What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Self-Made ধারাবাহিক গল্প : সম্পর্ক ,বিয়ে, অতপরঃ (1 Viewer)

Joined
Aug 23, 2020
Threads
74
Messages
111
Credits
7,054
আমি ডাঃ ফারহানা, পাঁচ বছরের প্রেমের সম্পর্ক, তারপর বিয়ে এবং এগারো বছর একসাথে চলা অতঃপর আমার হাজব্যান্ড ডাঃ রায়হানকে ডিভোর্স দিতে আজকে আইনজীবী ব্যারিস্টার আজমিরি সুলতানার চেম্বারে এসেছি।

ভিতরে আসতে পারি?
হ্যা অবশ্যই, ভিতরে আসুন।
ধন্যবাদ।
আপনি?
জ্বী আমি ডাঃ ফারহানা।
ওহ্ গতকাল রাতে তাহলে আপনিই কল দিয়েছিলেন?
জ্বী।
আচ্ছা বসুন আগে। এবার বলুন কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?
আমি আমার হাজব্যান্ড ডাঃ রায়হানকে ডিভোর্স দিতে ‌চাই।
উনার বিরুদ্ধে আপনার অভিযোগ কি?
কোনো অভিযোগ ছাড়া কি আমি ডিভোর্স দিতে পারিনা?
হ্যা পারেন, আপনি আপনার হাজব্যান্ডকে ডিভোর্স দিতে চাচ্ছেন ভালো কথা কিন্তু একজন আইনজীবী হিসেবে আমাকে জানতে হবে কেন আপনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?
রায়হানের সাথে আমার পক্ষে সংসার করা আর সম্ভব নয়।
ঠিক আছে, আপনি আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিন।
বলুন কি জানতে চান?
আপনার স্বামী কি আপনার সাথে কোনো দূর্ব্যবহার কিংবা আপনাকে মারধোর করে?
না আমার স্বামী কখনোই আমার গায়ে হাত তুলে নি।
তাহলে কি আপনার শশুর বাড়ির লোকজন আপনাকে কোনো শারীরিক নির্যাতন বা যৌতুকের কোনো বিষয় আছে?
না এমন কোনো সমস্যা নেই।
আপনাদের বিয়ে কি পারিবারের পছন্দে হয়েছিল?
আমরা দুজন দুজনকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি।
উনার কি এখন অন্য কোনো মেয়ের সাথে পরকীয়া আছে?
না, ও এমন পুরুষ না।
তারপরও পুরুষ মানুষের মনের কথা বলা যায় না। কত বছরের সংসার আপনাদের?
এইতো আগামী মাসে ছয় বছর পূর্ণ হবে।
আপনাদের ছেলে মেয়ে কয়জন?
ছেলেটার বয়স পাঁচ বছর আর মেয়েটার বয়স দুই বছর এখনো হয়নি।
আশ্চর্য! আপনারা দুজন দুজনকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন, ছয় বছর সংসারও করেছেন আবার দুটি সন্তানও আছে তাহলে এত বছর পর কি এমন ঘটলো যে, আপনি আপনার হাজব্যান্ডকে ডিভোর্স দিতে চাচ্ছেন?
শুনুন তাহলে।
এইচএসসি পাশের পর আমি একটা সরকারি মেডিকেল কলেজে চান্স পাই। সেখানেই রায়হানের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। আমরা দুজনেই ব্যাচম্যাট ছিলাম। দুজনেই খুব ভালো স্টুডেন্ট ছিলাম। আমাদের মাঝে পড়াশুনা নিয়ে সবসময়ই প্রতিযোগিতা চলত কে কার চেয়ে ভালো করব। তবে বেশিরভাগ সময়ই আমি রায়হানের চেয়ে এগিয়ে থাকতাম। এই নিয়ে ও খুব মন খারাপ করতো। প্রতিযোগিতা করতে করতেই একসময় দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলি। আমরা দুজনেই তখন পড়াশুনার বিভিন্ন বিষয়ে একে অপরকে সাহায্য করতাম। কলেজ লাইফটা আমাদের হাসি আনন্দে ভালোই কেটে যায়। এমবিবিএস কোর্স শেষে আমরা দুজন দুটি প্রাইভেট হাসপাতালে চাকরি নেই। বেশ কিছুদিন পর আমাদের দুই পরিবারের সম্মতিতে আমরা বিয়েও করি। বেশ ভালোভাবেই আমাদের সংসার জীবন কাটছিলো। পরিবারে আমার শশুরবাড়ির লোকজনদের সাথে আমার নিজের পরিবারের মতোই আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমার শশুর-শাশুড়ি আমাকে অনেক স্নেহ করতো। আমার কখনো মনেই হতো না যে আমি শশুর বাড়িতে আছি। ছয় মাস ভালোভাবে পার হলো। আমাকে ও রায়হানকে প্রায়সময় রাতেও ডিউটি করতে হত। আমাদের আলাদা আলাদা সময়ে ডিউটি পড়তো। যার জন্য আমাদের দুজনের একসাথে থাকা খুব কম হতো। আর এই বিষয় নিয়ে প্রথম কথা বলা শুরু করল আমার শাশুড়ি। বাড়ীর বউ রাতে বাড়ীর বাইরে থাকে আর স্বামী একা একা থাকে, এসব কেমন জীবন! আরো অনেককিছুই বলতো তখন। এরপর আস্তে আস্তে রায়হান নিজেও বলতো যে আমাকে ঠিকমত কাছে পায় না। ওর খুব কষ্ট হয়। তারপরে আমি যতটুকু সম্ভব রায়হানের সাথে ব্যালান্স করে ডিউটিগুলো করতাম। আরো কিছুদিন পর আমরা বেবী নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি যখন কনসিভ করি তখনও চাকরি করেছি। আর রায়হান তখন চাকরির পাশাপাশি পোস্ট গ্রাজুয়েশন কোর্স FCPS এ ভর্তি হয়ে যায়। আর আমি মা হবার কোর্সে ভর্তি হলাম। তখন রায়হান এত বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লো যে আমার সাথে তেমন একটা দেখাই হতো না। আমার প্রেগন্যান্সির পুরো সময়টা আমি একাই লড়াই চালিয়ে গেছি। রায়হান পড়াশোনা এবং হাসপাতালের কাজে ব্যস্ত থাকতো বলে আমি ওর কাছে কোনো অভিযোগ করিনি। আমি ব্যালান্স করে নিয়েছিলাম। আমার ছেলে হওয়ার পর শশুর-শাশুড়ি আমাকে যথেষ্ট পরিমাণে যত্নআত্নি করেছেন। প্রেগন্যান্সি এবং প্রেগন্যান্সির পর কয়েকমাস আমি চাকরি করিনি। ছেলেটা একটু বড় হলে শশুর শাশুড়ির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আমি আবার চাকরিতে যোগ দেই। আমার ছেলের বয়স যখন এক বছর হলো তখন আমি রায়হানকে বলি যে, আমিও FCPS করবো। রায়হান তখন আমাকে সাপোর্ট করলো না। বলল একসাথে বাচ্চা, চাকরি আবার FCPS করতে পারবো না। ও বললো, "মায়ের শরীর বেশি ভালো যাচ্ছেনা সংসারের দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। তাছাড়া ছেলেটা ঠিকমতো তোমাকেও পাচ্ছে না আমিও সময় দিতে পারি না। মা এসব নিয়ে আমাকে অনেক কিছু বলে।"
আমি ওকে বলি আমিও উচ্চতর ডিগ্রি নিতে চাই।
রায়হান তখন আমার উপর রেগে যায় "তাহলে চাকরি ছেড়ে দাও, নয়তো তোমার মায়ের কাছে আরিয়ানকে রেখে যেও।"
আমার ছেলের নাম আরিয়ান।
আমি তাই করলাম আমার ছেলেকে আমার মায়ের বাসায় রেখে রেখে চাকরি, FCPS করতে লাগলাম। এই নিয়ে রায়হানের সাথে এবং শাশুড়ির সাথে বেশ কয়েকবার আমার কথা কাটাকাটিও হয়েছে। কিন্তু আমি আমার পড়াশোনা ও চাকরি কোনোটাই বন্ধ করিনি।
এভাবেই চলে যাচ্ছিল, হঠাৎ করে একদিন শাশুড়ির হার্ট অ্যাটাক হলো। আমার উপর সংসারের সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ল। আমি সকালে রান্না করে বাসায় সবাইকে খাইয়ে দিয়ে হাসপাতালে শাশুড়ির সেবা করতাম। আবার আমার ডিউটিও থাকতো। ছেলেটাকে মায়ের বাসায় রেখে যেতাম। তখন রায়হান বলেছিল ওর কোর্সটা বন্ধ করে দিতে। কিন্তু আমি বললাম "তুমি মাঝপথে চলে এসেছ, এখন পিছিয়ে আসা ঠিক হবে না। আমি সবদিক সামলে নিতে পারব। আমিই বরং কোর্সটা বন্ধ করে দেই। পরে আবার সুযোগমতো করব। তুমি তোমার লক্ষ্য পূরণে মনোযোগ দাও।" এইভাবে সংসারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমার FCPS কোর্সটা আর করা হলো না। রায়হানের চেয়েও বেশি মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলাম আমি। রায়হান FCPS কোর্স শেষ করে রেজাল্ট পেয়ে যেদিন মিষ্টি নিয়ে আসলো সেদিন অনেক খুশি হয়েছিলাম। সেইসাথে নিজের জন্য আমার খারাপও লাগছিল। আমার অনেক ইচ্ছা ছিল আমি উচ্চতর ডিগ্রি নিবো। যাইহোক আমি সব কষ্ট ভুলে গিয়ে শুধু চাকরি, ছেলে আর সংসার নিয়েই জীবনে সুখী হবার চেষ্টা করলাম।

