Tyrion Lannister
Member
"তুমি কি কখনো কাউকে টুকরো টুকরো করে কেটে খুন করেছ?"
টাকা গোনা থামিয়ে ঠান্ডা চোখে সাইফ সাহেবের দিকে তাকাল রমিজ। বরফশীতল কণ্ঠে উত্তর দিলো সে, "হুম, করছি, দুইবার।"
সাইফ সাহেব বললেন, "কখনো তোমার কোনো টার্গেটকে জীবিত রেখেছ?"
রমিজ টাকা গুনতে গুনতে নির্লিপ্তভাবে বলল, "না। আমি কন্টাক্ট কিলার। কিলার মানে বুঝেন? আমি কাউরে জ্যান্ত রাখি না।"
- এবার একটা ব্যতিক্রম করতে হবে। তোমার টার্গেটকে জীবিত রাখতে হবে। এতগুলো টাকা যখন দিয়েছি তখন আমার কথা শুনতে হবে।
"কারে মারবেন? তার ছবি? জ্যান্তা রাইখা কী করবেন? আমার কী করা লাগবে? খুইলা বলেন।"
সাইফ সাহেব খুব শান্তভাবে বললেন, "আমিই তোমার টার্গেট। তোমাকে শুধু একটা কাজ করতে হবে। আমার দুই হাত কনুই থেকে কেটে ফেলতে হবে। খেয়াল রাখবে যাতে প্রচুর রক্ত বের হয়। পারবে না?"
রমিজ চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইল। এই লোকের মাথায় নিশ্চয়ই গণ্ডগোল আছে। তাতে ওর কী? ওর তো টাকা পেলেই হলো!
"কাটাকাটিতে সমস্যা নাই আমার; বহুত করছি, পারমু। কখন করা লাগবে?"
- এখন কি ফ্রি আছ?
রমিজ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, "ইয়ে, মানে, হ, আছি। এখনি করবেন?"
সাইফ সাহেব নিজের দুই হাতের দিকে তাকিয়ে আছেন। দশটা আঙুলই কাঁপছে। হাত দুটো কাটাকাটির দাগে ভরা। বেশ কিছু জায়গায় ব্লেড ব্যবহার করা হয়েছে; বোঝা যাচ্ছে। কিছু জায়গায় ছালও উঠে গেছে।
"শুরু হয়ে গেছে", বিড়বিড় করে বললেন সাইফ সাহেব।
হঠাৎ করে দুই হাত মুঠো করে টেবিলের উপর গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে ঘুষি মেরে প্রায় চেঁচিয়ে বললেন, "হ্যাঁ, এক্ষুনি করব। এক্ষুনি।"
রমিজ একটা বাক্স এনে সেখান থেকে একটা চাপাতি বের করল। কিছুটা বালি এনে চাপাতিটা ধার দিতে শুরু করল।
সাইফ সাহেব ছটফট করছেন। টেবিলে আরো কয়েকটা ঘুষি মেরে হিসহিসিয়ে বললেন তিনি, "তাড়াতাড়ি করো, প্লিজ তাড়াতাড়ি করো। ওটা শুরু হয়ে যাচ্ছে। আমি আর পারব না।"
রমিজ চাপাতিতে ধার দিতে দিতে বলল, "আপনের ঘটনাটা জানতে বড়ো ইচ্ছা করতেছে। এমন করতেছেন ক্যান? আর কী শুরু হইতেছে?"
