বেশ কয়েক বছর ধরে চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধ চলছে। করোনাভাইরাস চীন থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ায় ট্রাম্প বেশ কয়েকবার একে “চায়না ভাইরাস” নামে অভিহিত করেছেন। ট্রাম্পের সুরে তাল মিলিয়ে অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, জাপান চীনের বিরুদ্ধে একই কাতারে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি লাদাখ সীমান্তে ভারতের সাথে চীন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এর প্রেক্ষিতে ভারতবাসী “বয়কট চায়না” শ্লোগানে বেশ কিছুদিন দেশ কাঁপিয়েছে। কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও চীন “কুচ পরোয়া নেহি” মনোভাব নিয়ে তাদের শক্তিশালী অর্থনীতি আরও শক্তিশালী করার দিকে জোর কদমে এগিয়ে যাচ্ছে।
চীনের পররাষ্ট্রনীতি কিংবা অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকার কল্যাণে “আগ্রাসী” চীনকে সবাই চেনে। কিন্তু এই দেশের বর্তমান নীতি বুঝতে হলে অতীতের দিকেও একটু ফিরে তাকাতে হবে। ১৮৩৯ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত চীনের “দ্য সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশন” সময়কালে চলুন আপনাদের ঘুরিয়ে আনা যাক।
দ্য সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশন
চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বেশ কয়বার তার ভাষণে “দ্য সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশন”- এর কথা উল্লেখ করেছেন। ১৯৪৯ সালে পিপল’স রিপাবলিক অফ চায়না প্রতিষ্ঠার আগে প্রায় ১১০ বছর চীনের ইতিহাস ছিল পরাজয়ের আবর্তে আবদ্ধ। পশ্চিমা বিশ্ব, জাপান, রাশিয়ার হস্তক্ষেপে চীনকে ভোগ করতে হয়েছে পরাধীনতার তিক্ত স্বাদ।
২ হাজার বছরের বেশি সময় ধরে চীনে বিভিন্ন রাজ বংশের শাসন চলে আসছিল। আবিষ্কার ও প্রযুক্তিতে অন্যদের চেয়ে এগিয়েই ছিল। কিন্তু ১৭৬০ সাল থেকে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হওয়া শিল্প বিপ্লব পৃথিবীর হিসেব নিকেশ সব পাল্টে দিতে শুরু করে। গ্রেট বৃটেন হয়ে উঠে মহা শক্তিধর। অর্থ ও প্রযুক্তিতে অন্যদের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে যাওয়ায় তারা পুরো পৃথিবীব্যাপী নিজেদের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করা শুরু করে। অন্য দেশকে বাধ্য করে তাদের কথা মতো বাণিজ্য চুক্তি করতে। গ্রেট বৃটেনের লোলুপ দৃষ্টি থেকে চীনও বাদ যায় নি। কিন্তু সে সময় চীনের রাজারা বিশ্বাস করতো তাদের ভূমি প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা। অন্য কারো সাথে ব্যবসা করার কোন প্রয়োজন তাদের নেই। জীবন ধারণের জন্য যা যা দরকার তার সবই তাদের মাটিতে আছে।
গ্রেট বৃটেনের রাজা জর্জ-৩ ১৭৯২ সালে অনেক উপহার পাঠিয়ে চীনের ছিয়ানলং (Qianlong) রাজবংশের সম্রাটকে চীনের বাণিজ্য নীতি অবমুক্ত করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু চীনের সম্রাট সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।
দ্য ক্যান্টন সিস্টেম
১৭৫৭-১৮৪২ সাল পর্যন্ত অন্য দেশের সাথে বাণিজ্য করার মাধ্যম হিসেবে চীনে ক্যান্টন সিস্টেম চালু ছিল। ক্যান্টন (বর্তমান গুয়াংযু) চীনের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চল। এই সিস্টেম অনুযায়ী, ক্যান্টন শহরের কোহং (Cohong) নামক স্থানীয় চাইনিজ গোষ্ঠীর লোকেরা পশ্চিমাদের থেকে পণ্য কিনে চাইনিজদের কাছে বিক্রি করতো। আবার চাইনিজদের থেকে পণ্য কিনে সেটি পশ্চিমাদের কাছে বিক্রি করতো। মাঝে মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে তারা অনেক মুনাফা করতো।
