অত্যন্ত দুঃখ এবং হতাশার সাথে বলতে হয়… আমাদের বর্তমান সময়ের গুণী থেকে মাঝারি, কেউই কেন জানি মুক্তিযুদ্ধভিক্তিক কিংবা সেই সময়কার প্রেক্ষাপটকে ঘিরে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোতে, মুক্তিযুদ্ধের আবেদন শতভাগ নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরতে পারছে না। একইসাথে এও বলতে হয়, বর্তমান সময়ের সাথে খাপ খায় এমন নির্মাণ এসময়ে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধভিক্তিক চলচ্চিত্রগুলোতে খুঁজে পাওয়া যায় যাচ্ছে না। সারাবিশ্বের চলচ্চিত্র যেখানে প্রযুক্তির সুবিধা কাজে লাগিয়ে যতটা সম্ভব সুন্দর উপস্থাপনার সহিত বেশি বেশি পিরিয়ড ঘরানার চলচ্চিত্র বানিয়ে যাচ্ছে , সেই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা যা বানাচ্ছি, এগুলোর নাম হয়তো দুই-তিন বছর পর কারো মনেও থাকবে না।
আমরা মনে হয় ভুলে গেছি, যখন আমরা প্রযুক্তির দিক থেকে দুর্বল ছিলাম, তখন আমাদের দেশে চাষী নজরুল ইসলাম ‘ওরা ১১ জন’, ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, ‘মেঘের পরে মেঘ’ এর মতো হৃদয় স্পর্শ করা চলচ্চিত্র বানিয়েছেন। ‘ওরা ১১ জন’ এ দেখেছি একজন অকুতোভয় যুবককে, যিনি আর ১০ জনকে সঙ্গী করে ঝাপিয়ে পড়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রে। ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ এ দেখেছি এক মায়ের তিন কোরবানি, যে প্রতিবন্দী ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে তার কোনো আশা-প্রত্যাশা ছিল না, তাকেও তিনি শহীদ বানিয়ে ছেড়েছেন! ‘মেঘের পরে মেঘ’ এ দেখেছি কীভাবে একজন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধের পরেও সমাজ সংস্কার করতে গিয়ে ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়।
সুভাষ দত্ত ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ তে দেখিয়েছেন, যারা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি, পরবর্তীতে তারা কীভাবে আফসোস করে মানসিক দিক থেকে অসুস্থ হয়ে গিয়েছেন।
আলমগীর কবির তার ‘ধীরে বহে মেঘনা’য় পুরো যুদ্ধকেই যেনো ডকুমেন্টরি ষ্টাইলে আমাদের সামনে জীবিত করলেন।
খান আতাউর রহমান ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ‘এখনো অনেক রাত’ বানিয়ে এই বার্তা আমাদের দিলেন, স্বাধীনতা অর্জনের থেকে স্বাধীনতা রক্ষা করা অনেক কঠিন, যা আমরা এখনো মাধ্যমিকে ভাবসম্প্রসারণ হিসেবে পড়ে থাকি।
নারায়ণ ঘোষ মিতা ‘আলোর মিছিল’ এর মতো হৃদয়স্পর্শী চলচ্চিত্র দিয়ে দেখালেন পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আদর্শগত মতপার্থক্য থাকলে তার পরিণতি কতটা ভয়াবহ হয়।
ছন্দের জাদুকর হুমায়ুন আহমেদ দেখিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মধ্যবিত্তের জীবনযুদ্ধ। এ এক অন্যরকম যুদ্ধ, যা মুখে প্রকাশ করার মতো না। তাও তিনি সেই মানসিক যুদ্ধ সেসময়ের দুর্বল প্রযুক্তি দিয়ে আমাদের দেখিয়েছেন।
নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, যিনি বানিয়েছেন ‘একাত্তরের যীশু’ ও ‘গেরিলা’। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে সমাজের গণ্যমান্য মুনিরা একেকটা হিপোক্রেট সেজে আমাদের সবাইকে নাচাচ্ছে, যার খেসারত সাধারণ মানুষদের দিতে হয় যীশু সেজে। গেরিলাতে দেখেছি একজন সাধারণ মেয়ে কীভাবে পুরো সিস্টেমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
মোরশেদুল ইসলাম তার পরিচালিত ‘আমার বন্ধু রাশেদ’, ‘অনীল বাগচীর একদিন’ এর মাধ্যমে কিশোরদের মুক্তিযুদ্ধ দেখিয়েছেন। তানভীর মোকাম্মেল তার পরিচালিত ‘নদীর নাম মধুমতি’তে আমাদের দেখিয়েছেন মধুমতি নদীর তীরে গড়ে ওঠা গ্রামটির ভেতরকার অন্ধকার অবস্থা। ‘রাবেয়া’ তে দেখিয়েছেন এক নারীর প্রতিবাদী বীরাঙ্গনা হয়ে ওঠার গল্প। মোরশেদুল ইসলামের ‘অনীল বাগচীর একদিন’ এবং তানভীর মোকাম্মেলের ‘জীবনঢুলি’র নির্মাণ আমার ততটা ভালো লাগেনি, তবুও সেখানে একটি ক্লিয়ার মেসেজ ছিল। যা বুঝতে কোনো দর্শকের অসুবিধা হয়নি।
কিন্তু এখনকার সময়ে যা হচ্ছে সেগুলোতে যুদ্ধকেন্দ্রিক গল্প গ্লোরিফাই হচ্ছে না, গ্লোরিফাই করা হচ্ছে অন্যকিছু। আর এই ধরনের চলচ্চিত্রের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়, যার বেশিরভাগ রয়েছে মুক্তির অপেক্ষায়। দুর্বল অর্থনীতি ও প্রযুক্তির যুগে আমরা এতো এতো ভিন্নধর্মী ও ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ মুক্তিযুদ্ধভিক্তিক চলচ্চিত্র উপহার দিতে পেরেছি। এইরকম অতীতকে সঙ্গে নিয়ে কেন আমাদের দেশের গল্পকারেরা ২০২১ এ এসে চুপসে গেলাম? আসলেই কি বর্তমান রাজনৈতিক প্রেসার অনেক বেশি? এই প্রেসার কি জহির রায়হানের আমলের থেকেও বেশি? উত্তর এখনকার সময়ে কেউ জানতে না চাইলেও ভবিষ্যত প্রজন্মের কেউ না কেউ অবশ্যই জানতে চাইবে।
আমাদের নির্মাতাদের গল্প বলার ক্ষেত্রে আরো স্মার্ট হতে হবে। বলা হয় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের চোখ এবং মস্তিষ্ক হয়ে থাকে একজন অভিজ্ঞ দার্শনিকের মতো। সেই দার্শনিক দৃষ্টি বাংলা চলচ্চিত্রের দ্রুত ফিরে পাওয়া জরুরি। নয়তো এই জন্মে মনে হয় না আমরা আর ঘাড় বাঁকা করে ঘুরে দাঁড়াতে পারবো…