হজরত দাউদ (আ.) ছিলেন বনি ইসরাইলের নবী। মহান আল্লাহ তাআলা যে নবীদের মহান কিতাব দিয়েছিলেন, হজরত দাউদ (আ.) তাঁদের মধ্যে অন্যতম। দাউদ (আ.)-কে আল্লাহ যাবুর নামক কিতাব দান করেছিলেন। যাবুর কিতাবের অন্যতম দুটি বৈশিষ্ট্য ছিল, নন্দিত ছন্দ ও আল্লাহ তাআলার প্রশংসার বিবরণ। দাউদ (আ.)-এর ছিল সকাল-সন্ধ্যা মহান প্রভুর প্রশংসাপাঠের আমল ও মোহনীয় সুর। সুর ও ছন্দ, দুটোই আল্লাহ তায়ালার বিশেষ নিয়ামত। ছন্দ যেমন প্রাণকে আন্দোলিত করে, সুরও তেমনি হৃদয়ে উচ্ছ্বাস জাগায়, প্রাণিত করে। প্রত্যেক নবীকে আল্লাহ স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য দিয়েছিলেন।
দাউদকে দিয়েছিলেন বীরত্ব, সাহসিকতা, খেলাফত, বিচারিক দক্ষতা, পশুপাখির ভাষা বোঝার ক্ষমতা ও সুরলহরী। হজরত দাউদ (আ.)-এর মতো সুমধুর সুর আর কাউকে প্রদান করা হয়নি। সুর ও ছন্দের দারুণ সমন্বয় ঘটেছিল দাউদ (আ.)–এর মাঝে। যাবুরের ছন্দ আর দাউদ (আ.)-এর মোহনীয় সুর, দুইয়ে মিলে আল্লাহর প্রশংসাপাঠে এক অপূর্ব ঝংকার সৃষ্টি হতো, যে ঝংকার মানুষ, জিন, পশুপাখি ও প্রকৃতিকে আন্দোলিত করত। হজরত দাউদ (আ.) যখন তাঁর মোহনীয় সুরে যাবুর পাঠ করতেন, আকাশে উড়ন্ত পাখিও নীরবে দাঁড়িয়ে তিলাওয়াত শুনত। নদীর প্রবাহ থেমে যেত। বাতাসে সৃষ্টি হতো ভ্রমরের মতো গুন গুন গুঞ্জন।
বিখ্যাত ধর্মতাত্ত্বিক ইমাম আওজায়ি (র.) বলেন, ‘হজরত দাউদ (আ.)-এর মতো এত সুমধুর কণ্ঠস্বর আর কাউকে দেওয়া হয়নি। তিনি যখন কিতাব পড়তেন, আকাশের পাখি ও বনের পশু তাঁর চারপাশে জড়ো হতো। এমনকি পিপাসায় কাতর হয়ে জায়গায় মারা গেলেও নড়াচড়া করত না। শুধু তাই নয়; নদীর পানির প্রবাহ পর্যন্ত থেমে যেত তাঁর সুরে।’ ওহাব ইবনে মুনাব্বিহ বলেছেন, ‘দাউদ (আ.)-এর কণ্ঠস্বর যে-ই শুনত, সে–ই লাফিয়ে উঠত এবং সুরের তালে তালে যেন নাচতে শুরু করত। দাউদ (আ.) যাবুরকে এমনভাবে পাঠ করতেন, যা কোনো দিন আর কেউ শোনেনি। তাঁর যাবুর পাঠের সুর শুনে জিন-ইনসান, পশুপাখি জীবজন্তু স্ব-স্থানে ঠায় দাঁড়িয়ে যেত। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার ফলে তাদের কেউ কেউ মারাও যেত।’ (আল্লামা ইবনে কাসির, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃষ্ঠা: ৬১৫)
হজরত দাউদ (আ.)-এর সুমধুর সুরের কথা কোরআন ও হাদিসে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা হজরত দাউদ (আ.)-এর প্রতি তাঁর অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করে পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘আমরা দাউদের প্রতি আমাদের পক্ষ থেকে অনুগ্রহ প্রদান করেছিলাম এই মর্মে যে—হে পর্বতমালা, তোমরা দাউদের সঙ্গে আমার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো এবং (একই নির্দেশ দিয়েছিলাম) পাখিদেরও।’ (সুরা আস-সাবা, আয়াত : ১০)