কিছু দিন পর আমি আবার কনসিভ করি। আর এবার রায়হান FRCP করতে আয়ারল্যান্ডে সুযোগ পেল। কিন্তু আমি প্রেগন্যান্ট, শাশুড়ি মা অসুস্থ এই অবস্থায় ও যেতে চাইলো না। ও কিছুতেই দেশের বাইরে যাবে না সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। শেষে আমি অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে ওকে আয়ারল্যান্ড যেতে রাজি করাই। ও চলে যাওয়ার পর আমার একটা মেয়ে হয়। আমার মেয়ের নাম আরিশা। ছেলে-মেয়ে লালন পালন, শশুর-শাশুড়ির দেখাশোনা, চাকরি করে সংসার চালানো সবকিছু একসাথে সামলেছি। যতোই সমস্যা হোক, যতোই কষ্ট হোক আমি কখনো রায়হানকে কিছু জানাইনি। আমি চাইনি ওকে কোনো চিন্তা দিতে। আমি শুধু চেয়েছি ও কোর্সটা ভালোভাবে সম্পন্ন করে দেশে ফিরে আসুক। ও ভালোয় ভালোয় FRCP কোর্স শেষ করে দেশে ফিরেও আসে। দেশে এসে একটা বড় হাসপাতালে প্র্যাকটিস করা শুরু করে দিল। আমি তখনও MBBS সার্টিফিকেট নিয়ে ডিউটি ডাক্তার হিসেবে চাকরি করছি।
এবার রায়হান আমাকে বললো, "এই কয়েকটা বছর তোমার উপর অনেক ধকল গেছে এবার চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে শুধু ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জন্য চেষ্টা করো।"
আমি রায়হানকে বলি "আমি আমার ডাক্তারি পেশা ছাড়তে পারবো না। আমি আরো উচ্চতর ডিগ্রি নিতে চাই। স্কুল জীবন থেকেই আমার স্বপ্ন আমি অনেক বড় একজন ডাক্তার হবো।"
রায়হান তখন আমাকে ভালোমন্দ কিছুই বললো না।
ও ওর মত চেম্বার করছে আর আমি আমার মতো করে চাকরি করছি। সেইসাথে দেশের বাইরে MD করার জন্য এপ্লিকেশন করতে লাগলাম।
অনেক চেষ্টা করার পর আমেরিকায় MD করার জন্য স্কলারশিপ পেয়েও যাই। আমি আমার এত বড় সু-সংবাদটা প্রথমে রায়হানকে জানাই। ভেবেছিলাম রায়হান জেনে খুব খুশি হবে। কিন্তু না রায়হানের মুখ কালো হয়ে গেল। রায়হান বলল,
ছেলেমেয়েদের কে মানুষ করবে? সংসার, মা-বাবা উনাদের কে দেখাশোনা করবে? তুমি কোথাও যেতে পারবে না। আর তোমার চাকরি করারও দরকার নেই।
আমি প্রতিবাদ করি,
এ তুমি কি বলছো রায়হান? আমি সবকিছু ছেড়ে দিবো!
হ্যা, তুমি সংসার আর ছেলে মেয়েদের দেখাশোনা করো। তোমার আর চাকরি বা পড়াশোনা করার প্রয়োজন নেই।
রায়হান আমি ছোটবেলা থেকে একজন বড় ডাক্তার হবার স্বপ্ন দেখেছি। এইজন্য আমি অনেক পড়াশোনা করতে চাই।
তুমি পারবেনা।
আমি পারবোনা? তুমি ভুলে গেছো যে, আমি তোমার চেয়েও ভালো স্টুডেন্ট ছিলাম। আমি MD করবোই।
তুমি যেযেতু আমার কোনো কথাই শুনবে না তাহলে তুমি দেশেই করো।
আমার ইচ্ছে আমি দেশের বাইরে করবো।
না তুমি করতে পারবে না।
একশো বার করবো।
তুমি কিন্তু জেদ করছো ফারহানা।
হ্যা আমি আমার স্বপ্ন পূরণের জন্য জেদই করছি।

রায়হানের সাথে আমার অনেক ঝগড়া হয়। ও আমাকে থাপ্পর মারতেও চেয়েছিলো। কিন্তু পরে আর মারে নি। সেদিনের পর আমার আর রায়হানের মাঝে কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়। আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। একদিকে ছেলে-মেয়ে, সংসার আরেক দিকে আমার ছোটবেলা থেকে লালন করা স্বপ্ন।
আমি কিভাবে দুই কুল বাঁচাবো বুঝতে পারছিলাম না।

আরো কিছুদিন পার হয়ে যায়। আমি রায়হানকে বললাম,
আমি কি করবো?
আমি তো যা বলার বলে দিয়েছি।
কিন্তু আমি তো বিদেশ যেতে চাই।
তাহলে একেবারে আমাকে ছেড়ে চলে যাও।
কি বলতে চাচ্ছ তুমি?
যদি তোমার বিদেশ যেতেই হয় তবে আমি তোমাকে ডিভোর্স দিবো। তোমার সাথে আমার আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না। আমার সন্তানদেরও তোমার সাথে কোনো সম্পর্ক থাকবে না।
তোমার সন্তান মানে? ওরা আমার সন্তান। আমি যখন এই ছয়টা বছর একা একা ওদের বড় করেছি কোথায় ছিলে তুমি? তুমি বাবা হয়ে কোনো দায়িত্ব পালন করেছ?
আমি কেন দায়িত্ব পালন করতে পারিনি তা তুমি ভালো করেই জানো।
তুমিই আমাকে FCPS বন্ধ করতে দাওনি। তুমিই আমাকে বিদেশ যেতে বাধ্য করেছ।
হ্যা আমি করেছি, আমি তোমার স্বপ্ন পূরণের জন্য সাহায্য করেছি। আমি নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়েছি তোমার জন্য। আমি তোমার পাশে না দাঁড়ালে তুমি আজকে দেশ সেরা একজন ডাক্তার হতে পারতে না। তোমার অবর্তমানে তোমার সন্তানদের, তোমার মা-বাবার সবার দায়িত্ব আমি একা পালন করেছি।
একজন স্ত্রী হিসেবে একজন মা হিসেবে এসব দায়িত্ব পালন করা তোমার কর্তব্য।
আচ্ছা ঠিক আছে তোমার কথা মেনে নিলাম এসব আমার কর্তব্য। কিন্তু তোমার কি কোনো কর্তব্য নেই?
আমি তো তোমাকে বলেছি এখন পরিবারের সব দায়িত্ব আমার, আমি সব টাকা পয়সা দিবো। তুমি শুধু তাদের দেখাশোনা করো।
টাকা দিলেই সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? আর আমার স্বপ্ন? আমার স্বপ্ন পূরণের জন্য তুমি সাহায্য না করে উল্টো বাঁধা দিচ্ছ?
দেখো ফারহানা আমি এসব নিয়ে তোমার সাথে আর কথা বলতে চাই না। তোমার যদি বিদেশ যেতেই হয় তবে সব সম্পর্ক শেষ করে দিয়ে তবেই যাবে।

