‘যুদ্ধাপরাধ বলে আসলে কিছু নেই। যে জিতে সেই এর সংজ্ঞা লিখে। আজকে জেনেভা কনভেশন বলছে আমরা যুদ্ধাপরাধ করেছি, কাল জাকার্তা কনভেনশন আসবে। কে পরোয়া করে এসবের!’
_আদি জুলকাদরি ( ইন্দোনেশিয়া গণহত্যার অন্যতম অপরাধী)
মানব সভ্যতার ইতিহাসে গণহত্যার বর্বরতা অবিদিত নয়। বারবারই দেশ, অঞ্চল, ধর্মীয় ও জাতীয় পরিচয় ভেদে সংঘবদ্ধ আকারে চলেছে গণহত্যা। একাত্তরে ৩০ লাখ বাঙালি হত্যা কিংবা গেস্টাপোর ইহুদি নিধন- আন্তর্জাতিক আদালতে মানবতার বিরুদ্ধে চরমতম অপরাধ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ছয় বছর আগে ইন্দোনেশিয়ায় এমনই এক পৈশাচিক গণহত্যা সংঘটিত হয়। ঘটনার ৪০ বছর পর আন্তর্জাতিক মহলে এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা ও বিচারের দাবি উঠলেও খোদ ইন্দোনেশিয়াতেই ভিন্ন চিত্র চোখে পড়ে। অর্থাৎ গণহত্যার সম্মুখ কুশীলবেরা এখন সমাজের চোখে জাতীয় ‘হিরো’, অনেকেই রাজনীতিক ও উচ্চশ্রেণীর বাসিন্দা।
ঠিক কী হয়েছিল সেই সময়? কেনই বা ইতিহাসের পাদপ্রদীপের আলো থেকে বঞ্চিত এই নৃশংস ঘটনা? খুঁজে বের করেছেন ডেনমার্কের পরিচালক জশুয়া ওপেনহেইমার। কোন প্রপস বা কৃত্রিম চিত্রায়নের শরণাপন্ন হননি , গোটা গল্প বলার ভার ছেড়ে দিয়েছেন কুখ্যাত গণহত্যার আসামীদের হাতে।
বর্বর এই গণহত্যার উলঙ্গ সত্যটাকে বুঝতে হলে নির্দ্বিধায় দেখে ফেলুন ২ ঘণ্টা ৪৬ মিনিটের ২০১২ সালের প্রামাণ্যচিত্র The Act of Killing.
অস্থির রাজনীতি ও ক্ষমতার হাতবদল
ষাটের দশকে গোটা বিশ্বের রাজনীতিতেই ছিল শীতল আবহাওয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুই দশক কেটে গেলেও শান্তির সুবাতাস যাপিত হয়নি। জাপানের শক্তি হ্রাস, ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন সহ ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের পতন, এশিয়ার দেশগুলোর রাজনৈতিক পট পরিবর্তন তখন আলোচনার কেন্দ্রে। ওদিকে ‘দি গ্রেট’ জার্মানির বিভাজন, চীনের গোড়াপত্তন, পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক চর্চা ও চার্চিলের দৌরাত্ম্য ক্রমবর্ধনশীল।
ছিল পরাক্রমশালী সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন মুলুকের মুখোমুখি বিতর্ক, গোটা বিশ্বকে নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে সমর্থন দেয়া এবং পরবর্তী যুদ্ধের দামামার শব্দ। সংঘাতের ফলে বিপ্লব ঘটেছে আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরিকাসহ অনেক দেশে। রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেয়েছে কেউ, কেউ মিশে গেছে ইতিহাসের পাতায়।
পাশাপাশি উত্থান ঘটেছে নির্দয় স্বৈরশাসকের -দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, সুদান, উগান্ডা, চিলি এবং ইন্দোনেশিয়ায়। উক্ত প্রামাণ্যচিত্রের মূল বিষয়ই ছিল ইন্দোনেশিয়া কেন্দ্রিক। পরিচালক জশুয়া তাই সরাসরিই দর্শককে নিয়ে গেছেন ঐতিহাসিক পটভূমিতে। ষাটের দশকে দুই ধারার রাজনীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা তখন বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়, ওদিকে উগ্র ডানপন্থাও ধনিক শ্রেণির জন্য সুবিধাজনক।
