ভালোবাসা যত বড় জীবন তত বড় নয়, তোমায় নিয়ে হাজার বছর বাঁচতে বড় ইচ্ছে হয়।
সত্যিই মানুষের জীবন অনেক ছোট, অকালে হারিয়ে যায় অনেক প্রাণ। নিজের সিনেমার এই গানের কথাগুলো যেন ফলে গিয়েছিল উনার বেলায়। জীবনের মায়া ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন পরপারে, তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম জনপ্রিয় নায়িকা দিতি। যিনি বাংলা সিনেমার এক যুগসন্ধি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তার অভিষেককালে আধিপত্য ছিল শাবানা, ববিতাসহ রোজিনা-অঞ্জুদের মতো নায়িকার, আবার পরের দশকে এসে শাবনাজ, মৌসুমীর মতো একঝাঁক নতুন মুখের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এক সময় টেলিভিশনেও হয়ে উঠেন জনপ্রিয় মুখ।
কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো, সে কথা তুমি যদি জানতে, ‘উসিলা’ সিনেমায় চিরসবুজ নায়ক জাফর ইকবালের অত্যন্ত এই জনপ্রিয় গানে নবীন নায়িকা গালে তিলযুক্ত দিতিকে দেখে সবাই মুগ্ধ হয়েছিলেন, স্বপ্নকন্যা হয়ে এসেছেন তরুণদের মাঝে। দিতি প্রথমদিকে বিটিভিতে আল মনসুরের ‘লাইলি মজনু’সহ একাধিক নাটকে অভিনয় করেন। তবে চলচ্চিত্রের শুরুটা এফডিসির নতুন মুখের কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে।
মান্না, সোহেল চৌধুরীর সঙ্গে তিনিও সেই কার্যক্রমে নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রথম সিনেমা ‘ডাক দিয়ে যাই’, অনুদানের ছবিটি আজো মুক্তি পায়নি। প্রেক্ষাগৃহে প্রথম মুক্তি পাওয়া প্রথম সিনেমা ‘আমিই ওস্তাদ’। ‘উসিলা’ সিনেমায় প্রধান ভূমিকায় শাবানা থাকলেও গানের জনপ্রিয়তা ও নিজের সৌন্দর্যতার কারণে বেশ আলোচিত হয়েছিলেন।
এই সুখের নেই কোনো সীমানা,বসন্তের এই আমন্ত্রণে জড়িয়ে গেলাম আলিঙ্গনে, সুভাষ দত্তের ‘স্বামী স্ত্রী’ সিনেমায় মধ্যভাগ পার হবার অন্ধ মেয়ের চরিত্রে আবির্ভূত হন তিনি। সিনেমাটি মূলত শাবানার, সঙ্গে ছিল দুই বাঘা অভিনেতা রাজ্জাক ও আলমগীর। এদের মাঝেই নিজেকে সমুজ্জ্বল করেছিলেন, আর অভিনয় গুণে নবীন থাকাকালেই পেয়ে যান সেরা সহঅভিনেত্রীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
আমি একদিন তোমায় না দেখিলে, তোমার মুখের কথা না শুনিলে, আব্দুল্লাহ আল মামুনের যুগান্তকারী ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সিনেমা ‘দুই জীবন’। প্রধান ভূমিকায় বুলবুল আহমেদ ও কবরী। তবে তারুণ্যনির্ভর দর্শকদের কাছে অতি প্রিয় হয়ে উঠেছিল আফজাল-দিতি জুটি। টেলিভিশন নাটকে তখন সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেতা আফজাল হোসেন, সঙ্গে দিতির রসায়নে দর্শকরা মুগ্ধ হয়েছিলেন। শুধু যে সৌন্দর্যতায় মুগ্ধ করেছিলেন তা নয়, স্টাইলের দিক থেকেও তিনি ছিলেন অনন্যা। ববিতার পর উনাকেই সবচেয়ে বেশি স্টাইলিশ নায়িকা বলা হতো। ‘দুই জীবন’ সিনেমার তুমি আজ কথা দিয়েছো গানটিও বেশ শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছিল। একই বছর আমজাদ হোসেনের ‘হীরামতি’ ছিল ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য সিনেমার একটি, দারুণ প্রশংসিত হয়েছিল, সোহেল চৌধুরীর সাথে জুটি বেঁধে প্রথম সিনেমা ছিল এটি। এরপর ‘আজকের হাঙ্গামা’সহ বেশ কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেন এই জনপ্রিয় জুটি। তারকাবহুল সুপারহিট ছবি ‘ভাই বন্ধু’ ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন।
কাল সারা রাত ছিল স্বপনেরই রাত, আশা ভোঁসলের বিখ্যাত গানটি দিতিরই ‘প্রেমের প্রতিদান’ সিনেমার। ভালোবাসার এই সিনেমার আমার মনের আকাশে আজ জ্বলে শুকতারা গানটিও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এই ছবিতে দিতির নায়ক ছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন ও সোহেল চৌধুরী, যাদের সাথে গড়ে উঠেছিল জনপ্রিয় জুটি। দুজনেই কাছের মানুষ হয়ে এসেছিলেন ব্যক্তিজীবনে, দুটোই রূপ নিয়েছিল বিচ্ছেদে।