- না, সেসব বলা যাবে না। সেটা বললে ব্যথা আরো বাড়ে আমার। প্লিজ, তুমি তাড়াতাড়ি করো।
"ঘটনা না কইলে আমি কাজ করি না। সব কাস্টমারের কাছ থিকাই ঘটনা শুনি আমি। কারো ঘটনা ফাঁস করি না কখনো। আপনি ঘটনা না কইলে আপনার কাজ আমি করমু না।"
সাইফ সাহেব "আ..." বলে চিৎকার করে উঠলেন। টেবিলে সজোরে আরেকটা ঘুষি মারলেন। ছটফট করতে করতে বললেন, "আচ্ছা, বলছি। আমার স্ত্রী ছিল। ও আমাকে অনেক অনেক ভালোবাসত। তবে ওকে আমি আসলেই ভালোবেসেছিলাম কি না জানি না, হয়তো বাসিনি।"
রমিজ চাপাতিতে ধার দেওয়া থামিয়ে সাইফ সাহেবের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগল।
"আমার রাগ ছিল ভয়াবহ রাকমের। সহজেই রেগে যেতাম, একটু বেশিই রেগে যেতাম। ওর সাথে ছোটো ছোটো বিষয়ে রাগারাগি করতাম, আবার নিজেই গিয়ে রাগ ভাঙাতাম। একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখলাম, ও কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। আমাকে দেখেই ফোন কেটে দিয়েছিল ও। প্রথমে তেমন কিছু মনে করিনি। পরে এমনটা আরো ছয়-সাতদিন ধরে ঘটল। আমাকে না জানিয়ে কার সাথে কথা বলত ও? আমি গোপনে ওর ফোন ঘেঁটে দেখলাম আমারই এক কলিগ ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছে। অফিসেও সেই কলিগকে দেখতাম আমার থেকে লুকিয়ে কার সাথে যেন কথা বলছে। তাহলে কি ওদের মধ্যে কিছু চলছিল? মাথায় রক্ত উঠে গেল আমার। রাগে ফেটে যাচ্ছিলাম। সেদিনই বাসায় গিয়ে ঝোঁকের মাথায় বটি দিয়ে খুন করলাম আমার স্ত্রীকে। ওকে কিছু বলার সুযোগই দিলাম না। আমার দুই হাত রক্তে ভরে গিয়েছিল।"
রমিজ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে এই 'ঘটনা' শুনতে লাগল।
"পরে জানতে পেরেছিলাম যে ওরা আমার জন্মদিনে সারপ্রাইজ প্ল্যানিং করছিল। এজন্যই গোপনে কথা বলছিল। এটা শুনে আমার ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম, পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করব। জেলে পচে মরাটাই আমার শাস্তি হওয়া উচিত ছিল। অন্তত এখনকার শাস্তির চেয়ে ঢের ভালো হতো সেটা। কিন্তু কী ভেবে যেন সেটা করলাম না। হয়তো নিজের মান-সম্মান নিয়ে চিন্তা করছিলাম। হয়তো নিজেকে শাস্তি দিতে চাইছিলাম না; স্বার্থপর ছিলাম হয়তো। হয়তো ঈশ্বর চাইছিলেন যে আমি যেন আরো কঠিন কোনো শাস্তি পাই।"
এ পর্যন্ত বলার পরে পেছনে ফিরে সিমেন্টের ওয়ালে একটা ঘুষি মারলেন সাইফ সাহেব। তাঁর হাতটা এখনো কাঁপছে। হাতের ছাল উঠে গিয়ে অল্প রক্ত বেরোচ্ছে।
রমিজ মোহাচ্ছন্নের মতো শুনছে শুধু।
নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন সাইফ, "একদিন বেসিনে হাত ধুতে গিয়ে দেখি হাতে শুকনো রক্ত লেগে আছে। ওকে খুন করার সময় যে রক্ত লেগেছিল সেটাই যেন শুকিয়ে গেছে, এরকম মনে হচ্ছিল। যতই ধোয়ার চেষ্টা করি না কেন, কিছুতেই সে রক্ত ওঠে না। হঠাৎ করে হাত দুটোয় প্রচণ্ড যন্ত্রণা হতে লাগল। যেন ওই রক্ত অনেক বিষাক্ত কোনো কিছু। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত সেই সীমাহীন যন্ত্রণা সয়ে আসছি আমি। সবসময়ই হাতটাকে রক্তাক্ত দেখি আর প্রচণ্ড ব্যথা হতে থাকে হাতে। ব্যথা শুরু হলেই হাতটাকে নানাভাবে কষ্ট দেই। শক্ত কিছুতে ঘুষি মারি বা ব্লেড দিয়ে হাতটাকে ক্ষত-বিক্ষত করি। তাহলে একটু শান্তি লাগে। এই শান্তি শান্তি ভাবটা কিছুক্ষণ থাকে, তারপরে আবার ব্যথা শুরু হয়, আবার হাতটাকে কষ্ট দেই আমি।"
