ধারাবাহিক উপন্যাস— ‘খণ্ড খণ্ড ৎ’ (পর্ব – ১) - আহমেদ ইশতিয়াক
চারপাশে ঘন অরণ্য।
ঠিক তার মাঝখানে বেশ বড় একটা পুকুর।
কবোষ্ণ তার জল।
শীত গ্রীষ্ম সবসময়েই।
এবং কাকচক্ষু।
কাকচক্ষু জল। সাহিত্যের ভাষা। সহজ বাংলায় স্বচ্ছ। কাকের চোখ অত্যন্ত স্বচ্ছ এবং টলটলা।
এই পুকুরটার জলও ঠিক এমন। তাকালেই কেমন মায়া মায়া লাগে।
পুকুরের পাড়টা বাঁধানো। পাথরের সিঁড়ি। ধাপগুলো অত্যন্ত চওড়া। একজন মানুষ আরামে শুয়ে থাকতে পারবে এমন।
সিঁড়িতে আমরা দুজন বসে আছি।
আমি এবং মিলি।
আমাদের মাথার ওপর বিশাল চাঁদ। আজ জোছনা হয়েছে। ফিনিক ফাটা জোছনা। অত্যন্ত তীব্র।
হঠাৎ মিলি বলল, আনিস, পুকুরে নামবে?
আমি বললাম, না।
মিলির মধ্যে এমন পাগলামি আছে। উদ্ভট উদ্ভট কাজ করে। প্রায়ই রাতে পুকুরে নামে। সাঁতার কাটে। মাঝে মাঝে শুধু চুপচাপ ভেসে থাকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভেসে থাকতে পারে মিলি। পুকুরের জলে সামান্যতম কাঁপনও ওঠে না। পুকুরটা যেন একটা বিছানা।
মিলি বলল, আমি নামবো।
নামো।
মিলি আদুরে গলায় বলল, চলো না নামি!
আমার ভালো লাগছে না। তুমি নামো। আমি দেখি।
মিলি খিলখিল করে হাসল। বলল, দেখতে খুব মজা লাগে, না?
হুম লাগে?
কেন লাগে? কেন? হুম?
তা জানিনা। কিন্তু লাগে।
মিলি উঠে দাঁড়িয়েছে। সে এখন শাড়ি খুলবে। জলে নামবে পুরো নগ্ন হয়ে। সাঁতরাবে। ভেসে বেড়াবে। আমাকে বসে থাকতে হবে পুকুরের পাশে। রুটিন ওয়ার্ক। তবু প্রতিদিন জলে নামার আগে আমাকে সাধবে। আর আমার না করতে হবে। বলতে হবে, তুমি নামো, আমি দেখি।
মিলি জলে নামছে।
নামার ভঙ্গীটা সুন্দর। এক পা এক করে এগুচ্ছে। পুরো ব্যাপারটার মধ্যেই নাচের একটা ছন্দ আছে। এত ভালো লাগে দেখতে!
আমি আকাশের দিকে তাকালাম। এবং তাকিয়েই বিস্মিত হলাম।
আমার মনে হলো বিশাল চাঁদটা তার নির্দিষ্ট যায়গা থেকে অনেক খানি নিচে নেমে এসেছে। এমনিতেই তীব্র জোছনা। এখন আরো তীব্র লাগছে। চারপাশ কেমন দুধের মত সাদা হয়ে আছে।
হঠাৎ ঝপ করে শব্দ হলো। মিলি ঝাঁপিয়ে পড়েছে জলে।
মিলিকে দেখা যাচ্ছে না। ডুবে আছে। খানিক পরেই মাথা তুলবে। আমার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসবে।
আমার ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে কোত্থেকে যেন একরাশ গাঢ় বিষাদ ছুটে আসছে। এইতো আর কিছুক্ষণ। তারপরই বিষাদ গুলো আমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরবে।
আসুক। বিষাদ আসুক।
মিলিও ভেসে উঠুক।
বিষাদ এবং মিলির জন্যে অপেক্ষা না করে আমি বরং একটা গল্প বলি।
✒
অদ্ভুত একটা ঘটনা।
না। ভুল বললাম।
ঘটনাটা শুধু অদ্ভুত না।
ভয়ংকর রকম অদ্ভুত।
এরকম অদ্ভুত ঘটনা আগে কখনোই আমার সাথে ঘটেনি। ভবিষ্যতেও কখনো ঘটবে বলে মনে হয় না।
ঘটনাটি ঘটেছে রমনা পার্কে।
রমনা পার্ক।
এমনিতে আমার অতি পছন্দের একটি জায়গা। মাঝে মধ্যেই আমি রমনা পার্কে যাই। বিশেষ কোন কাজে যে যাই তা না। এমনিই যাই। মানুষ দেখতে যাই। মানুষ দেখতে আমার ভালো লাগে।
রমনা পার্কে আমার কাজগুলো এরকম-
১। বড় দেখে এক ঠোঙা বাদাম কেনা। (সাথে একগাদা বিটলবণ)
২। ভালো দেখে একটা বেঞ্চ বাছাই করা।
৩। বাদাম খেতে খেতে আশেপাশের বিচিত্র সব মানুষের বিচিত্র সব কাজকর্ম দেখা।
