভিধানের কোনো শব্দই যেনো তাকে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা নিয়ে সৃষ্টি নয়। মাত্র ২৮ বছরের জীবদ্দশায় তিনি যা করে গেছেন, যা দিয়ে গেছেন পৃথিবীকে, শব্দের সাধ্যই কতটুকু যে তা বিশ্লেষণ করে !
পুরোনাম হিথক্লিফ এ্যান্ড্রু লেজার ওরফে ‘দ্য জোকার’। ১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিলের পড়ন্ত এক বিকেলে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পার্থে জন্ম নেন তিনি। বাবা কিম লেজার ছিলেন একজন প্রকৌশলী এবং মা ছিলেন শিক্ষিকা। যথেষ্ট শিক্ষিত পরিবারের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও পড়াশোনার প্রতি মোটেও খুব একটা মনোযোগী ছিলেন না হিথ। মাথায় অভিনয়ের এর পোকা ঘুরঘুর করলে অবশ্য পড়াশোনায় মনোনিবেশ করা কষ্টসাধ্য ব্যাপারই বটে।
হিথের অভিনয়ের হাতেখড়িটা তাই দ্রুতই হয়ে যায়। মাত্র ১০ বছর বয়সে স্কুলের একটি অনুষ্ঠানে ‘পিটার প্যান’ এর চরিত্রে অভিনয় করে সবাইকে রীতিমত তাক লাগিয়ে দেন তিনি। সেসময় কি আদৌ কেউ ভেবেছিল যে, এই ছোট্ট হিথ লেজার ই একদিন হয়ে উঠবে সর্বকালের সেরা সুপারভিলেন? হয়তবা না। কিন্তু সেই ছোট্ট শিশুটি কিন্ত বড় হয়ে ঠিকই নিজের জাত টা চিনিয়ে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে, হয়েছে চলচিত্র ইতিহাসের প্রথম এবং একমাত্র ‘অস্কারপ্রাপ্ত সুপারভিলেন’।
স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে অভিনয় জগতে হিথ প্রথম পা রাখেন ১৯৯১ সালে ‘ক্লাউনিং এ্যারাউন্ড’ নামক একটি টিভি সিরিজে ছোট একটি রোল করার মাধ্যমে। এরপর ছোটবড় বেশ কিছু টিভি সিরিজে অভিনয় করেন তিনি। তবে তার বড়পর্দায় অভিষেক হয় ১৯৯৭ সালে ‘ব্ল্যাকরক’ সিনেমার মাধ্যমে। কিন্তু প্রথম দুটি সিনেমায় অভিনেতা হিসেবে খুব একটা সুনাম কুড়োতে পারেননি তিনি, সেরকম ব্যবসাসফল ও হয়নি সিনেমা দুটি।
তাতে কি? থেমে থাকার পাত্র তো তিনি নন। পরবর্তী সিনেমা ‘টেন থিংস আই হেইট এ্যাবাউট য়্যু’ এর মাধ্যমে সাড়া ফেলে দেন হিথ। সিনেমাটি দারুণ ব্যবসাসফল হয়, হিথও তার ‘প্যাট্রিক ভেরোনা’ চরিত্রটির জন্য প্রচুর সুনাম লাভ করেন। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ভাগ্য খুলে যায় তাঁর। একে একে দ্য প্যাট্রিয়ট, এ নাইট’স টেল, দ্য ফোর ফেদারস, ব্রোকব্যাক মাউন্টেইন এবং আই’ম নট দেয়ার এর মতো দারুণ দারুন সিনেমা উপহার দেন দর্শকদের। এর মধ্য ‘ব্রকব্যাক মাউন্টেইন’ সিনেমায় এনিস এর চরিত্রে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য অস্কারের ইতিহাসে নবম কনিষ্ঠ হিসেবে সেরা অভিনেতার ক্যাটাগরিতে মনোনিত হন তিনি।
এরপরই বিখ্যাত পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলানের নজরে পরেন হিথ লেজার ! জানা যায়, সুপারহিরো সিরিজ ‘ব্যাটম্যান’ এর প্রথম সিনেমা ‘ব্যাটম্যান বিগিনস’ এর ব্যাটম্যান চরিত্রের জন্য শুরুর দিকে তাকেই পছন্দ করেছিলেন নোলান। যদিও বেশ কিছু কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। ভাগ্যবিধাতা হয়ত সিনেমার সর্বাধিক অপছন্দনীয় এই ‘ভিলেন’ নামক চরিত্র কে কিছুটা আশীর্বাদ দিতে চাইছিলেন সেবার। তাই শেষমেশ এই সিরিজের দ্বিতীয় সিনেমা ‘দ্য ডার্ক নাইট’ এর সুপারভিলেন ‘দ্য জোকার’ চরিত্রের জন্য বাছাই করা হয় হিথ কে। হিথও নিজের সবটুকু অভিনয় প্রতিভা আর পরিশ্রম ঢেলে দেন এই চরিত্রকে পূর্ণতা দিতে। এমনকি নিজের অভিনয় একদম নিখুঁত করতে টানা ৪৩ দিন বদ্ধ ঘরে কাটিয়েছেন তিনি। অনেকেই হয়ত জানেন না যে, জোকার এর বিশেষ ধরনের এই মেকাপ ও হিথ নিজেই তৈরী করেছিলেন।
২০০৮ সালটা ছিল হিথের জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বছর। কেননা এ বছরই হিথ নিজের অভিনয় ক্যারিয়ার কে সর্বোচ্চ শিখরে নিয়ে গেছেন, হয়েছেন সিনেমা ইতিহিসের প্রথম এবং একমাত্র অস্কারজয়ী সুপারভিলেন। আর নিজেকে নিয়ে গেছেন তারও উপরে, ওপারে !
জানুয়ারির ২২ তারিখ, দুপুর ২:৪৫ মিনিটে হিথকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় তাঁর বেডরুমে। সিনেমা জগতের তারা থেকে আকাশের তারা বনে যান সকল সুপারহিরোর চেয়েও অধিক জনপ্রিয় এই সুপারভিলেন ।
সিনেমাকে নিজের এতটাই উজাড় করে দিয়েছিলেন হিথ যে, সিনেমা নামক শিল্পটা নিজেই হিথের কাছে ঋণী হয়ে গিয়েছিল। তাই তো মৃত্যুর পর সেই ঋণ শোধের ক্ষুদ্র পদক্ষেপ হিসেবে ‘জোকার’ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য অস্কারপ্রাপ্ত হন তিনি। আরও পেয়েছেন কোটি কোটি ভক্তের অকুন্ঠ ভালবাসা আর দিয়ে গেছেন অনেকখানি আক্ষেপ। অস্কারের ঐ বোবা মূর্তিটিও হয়ত ভুগবে হিথক্লিফ এ্যান্ড্রু লেজারের হাতের স্পর্শ না পাওয়ার আক্ষেপে !