বৃটিশদের এভাবে বাণিজ্য করা পছন্দ ছিল না। তারা আরও মুক্তভাবে বাণিজ্য করতে চাইছিল। এদিকে চাইনিজ চায়ের চাহিদা বৃটেনে দিনকে দিন বাড়ছিল। বৃটিশরা চীন থেকে চা কিনলেও চীনের কাছে বিক্রি করার মতো কোন পণ্য তাদের হাতে ছিল না। উপরন্তু চীন চায়ের বদলে বৃটিশদের থেকে নিতো সিলভার। বৃটেন সোনার বিনিময়ে স্প্যানিশদের থেকে সিলভার কিনে সেটি চীনে পাঠাতো। এভাবে চা কেনা বৃটেনের অর্থনীতির জন্য ছিল সুখকর ছিল না। তাই নিজেদের অর্থনীতি বাঁচাতে বৃটেন ঘৃণ্য এক চাল চালে। তারা ভারতের মাটিতে আফিম চাষ করে চায়নায় পাঠানো শুধু করে। এতে লক্ষ লক্ষ চাইনিজ ভয়াবহভাবে আফিমে আসক্ত হয়ে পড়ে।
প্রথম আফিম যুদ্ধ
চাইনিজ রাজারা অনেকবার আফিম নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু তবুও অবৈধভাবে আফিমের আনা-নেওয়া থামছিল না। তাই ১৮৩৯ সালে তারা ক্যান্টন শহরে থাকা আফিমের সব গুদাম জ্বালিয়ে দেয়। এতে বৃটিশরা ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের আধুনিক জাহাজ দিয়ে চীনের পূর্ব উপকূলীয় সব অঞ্চলে হামলা করে। বৃটিশ নেভির সামনে পুরনো আমলের জাহাজ ও অস্ত্র নিয়ে চাইনিজ নেভি দাঁড়াতেই পারে নি। বৃটেন এই যুদ্ধে ক্যান্টন থেকে পিকিং পর্যন্ত সমস্ত উপকূলীয় এলাকায় হামলা করে।
প্রথম আফিম যুদ্ধে বৃটেনের আধুনিক নেভির কাছে নাস্তানাবুদ হয় চীন
চীন এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বৃটেনের সাথে “ট্রিটি অফ নানকিং” নামক একটি চুক্তি করে। এই চুক্তি অনুযায়ী বৃটেন হংকং এর দখল নেয়। সেই সাথে চায়না বাধ্য হয় তাদের ৫টি বন্দরে আফিম বাণিজ্য বৈধ করে দিতে। এই যুদ্ধের ফলে ক্যান্টন শহর থেকে বৃটিশদের চাওয়া মতো মধ্যস্বত্বভোগী কোহংদের সরিয়ে দিয়ে সরাসরি বাণিজ্য শুরু হয়। আর ক্ষতিপূরণ হিসেবে চীনকে গুনতে হয় মোটা অঙ্কের জরিমানা।
পরাজয়ের মিছিল
বৃটেনের আফিমবাহী এক জাহাজ আটকে দেয়াকে কেন্দ্র করে ১৮৫৬ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত চলে দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ। এ যুদ্ধেও চীন পরাজিত হয়। এবার বৃটিশ সৈন্যরা চাইনিজ রাজার সামার প্যালেস নিজেদের দখলে নেয়। বৃটিশদের সাথে চীন দখলে যুক্ত হয় ইউরোপের আরেক শক্তিশালী দেশ ফ্রান্স। ১৮৮৪-১৮৮৫ সালে চলা সিনো-ফ্রেঞ্চ যুদ্ধে বরাবরের মতো চীন পরাজিত হয়। ১৮৯৪-১৮৯৫ সালে সংগঠিত প্রথম সিনো-জাপানিজ যুদ্ধেও পরাজিত দলের নাম চীন।
এত সব পরাজয়ের পর চীন নিজেদের মাটিতে এক রকম পরাধীন হয়ে পড়ে। বিশাল অঙ্কের জরিমানা, নিজেদের সব বন্দর বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া সহ চীনের নিয়ন্ত্রণ পুরোটা পশ্চিমা শক্তিদের হাতে চলে যায়। যে যার ইচ্ছামতো চীনকে ভাগ করতে থাকে। আর একের পর এক অসম চুক্তি দিয়ে চীনকে লুট করতে থাকে তারা। এই সব অসম চুক্তির এক ঝলক আগ্রহী পাঠকরা দেখে নিতে পারেন এখানে- অসম চুক্তি ।
১৮৯৮ সালে ফ্রান্সে প্রকাশিত একটি কার্টুন। গ্রেট বৃটেন, জার্মানি, রাশিয়া, ফ্রান্স ও জাপান চায়না নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিচ্ছে আর পেছন থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে চাইনিজ রাজা