রমনা পার্কে অসংখ্য মানুষ আসে। প্রতিদিনই আসে। এত মানুষ আলাদা আলাদা ভাবে দেখা সম্ভব না। তবে রমনা পার্কে যারা আসে তাদের সবাইকে আমি কয়েকটা গ্রুপে ভাগ করে নিয়েছি। প্রত্যেকটা গ্রুপের কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। কোন এক গ্রুপের দুই তিনজনকে দেখলেই সেই গ্রুপের বাকী সবার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
তিনটি গ্রুপের কথা বলি।
এক। স্বাস্থ্য সচেতন গ্রুপ।
এই গ্রুপের বেশীরভাগ সদস্য মধ্যবয়স্ক এবং উচ্চবিত্ত। পার্কে এদের একটাই কাজ- দামী ট্র্যাকসুট, কেডস ইত্যাদি পরে গম্ভীর মুখে দৌড়ানো। অবশ্য দৌড়ানোর ভঙ্গী যথেষ্টই সিরিয়াস। হেলাফেলার কোনই সুযোগ নেই।
স্বাস্থ্য সচেতন গ্রুপের সদস্যদের জীবনের মটো হচ্ছে, হেলথ ইজ ওয়েলথ। স্বাস্থ্যই সম্পদ।
মাঝে মধ্যে মহিলাদেরকেও দৌড়াতে দেখা যায়। তবে দৌড়বিদ মহিলারা ট্র্যাকসুট পরেন না। সালোয়ার কামিজের সাথেই কেডস পরেন। এরা সিরিয়াস ভঙ্গীতে দলবদ্ধ ভাবে দৌড় শুরু করেন। দৌড়ানোর গতি অত্যন্ত ধীর। দৌড় শুরু করার কিছুক্ষণ পরেই এরা হাঁপিয়ে যান এবং ধপ করে কোন একটা বেঞ্চে বসে পরেন। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে সঙ্গী মহিলার সাথে পাশের বাসার ভাবীর বদনাম করেন।
বদনাম কিন্তু ফিসফিস করে করেন না। উচ্চস্বরেই করেন। একটু কান খাড়া করলেই যে কেউ তাদের কথা শুনতে পাবে।
দৌড়বিদ মহিলাদের কথা শুনে শুনে আমি আশেপাশের এলাকার অনেক ভাবীর গোপন কথা জেনে ফেলেছি। এমনকি এসব ঘটনা নিয়ে আমি এখন আস্ত একটা বইও লিখে ফেলতে পারি।
বইয়ের নাম হবে, পাশের বাসার ভাবীদের যত কীর্তি!
দুই। রোমিও জুলিয়েট গ্রুপ।
শিশু থেকে দু তিনটা দাঁত পড়ে যাওয়া বৃদ্ধ সবাই এই গ্রুপের সদস্য। এই গ্রুপে বয়স কোন ফ্যাক্টর না এবং সদস্য সংখ্যা অসীমের কাছাকাছি।
রোমিও জুলিয়েট গ্রুপে অবশ্য একটা সমস্যা আছে। এদের দেখে কে কার স্বামী কে কার স্ত্রী এসব বোঝার কোন উপায় নেই। মনে হয় যে যাকে সামনে পায় তাকেই সঙ্গে করে নিয়ে চলে আসে।
এদের কাজকর্মও বিচিত্র।
এই বাদাম খাচ্ছে।
এই ঝালমুড়ি খাচ্ছে।
এই সঙ্গী সুযোগ বুঝে সঙ্গিনীর গায়ে হাত দিচ্ছে।
তবে গায়ে হাত দিলে সঙ্গিনী কিছু মনে করেন না। খুশিই হন। শুধু মাঝে মাঝে কপট বিরক্তি দেখান। চোখের ইশারায় বলেন, ইশ! কেন যে এত দুষ্টুমি করো!
তিন। চিত্রগ্রাহক গ্রুপ।
এদের গলায় সবসময় ডিএসএলআর ঝোলানো থাকে। হাতে থাকে স্মার্টফোন। এবং এরা চোখের সামনে যাই দেখে খটাখট ছবি তুলে ফেলে। ফ্রি পয়সায় বিনোদনের জন্যে এই গ্রুপের কোন জুড়ি নেই।
একবার এক ফটোগ্রাফারকে দেখেছিলাম। এক পথশিশুর ছবি তুলছে। পথশিশুটি হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার সর্দি লেগেছে। নাক থেকে পানি পরছে।
ফটোগ্রাফার বিভিন্ন এঙ্গেলে ক্যামেরা ধরছেন। সম্ভবত ভালো কোন ভিউ পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ ফটোগ্রাফার স্থির হয়ে গেলেন। উঁচু গলায় একের পর এক ডিরেকশন দিতে থাকলেন।
নড়িস না, খাড়ায়া থাক!
হাসি দে!
এইতো হইছে!
হইছে হইছে, আর না!
আরেকটু ‘হিঙ্গল’ বাইর করতো! হইছে হইছে।
বেশ কয়েকটা ছবি তোলা হলো।
ছবি তোলা শেষ হলে আমি ফটোগ্রাফারের কাছে গেলাম। বললাম, ব্রাদার, ছবিটা একটু দেখা যাবে?
