ফিনল্যান্ডে তখন তীব্র শীত। তাপমাত্রা -২০ ডিগ্রীরও নিচে। ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে ৩ মাস হলো । জার্মানী আর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার গোপন চুক্তি অনুসারে ইউরোপকে তারা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে লাগলো। এর এক পর্যায়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের চোখ পড়লো ফিনল্যান্ডের উপর। তারা এক অদ্ভূত দাবি করে বসলো ফিনল্যান্ডের কাছে, সেটা হলো সীমান্তবর্তী লেলিনগ্রাদ থেকে ২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত অঞ্চল তাদের দিয়ে দিতে হবে। ফিনল্যান্ড রাজি হলোনা। সোভিয়েত ইউনিয়ন এই অজুহাতে সীমান্তে ৭ লক্ষাধিক রেড আর্মির অফিসার ও সেনাসদস্য, ৬ হাজারের বেশি ট্যাংক, ১৫শ’র বেশি সাঁজোয়া যান, সাড়ে ৩ হাজারের বেশি বিমান নিয়ে এসে ফিনল্যান্ডের সীমান্তে হাজির হলো। গোপন নথিপত্র মতে, তাদের আসল উদ্দেশ্য ফিনল্যান্ড দখল করে পুতুল সরকার বসানো। ফিনল্যান্ড নিজেদের দেশের দখল ঠেকাতে তার সেনাবাহিনী মোতায়েন করলো। তাদের বাহিনী হোয়াইট গার্ডের সম্বল সাড়ে তিন লক্ষ সেনা, মাত্র ৩২ টি ট্যাংক আর ১১৪ টি বিমান।
সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ শুরু করলো। তবে এত বিশাল বাহিনী এক ভিন্ন অসুবিধায় পড়ে গেল। একজন স্নাইপার, যার নাম Simo Häyhä (ফিনিশ উচ্চারণ সিমো হালহা)। পেশায় কৃষক, কিন্তু ফিনিশদের অনিয়মিত বাহিনীর একজন সদস্য। তিনি তার রাশিয়ার তৈরি প্রিয় এম-২৮ রাইফেল দিয়ে একে একে সোভিয়েত বাহিনীর বিভিন্ন অফিসার আর সৈন্যদের খতম করতে লাগলেন। এমন আক্রমণে সোভিয়েতরা চমকে গেল। তারা তাকে নিয়ে আলাদা পরিকল্পনা করলো। প্রথমে তাকে মেরে ফেলার জন্য উচ্চ প্রশিক্ষিত আর আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত কয়েকজন স্নাইপার নিয়োগ দিল। কিন্তু সিমো হালহার সাথে পেরে উঠল না। এতে তার নাম অনেক ছড়িয়ে গেল। তার সাফল্যের কথা এবং ছবি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে লাগলো। তখন পর্যন্ত তার শিকারের সংখ্যা ১৩৬।
যুদ্ধ তখনো চলছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন তাকে মেরে ফেলার জন্য সাঁজোয়া যানে বিশেষ বাহিনী পাঠালো। তারাও পেরে উঠলো না। ক্রুদ্ধ আর হতাশাচ্ছন্ন সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন মরিয়া হয়ে গোলন্দাজ বাহিনীকে দিয়ে তার সম্ভাব্য অবস্থানে বোমাবর্ষণ করলো। ফিনিশীয়রা মজা করে বলে, এতে সিমো হালহার Coat-এ হালকা আঁচড় লেগেছিল।
ততদিনে সিমো হালহা আরও সুনাম অর্জন করে ফেললেন। দেশের বাহিনীর অন্যান্য প্লাটুনেও তিনি তার এই অতিমানবীয় ভূমিকা পালন করতে লাগলেন।
সামগ্রিক যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের তখন অবস্থা বেশ বেগতিক। তারা তাদের ট্যাংকের বহর নিয়ে ফিনিশীয় বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এই প্রতিরোধ যুদ্ধে সামনের সারিতেই ছিলেন সিমো হালহা। বলা হয়, এ সময় তিনি ৪০ জন প্রতিপক্ষ সেনাকে তার অব্যর্থ নিশানাতে হত্যা করেন । কিন্তু প্রচণ্ড আক্রমণে টিকতে না পেরে সিমো হালহার কমান্ডার সবাইকে পেছনে হটতে আদেশ দিলেন । পিছু হটার সময় সাহসী সিমো হালহা আরও একবার গুলি করার জন্য পিছন দিকে ফিরে বন্দুক তাক করেন। কিন্তু খুব কাছেই ছিল এক সোভিয়েত সৈন্য, সেই সৈন্যের এক গুলি এসে তার বাম চোয়াল ভেদ করে যায়।