রমিজ এক বিন্দুও নড়ছে না। অপলক দৃষ্টিতে সাইফ সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছে ও। ওর মাথায় আলোড়ন তৈরি করছে কথাগুলো। অদ্ভুত একটা অনুভুতি হচ্ছে ওর।
"সব ধরনের ডাক্তার দেখিয়েছি, পেইন কিলার খেয়েছি, কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। সাইকিয়াট্রিস্ট বলেছিল, এটা পুরোটাই আমার মনের কল্পনা, এমনকি ব্যথাটাও। তাকে আমি আমার স্ত্রীর খুন নিয়ে কিছুই বলিনি। তবে সে বুঝতে পারছিল, আমি তার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছি। সে বলেছিল, কথা লুকালে না কি কখনোই ভালো হবো না আমি। পরে ওই শালার কাছে আর যাইনি। আমি তো জানি, এই হাত দুটো কেটে ফেললেই আমার সব যন্ত্রণা শেষ হয়ে যাবে। যেই হাতকে ক্ষত-বিক্ষত করলে আমার শান্তি লাগে, সেই হাতকে যদি পুরোই কেটে ফেলি তাহলে তো সারা জীবন শান্তি লাগবে, তাই না? আমি আমার শাস্তি থেকেও মুক্তি পাব। তাই আমি তোমার কাছে এসেছি। এই হলো আমার ঘটনা। এবার তাড়াতাড়ি করো। হাত দুটো কেটে দাও, প্লিজ।"
রমিজ ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে আছে সাইফ সাহেবের দিকে। ও কিছু একটা চিন্তা করছে। ওর মাথার শিরা-উপশিরাগুলো দপদপ করছে।
সাইফ সাহেব বিরক্তিভরা গলায় বললেন, "তাকিয়ে দেখছ কী? কাটতে বললাম না?"
রমিজ ওর ডান হাতে চাপাতিটা ধরে আছে। ও চাপাতিটা নিজের মুখের কাছে ধরল। ওর মুখের কিছুটা অংশ দেখা যায় ওতে। হঠাৎ করে দেখল ও, ওখানে আর ওর নিজের প্রতিবিম্ব নেই। অন্য কারো মুখের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে এখন। সেই মুখটা পরিবর্তন হয়ে আরেকটা মুখ এলো। এভাবে একের পর এক মুখ আসতেই লাগল। এই সবগুলো মুখকে চিনতে পারল সে, এর প্রতিবিম্বগুলোকেও চিনতে পারল। এদের সবাইকেই খুন করেছে সে। এদের সবারই চিৎকার শুনেছে সে। মৃত্যুর আগে বিকট চিৎকার দেয় এরা।
"দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী ভাবছিস শুয়োরের বাচ্চা? কথা কানে যাচ্ছে না?" সাইফ সাহেব চেঁচিয়ে বললেন।
রমিজের হাতটা কাঁপতে লাগল। ও দেখল, ওর হাতে প্রচুর রক্ত। রক্তে ভরে গেছে ওর দুই হাত। কোথা থেকে এত রক্ত আসছে সেটা বুঝতে পারল না ও। না কি পারল? তবে ও এটা ঠিকই বুঝতে পারল, এই রক্ত হচ্ছে ওর সবগুলো শিকারের রক্ত। তবে এ কোনো সাধারণ রক্ত নয়। এ রক্তে যেন ওর সবগুলো শিকারের আর্তচিৎকার মিশে আছে। এই রক্তকে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী বিষের চেয়েও বেশি বিষাক্ত মনে হচ্ছে ওর কাছে। ওর দুই হাতে অসীম পরিমাণ ব্যথা হতে লাগল। কোনো জন্তু ওর দুই হাত কামড়ে খেয়ে ফেললেও এত ব্যথা হয়তো সে পেত না।
সাইফ সাহেব ছটফট করতে করতে চিৎকার করে বলছেন, "হাত দুটো কেটে দে। কেটে দে। আর পারছি না। তোকে এত টাকা দিলাম কী করতে?"
