মানুষের রক্তে অণুচক্রিকা বা প্লাটিলেট একটি গুরুত্বপূর্ণ রক্তকণিকা; যা কাজ করে রক্ত জমাট বাঁধতে। প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকার স্বাভাবিক সংখ্যা প্রতি ঘন মিলিলিটারে দেড় লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ। কেবল ডেঙ্গু নয়, আরও নানা রোগে রক্ত সংক্রমণে এই প্লাটিলেটের সংখ্যা কমতে পারে। তবে তা কমে এক লাখের নিচে আসে সাধারণত জটিল সময়ে।
ক্ল্যাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরে প্লাটিলেট সামান্য কমলেও সাধারণত এক লাখের বেশি থাকে। সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর আর ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের মধ্যে পার্থক্য আছে। শুধু জ্বর বা রক্তক্ষরণ হলেই সেটা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বলতে হলে প্লাটিলেট এক লাখের নিচে থাকতে হবে। সেই সঙ্গে রক্তের হিমাটক্রিট ২০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার প্রমাণ থাকতে হবে। সঙ্গে থাকতে পারে রক্তনালি থেকে রক্তরস বেরিয়ে আসা বা প্লাজমা লিকিংয়ের সমস্যা (যেমন প্রোটিন কমে যাওয়া, পেটে–বুকে পানি জমা) থাকবে। বিশ্বে প্রতিবছর ১০ থেকে ৪০ কোটি লোকের ডেঙ্গু হয়, এর মধ্যে খুব কমসংখ্যকের হেমোরেজিক ডেঙ্গু হয়ে থাকে।
ডেঙ্গু জ্বর হলে রক্তের সিবিসি (কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট) পরীক্ষা করার মাধ্যমে প্লাটিলেটের সংখ্যা নিরূপণ করা হয়। প্লাটিলেটের সংখ্যা এক লাখের কম হলে তাকে হেমোরেজিক বলে ধরে নেওয়া যায়।
আসলে ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায় প্লাটিলেট পরীক্ষার ভূমিকা শুধু হেমোরেজিক কি না, তা ডায়াগনসিসের জন্যই। ৮৯ থেকে ৯০ শতাংশ ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট কমে বটে, তবে এদের মধ্যে মাত্র ১০ থেকে ২০ শতাংশের জটিল পর্যায়ের নিচে যায়। মোটে ৫ শতাংশ ডেঙ্গু রোগীর মারাত্মক রক্তক্ষরণ জটিলতা হয় আর রক্ত পরিসঞ্চালন দরকার হতে পারে। প্লাটিলেটের সংখ্যা ২০ হাজারের নিচে নামলে রক্তক্ষরণের আশঙ্কা থাকে। প্লাটিলেট যদি ৫ হাজারের কম হয়, তখন মস্তিষ্ক, কিডনি, হৃৎপিণ্ডের মধ্য রক্তক্ষরণের ভয় থাকে।
তবে ডেঙ্গু জ্বরে যে রক্তক্ষরণের কারণ কেবল প্লাটিলেট কমা তা নয়, এর সঙ্গে অন্তত আরও ১১টি কারণ আছে। তাই শুধু এককভাবে প্লাটিলেট দিয়ে লাভ হবে না।
রক্তের প্লাটিলেট ২০ হাজারের নিচে হলে অনেকে প্লাটিলেট সংগ্রহের জন্য ছোটাছুটি করেন। তবে বিভিন্ন গবেষণা দেখাচ্ছে, ২০ হাজারে যাঁরা প্লাটিলেট সঞ্চালন করেছেন, আর যাঁরা করেননি, তাঁদের মধ্যে শেষ অবধি রক্তক্ষরণের মাত্রা বা ধরনের কোনো তারতম্য হয়নি। রোগের পরিণতিতেও আলাদা কিছু প্রত্যক্ষ করা যায়নি। অনেক সময় দেখা যায়, প্লাটিলেট ১০ হাজার বা তারও নিচে নেমে যাচ্ছে, তবু কোনো রক্তক্ষরণ নেই, এর কারণ যে সংখ্যাতেই আছে, তা কার্যকরী প্লাটিলেট। তা ছাড়া ডেঙ্গুর জটিল পর্যায় পার হতে হতে প্লাটিলেট দ্রুত আবার বাড়তে থাকে।