ফটোগ্রাফার বিরক্ত মুখে ক্যামেরার মনিটরে ছবি দেখালেন। দেখলাম ছবি যথেষ্টই ভালো হয়েছে। ফ্ল্যাশের আলোর কারণে শিশুটির ‘হিঙ্গল’ চকচক করছে।
আমি বললাম, বাহ! সুন্দর ছবি। আপনি কি প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার?
ফটোগ্রাফার বললেন, আমি ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফটোগ্রাফার। ফেসবুকে আমার পেজ আছে। পেজের নাম ‘আবুলজ ক্লিকজ’। আমার নাম আবুল।
ও আচ্ছা!
আবুল ভাই আর কিছু বললেন না। শিশুটিকে নিয়ে অন্যদিকে চলে গেলেন। সম্ভবত নতুন ব্যাকগ্রাউন্ডে ছবি তোলা হবে।
তবে যেই গ্রুপেরই হোক না কেন, সবাইকেই আমার ভালো লাগে। সবাইকেই আমি সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখি। গাহি সাম্যের গান।
তবে পার্কে যে সবসময় আনন্দময় ঘটনা ঘটে তা না।
মাঝে মধ্যে দুর্ঘটনাও ঘটে।
এইতো সেদিন কী একটা উৎসবের মত ছিল। গোটা পার্ক জুড়ে স্কুল কলেজের ছেলে মেয়েরা ছোট ছোট জটলা পাকিয়ে গল্প করছে। তুলকালাম অবস্থা।
এরকম একটা জটলার মধ্য থেকেই হঠাৎ এক তরুণী চিৎকার করে উঠল।
আম্মাআআআআআ!
চিৎকার শুনে কোত্থেকে তরুণীটির মা হুঙ্কার দিয়ে ছুটে এলেন। যেন তেন হুঙ্কার না। ব্রহ্মনাদ টাইপ হুংকার। সেই ভয়াবহ হুঙ্কার শুনে এক পাঞ্জাবী পায়জামা পরা বৃদ্ধকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতে দেখলাম।
ভদ্রমহিলা আকৃতিতে ছোটখাট একটা জলহস্তীর মতন। বয়স আনুমানিক পঞ্চাশ। পরনে বেঢপ আকৃতির জিন্স এবং সাদা কালো স্ট্রাইপড টি শার্ট।
মিসেস জলহস্তী তরুণীটিকে জিজ্ঞেস করলেন, কী হইছে রে?
তরুণীটি হাতের ইশারায় এক শুকনা ধরণের ছেলেকে দেখিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কী যেন বললো। মিসেস জলহস্তী দৌড়ে গিয়ে ছেলেটার শার্টের কলার ধরলেন। তারপর দুমদাম করে ঘুসি মারতে মারতে ছেলেটাকে মাটিতে শুইয়ে দিলেন।
ছেলেটা চিঁচিঁ করে বলল, খালাম্মা! আমি কিছু করি নাই! আমি কিছু করি নাই!
মিসেস জলহস্তী কোন কথাই শুনলেন না। অনবরত ঘুসি মারতেই থাকলেন। তাদের চারপাশে গোল হয়ে দর্শক দাঁড়িয়ে গেল।
আমিও দাঁড়ালাম।
দর্শকদের মধ্যে থেকে একজন বললেন, সিস্টার, আরো মারেন। হারামজাদার ঘরে মা ভইন নাই।
এই কথা শুনে মিসেস জলহস্তী উৎসাহিত হলেন। নব উদ্যমে ছেলেটাকে জোরে একটা ঘুসি মারলেন। ছেলেটা উড়ে গিয়ে দুই হাত পেছনে পড়ে গেল।
দর্শকরা আনন্দে হাততালি দিল। না দিয়েই বা করবে কী? এত আমোদের ব্যাপার সচরাচর ঘটে না। আমি নিজেও হাততালি দিলাম।
যাই হোক, এই দুই গ্রুপ বাদে যারা আছে তারা পার্কে আসে অকারণে।
যেমন, আমি।
আর এই অকারণে প্রায়ই পার্কে আসাতে একজনের সাথে আমার বেশ খাতির হয়ে গেছে।
ছেলেটার নাম কানা এরশাদ।
প্রথম দিকে কানা এরশাদকে একটা মেয়ে সাথে করে নিয়ে আসতে দেখতাম। রোমিও জুলিয়েট গ্রুপের সদস্য আর কী। তবে অন্যান্যদের তুলনায় বেশ ভদ্র এবং মার্জিত। দুজনে সারাক্ষণ বেঞ্চে বসে কুটুর কুটুর করে আলাপ করত। দেখতে ভালো লাগত।
প্রথম কয়েকদিন তাদের সাথে আমার শুধু চোখাচোখি হতো। অপরিচিত কিন্তু রোজ দেখা হলে যেমন হয় তেমন। তারপর একদিন ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে কেমন রহস্যজনক ভাবে হাসল। আমিও সামান্য হেসে হাসি ফেরত দিলাম। আমার হাসিতে সে উৎসাহিত হল। এবার চোখ টিপ দিলো। আমিও চোখ টিপ দিলাম।
সঙ্গের মেয়েটা তাকে কী যেন বলল। দেখলাম সে উঠে এল। আমার পাশে এসে বসতে বসতে বলল, পরিচিত হইতে আসলাম। ভাইজানের নাম কী?
