নিশ ফোরট্রেস থেকে ভেতরের দিকে একটু পা বাড়ালেই দেখা মিলবে অটোমান সাম্রাজ্যের শাসনামলে নির্মিত বালি বেগ মসজিদ। বর্তমানে অবশ্য মসজিদটি পরিত্যক্ত। সার্বিয়ার সরকার সংস্কারের মাধ্যমে মসজিদটিকে আর্ট গ্যালারির রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। বালি বেগ মসজিদের পাশাপাশি অটোমানদের সময়ে নির্মিত অনেক নিদর্শনও আপনি এখানে খুঁজে পাবেন। বর্তমানে অবশ্য সরকারিভাবে নিশে কেবল একটি মসজিদ রয়েছে। ১৭২০ সালে নির্মিত এ মসজিদের নাম ইসলাম আগা মস্ক। তবে ২০০৪ সালে এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে মসজিদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, পরে ২০১৩ সালে সংস্কারের মাধ্যমে মসজিদটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়। এখনো এ মসজিদে নিয়মিত নামাজ পড়া হয়।
ইসলাম আগা মস্ক, বর্তমানে নিশে এটিই একমাত্র অফিশিয়াল মসজিদ
নিশ ফোরট্রেস গোটা বলকান অঞ্চলের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক নিদর্শন হিসেবে সমাদৃত। নিশ সম্পর্কে সার্বিয়ানদের মধ্যে আরও একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে। সার্বিয়াসহ পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের কোনো দেশ থেকে বুলগেরিয়া কিংবা মেসিডোনিয়াতে যেতে হলে নিশের ওপর দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়া ও নিশের মধ্যবর্তী দূরত্ব ১০০ মাইলের কাছাকাছি। অন্যদিকে মেসিডোনিয়ার রাজধানী স্কুপিয়ে থেকে নিশ শহরের দূরত্ব ১৩১ মাইল।
নিশের প্রধান যে হাইওয়ে রয়েছে, সেটি দক্ষিণ-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পশ্চিম দিক বরাবর দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যথাক্রমে বুলগেরিয়া ও মেসিডোনিয়ায় প্রবেশ করেছে। সার্বিয়ানরা তাই বলে থাকেন, নিশ থেকে যত পূর্বদিকে যাওয়া যায়, সার্বিয়ান ভাষা ধীরে ধীরে ততটা পরিবর্তিত হয়ে একসময় বুলগেরিয়ান ভাষায় রূপান্তরিত হয়। অন্যদিকে নিশ থেকে যত পশ্চিমে যাওয়া যায়, সার্বিয়ান ভাষা ধীরে ধীরে ততটা পরিবর্তিত হয়ে মেসিডোনিয়ান ভাষার রূপ লাভ করে।
নিশের ল্যান্ডমার্ক হিসেবে পরিচিত নিশ ফোরট্রেস, নিশ ফোরট্রেসকে ‘ইস্তাম্বুল গেট’ নামেও ডাকা হয়
দীর্ঘদিন ধরে সার্বিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবেশের চেষ্টা চালিয়ে আসছে। তবে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সার্বিয়ার এখনো সেভাবে সখ্য গড়ে ওঠেনি। বিশেষত কসোভোকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সার্বিয়ার দ্বন্দ্ব বর্তমানে চরমে। সার্বিয়া এখনো কসোভোকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়নি, এমনকি যুগোস্লাভিয়া যুদ্ধের সময় বসনিয়াক ও আলবেনীয়দের ওপর সংঘটিত গণহত্যার দায়কেও সার্বরা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি। সার্বিয়ার সঙ্গে কসোভোর সীমানা থাকলেও পর্যটকেরা সচরাচর সহজে সার্বিয়া থেকে কসোভোতে প্রবেশ করতে পারেন না। এসব কারণে সার্বরা এখনো গোটা ইউরোপে একঘরে অবস্থানে রয়েছে।
নিশ ফোরট্রেসের অভ্যন্তরীণ অংশের সামনে লেখক, ছবি: সংগৃহীত
সুবোটিচা থেকে নিশ, দীর্ঘ প্রায় সাড়ে সাত ঘণ্টার যাত্রাপথে বিভিন্ন জায়গায় চীন, রাশিয়া ও তুরস্কের অর্থায়নে নির্মিত অনেকগুলো প্রকল্পের কাজ আমি দেখেছি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের এ দেশের প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদাসীনতার কারণে চীন, রাশিয়া ও তুরস্ক এ দেশকে কেন্দ্র করে ইউরোপে তাদের রাজনৈতিক বলয় সৃষ্টি করতে চাইছে।