সব তো শুনলেন। আর এইজন্য আমি রায়হানকে ডিভোর্স দিতে চাই। আপনি সব কাগজপত্র তৈরি করুন।
হুম বুঝলাম সবকিছু। আপনি এবার শান্ত হোন আর আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন।
হ্যা বলুন।
আপনি তো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যেভাবেই হোক বিদেশ যাবেন।
হ্যা।
আপনি এক কাজ করুন, আপনি আপনার মেয়েকে আপনার মায়ের কাছে রেখে বিদেশ চলে যান।
আর আমার ছেলে? আমি কিছুতেই আরিয়ানকে ওর হাতে তুলে দিতে চাই না।
আপনাদের তো ডিভোর্স হবে না।
মানে?
মানে আমি আপনাদের ডিভোর্স করাবো না।
কি বলতে চাচ্ছেন আপনি, আর কি করতে চাচ্ছেন?
আমি বলতে চাচ্ছি আপনি আপনার হাজব্যান্ডকে ডিভোর্স না দিয়ে, উনাকে না জানিয়ে বিদেশ চলে যাবেন।
এতে করে তো পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।
দেখুন আপনাদের প্রায় এগারো বছরের সম্পর্ক।
তাতে কি?
সম্পর্ক এত ঠুনকো নয় যে এত সহজে ভেঙে যাবে। আপনার কথা শুনে আমার মনে হয় আপনারা দুজন দুজনকে অনেক ভালোবাসেন। যা বলছেন আর যা করতে চাচ্ছেন সবকিছু রাগ থেকেই। দেখুন চাইলেই একটা সম্পর্ক ভেঙে ফেলা যায়। কিন্তু একবার ভেঙে গেলে সে সম্পর্ক কিন্তু আর জোড়া লাগানো যায় না। তাই আমি যা বলি তাই করুন।
ঠিক আছে বলুন, আপনি আমার আইনজীবী আপনি যেভাবে বলবেন সেভাবেই হবে।
আপনি আপনার ছেলেকে আপনার শশুরবাড়ীতে আর মেয়েকে আপনার মায়ের কাছে রেখে আমেরিকা চলে যাবেন। আর যাওয়ার আগে আপনার হাজব্যান্ডকে শুধু একটা চিঠি লিখে যাবেন।
শুধু একটা চিঠি!
হ্যা শুধু একটা চিঠি। আর চিঠিতে কি লিখবেন, কিভাবে লিখবেন সেটার বিষয়ে আমি আপনাকে সাহায্য করবো। তারপর কি করতে হবে সবকিছু আমি বুঝিয়ে বলছি।

ব্যারিস্টার আজমিরি সুলতানা আমাকে কিভাবে চিঠি লিখতে হবে তা বুঝিয়ে বললেন। আজমিরি সুলতানার পরামর্শ আমার পছন্দ হলো।

এখন আপনি আপনার ফ্লাইট কনফার্ম করতে পারেন। আপনি যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিন। আমাদের প্ল্যানিং যদি সফল না হয় অথবা পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যায় তাহলে আপনারা পরবর্তীতে নাহয় আলাদা হয়ে গেলেন।
ঠিক আছে। আপনি যেভাবে বলবেন সেভাবেই হবে। আমি তাহলে আসি আজকে।

আমি ব্যারিস্টার আজমিরি সুলতানার চেম্বার থেকে বের হয়ে জরুরী কিছু কেনাকাটা সেরে নিলাম। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুছিয়ে নিলাম। আর সবকিছু করেছি রায়হানকে না জানিয়ে। এখনও রায়হান আর আমার মাঝে কথাবার্তা হয়না। আগামী ২৭ তারিখে আমার ফ্লাইট। আমি মাকে সবকিছু খুলে বললাম। মা প্রথমে আমার সিদ্ধান্ত সাপোর্ট করলো না। কিন্তু ভালোভাবে বুঝিয়ে বলার পর আমার পাশে থাকবে বলে আস্বস্ত করলো।
আমি চিঠিটা লিখে ড্রয়ারে রেখে দিলাম। আরিয়ান রাতে ওর চাচ্চুর সাথেই থাকে। ওকে নিয়ে আমার তেমন কোনো চিন্তা নেই। একটু কষ্ট হবে প্রথম প্রথম কিন্তু ও আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে। এখনও আরিয়ান কিছুই জানে না।
আগামীকাল আমার ফ্লাইট তাই আমি আরিয়ান ও আরিশাকে নিয়ে মায়ের বাসায় চলে এলাম।
আমি আরিয়ানকে বুঝিয়ে বললাম যেন বাবার কথা শুনে চলে। আর ঐ বাড়ীতে ওর দাদা, দাদু, চাচ্চু সবাই আছে। সবাই ওকে চোখে চোখে রাখবে। আর মা আরিশাকে দেখে রাখবেন।

আজকে আমার ফ্লাইট। নির্দিষ্ট সময়ে ফ্লাইট হলো আর আমি দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আমেরিকায় এসে পৌঁছলাম।
আমি রায়হানকে কল দিলাম।

চলবে....
 
আজকে আমার ফ্লাইট। নির্দিষ্ট সময়ে ফ্লাইট হলো আর আমি দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আমেরিকায় এসে পৌঁছলাম। আমি রায়হানকে কল দিলাম।

হ্যালো রায়হান।
হ্যা কে বলছেন আপনি?
আমার গলা চিনতে পারছো না?
খুব চেনা লাগছে! কিন্তু...
কিন্তু নাম্বারটা আমেরিকার তাই তো।
হ্যা।
আমি আমেরিকায় আছি।
মানে?
মানে আমি আজকেই আমেরিকাতে পৌঁছেছি। আমি MD করতে আমেরিকায় আসবো তোমাকে বলেছিলাম তো।
আমার ছেলেমেয়ে কোথায়?
সবকিছু বলছি একে একে।
তোমার সাথে আমার আর কোনো কথা নেই। তুমি বলো আমার ছেলে মেয়ে কোথায়।
আরিয়ান ও আরিশা আমাদের বাসায় আছে। আর তোমার ড্রয়ারে একটা চিঠি আছে।

রায়হান সাথে সাথে কলটা কেটে দিলো। রায়হান চিঠিটার কথা শুনলো কিনা কে জানে?
আমি আর রায়হানকে কল দিলাম না। খুব কান্না পাচ্ছে আমার। আমার সবচেয়ে আপনজন আমার ভালোবাসার মানুষটির সাথে আমার মনোমালিন্য হয়েছে। আমার দুটি নয়নের মণিকে ছেড়ে আসার কষ্ট। এই সুদূর আমেরিকায় আমি একা, বড্ড বেশি একা। আমি কাঁদছি হাউমাউ করে কাঁদছি! বালিশে মুখ গুজে কত সময় ধরে কেঁদেছি বলতে পারবো না। আমার চোখের নোনা জল মুছে দেওয়ার মতো কেউ নেই এই দূর প্রবাসে। একটা সময় কান্না থামিয়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম, চোখের অশ্রু মুছে নিজেই নিজেকে বললাম, "ফারহানা তোকে কাঁদলে তো হবে না, তুই তো সবকিছু জেনেবুঝেই এই সংগ্রামী জীবন বেছে নিয়েছিস। তুই তো হাজার হাজার নারীর প্রতিবাদী উদাহরণ। তোকে যেন আর কখনো কাঁদতে না দেখি। তোকে অনেক শক্ত হতে হবে। তোর একটাই উদ্দেশ্য স্বপ্ন পূরণ এবং স্বপ্ন পূরণ। আজকের পর থেকে তুই অন্য কোনো কিছুর দিকে মনোযোগ দিবি না।"
হ্যা আজ থেকে আমার একটাই লক্ষ্য, আমার ঝিমিয়ে পড়া অস্তিত্বকে আবার জাগ্রত করা। আমি নিভে যেতে পারি না। আমি নিজেকে অনুপ্রাণিত ও সান্তনা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