না, তিনি তখনো মারা যাননি। তার সহযোদ্ধা বলেন, “half of his face was missing”। তিনি জ্ঞান হারিয়েছেন । সাতদিন পর তার জ্ঞান ফেরে, যেদিন দুই দেশের মধ্যে শান্তি চুক্তি হয়।
সিমো হালহার কৌশল ছিল ভিন্ন এবং চমকপ্রদ। তিনি আধুনিক টেলিস্কোপসহ স্লাইপার রাইফেল ব্যবহার করতেন না, কারণ টেলিস্কোপে চোখ রেখে গুলি চালানোর সময় মাথা একটু উঁচুতে নিতে হয়। এতে শত্রুর গুলির নিশানা হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। পাশাপাশি টেলিস্কোপে সূর্যের বা অন্য কোন আলোর প্রতিফলনের জন্য স্নাইপারের অবস্থান প্রকাশ হবার সম্ভাবনা থাকে। তিনি রাইফেলের আশেপাশে বরফের ছোট স্তুপ করে নিতেন। এতে রাইফেলের ভারসাম্য রক্ষা হত, আবার গুলি করার পর গরম ধোঁয়া বের হবার সম্ভাবনাও কমে যেতো। তিনি মুখের সামনেও বরফ রাখতেন, যেন ঠাণ্ডা আবহাওয়াতে শ্বাস প্রশ্বাসের ধোঁয়া তার অবস্থান শত্রুর কাছে প্রকাশ করে না দেয়। এই অসামান্য প্রতিভাধর যোদ্ধা তার কৌশল আর সাফল্যের জন্য White Death নামে পরিচিতি লাভ করেন।
তবে সিমো হালহার সুস্থ হতে বেশ কয়েক বছর লেগে যায়, এবং তার বাম চোয়াল থাকে বিকৃত। সুস্থ হলে তাকে কর্পোরেল পদমর্যাদা থেকে সেকেন্ড লেফটেনেন্টে উন্নীত করা হয়। তিনি যুদ্ধের ১শ’ দিনে ৫শ’র বেশি প্রতিপক্ষ যোদ্ধাকে হত্যা করেন, যা এক যুদ্ধে একজন স্নাইপারের জন্য এখনো একটি রেকর্ড। বলা হয়, তার বাসায় সাজানো ছিলো যোদ্ধাপূর্ববর্তী জীবনে অর্জিত অনেক মেডেল, ক্রেস্ট আর অন্যান্য পুরস্কার। ১৯৯৮ সালে যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, তার এমন অভাবনীয় ক্ষমতা আর সাফল্যের পেছনের কারণ কি, তিনি খুব সরলভাবে জানান, “Practice.” আর এত মানুষ মেরে ফেলার পেছনে তার কোন অনুশোচনা আছে কিনা – এর জবাবে তিনি দেন এভাবে, “I only did my duty, and what I was told to do, as well as I could.”
২০০২ সালে ৯৬ বছর বয়সে তিনি মারা যান। এই যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন অভাবনীয় ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়। তাদের সাড়ে তিন লক্ষ অফিসার ও সৈন্য মারা যায়, আহত হয়, গ্রেফতার হয় কিংবা নিখোঁজ হয়, যেখানে ফিনিশীয়দের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ৭০,০০০ । সোভিয়েত ইউনিয়ন সাড়ে ৩ হাজারের বেশি ট্যাংক এবং ৫শ’র বেশি বিমান হারায়। অন্যদিকে ফিনিশীয়দের ৩০ টি ট্যাংক আর ৬২ টি বিমান ধ্বংস হয়। এতে আন্তর্জাতিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিন্দিত হয় এবং তৎকালীন লীগ অব নেশনস থেকে তাদের সদস্যপদ বাতিল হয়। অন্যদিকে, ফিনিশরা তাদের স্বাধীনতা রক্ষা করতে সক্ষম হয়, যদিও আন্তর্জাতিক সাহায্য ও সহায়তা আসতে দেরি হয় এবং যা আসে, তাও অপ্রতুল। আন্তর্জাতিকভাবেও তাদের সাহসিকতা প্রশংসিত হয়।