নিশ ফোরট্রেস থেকে আমরা স্কাল টাওয়ারের দিকে গেলাম। মূলত এ স্কাল টাওয়ার দেখার উদ্দেশ্যে বেশির ভাগ দর্শনার্থী নিশে হাজির হন। নিশ ফোরট্রেস থেকে কয়েক গজ হাঁটলে ৩৪-এ বাসের দেখা পাবেন, এ বাস সরাসরি আপনাকে স্কাল টাওয়ারে পৌঁছে দেবে। সার্বিয়ার ভাষায় স্কাল টাওয়ারকে বলা হয় চেলে কুলা। নিশে বাসভাড়া বলতে গেলে অনেকটা সস্তা, মাত্র ৬০ সার্বিয়ান দিনার দিয়েই আপনি নিশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাতায়াত করতে পারবেন। বাসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাসের সহকারী এসে আপনার কাছ থেকে ভাড়া তুলবেন। ব্যবস্থাটা ঢাকার মতোই।
নিশের স্কাল টাওয়ার, মূলত এ স্কাল টাওয়ার দেখার জন্য বেশির ভাগ দর্শনার্থী নিশে আসেন
বয়োজ্যেষ্ঠ কিছু নাগরিক এবং তৃণমূল পর্যায়ের অল্প কিছু মানুষ ছাড়া সার্বিয়ার বেশির ভাগ মানুষই ইংরেজি বলতে পারেন। তাই সার্বিয়া গেলে অন্তত ভাষাগত কোনো সমস্যা আপনাকে পোহাতে হবে না। যেহেতু সার্বিয়ার বেশির ভাগ মানুষ অর্থোডক্স খ্রিষ্টান এবং জাতিগতভাবেও সার্বিয়ান স্লাভিক জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্গত; এ জন্য দৈনন্দিন জীবনে লেখার কাজে দেশটিতে সিরিলিক বর্ণমালা ব্যবহৃত হয় বেশি। অনানুষ্ঠানিকভাবে অনেকে অবশ্য লাতিন বর্ণমালাও ব্যবহার করেন। সার্বিয়াতে অফিশিয়াল কাজে সিরিলিক বর্ণমালা ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক।
স্কাল টাওয়ারের ভেতরে প্রবেশ করতে হলে বাইরের কাউন্টার থেকে ২০০ সার্বিয়ান দিনার দিয়ে টিকিট কিনতে হয়। যদিও এ স্কাল টাওয়ার অটোমান শাসনামলে নির্মিত, তবু সার্বিয়ার জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রতীক হিসেবে এটি দাঁড়িয়ে আছে দুই শতাব্দী ধরে।
১৮০৪ থেকে ১৮১৩—এ ৯ বছর সার্বিয়ার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। দীর্ঘ প্রায় সাড়ে ৩০০ বছর অটোমান শাসনের অধীন থাকা সার্বিয়ানরা এ সময় স্বাধীনতার ডাক দেন। এ ৯ বছর সার্ব সৈন্যদের সঙ্গে অটোমান সৈন্যদের বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। শেষ পর্যন্ত প্রশিক্ষিত ও দক্ষ অটোমান সেনাদের কাছে সে সময় অসংগঠিত, অদক্ষ এবং অন্তঃকলহে বিভক্ত সার্ব সৈন্যরা পরাস্ত হয়েছিলেন।
স্কাল টাওয়ারের ভেতরের অংশে লেখক, ছবি: সংগৃহীত
১৮০৯ সালে নিশের উপকণ্ঠে অবস্থিত চেগার পর্বতমালায় স্টেভান সিন্ডেলিচের নেতৃত্বে একদল বিদ্রোহী সার্ব সৈন্য একত্র হন। সার্বিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলকে অটোমান সাম্রাজ্যের শাসন থেকে মুক্ত করতে তিনি যুদ্ধের ঘোষণা দেন। যদিও অটোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো পর্যাপ্ত লোকবল ও রসদ তাঁর হাতে ছিল না। তাই অটোমান সেনাবাহিনী স্টেভান সিন্ডেলিচ ও তাঁর সঙ্গে থাকা বিদ্রোহী সেনা দলকে সহজে ঘিরে ফেলে। পরাজয় নিশ্চিত জেনে স্টেভান সিন্ডেলিচ আত্মঘাতী আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, তিনি কোনোভাবে অটোমানদের কাছে আত্মসমর্পণের পক্ষপাতী ছিলেন না। আগে থেকে মজুত করে রাখা গান পাউডারে তিনি আগুন ধরিয়ে দেন। ফলে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণের সৃষ্টি হয় এবং স্টেভান সিন্ডেলিচসহ আশপাশে থাকা সব বিদ্রোহী সার্ব ও অটোমান সেনাসদস্যের মৃত্যু হয়।
যদিও সে যাত্রায় সার্বিয়ানদের স্বাধীনতা আন্দোলন আলোর মুখ দেখেনি, তবে বিশালসংখ্যক অটোমান সেনাসদস্যের মৃত্যু স্থানীয় গভর্নর হুরশিদ পাশাকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। গভর্নর হুরশিদ পাশা তাই সেনাপতি স্টেভান সিন্ডেলিচসহ তাঁর অধীন থাকা সব সার্ব সেনার মৃতদেহ থেকে মাথাকে বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দেন এবং সেখান থেকে মাথার খুলিকে অবমুক্ত করে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে সেগুলোকে অটোমান সুলতান দ্বিতীয় মেহমুদের আছে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। সুলতান দ্বিতীয় মেহমুদ এসব মাথার খুলিকে পুনরায় নিশে ফেরত পাঠান।