রমিজের কানে কিছু যাচ্ছে না। মরণযন্ত্রণায় না কি মানুষ বধির হয়ে যায়। রমিজের হাতে এখনো চাপাতি আছে। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে সে একদৃষ্টে।
সাইফ সাহেব প্রচণ্ড চিৎকার করছেন। একটু পরে আরেকটা অপার্থিব চিৎকার যুক্ত হলো সেই চিৎকারের সাথে।
টাকা গোনা থামিয়ে ঠান্ডা চোখে সাইফ সাহেবের দিকে তাকাল রমিজ। বরফশীতল কণ্ঠে উত্তর দিলো সে, "হুম, করছি, দুইবার।"
সাইফ সাহেব বললেন, "কখনো তোমার কোনো টার্গেটকে জীবিত রেখেছ?"
রমিজ টাকা গুনতে গুনতে নির্লিপ্তভাবে বলল, "না। আমি কন্টাক্ট কিলার। কিলার মানে বুঝেন? আমি কাউরে জ্যান্ত রাখি না।"
- এবার একটা ব্যতিক্রম করতে হবে। তোমার টার্গেটকে জীবিত রাখতে হবে। এতগুলো টাকা যখন দিয়েছি তখন আমার কথা শুনতে হবে।
"কারে মারবেন? তার ছবি? জ্যান্তা রাইখা কী করবেন? আমার কী করা লাগবে? খুইলা বলেন।"
সাইফ সাহেব খুব শান্তভাবে বললেন, "আমিই তোমার টার্গেট। তোমাকে শুধু একটা কাজ করতে হবে। আমার দুই হাত কনুই থেকে কেটে ফেলতে হবে। খেয়াল রাখবে যাতে প্রচুর রক্ত বের হয়। পারবে না?"
রমিজ চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইল। এই লোকের মাথায় নিশ্চয়ই গণ্ডগোল আছে। তাতে ওর কী? ওর তো টাকা পেলেই হলো!
"কাটাকাটিতে সমস্যা নাই আমার; বহুত করছি, পারমু। কখন করা লাগবে?"
- এখন কি ফ্রি আছ?
রমিজ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, "ইয়ে, মানে, হ, আছি। এখনি করবেন?"
সাইফ সাহেব নিজের দুই হাতের দিকে তাকিয়ে আছেন। দশটা আঙুলই কাঁপছে। হাত দুটো কাটাকাটির দাগে ভরা। বেশ কিছু জায়গায় ব্লেড ব্যবহার করা হয়েছে; বোঝা যাচ্ছে। কিছু জায়গায় ছালও উঠে গেছে।
"শুরু হয়ে গেছে", বিড়বিড় করে বললেন সাইফ সাহেব।
হঠাৎ করে দুই হাত মুঠো করে টেবিলের উপর গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে ঘুষি মেরে প্রায় চেঁচিয়ে বললেন, "হ্যাঁ, এক্ষুনি করব। এক্ষুনি।"
রমিজ একটা বাক্স এনে সেখান থেকে একটা চাপাতি বের করল। কিছুটা বালি এনে চাপাতিটা ধার দিতে শুরু করল।
সাইফ সাহেব ছটফট করছেন। টেবিলে আরো কয়েকটা ঘুষি মেরে হিসহিসিয়ে বললেন তিনি, "তাড়াতাড়ি করো, প্লিজ তাড়াতাড়ি করো। ওটা শুরু হয়ে যাচ্ছে। আমি আর পারব না।"
রমিজ চাপাতিতে ধার দিতে দিতে বলল, "আপনের ঘটনাটা জানতে বড়ো ইচ্ছা করতেছে। এমন করতেছেন ক্যান? আর কী শুরু হইতেছে?"