পড়েছি কপালে টিপ,চোখে কাজল, পাকিজা প্রিন্ট শাড়ির বিজ্ঞাপনে মডেল হয়ে এসেছিলেন, এখানেও বাজিমাৎ। ‘ইত্যাদি’তে তপন চৌধুরীর সঙ্গে গান করেছিলেন, গানের জগতেও সুনাম আছে উনার, বিটিভিতে আগমন গানের সুবাদেই। অ্যালব্যামও বেরিয়েছিল।
চিঠি কেন আসে না আর দেরি সহে না, চিঠি নিয়ে বাংলা সিনেমার অন্যতম জনপ্রিয় গান, ‘প্রিয় শত্রু’ সিনেমায় ব্যবহৃত হয়েছিল। একই বছর মুক্তি পায় পারিবারিক সিনেমা ‘হিংসার আগুন’। সিনেমা দুটি বেশ উপভোগ্য, অভিনয়ও খুব ভালো করেছিলেন দিতি। কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে ছবিগুলো সাফল্য পায়নি। ‘দুই জীবন’ উনার সবচেয়ে জনপ্রিয় সিনেমা, তবে ব্যবসায়িকভাবে সবচেয়ে বেশি সাফল্য পাওয়া সিনেমা ‘আজকের হাঙ্গামা’। অ্যাকশন ধারার এই ছবি দারুণ সাফল্যের পর এই ধারার ছবিতে নিয়মিত হতে থাকেন, সেই সুবাদে অভিনয় করেন ‘লেডি ইন্সপেক্টর’-এর মকো আরেক হিট ছবিতে, বলা বাহুল্য খুব সম্ভবত বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশি পুলিশ অফিসারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
আজ বড় সুখে দুটি চোখে জল এসে যায়, ‘বেঈমানি’ সিনেমার শ্রুতিমধুর গান। ইলিয়াস কাঞ্চনের সাথে জুটি বেঁধে বহু দর্শকপ্রিয় সিনেমা উপহার দিয়েছেন; অন্যতম বেনাম বাদশা, চরম আঘাত, অজানা শত্রু, ভয়ংকর সাতদিন, আসামী গ্রেফতার ও বেপরোয়া। এ ছাড়া রাজ্জাক, আলমগীর, ফারুক থেকে আফজাল হোসেন, মান্না, রুবেলসহ ওপার বাংলার প্রসেনজিৎ সবার সাথেই অভিনয় করেছিলেন। মান্নার প্রথম প্রযোজিত সিনেমা ‘লুটতরাজ’-এ নায়িকা হয়েছিলেন দিতি, এই সিনেমার তুমি নাই কিছু নাই গানটি বেশ শ্রোতাপ্রিয়। শাবানা, ববিতা থেকে চম্পা, মৌসুমী সবার সাথেই স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করে গেছেন।
সাহিত্যধর্মী বা ভিন্নধর্মী সিনেমায় সেভাবে অভিনয়ের সুযোগ পাননি। দুই প্রজন্মের মাঝখানে পড়ে বেশ ভালোই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছিল। বাণিজ্যিক ছবিতেই নিজের অভিনয় গুণ দেখিয়েছিলেন বেশ সংখ্যক ছবিতে। দ্বৈত চরিত্রে ‘অমর সঙ্গী’ বা ‘সুখের ঘরে দুঃখের আগুন’ সিনেমায় দারুণ অভিনয় করেছিলেন। তবে বিশেষ করে বলতে হয় ‘শেষ প্রতীক্ষা’ সিনেমাটির কথা, বৈচিত্র্যময়ী এই চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু জাতীয় পুরস্কারে ভাগ্য সহায় হয়নি, অথচ সেই বছর এই বিভাগে কাউকেই জাতীয় পুরস্কারই দেয়া হয়নি।
মূলত নব্বই দশকের মাঝামাঝির পর থেকেই জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করে, সিনেমাগুলো ফ্লপ হতে থাকে। ব্যক্তি জীবনের চড়াই-উৎরাইয়ে সিনেমা থেকে দূরে সরে যান, চলচ্চিত্রেও অশ্লীলতা ঝেঁকে বসে। নিজের প্রিয় নায়করাও হয়তো তাকে এড়িয়ে গেছেন। বেশ বিরতির পর বান্ধবী নারগিস আক্তারের ‘চার সতীনের ঘর’ সিনেমায় চার নায়িকার একজন হয়ে প্রত্যাবর্তন করেন। এরপর অভিনয় করতে থাকেন কাল সকালে, বিন্দুর ছেলে, নয় নম্বর মহা বিপদ সংকেত, মেঘের কোলে রোদ, মাটির ঠিকানা, মুক্তি, পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী, সুইটহার্টসহ বেশ সংখ্যক সিনেমায়। অভিনয়ের ক্ষুধা ও জীবিকার তাগিদেই হয়তো শাকিব খান, অনন্ত, জয়াদের মা হয়ে অভিনয় করে গেছেন। তবে এটাও ঠিক তিনি বেঁচে থাকলে মাতৃ চরিত্রের জন্য অভিনেত্রী সংকট হতো না। এই সময়ে বহু নাটকে অভিনয় করেছেন। এর মধ্যে গুলশান এভিনিউ, মা, সোনার ময়না পাখি, অনলাইন ডটকম, ভবের হাট, বউ শ্বাশুড়ি নটআউট অন্যতম।
ব্যক্তিজীবনে দুই সন্তানের জননী তিনি, ভালোই কেটে যাচ্ছিল জীবন। কিন্তু দুঃস্বপ্ন হয়ে আসে মস্তিষ্কে ক্যান্সার, ভারতে চিকিৎসা করিয়েও ভালো ফল আসেনি। অবশেষে ঢাকাতেই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যান।
৩১ মার্চ উনার জন্মদিনর। জন্মমাসেই ২০১৬ সালের ২০ মার্চ, মাত্র ৫১ বছর আয়ুষ্কাল ছিল দিতির।
* লিখেছেন: হৃদয় সাহা | ব্যবহৃত ছবি: আজাদ আবুল কালামের সংগ্রহ থেকে