আমি বললাম, আমার নাম আনিস।
ছেলেটা হাসিমুখে বলল, আমার নাম এরশাদ। কানা এরশাদ।
আমি অবাক হয়ে বললাম, তোমার চোখ তো দুটাই দেখছি ভালো!
জে, ভাইজান। দুইটাই ভালো। সামান্য পলিটিক্সের সাথে জড়িত তো। তাই নাম হইছে কানা এরশাদ।
কোন দলের?
যখন যেই দল আসে, সেই দলের। বর্তমানে আমি লীগের।
ও আচ্ছা।
ভাইজার রেগুলার আসেন। দেখা হয়। কিন্তু কথা হয় না। সেঁজুতি আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতে বলল। তার কৌতুহল আবার অতি উচ্চ পর্যায়ের।
বুঝলাম মেয়েটির নাম সেঁজুতি।
কানা এরশাদ বলল, ভাইজান, আপনে করেন কী?
আমি উদাস গলায় বললাম, কিছু করি না। বেকার।
কানা এরশাদ আনন্দিত গলায় বলল, আমিও এইটাই ধারণা করছিলাম।
ও আচ্ছা!
ভাইজানের সাথে কথা বইলা ভালো লাগলো। আমার নম্বরটা রাখেন। প্রয়োজনে ফোন দিবেন। আজকে থাইকা আমি আপনের ছোট ভাই।
আমি মোবাইল নম্বর রাখলাম।
কানা এরশাদ উঠতে উঠতে বলল, আসি ভাইজান। সেঁজুতি আবার রাগ করে বেশী। সারাদিন টিভি দেখে তো। অত্যধিক ঢং শিখছে। দেখেন না কেমনে তাকাইতেছে!
আমি দেখলাম সেঁজুতি মেয়েটা বিরক্ত চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার চোখ দুটো সুন্দর। এত দূর থেকেও তার দীর্ঘ পল্লব বোঝা যাচ্ছে।
আমি বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে। যাও।
তাইলে এই যায়গাতেই দেখা হবে ভাইজান। আসি। স্লামালেকুম।
ওয়ালাইকুম আসসালাম।
কানা এরশাদের প্রেম বেশিদিন টিকলো না।
সেঁজুতি নামের মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেল।
এরশাদের কাছে শুনলাম বিয়ে ভালো যায়গাতেই হয়েছে। পাত্র সৌদি প্রবাসী। বিয়ে করতে দেশে এসেছিল। বিয়ের পর সেঁজুতিকে নিয়ে আবার সৌদি চলে গেছে।
প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাওয়াতে এরশাদের তেমন সমস্যা হলো না। শুধু ‘সামান্য পলিটিক্সটা’ ছেড়ে দিলো। গুরুতর সমস্যা হলো একটাই। কানা এরশাদের ভেতরে একটা দার্শনিক সত্ত্বা জেগে উঠল। এখন কানা এরশাদের প্রধান কাজ পার্কের বেঞ্চে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা এবং মাঝে মধ্যে ভারী ভারী কিছু জ্ঞানগর্ভ কথা বলা।
কানা এরশাদের সাথে আমার বর্তমান সম্পর্ক প্রায় গুরু শিষ্যের পর্যায়ের। আমি পার্কে এলেই সে আমার কাঁধে সিন্দাবাদের ভুতের মত ঝুলে থাকে।
কানা এরশাদের নিবাস কমলাপুর বস্তিতে। কমলাপুরের যে কোন পান বিড়ির দোকানিকে তার নাম বললেই চিনবে এবং তার ঘরে কীভাবে যেতে হবে বলে দেবে।
অনেক কথা হয়েছে। এবার অদ্ভুত ঘটনাটার কথা বলা যাক।
ঘটনাটা ঘটেছে গতকাল সন্ধ্যায়।
আমি বিকাল থেকেই পার্কে একা বসে আছি।
আবহাওয়া অত্যন্ত মধুর। আকাশে হালকা মেঘ। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে।
আশেপাশে কোথাও কানা এরশাদকে দেখা যাচ্ছে না।
ব্যাপারটা বোঝা গেল না। সচরাচর এরশাদ পার্কে আসা মিস করে না। গত একমাসে আমি যে কবার পার্কে এসেছি তাকে পেয়েছি। এমনটা আজই প্রথম।
অনেকক্ষণ তার জন্য অপেক্ষা করলাম। বিকাল পার হয়ে গেল। কানা এরশাদের কোন খবর নেই। তাকে ফোনও দেয়া যাচ্ছে না। ইদানিং আমি মোবাইল সাথে রাখি না। বাসায় থাকে। তাও বেশিরভাগ সময় অফ।
একবার কমলাপুর যাবো কি না ভাবলাম। হাতে কোন কাজ নেই। যাওয়া যায়। পরে কী মনে করে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিলাম। একদিন নাই আসতে পারে। মানুষের কত কাজ থাকে। সবাই তো আর আমার মত গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘোরে না।
আমি একাই বসে থাকলাম। বড় এক ঠোঙ্গা বাদাম শেষ করলাম। সন্ধ্যার দিকে ভেলপুরি খেলাম। সবশেষে ঝালমুড়ি।
ঝালমুড়ি খাওয়া যখন শেষ করলাম তখন সন্ধ্যা পুরোপুরি নেমে গেছে। পার্কের বাতি জ্বালানো হয়েছে। এই আলো পার্কের অন্ধকার দূর করতে পারছে না। বরং কেমন যেন অন্ধকারকে আরো ঘন করে দিচ্ছে।
এদিকে পার্ক আস্তে আস্তে ফাঁকা হতে শুরু করেছে। আর কিছুক্ষণ পরেই নিশিকন্যারা ভীর করবে। বিকৃত এবং কদর্য কিছু মানুষের কাছে সুলভ মূল্যে নিষিদ্ধ ভালোবাসা বিক্রি করবে।
নিশিকন্যা!