চীনের মানচুরিয়া অঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমের বেশ কিছু অঞ্চল দখলে নেয় রাশিয়ান সাম্রাজ্য। চিয়াওঝোও (Jiaozhou) উপসাগর দখলে নেয় জার্মানি, ঝানচিয়াং (Zhanjiang) দখলে নেয় ফ্রান্স, তাইওয়ান ও দালিয়ান (Dalian) এলাকা দখল করে জাপান, ম্যাকাও দখল করে পর্তুগাল আর হংকং তো প্রথম আফিম যুদ্ধের পর থেকেই ছিল গ্রেট বৃটেনের দখলে।
বক্সার বিদ্রোহ
নিজেদের মাটিতে বহির্বিশ্বের বাড়াবাড়িতে চীনের উত্তর দিকের এলাকাগুলোতে স্থানীয় চাইনিজরা বিদ্রোহ শুরু করে। এসব বিদ্রোহীরা বক্সার নামে পরিচিত ছিল বিধায় এটি বক্সার বিদ্রোহ নামে পরিচিতি পায়। বক্সারদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল পশ্চিমা সৈন্য ও খ্রিস্টান মিশনারিজগুলো। চীনা রাজার সরকার তখন পশ্চিমা শক্তিদের হুকুম তামিল করেই চলছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে একদল লোক বক্সারদের পক্ষে ছিল। তারা নানা ভাবে বক্সারদের সাহায্য সহযোগিতা করতো।
বক্সার যোদ্ধা
বক্সারদের দমন করতে ৮টি দেশ- গ্রেট বৃটেন, রাশিয়া, জাপান, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, ইটালি, আস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি যৌথভাবে তাদের সৈন্য চীনে পাঠায়। স্বাভাবিকভাবে বক্সাররা তাদের কাছে পরাজিত হয়। এই বিদ্রোহের ফলে পশ্চিমা শক্তিরা সিদ্ধান্ত নেয় বেইজিংয়ে তারা তাদের সৈন্যদের ঘাঁটি বানাবে, যেন এমন বিদ্রোহ করার সাহস আর কেউ না করে। তারা বক্সারদের সাহায্য করা সকল চাইনিজ সরকারি কর্মীদের মৃত্যুদন্ড দেয়। নিজের দেশে বিদ্রোহ আটকাতে না পারায় চীনকে আবারো মোটা অঙ্কের জরিমানা গুনতে হয়। যেই জরিমানা শোধ করতে চীনের ১৯৩০ সাল পর্যন্ত সময় লেগে যায়।
বক্সার বিদ্রোহের পরে সামরিক খাতে পশ্চিমাদের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তারা আস্তে আস্তে চায়না থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে শুরু করে। কিন্তু ততদিনে চরম শক্তিশালী হয়ে ওঠা জাপান চায়নার ওপর ছড়ি ঘোরানো শুরু করে। ১৯১১ সালে চীনের ছিং (Qing) রাজবংশের পতন ঘটে। সান ইয়াত সেনের নেতৃত্বে ন্যাশনালিস্ট পার্টি কুওমিনটাং চীনের ক্ষমতায় বসে।
আধুনিক চায়নার যাত্রা
চীনের নতুন ন্যাশনালিস্ট পার্টি পশ্চিমাদের সাথে চীনের অসম সব চুক্তির প্রতিবাদ করে সব চুক্তি বাতিলের খাতায় ফেলে দেয়। তারা নতুন করে সুষম চুক্তির আহ্বান জানায়। কিন্তু এসময়ে মাও সে তুং এর হাত ধরে চীনে কমিউনিস্ট দলের প্রভাব বাড়তে থাকে। ১৯২৭ সাল থেকে চীনে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। চাইনিজদের নিজেদের মধ্যে বিবাদের পূর্ণ সুযোগ নিয়ে জাপানিজরা বারবার চীন আক্রমণ করতে থাকে। ন্যাশলিস্ট দল ও কম্যুনিস্ট দল একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকলেও জাপানের বিরুদ্ধে তারা সময়ে সময়ে এক হয়ে লড়েছিল। ১৯৩১ সালে জাপান মানচুরিয়া অঞ্চল দখল করে নেয়। ১৯৩৭ সালে সংঘটিত হয় দ্বিতীয় সিনো-জাপানিজ যুদ্ধ। এই যুদ্ধে জাপানিজ সৈন্যরা চীনের সাধারণ মানুষের উপর ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালায়। এছাড়া “নানকিং ম্যাসাকার” নামে পরিচিত এক গণহত্যায় জাপানিজরা বহু চাইনিজ হত্যা করে ও নারীদের ধর্ষণ করে।
১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক বোমা ফেলার পর জাপানের শক্তি অস্তমিত হতে থাকে। চীনের গৃহযুদ্ধে ন্যাশনালিস্ট দলকে পরাজিত করে মাও সে তুং এর কম্যুনিস্ট পার্টি। ১৯৪৯ সালে মাও সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন এবং প্রতিষ্ঠা করেন পিপল’স রিপাবলিক অফ চায়না।