বলা হয় স্বাধীন ভারতে এর চেয়ে নিন্দনীয় ঘটনা আর কখনোই ঘটে নি। কারো কারো মতে, সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে উপমহাদেশে সবচেয়ে বড় আর নিষ্ঠুরতম ঘটনা এটি। সনাতন ধর্ম অধ্যুষিত দেশ ভারতের সবচেয়ে পশ্চিমের রাজ্য গুজরাটে আজ থেকে ১৮ বছর আগে যুক্ত হয় ইতিহাসের কালো এই অধ্যায়। রাজ্য সরকারের নীরব সম্মতির সুযোগ নিয়ে গুজরাটে দাঙ্গার নামে খুন করা হয় হাজারো মুসলমান নাগরিকদের। যদিও সে সময়কার গুজরাট রাজ্য প্রধান নরেন্দ্র মোদি তদন্ত শেষে নির্দোষ প্রমাণিত হন। তবে এখন পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদি এই ঘটনায় আক্রান্তদের কাছে খলনায়ক হিসেবেই রয়ে গেছেন। সম্প্রতি নাগরিকত্ব আইন এবং আসামে মুসলিম নির্যাতনের পর জেগে উঠেছে নতুন শঙ্কা। ২০০২ এর গুজরাট দাঙ্গা কি তবে আবার ফিরবে ভারতের বুকে?
যেভাবে শুরু
২০০২ এর ২৭ ফেব্রুয়ারি। গুজরাটের সমরবতী এক্সপ্রেস নামক ট্রেনে হামলায় সরকারি হিসেবে ভারতের ৫৯ জন মারা যায়। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে সংখ্যাটি যদিও ২৫৪ জন। এ ঘটনায় কোন প্রমাণ ছাড়াই মুসলমানদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়। অথচ পরবর্তীতে ‘নতুন নানাবতী’ কমিশনের তদন্তের রিপোর্টের ভিত্তিতে বেরিয়ে আসে যে, ভারতের মুসলমানদের উপর হামলা চালানোর পূর্ব-ষড়যন্ত্র হিসেবেই এ অগ্নিকান্ডের ঘটনা সাজানো হয়, যা উগ্র হিন্দু সন্ত্রাসীরা করেছিল। নানাবতী কমিশন দাবি করে, ট্রেন পোড়ানোর ঘটনা “পূর্ব পরিকল্পিত” ছিল এবং “কামরায় যেসব কর সেবকরা ছিলেন, তাঁদের ক্ষতি করবার উদ্দেশ্যেই” এই ঘটনা ঘটানো হয়।
দাঙ্গার প্রভাব
সংখ্যা লঘু হওয়াতে মুসলিমদের উপর হিন্দুদের নির্যাতন মাত্রা ছাড়ায়। নির্যাতনের ধরন সব যুগের সব বর্বরতাকে হার মানিয়েছিল। মুসলিমদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান,বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। অধিকাংশ মুসলিমদের পুরিয়ে মারা হয়েছে। শত শত মুসলিম নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। শিশুদেরকেও তারা ছাড় দেয়নি। প্রায় লাখখানেক মুসলিম তাদের বাড়ি ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। এই নির্যাতনে RSS সহ হিন্দু উগ্র সন্ত্রাসীরা অংশ নেয়।
তবে এর মাঝে একবারেই আলাদা ছিলেন বাবুভাই প্যাটেল, যিনি বাবু বজরঙ্গি হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। গুজরাটে মুসলিম হত্যাকান্ডের অন্যতম এই নেতা বর্বতার দিক থেকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন সব মাত্রা। ৯ মাসের ফিটাস (মায়ের পেটে থাকা ভ্রুণ) পেট চিরে বের করে আগুনে পোড়াবার মতো বর্বর কাজ তিনি নিজ হাতে করেন।
দাঙ্গায় সরকারী হিসেবে ১০৪৪ জনকে মৃত ঘোষণা করা হলেও এতে ২৫০০ এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল বলে বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশিত হয়। এছাড়া বিভিন্নভাবে শারীরিক অসুস্থতার শিকার ছিলেন আরো ২৫০০ জন। এই দাঙ্গায় প্রায় ১০ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। বন্ধ হয় প্রায় ১৫০০০ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং প্রায় ৫০০ টি মসজিদ আগুনে পুড়ে কিংবা ভাঙনের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘটনা চলাকালে মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে দোষী সাব্যস্ত করা হলেও ২০১৪ পূর্ণাঙ্গ প্রকাশিত তদন্ত প্রতিবেদনে তাকে এবং তার পুরো মন্ত্রীসভাকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়েছে।