শব্দটা বেশ সুন্দর। কাব্যিক একটা ভাব আছে।
আচ্ছা, নিশিকন্যারা কি জানে তাদের এত সুন্দর একটা নাম আছে?
রাত নামলে কখনোই আমি পার্কে থাকি না। তবে কাল থাকলাম। কেন যেন মনে হচ্ছিলো, আজ কোন এক নিশিকন্যার সাথে গল্প করলে কেমন হয়?
এরকম একটা জীবন তার নিজের কাছে কেমন লাগে জানতে চাইলাম।
কিংবা জানতে চাইলাম তার ভালোবাসার মানুষটার কথা।
নিশিকন্যারা হয়তো এসব প্রশ্নের উত্তর দেবে না। অথবা দিলেও ভুল উত্তর দেবে। তবু চেষ্টা করা যেতে পারে।
এসব যখন ভাবছি তখনই একটা বিড়াল দেখতে পেলাম।
বিড়ালটা আমার দিকেই আসছে। ধবধবে সাদা রঙের বিড়াল। শুধু একটা কান কুচকুচে কালো। সাদার মধ্যে কালো রঙটা ফুটেছে। দেখতে সুন্দর লাগছে।
বিড়ালটা একটা লাফ দিয়ে বেঞ্চে উঠল।
রাস্তার বিড়াল সচরাচর মানুষের ধারে কাছে আসে না। এ সেধে আমার কাছে এসেছে। এর ব্যাপারটা কী?
বিড়ালটা বেঞ্চে উঠেই লম্বা একটা হাই তুলল। তারপর কুণ্ডলী পাকিয়ে বসতে বসতে বলল, গুড ইভিনিং আনিস ভাই।
প্রথমে মনে হলো আমি ভুল শুনছি!
মনে হলো আবার কী! অবশ্যই ভুল শুনছি। বিড়াল কখনো কথা বলতে পারে না। শুধু বিড়াল কেন? মানুষ ছাড়া অন্য কোন কিছুই কথা বলতে পারে না।
তবে কিছু কিছু পাখি কথা বলতে পারে বলে শুনেছি। যেমন: ময়না, টিয়া, বউ কথা কও ইত্যাদি। তাও বেশী কথা বলতে পারে না। দুই তিনটা শব্দ বলতে পারে। এবং এইটুকু বলার জন্যেই তাদের কঠিন ট্রেনিঙের ভেতর দিয়ে যেতে হয়।
বিড়ালটা ঘাড় খানিকটা উঁচু করল। বলল, আনিস সাহেব, অবাক হবার কিছু নেই। আমি কথা বলতে পারি। আমি কোন সাধারণ বিড়াল না। আমি একটা পেইন্টিঙের সাবজেক্ট।
আমি বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা বাস্তবে ঘটছে না।
যে কোন কারণেই হোক আমার মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়ে আছে। তাই এরকম ঘটনা ঘটছে। জগতে অতি রহস্যময় ব্যাপার স্যাপার ঘটে। কিন্ত কোন একটা বিড়াল মানুষের মত বলছে, আমি কথা বলতে পারি- এমন ব্যাপার ঘটে না।
বিড়ালটা কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ল। কোন নড়াচড়া নেই।
আমি মোটামুটি ধাঁধাঁয় পড়ে গেলাম। ইচ্ছা করল বিড়ালটাকে ডাক দিয়ে দেখি। কিন্তু ডাক দেয়া ঠিক হবে কি না তাও বুঝতে পারছি না। অবশ্য এমন মুহূর্তে চুপ করে থাকাই উচিৎ। পুরো ব্যাপারটাই উত্তেজিত মস্তিষ্কের কল্পনা। উত্তেজিত মস্তিষ্ককে পাত্তা দেবার কিছু নেই।
শেষ পর্যন্ত কৌতুহলের কাছে যুক্তির পরাজয় ঘটল। আমি বললাম, এই বিড়াল, এই!
বিড়ালটা মাথা তুলল। আমার দিকে না তাকিয়েই বলল, আমার নাম মিস্টার টম। আমাকে এই বিড়াল এই বলে ডাকবেন না।
তোমার নাম মিস্টার টম?