পরবর্তী সময়ে অটোমানরা এসব মাথার খুলিকে একত্র করে একটি টাওয়ার নির্মাণ করেন। মূলত বিদ্রোহী সার্বদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করতে তারা এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে অনেক ঐতিহাসিক মতামত ব্যক্ত করেছেন। প্রায় ১৫ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট এ স্কাল টাওয়ারের চারদিকে ১৪টি ভিন্ন সারিতে ৯৫২টি মাথার খুলি স্থাপন করা হয়েছিল।
স্টেভান সিন্ডেলিচের মাথার খুলির সামনে লেখক। ধারণা করা হয়, গ্লাস কনটেইনারে আলাদাভাবে রাখা এ মাথার খুলিটি সেনাপতি স্টেভান সিন্ডেলিচের, ছবি: সংগৃহীত
অটোমান শাসনাধীন নিশে সর্বশেষ গভর্নর ছিলেন মিদাত পাশা। তিনি এ স্কাল টাওয়ারকে ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন এবং সেখান থেকে সব মাথার খুলিকে অপসারণের ঘোষণা দেন। তিনি মনে করতেন, এ ধরনের কোনো নিদর্শন মুক্তিকামী জনসাধারণের মধ্যে ভীতির সঞ্চারের পরিবর্তে স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে অটোমান সাম্রাজ্যের বর্বরতাকে তুলে ধরে। তাই তিনি ছিলেন এ স্কাল টাওয়ারের বিপক্ষে। ১৮৭৮ সালে নিশ অটোমান সাম্রাজ্যের শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এ সময় সার্বিয়ান সেনাবাহিনী আশপাশের এলাকাগুলোতে তল্লাশি চালায় এবং আরও কয়েকটি মৃতদেহ উদ্ধার করে, যাঁরা সেই ১৮০৯ সালের চেগার যুদ্ধের সময় নিখোঁজ হয়েছিলেন।
পরবর্তী সময়ে সার্বিয়ার অর্থোডক্স চার্চের অনুকরণে এ স্কাল টাওয়ারের বাইরের অংশকে পুনরায় সাজানো হয় এবং টাওয়ারের উপরিভাগে একটি ক্রস ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে নিশের এ স্কাল টাওয়ারে ৫৮টির মতো মাথার খুলি রয়েছে। স্কাল টাওয়ারটির সংস্কার করতে গিয়ে অনেকগুলো মাথার খুলি সরিয়ে ফেলতে হয়েছে। নিকটাত্মীয় পরিচয়েও অনেকে সেখান থেকে মাথার খুলি নিয়ে সেগুলোকে সৎকারের মাধ্যমে সমাহিত করেছেন। কেউ কেউ আবার সেখান থেকে মাথার খুলি নিয়ে বাইরে বিক্রিও করেছেন। স্কাল টাওয়ারের ভেতরে একটি গ্লাস কনটেইনারে আলাদাভাবে একটি মাথার খুলি রাখা হয়েছে। অনেকে বলেন, এটি সেনাপতি স্টেভান সিন্ডেলিচের মাথার খুলি।
স্কাল টাওয়ার থেকে আমাদের গন্তব্য ছিল বুবানি ন্যাশনাল পার্ক। নিশের দক্ষিণ-পশ্চিমে নিশ ও স্কুপিয়ের সংযোগ সড়কে এর অবস্থান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নাৎসি বাহিনী কর্তৃক নিশ ও এর আশপাশের অঞ্চলগুলোতে ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। বুবানির এ স্থান ছিল মূলত একটি এক্সিকিউশন স্কোয়াড, যেখানে তাদের হত্যা করা হয়েছিল ও তাদের মৃতদেহকে গণকবর দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিহত সেসব মানুষের স্মরণে মুষ্টিবদ্ধ হাতের অনুকরণে সেখানে তিনটি প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিশ ও এর আশপাশের অঞ্চলে যাঁরা নিহত হয়েছিলেন, তাঁদের স্মরণে বুবানি ন্যাশনাল পার্কে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ
এ তিনটি প্রতিকৃতির কোনোটি আকৃতিগত দিক থেকে একে অন্যের সমান নয়। মিলানের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, এ তিনটি প্রতিকৃতির মধ্যে যেটি অপেক্ষাকৃত আকারে বড়, সেটি পুরুষ হত্যাকে ইঙ্গিত করে এবং অপেক্ষাকৃত ছোট প্রতিকৃতিটি শিশু হত্যাকে ইঙ্গিত করে। মাঝামাঝি আকৃতির প্রতিকৃতিটি মূলত নারীর ওপর হওয়া হত্যাযজ্ঞ ও অমানুষিক নির্যাতনকে তুলে ধরে। মুষ্টিবদ্ধ হাত এ গণহত্যার প্রতি জোরালো নিন্দা জ্ঞাপন করে।
লেখক: রাকিব হাসান | শিক্ষার্থী, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।