নাসিরুদ্দিন হোজ্জা তথা মোল্লা নাসিরুদ্দিনের নাম শোনেননি এমন মানুষ বিরল। তাকে কিংবদন্তি বললেও কম বলা হবে। বিশ্বের এমন কোনো প্রান্ত নেই যেখানে নাসিরুদ্দিন হোজ্জার গল্প প্রচলিত নয়। হোজ্জাকে নিয়ে এক হাজারেরও বেশি গল্প চালু আছে। নাসিরুদ্দিনের উপস্থিত বুদ্ধি ও বিজ্ঞতার খ্যাতি দেশ ও কালের সীমানা ছাড়িয়েছে। কোনো গল্পে তাকে খুব বুদ্ধিমান একজন মানুষ মনে হয়। আবার কোনো গল্পে তার আচরণ একেবারেই বোকা ও নেহাতই সাদাসিধে মানুষ হিসেবে। তবে তিনি সারাবিশ্বে পরিচিতি পেয়েছেন তার রসবোধের কারণে। তার কথাবার্তা আমাদের যেমন হাসায়, তেমনি ভাবায়ও বটে। ফলে নাসিরুদ্দিন মহাবুদ্ধিমান নাকি মহাবোকা ছিলেন তা নিয়ে জল্পনাকল্পনার শেষ নেই। তবে আসল ঘটনা যাই হোক, নাসিরুদ্দিনের গল্পগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষকে নির্মল আনন্দ জুগিয়ে আসছে। মোল্লা নাসিরুদ্দিনের বিশাল গল্পসম্ভার থেকে মজার কয়েকটি এখানে গ্রন্থিত করার চেষ্টা করা হল মাত্র।
গল্প ১
একদিন এক আত্নীয় এসে নাসিরুদ্দিনকে একটা হাঁস উপহার দিলো। নাসিরুদ্দিন ভারী খুশি হয়ে সেটার মাংস রান্না করে তাকে খাওয়ালো।
কয়েকদিন পরে মোল্লাসাহেবের কাছে একজন লোক এসে বললো, আপনাকে যিনি হাঁস দিয়েছিলেন, আমি তার বন্ধু।
নাসিরুদ্দিন তাকেও মাংস খাওয়ালো।
এর পর আরেকদিন আরেকজন এসে বলে, আপনাকে যিনি হাঁস দিয়েছিলেন, আমি তার বন্ধুর বন্ধু। নাসিরুদ্দিন তাকেও খাওয়ালো।
তারপর আরেকদিন এল বন্ধুর বন্ধুর বন্ধু। মোল্লাসাহেব তাকেও খাওয়ালো।
এর কিছুদিন পরে আবার দরজায় টোকা পড়ল। আপনি কে? দরজা খুলে জিজ্ঞেস করলো নাসিরুদ্দিন।
আজ্ঞে মোল্লাসাহেব, যিনি আপনাকে হাঁস দিয়েছিলেন, আমি তার বন্ধুর বন্ধুর বন্ধুর বন্ধু।
ভেতরে আসুন, বললো নাসিরুদ্দিন, খাবার তৈরিই আছে।
অতিথি মাংসের ঝোল দিয়ে পোলাও মেখে একগ্লাস খেয়ে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কীসের মাংস মোল্লাসাহেব?
হাঁসের বন্ধুর বন্ধুর বন্ধুর বন্ধুর, নাসিরুদ্দিন নিরুত্তাপ কন্ঠে জবাব দিলেন।
গল্প ২
নাসিরউদ্দিনের পুরনো বন্ধু আইনুল্লাহ দূর গ্রাম থেকে বেড়াতে এসেছেন বন্ধুর বাড়িতে। নাসিরউদ্দিন চাইলেন কিছু পরিচিতজনের সঙ্গে বন্ধুকে পরিচয় করিয়ে দিতে। আইনুল্লাহ বললেন, ‘আমার পোশাক আশাকের অবস্থা সুবিধার নয়, তোমার পাগড়িটা আমাকে ধার দাও।’
নাসিরউদ্দিন নিজের পাগড়ি বন্ধুকে পরিয়ে দিয়ে তাকে নিয়ে ঘুরতে বেরুলেন। এক পরিচিতের বাড়িতে গিয়ে বললেন, ‘এই হল আমার বন্ধু আইনুল্লাহ। সে যে পাগড়িটা পড়েছে সেটা আমার।’
সে বাড়ি থেকে বিদায় নেয়ার পর আইনুল্লাহ মন খারাপ করে বললেন, ‘বন্ধু, পাগড়িটা যে তোমার সেটা ওই লোককে না বললে কি চলছিল না! দয়া করে এরপর যে বাড়িতে যাব সেখানে গিয়ে এটা বলো না।’
যে কথা সেই কাজ। পরবর্তী বাড়িতে গিয়ে নাসিরউদ্দিন বললেন, ‘এই হল আমার বন্ধু আইনুল্লাহ, এবং সে যে পাগড়িটা পড়েছে সেটি আমার নয়, তার নিজের।’
সেখান থেকে বেরুনোর পরও আইনুল্লাহর মুখ বেজার। বন্ধুকে তিনি বললেন, ‘পাগড়িটা তোমার নাকি আমার এটা কেন টেনে আনতে হবে বুঝলাম না। দয়া করে এই কাজটা আর করো না।’
নাসিরউদ্দিন মাথা নাড়লেন এবং পরবর্তী বাড়িতে গিয়ে বললেন, ‘এই হল আমার বন্ধু আইনুল্লাহ। তার মাথায় যে পাগড়িটা দেখছেন সেটা আমার নাকি তার এ বিষয়ে আমি কোনো কথা বলব না।’
গল্প ৩
রাজদরবারে নাসিরুদ্দিনের খুব খাতির।
একদিন খুব খিদের মুখে বেগুন ভাজা খেয়ে ভারী খুশি হয়ে রাজা নাসিরুদ্দিনকে বললেন, বেগুনের মতো এমন সুস্বাদু খাদ্য আর আছে কি?
বেগুনের জবাব নেই, বললে নাসিরুদ্দিন।
রাজা হুকুম দিলেন, এবার থেকে রোজ বেগুন খাব।
তারপর পাঁচদিন দু’বেলা করে বেগুন খেয়ে ছ’দিনের দিন রাজা হঠাৎ বেঁকে বসলেন। খানসামাকে ডেকে বললেন, দূর করে দে আমার সামনে থেকে এই বেগুন ভাজা।
বেগুন অখাদ্য, সায় দিয়ে বললে নাসিরুদ্দিন।
রাজা একথা শুনে ভারী অবাক হয়ে বললেন, সে কী মোল্লাসাহেব, তুমি যে এই সেদিনই বললে বেগুনের জবাব নেই!
আমি তো আপনার মোসাহেব, জাঁহাপনা, বললেন নাসিরুদ্দিন, বেগুনের তো নই।