মা, আরিয়ান আরিশা কেমন আছে? আরিশা খুব কান্নাকাটি করেছে তাই না?
ওরা খুব ভালো আছে, না একদমই কান্নাকাটি করেনি।
সত্যি বলছো মা?
হ্যা রে সত্যি বলছি।
ওরা এখন কি করছে?
ওরা ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে।
কি বলছ মা তুমি, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা।
রায়হান গতকাল রাতেই গাড়ি নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে আসে। তারপর নিজ হাতে আরিয়ান আর আরিশাকে খাইয়েছে। ওদের নিয়ে তারপর তোর রুমে ঘুমিয়ে পড়েছে।
রায়হান কিছুই বলেনি? কোনো রাগ দেখায় নি?
নারে মা। জামাইবাবাজি তো আগের মতোই আমাদের সাথে কথা বলল। আমি আর তোর বাবাও তো অবাক।

ও মাই গড ২০ টা মিসডকল! নিশ্চয়ই মা।
হ্যালো মা।
কতগুলো কল দিলাম কোথায় ছিলি?
মা কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, মোবাইল সাইলেন্ট ছিলো। আচ্ছা এতগুলো কল কেন?
কি বলব বলতো, তুই কি বিপদে ফেলে গেলি আমাদের? গতকাল রাতে জামাই আমাদেরকে কল দিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছে। আমার তো বিশ্বাস হচ্ছিল না এটা কি সেই রায়হান।
তার মানে আমি এতক্ষন ধরে স্বপ্ন দেখছিলাম! রায়হান কি তবে চিঠিটা পড়ে নি? না কি চিঠিটার কথা ও শুনতে পায়নি, এর আগেই লাইন কেটে দিয়েছিল? নাকি চিঠিটা পড়ে ওর কোনো পরিবর্তন হয়নি! তাহলে তো...
কি বলছিস ফিসফিস করে?
কিছুনা, মা তুমি ধৈর্য্য ধরো, দেখো কি হয়।
আজকে ওরা আসবে আরিয়ান আর আরিশাকে নিতে। আমার তো খুব ভয় করছে। ওরা বাসায় এসে যদি আরো ঝামেলা করে।
তুমি চিন্তা করো না আমি ব্যারিস্টার আজমিরি সুলতানাকে সবকিছু জানাচ্ছি।
তাই কর।
আমি রাখলাম মা।

হ্যালো সুলতানা আপা।
হ্যা কেমন আছেন ফারহানা?
আপা ভালো না। রায়হান মা কে কল দিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছে।
এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে। রায়হান সাহেবের রাগ করাটাই তো স্বাভাবিক তাই না।
কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন চিঠিটা পড়লে রায়হান সবকিছু ভালোভাবে নিবে।
আপনাদের মাঝে যদি সত্যিকার ভালবাসা থাকে আর ডাঃ রায়হান যদি সত্যিই একজন সুপুরুষ হয়ে থাকে তাহলে পজেটিভ কিছু হওয়ারই কথা। হয়তো ডাঃ রায়হান চিঠিটা পড়েই নি।
তাহলে?
আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
আর রায়হান আজকে আরিয়ান ও আরিশাকে নিয়ে যেতে আমাদের বাসায় যাবে।
সেটা আমি দেখছি কি করা যায়। আমি আপনাদের বাসায় যাবো, আমি সরাসরি কথা বলবো ডাঃ রায়হানের সাথে। তবে আমি অ্যাডভোকেট সেই পরিচয় দিবো না।
ঠিক আছে আপা, আপনিই আমার এখন ভরসা। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

বাবা রায়হান।
হ্যা মা বলো।
গতকাল রাতে কারসাথে এমন অভদ্র ভাষায় কথা বলেছিস?
ফারহানার মায়ের সাথে। ফারহানা আমেরিকা চলে গিয়েছে।
কি! কি বলছিস তুই?
হ্যা মা আমি সত্যিই বলছি। ও গতকাল আমেরিকায় পৌঁছে আমায় কল দিয়েছিলো। তাই ওর মাকে কল দিয়ে খারাপ ব্যবহার করেছি।
তুই বেয়াইনের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে গেলি কেন?
করবো না কেন? উনারা তো সব জেনেই ফারহানাকে সাপোর্ট করেছে। নয়তো ফারহানা এভাবে চলে যাওয়ার সাহস পায়?
কিন্তু ফারহানা তোকে আগে বলেনি? হঠাৎ করে কেন চলে যাবে? ফারহানা তো এমন মেয়ে ছিলো না। নিশ্চয়ই তোর সাথে কোনো ঝামেলা হয়েছে।
আমাকে বলেছিল ও আমেরিকায় স্কলারশীপ পেয়েছে। আমি ওকে নিষেধ করি যাওয়ার জন্য। কিন্তু ও জিদ করে যে আমেরিকা যাবেই। তখন আমি ওকে বলি যদি যেতে হয় তবে যেন আমাকে ডিভোর্স দিয়ে তারপর যায়।
আমার নাতি নাতনিরা এখন কোথায়?
ওরা আছে ঐ বাসাতেই। আমি যাবো একটু পর ওদের নিয়ে আসতে।আমিও যাবো তোর সাথে। কেমন মেয়েরে বাবা কাউকে কিছু না বলে আমেরিকা চলে গেল!
মা আমি ওকে ডিভোর্স দিবো।
কি বলছিস তুই?
হ্যা আমি ঠিকই বলছি। আমি এমন অবাধ্য, বেয়াদব মেয়েমানুষের সাথে আর সংসার করবো না।
এসব নিয়ে পরে ঠান্ডা মাথায় আলোচনা করা যাবে। আগে চল আরিয়ান ও আরিশাকে নিয়ে আসি।
ঠিক আছে তুমি রেডি হও। আমি একটু হাসপাতাল থেকে ঘুরে আসছি। কিছু মুমূর্ষু রোগী আছে।
ঠিক আছে তাড়াতাড়ি আসিস।

দুপুরের পর।
বেয়াই কি বলবো বলুন? কেমন মেয়ে আপনাদের আর আপনারাই বা কেমন মা-বাবা? মেয়ে একা সিদ্ধান্ত নিয়ে কাউকে না জানিয়ে বিদেশ চলে গেল। আমরা ওর শশুর-শাশুড়ি এখনো বেঁচে আছি, আমাদেরকে অন্তত বলতে পারতো। কোন্ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হয়না বলতে পারেন? তাই বলে এভাবে বিদেশ চলে যাবে!
মা এসব নিয়ে উনাদের সাথে আর কোনো কথা বলার দরকার নেই। আমরা যে জন্য এসেছি সেটা বলো।
বেয়াই সাহেব আমার নাতি নাতনিকে নিয়ে আসুন আমরা ওদের এখান থেকে নিয়ে যাবো।
অবশ্যই আপনারা আপনাদের নাতি নাতনিকে নিয়ে যাবেন। কিন্তু এইমাত্র ওরা ঘুমিয়েছে। ওরা আগে ঘুম থেকে উঠুক। আপনারা বসুন আমি চা নিয়ে আসি।
না, আমরা বসবো না। আপনি ওদের ঘুম থেকে ডেকে তুলুন।
রায়হান সাহেব শান্ত হোন, আপনি এমন করলে বাচ্চাদের মনের উপর খারাপ প্রভাব পড়বে।
আপনি কে? আপনাকে তো চিনলাম না।
আমি আজমিরি সুলতানা, ফারহানার দু্ঃসম্পর্কের বড় বোন।
আমি তো আপনার সাথে কোনো কথা বলতে চাই না।
আপনাকে আমার কথা শুনতে হবে। আপনার সন্তানদের ভালোর জন্যই আপনাকে বলছি। আমি জানি আপনারা দুজন দুজনকে অনেক ভালোবাসেন। একটা ঘটনা ঘটে গেছে আপনার রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। তব এই বিষয়গুলো নিয়ে এমন ব্যবহার করবেন না যাতে এই ছোট্ট বাচ্চাদের মনের উপর কোনো নেগেটিভ প্রভাব পড়ে। বাবা হিসেবে এই মুহূর্তে আপনাকে ধৈর্য্য ধরতে হবে।
আপনি কি বলতে চাচ্ছেন?
আমি বলতে চাচ্ছি ওদের এখন ডেকে কাঁচা ঘুম ভাঙানোর দরকার নেই। আর ওদের জোর করে নেওয়ারও দরকার নেই।
আমি তো আমার ছেলেমেয়েদের কিছুতেই এখানে রাখবো না।
আমি তো বলিনি আপনি ওদের এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবেন না। আমি শুধু বলছি ওরা ঘুম থেকে উঠলে স্বেচ্ছায় যেতে চাইলে নিয়ে যাবেন। জোরজবরদস্তি করলে ওরা ভয় পেয়ে যাবে। আজ যেতে না চাইলে দুইদিন পর নিয়ে যাবেন। কেউ আপনাকে কোনো বাঁধা দিবে না।
রায়হান উনি বোধহয় ঠিকই বলছেন। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে কিন্তু তার প্রভাব যেন আমার নাতি নাতনির মনের উপর না পড়ে।
ঠিক আছে মা তুমি যা বলবে তাই হবে।