সমাজতান্ত্রিক নেতাদের মূল লক্ষ্য ছিল সাধারণ জনতার কল্যাণ, তাদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক নীতির বিকাশ ঘটানো। ডানপন্থীরা এত বিস্তৃত পন্থায় এগোয়নি। কেন্দ্রের শীর্ষ পদধারিদের হাত করেই একাট্টা হতে থাকে তারা। রাষ্ট্রক্ষমতায় তখন প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ অধিষ্ঠিত, বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে তার জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে।
সমাজতন্ত্রীরা যখন বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে তখনই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মোড় ঘুরিয়ে দেয় ইন্দোনেশিয়ার। সুকর্ণর ‘গাইডেড ডেমোক্রেসি’ কে হটিয়ে জেনারেল সুহার্তো ক্ষমতা দখল করে। এর সূত্রপাত হয় ’৬৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মধ্যরাত থেকে ১ অক্টোবর ভোরের ভেতর ইন্দোনেশিয়ার সামরিক বাহিনীর ৬ জেনারেলকে হত্যার ঘটনায়।
বাহিনীর অভ্যন্তরীণ সংবাদ অনুযায়ী এদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ছিল। এই হত্যাকাণ্ডের পর সৈন্যরা সুকর্ণর সমর্থন চায় এবং আন্দোলনকে বেগবান করতে বলে। কিন্তু সুকর্ণ এর পক্ষপাতী ছিলেন না। ফলে দেশে যেন অস্থির অবস্থার সৃষ্টি না হয় সে লক্ষ্যে রেডিও বার্তা পাঠাতে থাকেন।
গণহত্যার মূল হোতা জেনারেল সুহার্তো; Photo: Inside Indonesia
আন্দোলনকারীরা এই ঘটনার জের আর টানেনি। কিন্তু সুকর্ণর দূর্বল নেতৃত্ব ও তার বার্তার অসামঞ্জস্যতাকে পুঁজি করে ফেলে জেনারেল সুহার্তো। দিনের মধ্যেই এঁকে ফেলেন গণহত্যার নীলনকশা। ৫ অক্টোবর থেকে সমাজতন্ত্রীদের নামে মিথ্যে প্রোপাগান্ডা ছড়াতে থাকে সুহার্তোর দল। জেনারেলদের হত্যার বানোয়াট ছবি ও তথ্য সম্বলিত পোস্টার, সংবাদপত্র ও লিফলেট বিতরণ করা হয় সর্বত্র। এতে বলা হয়, এই কম্যুনিস্টরা দেশব্যাপী হত্যাকাণ্ডের পায়তারা চালাচ্ছে।
মিথ্যে হলেও এই ক্যাম্পেইন ছিল সফল। গণমানুষের ভেতর কম্যুনিস্টদের প্রতি ঘৃণা তৈরি হতে থাকে। ফলে কম্যুনিস্ট শুদ্ধি অভিযান একদম বিনা বাধাতেই শুরু হয়। সুকর্ণ বার কয়েক বিবৃতি দিয়ে এই উদ্দেশ্যকে প্রতিহতের চেষ্টা চালালেও লাভ হয়নি। কেননা সামরিক বাহিনীর সর্বময় ক্ষমতা তখন সুহার্তোর হাতে।
নারকীয় গণহত্যা
সেসময় চীন ও সোভিয়েত রাশিয়ার পরেই সর্ববৃহৎ কম্যুনিস্ট সমর্থক দল ছিল ইন্দোনেশিয়ায়। পিকেআই বা কম্যুনিস্ট পার্টি অফ ইন্দোনেশিয়ার সদস্য সংখ্যা ছিল ৩০ লাখ। শুদ্ধি অভিযানের ফলে প্রথম আঘাত আসে সুকর্ণর নাসাকম আইনের ওপর। এর মূল ভিত্তিই ছিল জাতীয়তাবাদ (Nationalism), ধর্ম (Religion) ও সমাজতন্ত্র (Communism)। সুহার্তো এর দুই নীতি সরিয়ে ইসলামিক রাজনীতি ও সামরিক নীতিকে প্রতিষ্ঠিত করে।
মোট মৃতের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ আছে। ইতিহাসবিদদের মতে তা ৫ লাখ। তবে বিভিন্ন নথির ভিত্তিতে জানা যায় প্রকৃত সংখ্যা ১০ লাখ থেকে ২৫ লাখ পর্যন্ত হতে পারে।