- না, সেসব বলা যাবে না। সেটা বললে ব্যথা আরো বাড়ে আমার। প্লিজ, তুমি তাড়াতাড়ি করো।
"ঘটনা না কইলে আমি কাজ করি না। সব কাস্টমারের কাছ থিকাই ঘটনা শুনি আমি। কারো ঘটনা ফাঁস করি না কখনো। আপনি ঘটনা না কইলে আপনার কাজ আমি করমু না।"
সাইফ সাহেব "আ..." বলে চিৎকার করে উঠলেন। টেবিলে সজোরে আরেকটা ঘুষি মারলেন। ছটফট করতে করতে বললেন, "আচ্ছা, বলছি। আমার স্ত্রী ছিল। ও আমাকে অনেক অনেক ভালোবাসত। তবে ওকে আমি আসলেই ভালোবেসেছিলাম কি না জানি না, হয়তো বাসিনি।"
রমিজ চাপাতিতে ধার দেওয়া থামিয়ে সাইফ সাহেবের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগল।
"আমার রাগ ছিল ভয়াবহ রাকমের। সহজেই রেগে যেতাম, একটু বেশিই রেগে যেতাম। ওর সাথে ছোটো ছোটো বিষয়ে রাগারাগি করতাম, আবার নিজেই গিয়ে রাগ ভাঙাতাম। একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখলাম, ও কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। আমাকে দেখেই ফোন কেটে দিয়েছিল ও। প্রথমে তেমন কিছু মনে করিনি। পরে এমনটা আরো ছয়-সাতদিন ধরে ঘটল। আমাকে না জানিয়ে কার সাথে কথা বলত ও? আমি গোপনে ওর ফোন ঘেঁটে দেখলাম আমারই এক কলিগ ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছে। অফিসেও সেই কলিগকে দেখতাম আমার থেকে লুকিয়ে কার সাথে যেন কথা বলছে। তাহলে কি ওদের মধ্যে কিছু চলছিল? মাথায় রক্ত উঠে গেল আমার। রাগে ফেটে যাচ্ছিলাম। সেদিনই বাসায় গিয়ে ঝোঁকের মাথায় বটি দিয়ে খুন করলাম আমার স্ত্রীকে। ওকে কিছু বলার সুযোগই দিলাম না। আমার দুই হাত রক্তে ভরে গিয়েছিল।"
রমিজ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে এই 'ঘটনা' শুনতে লাগল।
"পরে জানতে পেরেছিলাম যে ওরা আমার জন্মদিনে সারপ্রাইজ প্ল্যানিং করছিল। এজন্যই গোপনে কথা বলছিল। এটা শুনে আমার ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম, পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করব। জেলে পচে মরাটাই আমার শাস্তি হওয়া উচিত ছিল। অন্তত এখনকার শাস্তির চেয়ে ঢের ভালো হতো সেটা। কিন্তু কী ভেবে যেন সেটা করলাম না। হয়তো নিজের মান-সম্মান নিয়ে চিন্তা করছিলাম। হয়তো নিজেকে শাস্তি দিতে চাইছিলাম না; স্বার্থপর ছিলাম হয়তো। হয়তো ঈশ্বর চাইছিলেন যে আমি যেন আরো কঠিন কোনো শাস্তি পাই।"
এ পর্যন্ত বলার পরে পেছনে ফিরে সিমেন্টের ওয়ালে একটা ঘুষি মারলেন সাইফ সাহেব। তাঁর হাতটা এখনো কাঁপছে। হাতের ছাল উঠে গিয়ে অল্প রক্ত বেরোচ্ছে।
রমিজ মোহাচ্ছন্নের মতো শুনছে শুধু।
নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন সাইফ, "একদিন বেসিনে হাত ধুতে গিয়ে দেখি হাতে শুকনো রক্ত লেগে আছে। ওকে খুন করার সময় যে রক্ত লেগেছিল সেটাই যেন শুকিয়ে গেছে, এরকম মনে হচ্ছিল। যতই ধোয়ার চেষ্টা করি না কেন, কিছুতেই সে রক্ত ওঠে না। হঠাৎ করে হাত দুটোয় প্রচণ্ড যন্ত্রণা হতে লাগল। যেন ওই রক্ত অনেক বিষাক্ত কোনো কিছু। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত সেই সীমাহীন যন্ত্রণা সয়ে আসছি আমি। সবসময়ই হাতটাকে রক্তাক্ত দেখি আর প্রচণ্ড ব্যথা হতে থাকে হাতে। ব্যথা শুরু হলেই হাতটাকে নানাভাবে কষ্ট দেই। শক্ত কিছুতে ঘুষি মারি বা ব্লেড দিয়ে হাতটাকে ক্ষত-বিক্ষত করি। তাহলে একটু শান্তি লাগে। এই শান্তি শান্তি ভাবটা কিছুক্ষণ থাকে, তারপরে আবার ব্যথা শুরু হয়, আবার হাতটাকে কষ্ট দেই আমি।"