হ্যালো মা বলো।
রায়হান আর ওর মা এসেছিলো। আরিয়ান ওদের সাথে চলে গেছে।
আর আরিশা?
ও যেতে চায়নি তাই ওরা আরিশাকে রেখে গেছে। পরে এসে নিয়ে যাবে।
ওরা কোনো খারাপ ব্যবহার করেছে তোমাদের সাথে?
না কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি। তবে তোর শাশুড়ি অনেক কথা বলেছে।
কি বলেছেন?
এই যে তুই কাউকে না জানিয়ে চলে গেলি এটা ঠিক হয়নি। এইজন্য আমাদের দায়ী করলো। আমার তো এখন মনে হচ্ছে তোর কথা শুনে হয়তো ভুলি করেছি।
তুমি একথা বলছ মা?
হ্যা বলছি। কারণ তুই একটা মেয়ে, তাছাড়া তুই এখন একা না, তোর দুটি সন্তান রয়েছে।
মা আমি তোমাকে তো বলেছি আমার স্বপ্ন পূরণের জন্য আমার আর কোনো উপায় ছিল না।
তোর শশুরবাড়ির লোকজন যখন জানতে পারবে বিষয়টা উনারা কিভাবে নিবে ভেবেছিলি? বেয়াই, বেয়াইন আমাদের কাছে জানতে চাইলে আমরা তখন কি উত্তর দেব? আমাদের তো মাথা নিচু করে চুপচাপ সব অপমান সহ্য করতে হবে। এই বিষয়গুলো তোর আগে ভাবা উচিত ছিল। বেয়াইন বারবার বলছেন তোদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া বিবাদ যাই হয়ে থাকুক শশুর-শাশুড়িকে অন্তত একবার জানানো উচিত ছিল।
মা এটা আমার ছোট একটা ভুল হয়ে গেছে। আর জানালেও রায়হান উনাদের কথা শুনত না। রায়হান কলেজে থাকতেই আমার পড়াশোনার বিষয়ে জেলাস ফিল করতো।
যাইহোক তোর শশুরবাড়ির লোকজনদের না জানিয়ে তুই এটা মস্ত বড় ভুল করেছিস। আর আমারও কেন জানি তোর স্বপ্ন পূরণের কথা শোনার পর এইসব বিষয় মাথা থেকে চলে গিয়েছিল।
মা একজন মেয়ের বিয়ের পর তার স্বামী হলো প্রধান অভিভাবক, বিপদ-আপদের ঢাল, স্বামী যদি স্ত্রীর পাশে না থাকে তাহলে একজন স্ত্রী খুব অসহায় হয়ে পড়ে। তখন নিজের অস্তিত্ব রক্ষার্থে কঠিন হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। আমার দেয়ালে পিঠ আঁটকে গিয়েছিল। আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলাম। আর তুমি নিজেই তো বলেছিলে যে "ফারহানা, আমাকে বিয়ের পর শশুরবাড়ি থেকে অনুমতি না দেওয়ায় পড়াশোনা করতে পারিনি, কিন্তু তুই কখনো তোর পড়াশোনা ছেড়ে দিবি না।"
হ্যা বলেছিলাম, কিন্তু...
মা তুমি আমার উপর বিশ্বাস রাখো। সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখবে আমি যেদিন বড় ডাক্তার হবো অনেক নাম করবো সেদিন তোমার গর্বে বুকটা ভরে যাবে।
মা রে সবকিছুর পরেও মেয়েদের স্বামী ছাড়া জীবন পূর্ণতা পায় না। মানুষজন অনেক কথা বলবে।
মা আমি রায়হানকে অনেক ভালোবাসি, রায়হানও আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমি জানি ও আমাকে ছাড়া ভালো থাকতে পারবে না।
আমার বিশ্বাস ও চিঠিটা পড়লে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। যদি ঠিক না হয়ে যায় তবে আমি বুঝবো আমি ভুল মানুষকে ভালোবেসেছিলাম। আর একজন ভুল মানুষের জন্য তখন আমার আর কোনো খারাপ লাগা কাজ করবে না। ও এখনো চিঠিটা পড়ে নি হয়তো।
কিসের চিঠির কথা বলছিস?
আমি ওর জন্য একটা চিঠি লিখে রেখে এসেছি। মানুষ হয়তো রাগ করে কথা শুনতে চায় না কিন্তু লুকিয়ে হলেও চিঠি পড়ে।
আমার উপর একটু বিশ্বাস রাখো মা। আর আমাকে মানসিকভাবে একটু সাপোর্ট দাও আমি নিজেকে ঠিক প্রমাণ করবো। আর রায়হানও ঠিক বুঝতে পারবে ওর ভুলটা কোথায়। আর আমি আমার শশুর-শাশুড়িকে কল দিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিবো। আমি বড় ডাক্তার হলে আমার শশুরবাড়ির লোকজন দেখবে আমাকে নিয়ে কত গর্ব করবে।
উনি তো আমার বিয়ের পর সবার কাছে বলতো "কপালগুণে এমন বৌমা পেয়েছি। কলেজের সেরা স্টুডেন্ট, চাকরির পাশাপাশি আমার কত সেবাযত্ন করে। সংসারের সব কাজ একা হাতে সামলায়।"
আরো কত কি।
কি জানি আল্লাহ জানে তোর কপালে কি আছে।
মা আমি তো কোনো অন্যায় করিনি। আমি সবসময় নিজেকে সঠিক রেখেছি, সব দায়িত্ব পালন করেছি। কখনো বাইরে খারাপভাবে চলাফেরাও করিনি যাতে তোমাদের বা শশুরবাড়িবাড়ীর লোকজনের বদনাম হয়। আল্লাহ আমাকে অবশ্যই এর প্রতিদান দিবেন। আমি কখনো আল্লাহর উপর থেকে ভরসা হারাই নি। মা আরিশাকে দেখে রেখো। আমি এখন রাখছি।

কয়েকদিন পর।
বাবা রায়হান তুই তাড়াতাড়ি বাসায় আয়।
কেন কি হয়েছে?
আরিয়ানের হাত কেটে গেছে।
কিভাবে?
আমি দেখিনি ও কোথায় থেকে যেন একটা ব্লেড আর কাগজ দিয়ে খেলছিল।
ও মাই গড। আমিই তো শেভ করে ব্লেডটা ফেলতে ভুলে গিয়েছিলাম।
আমি এখনি আসছি।

আরো কিছুদিন পর।
মা কিসের শব্দ হলো?
আরিয়ান বল মেরে অ্যাকুরিয়াম ভেঙে ফেলেছে।
বেয়াদব ছেলে একটা থাপ্পর মেরে দাঁত ফেলে দিবো। অনেক দুষ্টুমি করো তুমি।
আরিয়ান কাঁদছে, আম্মু কখনো আমাকে মারে নি। আমি আম্মুর কাছে যাবো। দাদু আমাকে আম্মুর কাছে নিয়ে যাও।

রাতের বেলা খাবার টেবিলে।
রায়হান আরিয়ানের স্কুল থেকে অভিযোগ এসেছে।
কিসের অভিযোগ?
আরিয়ান ঠিকমতো পড়াশোনা করছে না। ওর কোনো হোমওয়ার্ক হচ্ছে না।
আমি কালই ওর জন্য টিচারের ব্যবস্থা করবো।
আরেকটা কথা বলার ছিল।
বলো।
আরিশাকে নিয়ে আসবি না?
কিভাবে আনবো মা? সবাই মিলে তো আরিয়ানকেই সামলাতে পারছিনা। থাক ওর নানুর কাছেই।