অভিযোগ আছে ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাথাতেও। এই ‘ব্যাপক গণহত্যাযজ্ঞ’ সম্পর্কে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা পূর্ব থেকেই জানতো। বার্তা সংস্থা এএফপির বরাতে জানা যায়, ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত জাকার্তার মার্কিন দূতাবাসে এ সংক্রান্ত ৩৯টি নথি প্রকাশিত হয়েছিল। এই নথিসমূহে দেখা যায়, দেশটিতে অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকেরা এই বর্বর গণহত্যা সম্পর্কে জানতেন। উক্ত সমাজের উচ্চ স্থানীয় মুসলিম নেতারা এতে যুক্ত ছিলেন বলেও প্রমাণ পাওয়া যায়।
জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির ন্যাশনাল সিকিউরিটি আর্কাইভে প্রাপ্ত দলিলে বের হয়ে আসে আরও ভয়ানক সব তথ্য। সমাজতন্ত্র বিরোধী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আঁতাত করেছিল সামরিক সরকারের সাথে। সহযোগিতার স্বার্থে ইন্দোনেশীয় কম্যুনিস্টদের বিশাল তালিকা তৈরি করে তুলে দিয়েছিল জান্তা সরকারের হাতে। সামরিক বাহিনীকে নানান পন্থায় সাহায্যের পাশাপাশি অর্থ ও হত্যার সরঞ্জাম দিয়েছিল তারা।
প্রকাশিত নথির সূত্র ধরে জানা যায়, ১৯৬৫ সালের ২৬ নভেম্বর সুরাবায়া শহরে তৎকালীন মার্কিন কনস্যুলের একটি টেলিগ্রামে হত্যাযজ্ঞের পূর্বাভাস ছিল। এতে বলা হয়, পূর্ব জাভায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানোর আভাস রয়েছে। মাত্র এক অভিযানেই ১৫ হাজার কমিউনিস্টকে হত্যা করা হতে পারে। ডিসেম্বরের ২১ তারিখের মধ্যেই ১ লাখ কম্যুনিস্ট ও তাদের পরিবারকে হত্যা করে সামরিক সরকার। এই ঘটনা আমেরিকা ও ইন্দোনেশিয়ার পারস্পরিক সম্পর্ককে আরও পোক্ত করে। ১৯৬৬ এর মার্চের মধ্যে পিকেআইকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সুহার্তো বাহিনী। স্নায়ুযুদ্ধে মিত্রে পরিণত হওয়া দেশটিকে বৃহদাকারে অস্ত্র ও আর্থিক সহায়তা দিতে থাকে মার্কিনীরা।
হত্যার পূর্ব মুহূর্ত
উক্ত কনস্যুল এর পরের মাসে জানায়, বন্দি কমিউনিস্টদের সেনাবাহিনী বেসামরিক লোকদের হাতে তুলে দিচ্ছে। এই বেসামরিক লোকদের মধ্যে ছিল সেকালের উগ্রপন্থী সংবাদপত্র প্রকাশক, গ্যাংস্টার, সন্ত্রাসী এবং উচ্চবিত্ত প্রভাবশালী মুসলিম পরিবারগুলো। এদের কাজই ছিল বিনা বিচারে বন্দিদের নির্দয়ভাবে হত্যা করা।
নানান উপায়ে খুন করা হতো তাদের। শিরোচ্ছেদ, গুলি করে বা পিটিয়ে মারা ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। ঘর জ্বালিয়ে দিয়ে তাদের জমি ও সম্পদ দখল করতো অত্যাচারীরা। পরে তাদের ধরে নেয়া হতো কার্যালয়ে, পক্ষান্তরে ‘কসাইখানা’য়। হত্যার পর মৃতদেহ গণকবর খুঁড়ে চাপা দেয়া হতো। অনেকগুলো নদীতে ফেলেও দেয়া হতো নির্দ্বিধায়।
কতিপয় সাংবাদিক ও প্রকাশকের কাজ ছিল এই বন্দিদের জবানি নেয়া। নির্দোষ হলেও শুধুমাত্র তাদের নাম ব্যবহার করে মিথ্যে খবর প্রকাশ করা হতো। কম্যুনিস্টদের খুনে জল্লাদ হিসেবে পরিচিত করাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য।