রমিজ এক বিন্দুও নড়ছে না। অপলক দৃষ্টিতে সাইফ সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছে ও। ওর মাথায় আলোড়ন তৈরি করছে কথাগুলো। অদ্ভুত একটা অনুভুতি হচ্ছে ওর।
"সব ধরনের ডাক্তার দেখিয়েছি, পেইন কিলার খেয়েছি, কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। সাইকিয়াট্রিস্ট বলেছিল, এটা পুরোটাই আমার মনের কল্পনা, এমনকি ব্যথাটাও। তাকে আমি আমার স্ত্রীর খুন নিয়ে কিছুই বলিনি। তবে সে বুঝতে পারছিল, আমি তার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছি। সে বলেছিল, কথা লুকালে না কি কখনোই ভালো হবো না আমি। পরে ওই শালার কাছে আর যাইনি। আমি তো জানি, এই হাত দুটো কেটে ফেললেই আমার সব যন্ত্রণা শেষ হয়ে যাবে। যেই হাতকে ক্ষত-বিক্ষত করলে আমার শান্তি লাগে, সেই হাতকে যদি পুরোই কেটে ফেলি তাহলে তো সারা জীবন শান্তি লাগবে, তাই না? আমি আমার শাস্তি থেকেও মুক্তি পাব। তাই আমি তোমার কাছে এসেছি। এই হলো আমার ঘটনা। এবার তাড়াতাড়ি করো। হাত দুটো কেটে দাও, প্লিজ।"
রমিজ ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে আছে সাইফ সাহেবের দিকে। ও কিছু একটা চিন্তা করছে। ওর মাথার শিরা-উপশিরাগুলো দপদপ করছে।
সাইফ সাহেব বিরক্তিভরা গলায় বললেন, "তাকিয়ে দেখছ কী? কাটতে বললাম না?"
রমিজ ওর ডান হাতে চাপাতিটা ধরে আছে। ও চাপাতিটা নিজের মুখের কাছে ধরল। ওর মুখের কিছুটা অংশ দেখা যায় ওতে। হঠাৎ করে দেখল ও, ওখানে আর ওর নিজের প্রতিবিম্ব নেই। অন্য কারো মুখের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে এখন। সেই মুখটা পরিবর্তন হয়ে আরেকটা মুখ এলো। এভাবে একের পর এক মুখ আসতেই লাগল। এই সবগুলো মুখকে চিনতে পারল সে, এর প্রতিবিম্বগুলোকেও চিনতে পারল। এদের সবাইকেই খুন করেছে সে। এদের সবারই চিৎকার শুনেছে সে। মৃত্যুর আগে বিকট চিৎকার দেয় এরা।
"দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী ভাবছিস শুয়োরের বাচ্চা? কথা কানে যাচ্ছে না?" সাইফ সাহেব চেঁচিয়ে বললেন।
রমিজের হাতটা কাঁপতে লাগল। ও দেখল, ওর হাতে প্রচুর রক্ত। রক্তে ভরে গেছে ওর দুই হাত। কোথা থেকে এত রক্ত আসছে সেটা বুঝতে পারল না ও। না কি পারল? তবে ও এটা ঠিকই বুঝতে পারল, এই রক্ত হচ্ছে ওর সবগুলো শিকারের রক্ত। তবে এ কোনো সাধারণ রক্ত নয়। এ রক্তে যেন ওর সবগুলো শিকারের আর্তচিৎকার মিশে আছে। এই রক্তকে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী বিষের চেয়েও বেশি বিষাক্ত মনে হচ্ছে ওর কাছে। ওর দুই হাতে অসীম পরিমাণ ব্যথা হতে লাগল। কোনো জন্তু ওর দুই হাত কামড়ে খেয়ে ফেললেও এত ব্যথা হয়তো সে পেত না।
সাইফ সাহেব ছটফট করতে করতে চিৎকার করে বলছেন, "হাত দুটো কেটে দে। কেটে দে। আর পারছি না। তোকে এত টাকা দিলাম কী করতে?"
রমিজের কানে কিছু যাচ্ছে না। মরণযন্ত্রণায় না কি মানুষ বধির হয়ে যায়। রমিজের হাতে এখনো চাপাতি আছে। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে সে একদৃষ্টে।
সাইফ সাহেব প্রচণ্ড চিৎকার করছেন। একটু পরে আরেকটা অপার্থিব চিৎকার যুক্ত হলো সেই চিৎকারের সাথে।