অনেক দিন হয়ে গেল আরিয়ানকে নিয়ে গেল ওর বাবা। এর মধ্যে অনেকবার আমি রায়হানকে কল দিলাম কিন্তু ও কল তুলে নি। আরিয়ান কেমন আছে আমি জানিনা। আমি প্রতিদিন মাকে কল দেই। রায়হান আরিশাকে নিতে আর আসেনি আমাদের বাসায়। আরিশা মায়ের কাছে ভালোই আছে।

বাবা রায়হান।
এতো রাতে কল দিয়েছেন কেন?
আরিশার খুব জ্বর কয়েকবার বমি করেছে। শরীর কেমন নীল হয়ে গেছে। তুমি একটু তাড়াতাড়ি আসবে? আমার মনে হয় ওকে এখনই হসপিটালে নিয়ে যাওয়া দরকার।
আপনার মেয়েকে জানান। আমাকে বলছেন কেন?
বাবা এখন রাগ করার সময় নয়। তুমি দয়া করে তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে আসো।
আমি এখনি আসছি আপনারা রেডি হোন।

ডাঃ রায়হান আপনার মেয়ের অবস্থা বেশী ভালো না। এখনি আইসিইউ তে লিফট করতে হবে। ওর খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে লাইফ সাপোর্টে দিতে হবে।
যা করতে হবে তাড়াতাড়ি করুন। যেভাবেই হোক আমার মেয়েকে বাঁচান।
আমাদের হাসপাতালে পেডিয়াট্রিক আইসিইউ নেই।
তাহলে?
আপনি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা পেডিয়াট্রিক আইসিইউতে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন।

চার দিন পর।
আরিশা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ আছে। ওকে এখন বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন।
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে মাসুম ভাই।
সঠিক সময়ে নিয়ে আসায় আল্লাহ রহমত করেছেন। মেয়েটাকে একটু সাবধানে রাখবেন।
ঠিক আছে মাসুম ভাই।
মা, আরিশা এখন থেকে আমাদের বাসায় থাকবে।
ঠিক আছে বাবা তোমার মেয়ে তোমার যা ভালো মনে হয়। কিন্তু একবার ফারহানাকে জানাই।
সে আপনার মেয়ে আপনি তা ইচ্ছে করুন। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে চলে যাচ্ছি। ওর জন্যই আজকে আমার মেয়েটা মরতে বসেছিলো। ওকে আমি কখনো ক্ষমা করবো না।

হ্যালো ফারহানা।
হ্যা মা। আরিশা এখন কেমন আছে?
ও এখন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছে। ডাক্তার রিলিজ করে দিয়েছে।
যাক আলহামদুলিল্লাহ।
জামাইবাবাজি আরিশাকে নিয়ে যেতে চায়।
নিয়ে যাক তুমি কিছু বলো না ওকে।
ঠিক আছে বলবো না।

বাসায় ফেরার পর।
মা আমি ফারজানাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবো। আমি ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলামের সাথে কথা বলেছি।
এটা কি ঠিক হবে?
ঠিক বেঠিক বুঝি না। আমি চাইনা ওর সাথে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে আর।
তোর হাতে এটা কিসের কাগজ?
উনি বিয়ের কাবিন নামা নিয়ে যেতে বলেছেন।
আরেকটু ভেবে চিন্তে দেখ।
আর ভাবার কিছু নেই।
ঐটা কিসের কাগজ পড়ে আছে?
দেখি দাও তো।
চিঠি! ফারহানার লেখা চিঠি।
কবে লিখেছে? কি লেখা আছে পড়তো।
দাঁড়াও এটা শুধু আমার জন্য লিখা। মনে হচ্ছে যাওয়ার আগে লিখে গেছে।

চলবে...
 
ঐটা কিসের কাগজ পড়ে আছে?
দেখি দাও তো।
চিঠি! ফারহানার লেখা চিঠি।
কবে লিখেছে? কি লেখা আছে পড়তো।
দাঁড়াও এটা শুধু আমার জন্য লিখা। মনে হচ্ছে যাওয়ার আগে লিখে গেছে। মা আমি রুমে যাচ্ছি।

রায়হান রুমে গিয়ে চিঠিটা পড়ার ঘন্টা দুয়েক পর।

আরিয়ান, আরিশা চলো আমরা বাহিরে বেড়াতে যাব।
ওয়াও কি মজা! কি মজা! আমরা বেড়াতে যাব।
মা তুমি যাবে আমাদের সাথে?
না তোরাই যা, আমার পায়ে ব্যাথা।
তাহলে চলো তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।
না আজকে তোরা ঘুরতে যেতে চাচ্ছিস সেটাই কর। বাচ্চা দুটোরও ভালো লাগবে।
তাহলে কাল তোমাকে নিয়ে যাব।
ঠিক আছে।
আব্বু আমরা কোথায় যাব?
আমরা আগে হাতিরঝিলে ঘুরবো তারপর রেস্টুরেন্টে খেতে যাবো।
তারপর?
তারপর কী করবো সেটা তো এখন বলা যাবেনা!
বলো না আব্বু, বলো না। দাদু আব্বুকে বলতে বলো না।
না বলব না।
বলো না আব্বু।
তোদের এমন হাসিখুশি দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল। অনেকদিন পর আবার তোদের সবার মুখে হাসি ফুটে উঠল।
মা এখন থেকে আমরা সবসময় হাসি আনন্দে থাকবো।
তাই যেনো হয়।
মা আমরা বের হলাম।
সাবধানে যাস বাবা। কি হলো হঠাৎ করে ছেলেটার মনে?

আব্বু আমি খেতে পারছি না।
দাও আমি তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি।
আরিশা তুমি কি খাবে মামনি?
চিপস খাবো।
না মামনি এখানে তো চিপস নেই। আসো আমার কোলে আমি তোমাকে স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছি।
আমি স্যুপ খাবো না। আমি চিপস খাবো, আমি চিপস খাবো।
না মামনি এমন করে না। আচ্ছা আমরা এখান থেকে বের হয়ে তোমাকে এত্তো এত্তো চিপস কিনে দিবো।
আব্বু আমাকেও আইসক্রিম কিনে দিতে হবে কিন্তু।
ঠিক আছে বাবা তোমাকেও কিনে দিবো। এবার তাড়াতাড়ি খাও তো।
বলতো এবার আমরা কোথায় যাবো?
জানি না।
এবার আমরা তোমার নানুদের বাসায় বেড়াতে যাবো।
কি মজা! কি মজা! আব্বু কত ভালো। আব্বু আমি আম্মুর সাথে কথা বলবো ভিডিও কল দাও।
বাবা তোমার নানুর বাসায় গিয়ে তারপর দিবো, ঠিক আছে?
আচ্ছা।
ওয়েইটার আমাকে এই খাবারগুলো পার্সেল করে দিন তো।
ঠিক আছে স্যার।