গণহত্যা ১৯৬৫-৬৭ সাল পর্যন্ত চললেও নিপীড়ন চলে আরও ৩২ বছর। সুহার্তোর একনায়কত্বের পতন ঘটে ১৯৯৮ সালে। এর মধ্যে দেশটি দুর্নীতি ও অত্যাচারের চারণভূমিতে পরিণত হয়। বিশেষত বামপন্থিদের উত্তরসূরিরা প্রকৃত বিচার পাওয়া তো দূরের কথা স্বাভাবিক জীবনধারণের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয়েছে। প্রোপাগান্ডার ঝাণ্ডা আরও বেগবান হয় এই সময়ে। জনতার মনে কম্যুনিজমের প্রতি বিরূপ ধারণা সৃষ্টিতে একের পর এক সস্তা, পৈশাচিক সিনেমা নির্মিত হয়। এর ফলে দর্শক ধরেই নেয় বামপন্থার অনুসারীরা নির্দয় পিশাচ ছাড়া কিছু নয়।
এই শাসনামলেই কট্টর কিছু নিয়মের প্রবর্তন করে তারা। যেমন- নারীদের পুলিশ পদে আবেদন করতে হলে হলে কুমারীত্ব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। অন্যদিকে বামপন্থিদের উত্তরসূরিরা উচ্চপদের সরকারি চাকরিতে সুযোগই পায় না। জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিতেও বৈষম্য চলে। অনেক উত্তরসূরি বিবাহের অনুমতি পর্যন্ত পায়না। শিক্ষা, চাকরি, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক-সব ক্ষেত্রেই বঞ্চিত এরা।
চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই অমানবিক হত্যাযজ্ঞের কোন সুরাহা হয়নি। মানবাধিকার সংগঠনগুলো গণহত্যার গোপন দলিল প্রকাশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনকে ক্রমাগত তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে প্রত্যক্ষদর্শীর সংখ্যাও নগণ্য, কারণ একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করা হয় সেসময়ে। এরপরেও যারা বেঁচে ছিলেন তাদের অধিকাংশই বন্দিশিবিরে নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন। সঙ্গত কারণেই এরা খুব একটা এগিয়ে আসেনি। এছাড়া হুমকি, অত্যাচার ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি সামাজিকভাবে তাঁদের ভীতিকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে গত ৫৫ বছরে।
আনোয়ার কঙ্গো ও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীরা
‘At some point during The Act of Killing, your brain will simply want to shut down.’
তথ্যচিত্র দেখবার সময় ফিল্ম সমালোচক লারসেন এভাবেই তার অনুভূতি ব্যক্ত করেন। মৃতদেহ, রক্তপাতের অকৃত্রিম কোন দৃশ্য না থাকলেও খুনিদের ভয়ংকর স্পর্ধাই আপনাকে হতবিহবল করে দেবে।
প্রথম ভাগেই আমরা পরিচিত হই আনোয়ার কঙ্গোর সাথে, যার বিরুদ্ধে এক হাজার হত্যার অভিযোগ আছে। যুবা বয়সেই কুখ্যাত গ্যাংস্টার ছিল সে। মূলত সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক করেই আয় করতেন। সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা আসায় হলগুলোতে মার্কিন সিনেমা বয়কট করা শুরু হয়। ফলে ব্যবসাতেও মার খেতে থাকে আনোয়ার সহ অন্য মাফিয়ারা।
সামরিক সরকার সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। কম্যুনিস্টদের প্রতি ক্ষোভটাকে ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক খাতে প্রবাহিত করে।
-‘কীভাবে হত্যা করতেন বন্দিদের?’
