ঈদ বা আনন্দের কোনো বয়স নেই। যখন ছোট ছিলাম, তখন ওই ছোট আমার ভেতরের মানুষটা চারপাশের সব কার্যকারণেই বিস্মিত হতো। আবার দুই যুগের বেশি সময় কাটিয়ে এসে এখনো আমি বিস্মিত হই, কিন্তু এই দুই বিস্ময় কোনোভাবেই এক নয়।
ছোটবেলার ঈদে নতুন জামা কেনাতেই ছিল বড় আনন্দ। যেন জামাকাপড় কেনার সেই উচ্ছ্বাসময় দিনগুলো আজও লেপটে আছে আমার মনের গহিনে। কখন নতুন পোশাক কেনা হবে, রোজার শুরু থেকেই শুরু হতো দিন গোনা। তখন আমরা থাকতাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকা আসতাম ঈদের পোশাক কিনতে। শুধু কি জামা? নতুন জামার সঙ্গে রং মিলিয়ে জুতা, চুলের ক্লিপ—আনন্দের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠার কী এক প্রাণান্তকর চেষ্টা ছিল ছোটবেলায়। নতুন জামা কেনার পর সবাইকে দেখিয়ে সেটার প্রদর্শনী না করা পর্যন্ত মনই ভরত না। আমার তখন ছিল ছোট ছোট বিষয়ের আনন্দ। অপার্থিব আনন্দ।
তবে এখন লিখতে বসেছি অতারকা ও তারকাজীবনের ঈদ নিয়ে। প্রথমেই বলে রাখি, এই তারকা বা ‘সেলিব্রিটি’ শব্দটি আমাকে ঠিক আরাম দেয় না, হয়তো তার অতিব্যবহারের কারণে। রবিঠাকুর যেমন বলেছিলেন, ‘ভালো কম বলেই তা ভালো। না হয় নিজের ভিড়ে হয়ে যেত মাঝারি।’ তো এই প্রচলিত ‘সেলিব্রিটি’ মম এখনো সেই আনন্দই করতে চাই ঈদ বা পূজার সময় এলে।
বেড়ে উঠেছিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আলো-হাওয়ায়। শহরের সুরসম্রাট দ্য আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গনেই তো আমার সংস্কৃতিচর্চার শুরু। আড্ডায়, গানে, কবিতায়, অভিনয়ে আর নাচের ছন্দে তখন ঈদের আনন্দের মতোই উচ্ছল থাকতাম সব সময়। কিন্তু আমার শিক্ষাজীবনের সেই প্রথম প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে এখন আগুনে পোড়ার ছাপ। পুড়ে যাওয়া বাদ্যযন্ত্র, শতরঞ্জি ও বই নিমেষেই আমার জগৎজুড়ে ছড়িয়ে দেয় আতঙ্ক, অনিরাপত্তা। এই বাস্তবতার ভেতরে এখন ভাবতে বসেছি নিজের দুই জীবনের ঈদের কথা।
ছোটবেলায় ঈদের সময় মা-বাবাকে অনেক খাটিয়েছি। কত কত বায়না ছিল তখন! সে সময় আমার ঈদগুলোও ছিল অন্য সবার মতো। ঈদের দিন বাসার কাজকর্মে সহায়তা করা আর বন্ধুবান্ধব ও নিকট আত্মীয়দের বাসায় হাজিরা দেওয়া—চিত্র ছিল এমনই। কখনো-বা এদিনে বাবার সঙ্গে পুরো ব্রাহ্মণবাড়িয়া টইটই করে ঘুরে বেড়াতাম, তিনি যেখানে যেতেন, তাঁর আঙুল ধরে আমিও যেতাম সেদিকে। আর রাতে বাড়ির সবাই মিলে একসঙ্গে টেলিভিশনে ঈদের অনুষ্ঠান দেখার মধ্যেও ছিল অন্য রকম এক আনন্দ।
কলেজে পড়াকালেই যেন আমি বড় হয়ে গেলাম। নাচ করতাম। তাই যৎসামান্য রোজগারও শুরু করি এ সময়ে। তো, এই সময়েই এক ঈদে জীবনে প্রথমবারের মতো মা-বাবা আর ভাইয়ের জন্য জামাকাপড় কিনেছিলাম। ওই সামান্য পয়সায় নিজের পরিবারকে প্রথমবার কিছু দিতে পেরে কী যে শান্তি পেয়েছিলাম!
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছর থেকেই ‘তারকা’ তকমা লেগে গেল আমার গায়ে। এ সময় আগের স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনে একটু ব্যাঘাত কি ঘটল না? ঘটল তো বটেই। সেই জীবনের ঈদের কথা যদি বলি, শুরু হলো কিছুটা আনুষ্ঠানিক এক ধরাবাঁধা জীবন। তবে আনুষ্ঠানিকতা মেনে কিছু করা আমার তেমন ধাতে নেই। তাই আমি ওই ‘মাপা হাসি’র আনুষ্ঠানিক জীবনে আটকে থাকিনি। এখনো আমি নিজের মতোই থাকি ঈদের দিনে। নিজের ঘরদোর গোছগাছ করে আম্মার বাসায় যাই। আমার নিজস্ব এক বন্ধুবৃত্ত আছে; হয় তারা বাসায় আসে, না হয় তাদের বাসায় যাই, আড্ডা দিই—এভাবেই কেটে যায় ঈদের সময়।
তারকা আর অতারকার জীবন—এই দুইয়ের ঈদের ফারাক সম্পর্কে বলতে গেলে বলব, আগের জীবনে কোনো দায়িত্ব ছিল না, এখন নানা রকম দায়িত্ব চেপেছে কাঁধে। চারপাশের আনন্দকেই এখন বড় মনে হয়। সবার আনন্দে নিজের আনন্দটা বড় হয়। নিজের জন্য নয়, বরং সন্তানের জন্য কেনাকাটা করাতেই এখন আনন্দ। যেমন আমার ছেলে উদ্ভাস এবার আমার কাছে অন্য কিছু চায়নি, ঈদ উপহার হিসেবে চেয়েছে দুটো বই। ওকে তা দিয়েছি। এতে ওর ভেতরে যে খুশি দেখেছি, তাতেই আমার ষোলোআনা ঈদের আনন্দ হয়ে গেছে। ছেলে, মা-বাবা, বন্ধু—এই মানুষগুলোর ভালো লাগার মতো কিছু করতে পারার মধ্যেই এখন পূর্ণতা পায় আমার ঈদ।
শিশুকালে খুবই সরল ভঙ্গিতে আমাকে চমকে দিত যে আনন্দ, জীবনে একবার হলেও সেই নির্ভার আনন্দের কাছে আমি ফিরতে চাই। আহা, কে আমাকে ফিরিয়ে দেবে সেই নির্মল ঈদের ক্ষণ!