আরে বাবা রায়হান তুমি! সাথে আমার নানু ভাইরাও আছে দেখছি।
জ্বী মা ভালো আছেন?
হ্যা বাবা, আমরা ভালো আছি। তোমরা সবাই ভালো আছো?
মা এগুলো নিন।
এগুলো কি?
আপনার আর বাবার জন্য কিছু খাবার নিয়ে এলাম।
এসব আবার আনতে গেলে কেন?
মা আজকে রাতে আমরা আপনাদের বাসায় থাকবো।
আমাদের বাসায়!
কোনো আপত্তি নেই তো মা?
কি বলছো বাবা? আপত্তি থাকবে কেন? এটা তো তোমার বাসাও । যখন ইচ্ছা আসবে, যখন ইচ্ছা থাকবে, যখন ইচ্ছা যাবে।
মা বাবাকে ডাক দিন ফারহানাকে ভিডিও কল দিবো।
ঠিক আছে বাবা আমি এখনি ডাকছি।
এ কই গেলে? জামাই বাবা আসছে, এদিকে আসো না।
আরে জামাই বাবা দেখছি। কেমন আছো?
ভালো বাবা, আপনি ভালো আছেন?
এই বয়সে আর ভালো থাকা! দেখো না কোমড়ের ব্যাথার জন্য সেজদা দিতে পারি না দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে হয়।
মায়েরও পা ব্যাথা কাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। আপনিও চলুন না আমাদের সাথে।
আমি যাবো?
হ্যা।
কি গো তুমি কি বলো?
এখানে আবার আমার বলার কি আছে? জামাই যখন বলছে তুমি যাও না। ভালোই তো হবে, তুমি না যাওয়ার জন্য মানুষ পাচ্ছিলে না।
ঠিক আছে বাবা।
বাবা আরিয়ান, নাও তোমার মায়ের সাথে কথা বলো।
আম্মু...
আব্বু তুমি কেমন আছো?
আমি ভালো আছি। আম্মু তুমি কোথায়?
আমি বাবা অনেক দূরে!
আমিও যাবো তোমার কাছে।
এখানে বাবা আমি একা তুমি ঐখানেই থাকো, ঐখানে কত মানুষ।
তুমি কবে আসবে?
খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবো বাবা।
আমার তোমার জন্য খুব খারাপ লাগে।
আমারো খুব খারাপ লাগে তোমাদের জন্য।
আমি একা হাত দিয়ে খেতে পারি না।
বাবা তুমি তো বড় হয়ে গেছ, তোমাকে একা নিজ হাতে খাওয়া শিখতে হবে। তোমাকে যে আরিশাকে দেখে রাখতে হবে। তুমি তো ছেলে মানুষ তোমার তো অনেক দায়িত্ব পালন করতে হবে।
আচ্ছা আম্মু আমি সব করব। নাও আরিশার সাথে কথা বলো।
আ.. আম্মু... তুমি কোথায়? আমি তোমার কাছে যাবো। আমি তোমার সাথে ঘুমাবো।
এইতো মা আমি। আমি বাসায় ফিরে তোমাকে বুকে নিয়ে ঘুমাবো। এখন কয়েকটা দিন তোমার দাদুর সাথে ঘুমাও।
মা ফারহানা কেমন আছিস?
ভালো আছি মা।
তুমি বুঝি রায়হানদের বাসায় গিয়েছ?
না রে মা। রায়হান বাবাজি ওদের নিয়ে আমাদের বাসায় এসেছে। আজকে আমাদের বাসায় থাকবে।
ওহ্ তাই বুঝি।
হ্যা তুই কথা বল না রায়হানের সাথে।
না মা আমি ফারহানার সাথে কথা বলবো না। আপনারা কথা বলুন আমি একটু ছাদে যাচ্ছি।
রায়হান তোর সাথে কথা বলতে চাচ্ছে না।
ঠিক আছে মা, আমিও ওর সাথে কথা বলবো না। রাখছি মা আমার ক্লাশ আছে।

আমি কলটা কেটে দিলাম। রায়হান হঠাৎ করে সবাইকে নিয়ে আমাদের বাসায়! তাহলে কি রায়হান চিঠিটা পড়েছে? আর এইজন্য পরিবর্তন। তারমানে রায়হান ওর ভুল বুঝতে পেরেছে। কিন্তু তাহলে আমার সাথে কথা বলল না কেন?
অভিমান নাকি ইগো? ঠিক আছে যতদিন ও নিজ থেকে কথা বলতে চাইবে না আমিও ততদিন কথা বলব না।

অনেকদিন পর।
মায়ের সাথে আমার প্রতিদিনই কথা হয়। আজকেও কথা হলো। রায়হান নাকি এখন চেম্বারে কম সময় দেয়। আগে তিনটা হাসপাতালে ডিউটি করতো এখন একটা ছেড়ে দিয়েছে। আরেকটায় অন কলে যায়। বিকেলবেলা চেম্বার করে না। বিকেলটা আরিয়ান আর আরিশাকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে বের হয়। আরিয়ানের জন্য একটা টিচার রেখে দিয়েছে, নিজেও আরিয়ানের পড়াশোনার প্রতি নজর রাখছে। আরিয়ান ও আরিশা আমাদের এবং রায়হানদের বাসায় দুই জায়গাতেই থাকে। আর রাত বারোটার আগেই চেম্বার বন্ধ করে বাসায় চলে আসে। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সংখ্যক রোগী দেখে। আরিয়ান ও আরিশা যেই বাসায় থাকুক না কেন রায়হান সেখানেই রাতে ফিরে ওদের বুকে নিয়ে ঘুমায়। কখনো কখনো সময় পেলে নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। আমার মা বাবার দিকেও খোঁজ খবর রাখে। বাবাকে নিয়মিত ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যায়। বাবার কোমর ব্যাথা এখন নেই বললেই চলে। বাবা এখন নামাজে সিজদা দিতে পারে। নামাজ পড়ে দুহাত তুলে আমাদের জন্য বাবা দোয়া করেন। শশুর-শাশুড়ি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। বাড়ির লোকজনের আমার উপর আর কোনো রাগ নেই। রায়হান ওদের নাকি সবকিছু বুঝিয়ে বলেছে। সবার সাথে আমার নিয়মিত ভিডিও কলে কথা হয়। তবে রায়হান আমার সাথে কথা বলে না। আমি খুব ভালোভাবে পড়াশোনা করতে লাগলাম। রায়হান তার সবগুলো দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে। সবদিকে তার সমান নজর থাকে। সবাইকে ভালো রাখার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। রায়হানের এমন পরিবর্তনে সবাই অবাক। আমি অনেক খুশি ওর পরিবর্তনে। সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই চলে যাচ্ছে। আমাদের জীবনে আর কোনো সমস্যাই নেই। আমিও পড়াশোনা ছাড়া অন্য কোনো কিছু নিয়ে ভাবি না।

তিন বছর পর।
আমার MD কোর্স সম্পন্ন হলো। আমি অনেক ভালো রেজাল্ট করলাম। আমেরিকায় অনেক হসপিটাল থেকে আমাকে অফার করা হলো। কিন্তু আমি আমেরিকায় থাকতে রাজি হলাম না। আমি আমার নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি আমার নিজ দেশের মানুষের সেবা করবো। তাছাড়া আমি ওদের ছেড়ে আর একমুহুর্ত আমেরিকায় থাকতে চাইনা।

আজকে আমার ফ্লাইট। বাসায় কল দিয়ে বলেছি আমি বাংলাদেশে ফিরছি। মা বলল শরীরটা ভালো না। আর রায়হান তো তিন বছর পেরিয়ে গেলেও আমার সাথে একবার কথা বলেনি। ও এত পাষাণ কিভাবে হয়ে গেল ভাবতেও আমার অবাক লাগছে। এয়ারপোর্টে হয়তোবা আমার জন্য কেউ দাঁড়িয়ে থাকবে না।

নির্দিষ্ট সময়ে বাংলাদেশের মাটিতে প্লেন ল্যান্ড করল। আমার মনটা কেমন শীতল হয়ে উঠলো যেন মায়ের বুকে জড়িয়ে আছি। এ এক অন্যরকম অনুভুতি আমি বলে বুঝাতে পারব না। আমি প্লেন থেকে নেমে সবকিছু সম্পন্ন করে এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে আসলাম। আমার দু'চোখ আপন মানুষদের খুঁজে ফিরছে। কিন্তু কাউকেই খুঁজে পাচ্ছি না। এক বুক কষ্ট নিয়ে আমি লাগেজ নিয়ে বের হচ্ছি।
হঠাৎ আরিয়ান আর আরিশা আম্মু বলে চিৎকার করে উঠল। আমি লাগেজ ফেলে দিয়ে ছুটে গিয়ে ওদের জড়িয়ে ধরে সমানে চুমু খাচ্ছি। আমার চোখ জুড়ে অশ্রুর বন্যা। তাকিয়ে দেখি সবাই এসেছে আমাকে রিসিভ করতে। রায়হানের হাতে ফুলের তোড়া। আমার পাগুলো যেন অসার হয়ে গেছে। আমি এগুতে পারছি না। রায়হান নিজেই আমার দিকে এগিয়ে এলো আমার সামনে এসে দাড়ালো। দুজন দুজনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। অনেক কথা জমে আছে। রায়হানও কিছু বলছে না। পুরুষ মানুষ শব্দ করে কাঁদতে পারেনা। রায়হানের চোখে অশ্রু টলমল করছে। রায়হান আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি হাওমাও করে কেঁদে ফেলি। আমি গত তিন বছর একদিনও কাঁদিনি। আজকে আমার তিন বছরের জমানো চোখের পানি সব যেনো বেড়িয়ে যাচ্ছে। আমি কিছুতেই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছি না। মনে মনে খুব সংকল্প করেছিলাম রায়হানের সামনে অনেক শক্ত আচরণ করব।
কিন্তু পারছি না।