প্রখ্যাত মুফাসসির আল্লামা ইবনে কাসির (রা.) তাঁর প্রসিদ্ধ তাফসির গ্রন্থে বর্ণিত আয়াতের তাফসির প্রসঙ্গে বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা এখানে বলতে চাইছেন, তিনি তাঁর বান্দা ও রাসুল দাউদের ওপর পার্থিব ও অপার্থিব রহমত নাজিল করেছিলেন। তাঁকে নবুয়ত, রাজত্ব, সৈন্য-সামন্ত ও শক্তি-সামর্থ্য দান করেছিলেন। এর সঙ্গে অতিরিক্ত আরেকটি মুজিজাও প্রদান করেছিলেন—একদিকে দাউদ (আ.) মিষ্টি সুরে আল্লাহর একাত্মবাদের গান ধরতেন, অপর দিকে বিকেলে ফেরা ভোরের পাখিরা দাউদের কণ্ঠে আল্লাহর প্রশংসা শুনে থেমে যেত ও হজরত দাউদের সুরে সুর মিলিয়ে গান করত। দাউদ (আ.) পাখিদের ভাষাও বুঝতেন। পাখিদের সঙ্গে কথা বলতেন। পাহাড়-পর্বতও তাঁর সঙ্গে সুর মিলিয়ে আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করত।’
পবিত্র কোরআনের অন্য আয়াতেও হজরত দাউদ (আ.)-এর প্রতি পাহাড়-পর্বত ও পশুপাখির আনুগত্য ও আল্লাহর তাসবিহ পাঠের কথা বলা হয়েছে—‘আমরা পাহাড়কে এবং পাখিদের দাউদের অনুগত করে দিয়েছিলাম। তারা তাসবিহ পাঠ করত এবং আমরা এটা করে থাকি।’ (সুরা আল আম্বিয়া, আয়াত: ৭৯)
মুফতি শফি (রা.) বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা হজরত দাউদ (আ.)-কে যে সকল বাহ্যিক গুণ দান করেছিলেন, তাঁর মোহনীয় সুর এর মধ্যে অন্যতম। দাউদ যখন যাবুর পাঠ করতেন, পাখিরা বাতাসে দাঁড়িয়ে তাঁর সুরে সুর মিলিয়ে আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করত। একইভাবে পাহাড়-পর্বত, বৃক্ষরাজি থেকেও আল্লাহর তাসবিহর আওয়াজ আসত। দাউদের সুরের মূর্ছনা ছিল তাঁর বাহ্যিক পূর্ণতা আর পশুপাখি ও পাহাড়-পর্বতের তাসবিহ পাঠ ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ মুজিজা।’ (মুফতি শফি, তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ২১১)
সাহাবিদের মধ্যে হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.)-এর সুর ছিল সবচেয়ে মধুর। আশআরির সুরের প্রশংসা করে আবু উসমান নাহদি বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! আমি আবু মুসা আশআরির সুরের চেয়ে মিষ্টি সুর কোনো বাদ্যযন্ত্রেও শুনিনি। (ফাযায়িলুল কোরআন, পৃষ্ঠা: ৭৯) রাসুল (সা.) এই আবু মুসা আশআরির সুরকে দাউদ (আ.)-এর সুরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। যা দ্বারা দাউদ (আ.)-এর সুরের সৌন্দর্য কিছুটা অনুভব করা সম্ভব। হাদিসে এসেছে, ‘এক রাতে হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করছিলেন।