জশুয়ার প্রশ্নের উত্তরে হলদে হয়ে আসা দাঁতে হাসেন আনোয়ার।
‘বন্দি টন্দি বলে কিছু ছিল না, তালিকায় নাম থাকতো, এনে সরাসরি খুন করতাম। প্রথমদিকে পিটিয়ে মারতাম কম্যুনিস্টগুলোকে। ওতে সময়ও বেশি লাগতো, রক্তও ছড়াত প্রচুর। মেঝে ধোয়ার পরেও বিচ্ছিরি গন্ধ থাকতো। কম রক্তপাতে খুনের পদ্ধতিও আবিষ্কার করে ফেললাম। রডে বেঁধে স্রেফ গলায় তামা বা লোহার তার পেঁচিয়ে টান দিতাম, মিনিটের মধ্যেই কম্ম খতম!’
জিন্সের প্যান্টের উপকারিতা নিয়েও দুই ছত্র বলেন এই সাবেক গ্যাংস্টার।
‘গণহত্যার জন্য সবচেয়ে ভালো হল জিন্সের প্যান্ট। নিজেকে হলিউডি নায়কও লাগে আবার রক্তে তেমন ভেজেও না। খুনের মতো ব্যাপারে পুরু কাপড় পরা বুদ্ধিমানের কাজ।‘
হত্যার পদ্ধতি দেখাচ্ছেন কঙ্গো; Photo:Inside Indonesia
ফিল্ম এগুবার সাথে সাথে আমরা দেখতে পাই, আনোয়ার ও তাঁর সাথিরা হত্যার নানান পন্থা তুলে ধরছেন। যেমন- নির্যাতনের পর ভিকটিমের গলার উপর টেবিলের পায়া তুলে এর উপর বসে থাকা, বিভিন্ন অঙ্গ বিচ্ছিন্ন করা ইত্যাদি।
তাঁদের দাবি, অধিকাংশ প্রক্রিয়াই হলিউডি সিনেমার অনুকরণে করা। ওয়েস্টার্ন চলচ্চিত্র, মার্লোন ব্র্যান্ডো ও আল পাচিনোর প্রসঙ্গও উঠে আসে অনুপ্রেরণায়।
ওপেনহেইমারের দৃষ্টিকোণ
কুখ্যাত অপরাধীর মনস্তত্ত্ব কী বলে? কীভাবে অপরাধকে স্বীকৃতি দিয়ে চলেছে এরা?- ঠিক এই প্রশ্নগুলোই মাথায় ঘুরছিল জশুয়ার। তথ্যচিত্রকে ‘ডিস্টার্বিং’ আখ্যা দিলেও জানান ‘গণহত্যার গতিপ্রকৃতি’ বোঝার জন্য আদর্শ এটি।
‘ইতিহাসে প্রচুর গণহত্যার নিদর্শন পাবেন। কিন্তু এগুলো থামাবার জন্য আপনার আগে জানতে হবে কেন এধরণের অপরাধ সংঘটিত হয়। মাথায় রাখতে হবে আপনার শত্রু ঘরের বাইরে নয়, ঘরেও থাকা সম্ভব। এদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা ও শাস্তি প্রদান করতে হবে।‘
ওপেনহেইমারের মতে এটি ‘কল্পনার প্রামাণ্যচিত্র’। কেননা, মূল নৃশংসতাকে না দেখিয়ে হত্যাকারীদের মুখে মুখেই তিনি দৃশ্যগুলো দেখাতে চেয়েছেন। দর্শক সরাসরি ঘটনা না দেখেও কল্পনার ভিত্তিতে এর ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পারবেন।
আনোয়ার কঙ্গোর সাথে দীর্ঘদিন স্কাইপের মাধ্যমে যোগাযোগ চালিয়ে গেছেন জশ। কঙ্গোর মানসিক দোটানা বোঝার পাশাপাশি নিজেদের সম্পর্ককে খোলাসা করে বলেছেন এভাবে,
‘হ্যাঁ, আমি আনোয়ারকে নিয়ে ভাবি। ওর সাথে যোগাযোগের ফলে মনে হয় আমি নিজেকে ‘ভালো মানুষ’ হিসেবে গ্রহণ করতে পারছি। এটা হলো ‘স্টার ওয়ারস মোরালিটি’। ওর সাথে আমার ঠিক বন্ধুত্ব নেই, কিন্তু ওর মধ্য দিয়ে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোকে বার্তা পৌঁছাতে পারি। ওর মধ্যে এখন অনুতাপ আছে, দুঃস্বপ্নের তাড়া আছে। এজন্য হয়তো খুব একটা পছন্দ না করলেও মানবিক দিকটা দেখতে পাই।‘
