১৯৬০ এর দশক। দিকে দিকে পরিবর্তনের বাণী। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর অনেক দেশই চেয়েছিল নিজেদের ঢেলে সাজাতে। সে সময়ই চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সে তুং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ডাক দেন। সারা বিশ্বে এটি পরিচিত গণচীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব বা মহান শ্রমিক সাংস্কৃতিক বিপ্লব নামে। এ বিপ্লব সংঘটিত হয় বেশ লম্বা সময় ধরে। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬ সাল সময়কালে চীনে বেশ বড় পরিবর্তন আনে মাওয়ের রেড আর্মি। যারা বাস্তবায়ন করেছিল তার সাংস্কৃতিক বিপ্লবের স্বপ্ন। ইতিহাস বলে, পুঁজিবাদী ও প্রাচীন ধ্যানধারণা থেকে চীনকে দূরে রাখতে এবং প্রকৃত সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার বিকাশের জন্য এ বিপ্লবের ঘোষণা দিয়েছিলেন মাও।
সালটা ১৯৬৫। বছরের শেষের দিকে মাও সে তুং ও দেং জিয়াও পিংয়ের সমর্থকদের মধ্যে দেখা দেয় মতবিরোধ। দুই ভাগ হয়ে যায় কমিউনিস্ট পার্টি। খানিক সময় নিলেন মাও। ১৯৬৬ সালের ১৬ মে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মাও সে তুং সমাজের বিত্তহীন শোষিত শ্রেণির প্রতি সামাজিক বিপ্লবের ডাক দেন। এর আগে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সালে চীনে “গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড” নামের একটি ধারণার প্রচলন ঘটান মাও যা কিনা ছিল চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ। এর ব্যর্থতা শাসক হিসেবে মাওকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। নিজেকে আরও শক্তিশালীভাবে জাহির করতে ও বিরোধী মতকে দমন করার কৌশল হিসেবেই মাও ঘোষণা করেন এই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের।
চীনের তরুণদের সমর্থন আদায়ের জন্য মাও বের করেন রাজনৈতিক দর্শনের একটি বই। সারা বিশ্বে এটি পরিচিতি পায় ‘লিটল রেড বুক’ নামে। বইটির প্রচ্ছদ ছিল উজ্জ্বল লাল রঙের। চীনের সংস্কৃতি ও রাজনীতি থেকে শুরু করে যুদ্ধ পরিচালনার কলাকৌশল সম্পর্কে চেয়ারম্যান মাও কী ভাবতেন, এ সবই ছিল এই বইয়ের বিষয়বস্তু।
মাওয়ের রেড বুকের ফলাফল ছিল চমকপ্রদ। এটি রাতারাতি স্বৈরশাসক ও বিত্তবানদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ঐক্য গড়ে তোলে। ফলে চীনের ইতিহাসে ঘটে এক দীর্ঘ রাজনৈতিক ও সামাজিক সংঘাত আর অস্থিতিশীলতার ঘটনা। মাওয়ের লাল বইয়ে প্রভাবিত এই বিশাল জনগোষ্ঠী মাওয়ের বিরুদ্ধবাদীদের মারধর করতে থাকে এবং তাদের বাড়িঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। অনেক জায়গায়ই সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় গোটা চীনে জুড়ে।
জনগণের সিংহভাগকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে মাওয়ের সত্যি বলতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। শুরু থেকে মাও চীনে ছিলেন সবচে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। তখনকার বিপ্লবী সো ইয়ং বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাতে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন,
“জন্ম থেকেই আমাদের শেখানো হয়েছে যে তিনি হচ্ছেন একজন মহান নেতা। আমরা মনে করতাম, তিনি একজন ঈশ্বর।”
সাংস্কৃতিক বিপ্লব যখন শুরু হয় তখন সো ইয়ংএর তখন বয়েস ছিল মাত্র ২০। চেয়ারম্যান মাও এর ব্যাপারে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নিবেদিত। শুধু তিনিই নন। সম্ভবত পুরো তরুণ সমাজই ছিল নিবেদিত।
“তিনি পুরো দেশকে এবং দেশের মানুষকে মুক্ত করেছেন। তিনি গরীব মানুষকে উদ্ধার করেছেন। তাই তিনি আমাকে যা-ই করতে বলবেন, তার জন্য আমি আমার সমস্ত শক্তি এমনকি আমার জীবন দিয়ে দিতে রাজী ছিলাম।”
বিপ্লবের দর্শন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি জানান, “এটা হবে এক নতুন বিপ্লব – এক সাংস্কৃতিক বিপ্লব। যে বিপ্লব ঘটবে মানুষের চিন্তায়। এর লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের মনে যে সব পুরোনো ধ্যানধারণা আর অভ্যাস ছিল – সেগুলো সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করা। মাও বিশ্বাস করতেন, এগুলো কমিউনিজমের পথে অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে পারে।”