এমন সময় রাসুল (সা.) তাঁর পাশ দিয়ে গমন করছিলেন। আবু মুসা আশআরির মিষ্টি সুরে কোরআন তিলাওয়াত শুনে রাসুল দাঁড়িয়ে যান এবং দীর্ঘক্ষণ ধরে শুনতে থাকেন। তারপর তিনি বলেন, তাকে তো হজরত দাউদের মতো মিষ্টি সুর দান করা হয়েছে। আবু মুসা আশআরি (রা.) ঘটনাটি জেনে বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি জানতাম যে আপনি আমার কোরআন তিলাওয়াত শুনছিলেন, তাহলে আমি আরও উত্তমভাবে পাঠ করতাম।’ (ফাতহুল বারি, অষ্টম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৭১১) অন্য আরেক হাদিসে বলা হয়েছে, ‘এক রাতে রাসুল (সা.) হজরত আবু মুসা আশআরির কোরআন তিলাওয়াত শুনে দাঁড়িয়ে যান এবং দীর্ঘক্ষণ ধরে শুনতে থাকেন। তারপর তিনি বলেন, তাঁকে তো হজরত দাউদের মিষ্টি সুরের কিছু অংশ দান করা হয়েছে।’ (সহি মুসলিম, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৫৪৬)
ইমাম বুখারি ও মুসলিম থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসুল (সা.) সরাসরি হজরত দাউদ (আ.)-এর সুরের প্রশংসা করেছেন। রাসুল (সা.) বলেছেন,‘আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় নামাজ হচ্ছে হজরত দাউদ (আ.)-এর মতো নামাজ ও সবচেয়ে প্রিয় রোজা হচ্ছে দাউদ (আ.)-এর মতো রোজা। দাউদ রাতের প্রথম অর্ধেক সময় ঘুমাতেন, তারপর এক-তৃতীয়াংশ নামাজে কাটাতেন এবং এক–ষষ্ঠাংশ আবার ঘুমিয়ে কাটাতেন। এক দিন পরপর রোজা রাখতেন। আর শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কখনো ভয়ে পালাতেন না।
পাহাড় ও পাখিরা সকাল-সন্ধ্যা তাঁর সঙ্গে তাসবিহ পড়ত। হজরত দাউদকে আল্লাহ এত সুউচ্চ, সুমধুর ও সুললিত কণ্ঠস্বর দান করেছিলেন, যা পৃথিবীর আর কাউকে দান করেননি। হজরত দাউদ (আ.) যখন তাঁর প্রতি অবতীর্ণ যাবুর কিতাব সুর দিয়ে পাঠ করতেন, তখন আকাশে উড়ন্ত পাখিরা তাঁর সুরের মূর্ছনায় থমকে দাঁড়াত। হজরত দাউদ (আ.)-এর সুরের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আবৃত্তি করত ও তাঁর সঙ্গে তাসবিহ পাঠ করত। একইভাবে পাহাড়-পর্বতও সকাল-সন্ধ্যা তাঁর সঙ্গে তাসবিহ পাঠে শরিক হতো।’
মোহনীয় সুরের কারণে হজরত দাউদ (আ.) কিয়ামতের দিন বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত হবেন। তাঁর হৃদয়কাড়া সুরে জান্নাতের অধিবাসীরা মুগ্ধ হবে। স্বয়ং আল্লাহ তাঁকে সুরের ঝংকার তুলে মুগ্ধ করার আদেশ দেবেন এবং নিজেও শ্রবণ করবেন। আল্লামা ইবন কাসির (রা.) বলেন, হজরত দাউদ (আ.) কিয়ামতের দিন আরশে আজিমের স্তম্ভের কাছে দণ্ডায়মান থাকবেন। আল্লাহ তখন বলবেন, হে দাউদ! দুনিয়ায় তুমি যে মধুর সুরে আমার প্রশংসা ও মহত্ত্ব প্রকাশ করতে, সে রকম মধুর সুরে আজ আমার প্রশংসা ও মহত্ত্ব প্রকাশ করো। দাউদ বলবেন, হে আল্লাহ! আপনি তো সে সুর আমার থেকে উঠিয়ে নিয়েছেন। এখন আমি কীভাবে প্রশংসা করব। আল্লাহ বলবেন, আজ আমি আবারও তোমাকে সে সুর ফিরিয়ে দিচ্ছি। সুতরাং প্রশংসা করো। এরপর দাউদ সুমধুর সুরে প্রশংসা করবেন। আর সে সুরে জান্নাতবাসীরা মুগ্ধ হবে।’ (কাসাসুল আম্বিয়া, পৃষ্ঠা: ৬১৮)