অথচ দাঙ্গার পর তাকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি। মোদি নিজে থেকে না সরলে গুজরাট সরকারকে বরখাস্ত করা হবে- এমনটাই ছিল বাজপেয়ির পরিকল্পনা। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী বিজেপি নেতা যশবন্ত সিনহা গত বছর মে মাসে এই বিস্ফোরক তথ্য দিলে আবারো প্রশ্নবিদ্ধ হয় নানাবতী কমিশনের রিপোর্ট।
যশবন্ত সিনহা জানান, তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এলকে আদভানি বেঁকে বসায় শেষ মুহূর্তে ওই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন বাজপেয়ি। সিনহা বলেন, একটি দলীয় বৈঠক হয়েছিল। আমি যতদূর জানি, আদভানি এই সিদ্ধান্তের ঘোর বিরোধী ছিলেন।
তিনি অটল বিহারিকে বলেছিলেন, যদি মোদিকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়, তবে তিনি নিজে সরকার থেকে ইস্তফা দেবেন। অগত্যা সিদ্ধান্ত বদলাতে হয় বাজপেয়িকে।
তদন্ত প্রতিবেদন
গুজরাট দাঙ্গার চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন ছিল ৯ খণ্ডের, ২৫০০ পৃষ্ঠার। মোদি এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের ক্লিন চিট দেওয়া হয়েছে এই রিপোর্টে। তদন্তকারী কমিশন তিন প্রাক্তন আইপিএস অফিসার, অবসরপ্রাপ্ত ডিজিপি শ্রীকুমার, রাহুল শর্মা এবং সঞ্জীব ভাটের দেওয়া প্রমাণ নাকচ করে দেয়। এই তিন প্রাক্তন পুলিশকর্তার অভিযোগ ছিল সরকার ও তার কার্যনির্বাহীদের একাংশ এই ষড়যন্ত্রের অংশীদার ছিল।
কমিশন মনে করেছে দাঙ্গা ঘিরে কোনও ষড়যন্ত্র হয়নি, যা হয়েছে তা মূলত ছিল গোধরা স্টেশনে সমরবতী ট্রেন পোড়ানোর ঘটনার উদ্ভূত ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। তিস্তা শেতলবাদ পরিচালিত সিটিজেন্স ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস এবং প্রয়াত মুকুল সিনহা পরিচালিত জনসংঘ মঞ্চ, যে সমস্ত সরকারি আধিকারিক ও রাজনৈতিক নেতাদের জেরা করেছিল তাদের দেওয়া তথ্যপ্রমাণ খতিয়ে দেখেছে কমিশন।
সেনাবাহিনীর সাবেক উপপ্রধান জমিরউদ্দিন শাহ গুজরাট দাঙ্গার মোকাবিলায় মোতায়েন করা সেনাদের নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি তার সদ্যপ্রকাশিত বইতে দাঙ্গা ঠেকানোর ক্ষেত্রে প্রশাসনের ভূমিকার কড়া সমালোচনা করেছেন। ‘দ্য সরকারি মুসলমান’ নামে তার ওই বইটি প্রকাশ করতে গিয়ে ভারতের সাবেক উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারিও দাঙ্গার সময় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
২৮ তারিখ দাঙ্গা শুরুর পরপরই সেনা উপপ্রধানের নির্দেশে মধ্যরাতেই গুজরাট পৌছান জমিরউদ্দীন শাহ। কিন্তু সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি এতই প্রতিকূল অবস্থায় পান যে তিনি এবং তার ফোর্স সরাসরি কোন প্রতিরোধ গড়তে পারেনি। গণমাধ্যমে তিনি জানান, “আমাকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল গুজরাটে পৌঁছানোর পর বাহিনীকে গাড়ি, ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ এসকর্ট, কমিউনিকেশন সিস্টেম আর শহরের নকশা দেওয়া হবে। কিন্তু পৌঁছে দেখলাম ওসব কিছুই নেই।”
সাবেক এই সেনা উপপ্রধান দাবী করেন, শুরুতেই তাদের নিষ্ক্রিয়তার প্রভাবে দাঙ্গায় বজরঙ্গি পার্টি বেশ সক্রিয় হয়ে পড়ে। যার ফলাফল হিসেবে সেনাবাহিনীও অসহায় হয়ে যায়। এবং তারই প্রভাবে রচিত হয় ভারতীয় ইতিহাসের কলঙ্কিত এক অধ্যায়।