মাওয়ের রেড গার্ড চারটি পুরোনো জিনিসের বিরুদ্ধে শুরু হলো তাদের অভিযান। পুরোনো অভ্যাস, পুরোনো ধ্যান-ধারণা, পুরোনো ঐতিহ্য আর পুরোনো সংস্কৃতি। তাই সেসময় পুরোনো যে কোন কিছুই আক্রান্ত হলো। রেড গার্ড যদি পুরোনো আমলের কোন সামগ্রী পেতো, যে কোন আসবাব, তাদের যদি মনে হত যে এটা আধুনিক নয় – তাহলেই সেটা পুরোনো। যদি এমন কোন কাপড় চোপড়ও পাওয়া যায় – যা খুব বেশি রকমের সুন্দর, বেশি রংচঙে, বলে দিলেন, এটাও পুরোনো। এ ক্ষেত্রে রেডগার্ডের তরুণরা যা বলবে তাই ছিল চূড়ান্ত। ফলে অরাজকতার পাশাপাশি একরকম হিংসা এবং ক্রোধ বাড়তে থাকে পুরো চীনজুড়ে।
মাওয়ের ‘লিটল রেড বুক’ হাতে রেড গার্ডরা
তাদের ভাষায় যা-ই পশ্চাৎপদ, বা ক্ষয়িষ্ণু – তার বিরুদ্ধেই রেড গার্ডরা এক সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলো। তারা লোকের বাড়িঘরে ঢুকে আসবাবপত্র ভেঙে দিতে লাগলো। যেসব প্রসাধনী বিক্রি করে এমন দোকানও ভেঙে দিতে লাগলো তারা। করো চুল বেশি লম্বা মনে হলে তাকে ধরে চুল কেটে দেয়া হতে লাগলো।
রেডগার্ডদের জন্য এই আন্দোলন ছিল খুবই উত্তেজনাকর। হঠাৎ তারা উপলব্ধি করলো তারাই যেন দেশ চালাচ্ছে। তারা দেশের সব জায়গায় যেতে পারছে। তারা যা বলছে সবাই তা করতে বাধ্য হচ্ছে।
যারা তাদের কথা শুনছিল না। তাদের জন্য প্রকাশ্যে অপমান করা হতে লাগলো। তাদের ভুল ধরিয়ে দেয়া হতে লাগলো। পুরো চীন জুড়ে রেডগার্ডরা এই কর্মসূচি চালু করলো – এর শিকার হলেন স্থানীয় কর্মকর্তারা এমন কি ছাত্ররাও। তাদের প্রকাশ্যে তিরস্কার করা হতো, কখনো কখনো শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত করা হতো।
এই রকম গণ অপমান কর্মসূচির একটা বড় লক্ষ্য ছিল শিক্ষকরা। তাদের বিশ্বাস, শিক্ষকরা ছিল বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী তাই তাদের বিশ্বাস করা যাবে না। সারা চীন জুড়ে ক্লাসরুম আর লেকচার হলে শিক্ষকদের গালাগালি এবং অপমান করতো ছাত্ররা। তাদের পরিয়ে দেয়া হতো গাধার টুপি বা তাদের ভুল স্বীকারের চিহ্ন। কাউকে কাউকে কলমের কালি খাইয়ে দেয়া হতো, বা মাথার চুল কামিয়ে দেয়া হতো। কারো কারো গায়ে থুথু ছিটানো হতো। অনেককে আবার মারধরও করা হতো। কিছু ক্ষেত্রে মেরে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে।
মাও সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু করেছিলেন পার্টির শোধনের জন্য। কিন্তু রেড গার্ডকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়লো। যে কেউ তাদের শিকার হতে পারতো। তাই ১৯৬৭ সালের দিকে অনেকেই চীন থেকে পালিয়ে যেতে শুরু করেন।
সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ফলে চীনে তখন বহু ধরনের সমস্যার জন্ম হয়। অনেকে জানত না ঠিক কী কারণে তারা বিপ্লবে শামিল হয়েছে। কল-কারখানায় নিযুক্ত কর্মীরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ায় উৎপাদন কমতে থাকে। চীনের শিল্পজাত দ্রব্য উত্পাদন নেমে আসে ১৪ শতাংশে। পরিবহনব্যবস্থায়ও এর প্রভাব পড়ে। অনেক রেলগাড়ি ‘রেডগার্ড’দের জন্য ব্যবহার করা হয়। বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের পাঠানো হয় কারাগারে কিংবা যুক্ত করা হয় খামারের কাজে। তাঁদের জ্ঞান যায় বিফলে।
চীনের শহরগুলোয় শিক্ষা পদ্ধতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেকেরই শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে যায়। ‘তরুণদের প্রেরণ করো’ পরিকল্পনা শিক্ষাজীবনকে আরো বাধাগ্রস্ত করে। ওই পরিকল্পনায় শিক্ষার্থীদের শহর থেকে দেশের নানা স্থানে পাঠানো হয়েছিল বিপ্লবের কাজে। এই কথিত বিপ্লব মাওকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করে তোলে। কঠোর হাতে দমন করা হয় বিরোধী পক্ষকে। এক কথায় সমাজতন্ত্রের আদলে মাও হয়ে ওঠেন চীনের একক ক্ষমতার উৎস। তার এবং রেড আর্মির একক ইচ্ছায় চলতে থাকে পুরো দেশ। ইতিহাসবিদদের মতে, সাংস্কৃতিক বিপ্লবে ফলে প্রায় ৫ থেকে ২০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়।
মাও মারা যান ১৯৭৬ সালে। লাল বইয়ের স্বর্ণযুগের সমাপ্তি ঘটে ওই দশকেই। ক্ষমতায় আসেন দেং জিয়াও পিং। তিনি লাল বইকে ‘বাম বিচ্যুতি’ দোষে দুষ্ট করেন। বহির্বিশ্বেও এর গুরুত্ব কমতে থাকে। দেং চীনে শুরু করেন সত্যিকার আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। চীনকে মুক্ত বাজার অর্থনীতির রাষ্ট্র ঘোষণা করেন সবার আগে। দেশে ব্যবসা, শিক্ষা থেকে শুরু করে সবক্ষেত্রে নাগরিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন দেং। বাধ্যতামূলক কৃষি থেকে সরে এসে গুরুত্ব দেন শিল্পায়নের প্রতি। আধুনিক চীনের শিকড় সেদিন থেকেই বাড়তে থাকে।