আট বছর টানা শ্রম দিয়েছেন এই ফিল্মের পেছনে। তথ্যে প্রবাহ বারবার বিঘ্নিত হয়েছে, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও ছিল। কিন্তু দমে যাননি তিনি। আকাশচুম্বী আশা না থাকলেও ফলাফলে মহাখুশি তিনি। এমনকি এরল মরিস ও ওয়ারনার হারজগের মতো ঝানু ডকুমেন্টরি মাস্টারকে নির্বাহী প্রযোজকের খাতায় তুলে ফেলেছেন।
‘নির্মাণের সময় মনে হয়েছে আনোয়ার, কাদরি, কোটো এরা সবাই বাস্তবতা থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। যখন আয়নায় আপনি আপনার প্রতিবিম্ব দেখতে চান না তখনই এই গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেবার চেষ্টা চালান। এদের অবস্থাও এক। অনুতাপের বদলে এরা তা উদাযপন করছে। কেন? কারণ এতদিন তাদের কেউ বলেনি, যা তারা করেছে সেটা অন্যায়। কিন্তু যখন সত্যটা তাদের সামনে আসে-সেসময়ের অনুধাবনটা আমি দেখাতে চাই।‘
কঙ্গো, জুলকাদরিদের সাথে পরিচালক; Photo: DW
বিচারহীনতার স্পর্ধা
তথ্যচিত্রের শেষভাগে আনোয়ারের উপলব্ধি দেখতে পাই আমরা। যেই ছাদে নিয়মিত গণহত্যা চালাতো তারা, সেখানে অসুস্থ স্বরে ‘অনুতপ্ত’ বলে বারকয়েক প্রলাপ বকতে দেখা যায়। অভিনয়ের এক পর্যায়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্তও দেখায়। জশুয়াকে জিজ্ঞেস করে,
‘আমি যেমন অনুভব করছি তারাও কি ঠিক এমন ভাবতো?’ আমি কি পাপ করেছি?’
৭৫ বছরের শ্রী মুহায়াতি, গণহত্যার গ্রাস থেকে বাঁচলেও হারিয়েছেন পরিবার, ক্যাম্পে নির্যাতিত হন ৫ বছর; Photo: Ulet Ifansasti—Getty Images
২০১৪ সালে নির্বাচিত হন প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো। যদিও পরিচালক জশুয়া এই অবস্থাকে সঠিক গণতন্ত্র বলতে রাজি নন। এর নিদর্শনও মেলে পঞ্চশীলা ইউথ দলের নেতা ইয়াপ্টো সোয়েরজোসেমারনোর কণ্ঠে,
‘গণতন্ত্র মানেই চিল্লাপাল্লা। মানবাধিকার মানিবাধিকার বলে চেঁচানিটা জঘন্য লাগে আমার।‘
২০১৬ সালে এক দাপ্তরিক ঘোষণার মাধ্যমে গণকবরের সন্ধান ও তথ্য সংগ্রহের নির্দেশ দেন। সে বছরের মে মাসে তদন্তকারী দল ১২২ টি গণকবর তালিকাভুক্ত করে। কিন্তু এরপর তদন্তে অগ্রগতি হয়নি। এমনকি ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণের আশ্বাসও এড়িয়ে যাওয়া হয়। তদন্তের ফলে বহু প্রভাবশালীর ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হবার আশঙ্কাই এর মূল কারণ বলে ধরা হচ্ছে। দুঃখের ব্যাপার হলো, গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট হলেও ক্ষতিগ্রস্ত ও মৃতদের স্বার্থে মূল হোতাদের কোন ক্ষমা প্রার্থনার চেষ্টা নেই।
অস্কারে মনোনীত হলেও পুরস্কার জোটেনি এর। তবে ঠিকই ৬৭তম বাফটা, ইউরোপিয়ান ফিল্ম এ্যাওয়ার্ড সহ অজস্র পুরস্কার জয় করে এটি। পরিচালকের জবানিতে বিস্তারিত জানতে চাইলে Vice Podcast ও শোনার আহ্বান রইলো।