জি।
এখন ব্যাপারটা কিছুটা পরিষ্কার হচ্ছে। মাস খানেক আগে মিলিদের বাসায় গিয়েছি। দেখি সে রঙ টঙ নিয়ে বসেছে। ছবি আঁকবে।
আমি বললাম, কী করছিস?
মিলি বিরক্ত গলায় বলল, দেখছিস না কী করছি?
মানে জিজ্ঞেস করলাম, কী আঁকবি।
মিলির হাতে একটা পেন্সিল। সে পেন্সিলটা কাটতে কাটতে বলল, ঘন সবুজ অরণ্যের মাঝে একটা পুকুর। আকাশে চাঁদ। চারিদিকে উত্থাল পাত্থাল জোছনা। পুকুরের পাড়ে একটা বিড়াল। বিড়ালটা অবাক হয়ে জোছনা দেখছে। বিড়ালটা ধবধবে সাদা। শুধু ডান কানটা কুচকুচে কালো।
আমি বললাম, শুনে তো অসাধারণ লাগছে!
হুম।
বিড়ালটার নাম কী?
বিড়ালের আবার নাম কী!
নাম নেই?
না।
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, বিড়ালটার একটা নাম দে। যেমন, মিস্টার টম।
মিলি উত্তর দিল না। সে আরেকটা পেন্সিল কাটা শুরু করেছে।
আমি বললাম, বিড়াল কি একটা আঁকবি?
হুম।
একটা বিড়াল না। দুইটা আঁক। নবদম্পতি টাইপ। হানিমুন করতে জঙ্গলে এসেছে।
মিলি বিরক্ত মুখে বলল, রসিকতা করছিস?
না। আমি সিরিয়াস। কোন বিড়াল দম্পতিকে এখনো হানিমুন করতে দেখা যায় নি। তুই আঁকতে পারিস। আনকমন হবে।
মিলি আমার দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলল, আগামী সাতদিন তুই আমার বাসায় আসবি না। ছবি কমপ্লিট হোক, তারপর আসবি।
আমি উঠতে উঠতে বললাম, আচ্ছা যা। খোদা হাফেজ।
এখন বুঝতে পারছি মিলির এই বিড়ালের ব্যাপারটা আমার অবচেতন মনে জমা ছিল। এখন কোন একটা বিচিত্র কারণে সেই বিড়ালটাকে আমি চোখের সামনে দেখছি। শুধু যে দেখছি তাই না। বিড়ালটা আমার সাথে কথাও বলছে।
মিস্টার টম বলল, আশা করি আমাকে চিনতে পেরেছেন?
হুম।
আপনি অনেক দিন মিলি ম্যাডামদের বাসায় যান না। কেন যান না জানতে পারি?
আমি বললাম, মিলি আঁকা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার বাসায় যেতে নিষেধ করেছে।
এটা এক মাস আগের কথা। ছবি আঁকা অনেক আগেই শেষ হয়েছে। সেই ছবি বাঁধাই করে দেয়ালে টানানো হয়েছে।
বলো কী!
যা সত্য তাই বলি। মিস্টার টম অকারণে মিথ্যা কথা বলে না।
ও আচ্ছা।
মিস্টার টম গম্ভীর গলায় বলল, আপনাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারি?
অবশ্যই পারো।
আপনি অনেকক্ষণ ধরেই নিশিকন্যার কথা ভাবছেন। কেন ভাবছেন?
আমি একটা ধাক্কার মত খেলাম। আমি নিশিকন্যার কথা ভাবছি এই কথা তার জানার কথা না।
আমি বললাম, আমি নিশিকন্যার কথা ভাবছি তুমি জানলে কীভাবে?
মিস্টার টম বলল, আমি মানুষের মাথার ভেতর ঢুকতে পারি। আপনার মাথার ভেতর ঢুকলাম। দেখলাম নিশিকন্যা শব্দটা বন বন করে ঘুরছে।
বলো কী!
জি। তবে বিনা অনুমতিতে একজন মানুষের মাথায় ঢোকা অন্যায়। ভুলক্রমে ঢুকে পড়েছি। অন্যায় হয়েছে। ক্ষমাপ্রার্থী। আই এম সরি।
ইটস ওকে।
মিস্টার টম একটা বেশ বড় একটা হাই তুলল। তারপর বলল, আনিস সাহেব, আমি দুটো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে এসেছি। কথাগুলো বলে বিদায় হই। অধিক সময় ছবির বাইরে থাকলে আমার সমস্যা হয়।
তুমি ছবির ভেতর থেকে বের হয়ে এসেছো না কি!
জি। এত অবাক হওয়ার কিছু নাই। দুনিয়াটা বড় অদ্ভুত।
তাই তো দেখা যাচ্ছে!
এখন শুনুন। প্রথম গুরুত্বপুর্ন কথা হচ্ছে, মিলি ম্যাডাম আপনাকে খুঁজছে। আপনাকে ফোনও করেছিল। আপনার মোবাইল অফ।
ও আচ্ছা।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে তার অপঘাতে মৃত্যুর সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। গলায় ফাঁস টাঁস টাইপ।
আমি হকচকিয়ে গেলাম। এধরণের কোন কথার জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না। বললাম, বলো কী! তুমি জানলে কীভাবে?