এ জন্য অনেক দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের নিয়ম অনুযায়ী, প্লাটিলেট ১০ হাজার পর্যন্ত নামলেও প্লাটিলেট সঞ্চালনের দরকার নেই। তবে এর নিচে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ফলে প্লাটিলেট বিপজ্জনক মাত্রায় না নামা পর্যন্ত (২০ হাজারের নিচে) প্লাটিলেট বা রক্ত সংগ্রহ করার জন্য অকারণ দুশ্চিন্তার কারণ নেই। কারণ, খুব নগণ্যসংখ্যক রোগীরই শেষ পর্যন্ত তা দরকার হবে।
ডেঙ্গু রোগের আসল চিকিৎসা প্লাটিলেট সঞ্চালন নয়, বরং নিখুঁতভাবে পানিশূন্যতা, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা, প্লাজমা লিকেজ বা প্লাজমা রক্তনালির বাইরে যাতে চলে না আসে, সে চেষ্টা করা। রক্তক্ষরণের জন্য ডেঙ্গু রোগী মারা যায় না, বেশির ভাগের মৃত্যু ঘটে ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে। মানে রোগী যখন শকে চলে যায়, হৃৎস্পন্দন দুর্বল হয়ে পড়ে, রক্তচাপ নেমে যায় আর শরীরের বিভিন্ন অপরিহার্য অঙ্গে রক্ত সঞ্চালন কমে যায়। তা ছাড়া প্লাটিলেট এক বা দুই ইউনিট দিয়ে যেটুকু বাড়ে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম।
ডেঙ্গু হলে অনেকে সকাল-বিকেল প্লাটিলেট পরীক্ষার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন বা প্লাটিলেট একটু কমতে থাকলেই আতঙ্কিত হতে থাকেন। এর কোনোই দরকার নেই। বারবার পরীক্ষা করালে দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ বাড়া ছাড়া আর কোনো উপকার হয় না। আবার মেশিনে গুনলে এই সংখ্যা ভুল হতে পারে, কারণ প্লাটিলেট ক্লাম্প বা গুচ্ছ হিসাবে থাকায় মেশিন অনেকগুলোকে একটা হিসেবে ধরে সংখ্যা নিরূপণ করে।
মূলত ডেঙ্গুতে গুরুতর রক্তক্ষরণ হলে, যেমন মলের সঙ্গে রক্তপাত বা রক্তবমি হলে রক্তের বদলে রক্ত দেওয়াই উত্তম, প্লাটিলেট নয়। তা ছাড়া প্লাটিলেট সঞ্চালন খুবই ব্যয়সাধ্য ও শ্রমসাধ্য ব্যাপার, এক ইউনিটের জন্য চারজন দাতাকে রক্ত দিতে হয়। সর্বত্র প্লাটিলেট পৃথক করার যন্ত্রও নেই।
সব মিলিয়ে ডেঙ্গু হলে প্লাটিলেট কমা ও প্লাটিলেট জোগাড় নিয়ে অযথা দুশ্চিন্তা ও ছোটাছুটি করবেন না। সাধারণ ডেঙ্গু হলে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন, যথেষ্ট তরল খাবার খান। প্রয়োজন হলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে স্যালাইন নিন। ডেঙ্গু জ্বরের এর বাইরে আর তেমন কোনো চিকিৎসা নেই, আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আপনা–আপনি সেরে যায়।
[FA]pen[/FA] লেখক: অধ্যাপক ডা. খাজা নাজিমুদ্দিন, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