তুমি কাঁদো ফারহানা। চোখের নোনা জলে তোমার সকল কষ্ট ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যাক।
তুমি অনেক নিষ্ঠুর, অনেক পাষাণ! তুমি এই তিন বছর আমার সাথে কেন কথা বলনি, আমাকে শাস্তি দেয়ার জন্য?
না আমি নিজেকে শাস্তি দেয়ার জন্য তোমার সাথে এতদিন কথা বলি নি। তুমি স্ত্রী হয়ে আমার ক্যারিয়ার গুছানোর জন্য সর্বোচ্চ স্যাক্রিফাইস করেছ। আর আমি স্বামী হয়ে তোমার স্বপ্ন পূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তাই আমি নিজেকে শাস্তি দিয়েছি।
তোমার কথা মনে করে আমার অনেক কষ্ট হয়েছে, কিন্তু কথা বলিনি।আমি যে তোমার কাছে অপরাধী। কিন্তু এতদিন ধরে আমি তোমার জন্য আমার সকল ভালোবাসা হৃদয়ে জমিয়ে রেখেছি।
আমি তোমাকে আর কখনো কোনো কষ্ট পেতে দিবো না। তোমার চোখে আর এক ফোঁটা অশ্রুর কারন হব না।
তুমি আমার চিঠি পেয়েছিলে?
হ্যাঁ আমি তোমার চিঠি পেয়েছিলাম। তুমি আমাকে কথাগুলো সামনাসামনি আরো আগে কেন বললে না?
আমি সামনাসামনি বললে তুমি কথাগুলো কিছুতেই শুনতে চাইতে না।
খুব অভিমান হয়েছিল আমার উপর তাই না? চিঠিটা পড়ে খুব অভিমান হয়েছিল?
হ্যাঁ হবেই তো। আমি নাহয় ভুলে গিয়েছিলাম, ক্যারিয়ারের পিছনে ছুটতে গিয়ে ভুলে গিয়েছিলাম তোমার প্রতি, সন্তানের প্রতি, মা বাবার প্রতি দায়িত্বের কথা কিন্তু তুমি তো আমার অর্ধাঙ্গিনী হয়ে বুঝিয়ে দিতে পারতে।
আমারও তোমার প্রতি ক্ষোভ, অভিমান হয়েছিল এইজন্য যে, কেন তুমি আমাকে বুঝতে পারো না।
আমি আর কোনোদিন আমার উপর তোমাকে অভিযোগ আনতে দিবো না। আমি একজন আদর্শ স্বামী হয়ে উঠব। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।
তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ, অণুযোগ নেই। আমি শুধু চেয়েছি একজন স্বামী হিসেবে তুমি আমাকে বুঝতে পারো। আমাকে আমার স্বপ্ন পূরণের জন্য সাপোর্ট করো। সব সময় আমার পাশে ছায়া হয়ে থাকো।
আজ থেকে আমি সবসময় তোমার ছায়া সঙ্গী হিসেবে থাকবো। আমরা দুজন মিলে সবকিছু ম্যানেজ করে চলব।
তোমার মতো স্বামী পেয়ে আজকে আমি নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী মনে করছি।
তুমি একজন আদর্শ স্ত্রী বাংলার ঘরে ঘরে যেন তোমার মতো স্ত্রী থাকে।
আর তুমি একজন আদর্শ স্বামী তোমার মত স্বামী যেন প্রতিটা মেয়ের ভাগ্যে জুটে। তুমি একজন দায়িত্ববান ও আদর্শ পুরুষ হয়ে দেখিয়ে দিয়েছ পুরুষ মানুষ সব সময় নিষ্ঠুর, পাষাণ হয় না।

এই তোদের মান অভিমানের পালা শেষ হলো? আর কতক্ষণ চলবে এভাবে, আমরা কি দাঁড়িয়েই থাকব নাকি এখানে?
চলো রায়হান, সবাই কি ভাবছে।
মা-বাবা আপনারা সবাই বাসায় চলে যান।
আমরা সবাই বাসায় চলে যাব মানে কি?
আমরা এখন বাসায় যাব না।
বাসায় যাব না মানে, আমরা কোথায় যাব তাহলে?
আমরা এখন রেডিও স্টুডিওতে যাব।
রেডিও স্টুডিওতে! কিন্তু কেন?
আমি চাই আমাদের জীবনের গল্পটা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ শুনুক।
রায়হান, আমি চাইনা আমাদের পার্সোনাল বিষয়গুলো মানুষ জানুক।
দেখো ফারহানা, আমাদের কথাগুলো যখন মানুষ জানতে পারবে তখন তারা তাদের ভুলগুলো বুঝতে পারবে, নিজেদের সংশোধন করতে পারবে।
কিন্তু এতে তোমাকে হয়তো মানুষ খারাপ ভাববে।
সে ভাবলে ভাবুক আমাদের কথা জানার মাধ্যমে মানুষ যদি তাদের ভুলটা বুঝতে পারে তাতেই আমি খুশি।
আমি চাই তোমার চিঠিটা তুমি নিজেই পড়ে শোনাও।
আমি পড়ব?
হ্যা, তাহলে মানুষ বুঝতে পারবে একজন নারীর কষ্টটুকু কি পরিমাণ। তার লুকিয়ে থাকা আর্তনাদ জানতে পারবে। আর পুরুষ মানুষ বুঝতে পারবে নিজের অজান্তে সে কিভাবে একজন স্ত্রীর স্বপ্ন ভেঙ্গে দেয়। কিভাবে একজন নারীর নিজস্ব সত্তাকে বিলীন করে দেয়। আর তোমার বিজয়ের গল্প শুনে নারীরা নিজেদের হারিয়ে যাওয়া অস্তিত্ব ফিরে পেতে লড়াইয়ের জন্য অণুপ্রাণিত হবে। একটা সংসার, একটা পরিবার তখনই সুন্দর হয়ে উঠে যখন একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠে।
তুমি কত সুন্দর করে কথাগুলো বলছ রায়হান। তুমি সত্যিই অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছ। মনে হচ্ছে আজকে আমার জীবন পূর্ণতা পেল।
আর তুমি ছাড়া আমি তো অপূর্ণ, তুমি যে আমার অর্ধাঙ্গী। আচ্ছা এবার তাড়াতাড়ি চলো শো শুরু হতে আর মাত্র পঁয়ত্রিশ মিনিট বাকি।
চলো তাহলে যাওয়া যাক।

আমি রায়হানের কাঁদে মাথা রেখে গাড়িতে বসেছি। আমি কখনো রায়হানকে বলবো না যে ওকে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য অ্যাডভোকেট আজমিরি সুলতানার কাছে গিয়েছিলাম। আজমিরি সুলতানা আমার বড় বোন হিসেবেই থেকে যাবেন। আমি যদি রাগের মাথায় এই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতাম তাহলে আজকে আমার জীবনে এই সুখের দিন আসতো না। আমাদের সকলের উচিত যেকোনো পরিস্থিতিতে ধৈর্য্য ধারণ করা এবং রাগের মাথায় কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করা। পরিস্থিতি যতোই খারাপ হোক একটু ধৈর্য ধরে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। ভুলত্রুটিগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে হবে। যদি সমস্যার সমাধান হয়ে যায় তাহলে তো ভালোই নাহলে পড়ে না হয় ডিভোর্সের মতো সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। একটা সম্পর্ক গড়ে তোলা অনেক কঠিন আর ভেঙে ফেলা অনেক সহজ কিন্তু একবার ভেঙে গেলে সেই সম্পর্ক আবার নতুন করে গড়ে তোলা অসম্ভব। আর এই ভাঙ্গা গড়ার মাঝে নিষ্পেষিত হয় ছোট অবুঝ বাচ্চারা।
আমি আমার আরিয়ান ও আরিশাকে বুকে জড়িয়ে নিলাম।
গাড়ি চলছে রেডিও স্টেশনের দিকে।

সমাপ্ত।।
 
চিঠির সেই কথা গুলো শোনার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছি।
গল্পের মাধ্যমে দামি কিছু মেসেজ দিয়েছেন, অনেক ধন্যবাদ।
 
ভাই বিষয়টা একটু বেশিই নির্মম আর নিষ্ঠুর হয়ে গেল আর তারই সমর্থন শেষ পযর্ন্ত।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top