এসব কিছু কিছু ব্যাপার আমি আগে থেকেই বুঝতে পারি। কীভাবে বুঝতে পারি তা বলতে পারবো না।
ও আচ্ছা।
দেখলাম মিস্টার টম কেমন উদাস হয়ে গেল। বলল, আনিস ভাই। ব্যাপারটা জানার পর থেকেই আমার অনেক মন খারাপ। মিলি ম্যাডামকে আমি খুবই পছন্দ করি।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে আমার নিজেরই কেমন মন খারাপ লাগল। ফাঁসির ব্যাপারটা মাথায় ঢুকে গেল। কেন যেন মনে হল আমার মৃত্যু হবে ফাঁসিতে ঝুলে।
আজ রাতেই ফাঁসি।
ফাঁসির সময় রাত দশ ঘটিকা।
এখন বাজে আটটা।
হাতে আর বেশী সময় নেই। কিছুক্ষণ পরেই জেলার আমাকে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করবেন, আনিস সাহেব, রাতে কী খাবেন? বিশেষ কিছু কি খেতে ইচ্ছে করছে?
স্যার অনেক কিছু খেতে ইচ্ছে করছে।
কী? বলুন।
বাসমতি চালের ভাত।
খাসির রেজালা (ওপরে বড় বড় গোল গোল করে কাটা পেঁয়াজ)।
টমেটোর চাটনি।
টমেটো, কাঁচা মরিচ, ধনে পাতার সালাদ।
এক গ্লাস বোরহানি।
এক বোতল মিনারেল ওয়াটার।
আচ্ছা আচ্ছা। ব্যবস্থা করছি।
শেষে এক বাটি ক্ষীর কি পাওয়া যাবে স্যার?
অবশ্যই। চাইলে সিগারেটও খেতে পারবেন।
ধন্যবাদ স্যার। একটা সিগারেট লাগবে। বেনসন এন্ড হেজেস।
আমার মাথা হ্যাং করল। কারণ মস্তিষ্ক একই সাথে ভিন্ন দুই ধরণের চিন্তা করছে। একদিকে আছে সুখাদ্যের সুখকর চিন্তা। অন্য দিকে আসন্ন মৃত্যুর গভীর বেদনার চিন্তা।
হঠাৎ এক কাণ্ড হলো। হুট করে পার্কের ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল। আমি অবাক হয়ে গেলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার! পার্কেও লোডশেডিং হয় না কি!
এসব যখন ভাবছি তখনই একসাথে অনেক গুলো কাক ডেকে উঠল।
কা কা কা!
আমি যথেষ্টই ভয় পেলাম। কাকের ডাক থামছে না। প্রতিধ্বনির মত হচ্ছে। প্রতিধ্বনির জন্যে মনে হচ্ছে একসাথে হাজার হাজার কাক ডাকছে।
আনিস ভাই, কী হইছে আপনের!
আমি চমকে উঠলাম। দেখলাম, কানা এরশাদ চিন্তিত মুখে আমার দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। আমার সারা শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে।
আমি বেঞ্চের দিকে তাকালাম। মিস্টার টমকে দেখতে পেলাম না। পার্কে ইলেকট্রিসিটিও আছে দেখলাম। মাথার উপর ল্যাম্পপোস্টে লাইট জ্বলছে।
কানা এরশাদ চিন্তিত গলায় বলল, আনিস ভাই হইছে কী? ডর খাইছেন?
আমি বললাম, এরশাদ, তুমি কি এখানে কোন বিড়াল দেখেছো?
কানা এরশাদ কিছুক্ষণ এদিক ওদিক দেখে বলল, কই বিলাই?
কোন কাকের ডাক শুনেছো?
কানা এরশাদ অবাক গলায় বলল, কই না তো! আপনার হইছে কী!
আমি উত্তর দিলাম না। আমার মনে হলো আমি পাগল টাগল হয়ে যাচ্ছি।
পাগল হওয়া বিচিত্র কিছুই না। আমাদের বংশে মাথা খারাপ রোগ আছে।
আমার ছোট চাচীর মাথা খারাপ। ভয়াবহ রকমের খারাপ। এমনিতে অবশ্য ঠিকই থাকেন। স্বাভাবিক চলাফেরা করেন। কাজকর্ম করেন। হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই গায়ের সব কাপড় খুলে ফেলেন। তারপর সেই কাপড় ছেঁড়া শুরু করেন। এই সময়ে তার গায়ে অন্য কোন কাপড় দেয়া যায় না। দিলেই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেন। তখন তাকে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়।
অনেক আগে আমি একবার চাচীকে নগ্ন দেখেছিলাম। চাচী অতি রূপবতী। গায়ের রঙ দুধে আলতায়।
আমিও মনে হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি। মনে হয় আবার কী! ইতিমধ্যেই হয়ে গেছি।
বিড়ালের কথা শোনা।
রাত বিরাতে শত শত কাকের ডাক শোনা।
পাগল নয় তো কী?
তবে রোগটা হয়তো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। আর কিছুদিন পরেই দেখা যাবে আমি নগ্ন হয়ে রাস্তায় ট্রাফিক কন্ট্রোল করছি। ঢাকার পাগলদের প্রথম কাজই হচ্ছে ট্রাফিক কন্ট্রোল করা।
ভাইজান কী চক্ষে ধান্ধা দেখছেন?
তেমনই মনে হচ্ছে।
এগুলা কোন ব্যাপার না। মাঝে মধ্যে ধান্ধা দেখন ভালো। স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
ও আচ্ছা।
আপনে এত রাইত পর্যন্ত করেন কী?
কিছু না। যাবো যাবো করে দেরী হয়ে গেল।
জলদি বাসায় যান। আকাশের অবস্থা ভালো না। এখন না গেলে বৃষ্টিতে ভিজবেন।
আমি আকাশের দিকে তাকালাম। সত্যিই মেঘ করেছে। আশ্চর্যের ব্যাপার। চারপাশ কেমন থম মেরে আছে। যে কোন মুহুর্তে বৃষ্টি নামবে।
চলেন ভাইজান। আপনারে রিকশাতে তুইলা দেই। যে অবস্থা আপনারে একলা ছাড়ন ঠিক হইবো না।
আমারো তাই ধারণা। চলো।
শাহবাগ মোড়ে একটা রিকশা পাওয়া গেল। রিকশাওয়ালা অতি বৃদ্ধ। মনে হয় না সে এই শরীর নিয়ে জিগাতলা পর্যন্ত রিকশা টেনে নিয়ে যেতে পারবে। আশে পাশে আর একটা রিকশাও দেখা যাচ্ছে না। এমনিতেই শুক্রবার। ছুটির দিন। তার উপর আকাশের অবস্থা ভালো না। নয়টা বাজতেই রাস্তা খালি হয়ে গেছে। এই বৃদ্ধের রিকশায় যাওয়ার চেয়ে বাসে যাওয়া ভালো।
বাসে যাবো এই চিন্তা করছি তখন বৃদ্ধ বললেন, বাবাজী চলেন, যাই, আমার কয়টা টেকা ইনকাম হউক।
আমি কিছু বলার আগেই কানা এরশাদ বললো, ভাইজান, এ বুড়া হইলেও গায়ে জোর আছে। অসুবিধা নাই। আর এমনিতেও আকাশের অবস্থা ভালো না। এইটাতেই যান গা। আল্লা ভরসা।
কানা এরশাদকে বিদায় দিয়ে রিকশায় উঠলাম।
রিকশা কিছুদূর চলতেই বোঝা গেল বৃদ্ধের গায়ে জোরের জ ও নেই। বৃদ্ধ অতি কষ্টে রিকশা টানছেন। এমন অবস্থায় রিকশায় বসে থাকাটাও অস্বস্তির ব্যাপার।
আমি বললাম, চাচা, এক কাজ করি, আমি রিকশা চালাই। আপনে সিটে বসেন।
বৃদ্ধ বললেন, একসিডেন করবেন। পারবেন না। রিশকা চালাইন্যা এত সহজ না।
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টি যখন শুরু হয়েই গেছে তখন আর রিকশায় যাওয়ার কোন মানে হয় না। তাছাড়া অনেক দিন বৃষ্টিতেও ভিজি না।
কাঁটাবনের সামনে রিকশা থামাতে বললাম। ভাড়া পুরোটাই দিলাম। পুরো ভাড়া পেয়েও বৃদ্ধ কিছুই বললেন না। নির্বিকার ভঙ্গীতে টাকাটা পকেটে রেখে দিলেন।
বৃদ্ধ এখন নীলক্ষেতের দিকে যাচ্ছেন। খালি রিকশা টানতেও তার বেশ কষ্ট হচ্ছে।
বৃষ্টির বাড়ছে। রাস্তায় সোডিয়াম ল্যাম্পের সোনালী আলো। মনে হচ্ছে আকাশ থেকে সোনালী রঙের বৃষ্টি পড়ছে।
আমি ভিজতে ভিজতে এগুচ্ছি। কিছুক্ষণ আগের ভয়টা কেটে গেলো। মনে হলো কিছুই ঘটেনি। হয়তো তন্দ্রার মত হয়েছিল। তাই দুঃস্বপ্ন দেখেছি। চিন্তাটা আমাকে বড়ই স্বস্তি দিল। আমি আনন্দিত গলায় গান ধরলাম, আজি ঝর ঝর মুখর বাদল দিনে…
এখন দিন না। রাত।
আমি গানের কথা সামান্য পাল্টে দিলাম। আজি ঝর ঝর মুখর বাদল রাতে…
শব্দ পাল্টে দেয়াতে সুরের কোন হেরফের হলো না। মাত্রা ঠিক আছে। রবীন্দ্রনাথ অসাধারণ প্রতিভার একজন মানুষ। তিনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিলেন তার এই গানটা রাতেও গাওয়া হতে পারে। তাই গানটার স্ট্রাকচার এমন ভাবে করে গেলেন যাতে দিন রাত যে কোন শব্দ দিয়েই এটা গাওয়া যায়।
হোয়াট আ ট্যালেন্ট!
(চলবে…)