ছাদেই গড়ে তোলা যায় আম বাগান। বর্ষার সময়েই লাগিয়ে ফেলতে পারেন গাছ। গাছ পেড়ে আম খাওয়ার স্বাদ পেয়ে যাবেন দুই বছরের মাথাতেই।
আমের মৌসুমে আম মিলবে, এটাই তো স্বাভাবিক। সেই আম যদি বাজারের না হয়ে বাসার ছাদ থেকে মেলে, তবে তো বেশ হয়। ছাদবাগানে যদি কয়েক জাতের আমগাছ থাকে, নিশ্চিন্তে নিরাপদে আমের স্বাদ নিতে পারেন বাড়ির ছাদে বসেই। বর্ষার এ সময় যেহেতু গাছ লাগানোর জন্য উপযুক্ত, তাই আগে থেকে না থাকলেও এখনই ছাদবাগানে যোগ করে নিতে পারেন আমের চারা। রৌদ্রোজ্জ্বল খোলা ছাদে বড় টব কিংবা ড্রাম, হাফ ড্রামে কলমের গাছে ফল মিলবে বছর দুই না যেতেই। পর্যাপ্ত রোদ পড়ে এমন বারান্দা হলে দু-একটি আমগাছ অনায়াসে ঠাঁই দেওয়া যায় সেখানেও। তখন আম পেতে অবস্থা হবে এমন—‘ছাদ কিংবা বারান্দা, যেখানেই যাই হাত বাড়ালেই পাই’।
কথা হয় ঢাকার নূরের চালার (আমেরিকান দূতাবাসের কাছে) বাসিন্দা কবির খানের সঙ্গে।পেশায় ব্যবসায়ী কবির খান নিজ বাসার ছাদে বাহারি ফুল আর রকমারি ফলের সমন্বয়ে গড়ে তোলেন দৃষ্টিনন্দন ছাদবাগান।ফলের মধ্যে ফলের রাজা আমের রাজত্ব চোখে পড়ার মতো।মহাচানক, রঙিন আমেরিকান পালমার, থাই কাটিমন, থাই নামডকমাই, থাই ব্যানানা আম, মালয়েশিয়ান লুবনা, হাঁড়িভাঙা, কিউজাই, পুনাই, চেন্নাইসহ অনেক জাতের আম।ফলে সারা বছরই কোনো না কোনো গাছে থোকা থোকা আম থাকেই। ফেসবুকে পোস্ট করা আমের ছবি দেখে যাঁরা প্রথমবার অবাক হন, দ্বিতীয়বার অবাক হতে হাজির হন ছাদ বাগানে।কবির খান জানান, ‘এত যে আম ফলে, তার সবই পরিবার–পরিজন–বন্ধুদের মধ্যে বণ্টন হয়ে যায়। দূরের কোনো বন্ধু আসতে না পারলে পাঠিয়ে দিই কুরিয়ারযোগে। দেখা যায় দুটি আম পাঠাতে খরচ পড়ে যায় ২০০–৩০০ টাকা। কিন্তু এতে যে আনন্দ তা লাখ টাকায়ও মেলে না।’
অভিনব জাতের আমের চারাও এখন পাওয়া যায়
আমের জাত নির্বাচন
যেহেতু ছাদে বড় টব কিংবা ড্রামের মাটিতে বড় হবে গাছটি, তাই উপযুক্ত চারা নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। বেছে নিতে হবে সুস্থ–সবল ঝোপালো কলম করা আমের চারা। জাতের মধ্যে ফজলি, ল্যাংড়া, হিমসাগর, গোপালভোগ, হাঁড়িভাঙা, গৌড়মতি থেকে শুরু করে আম্রপালি, আলফেনসো, মহাচানক, রঙিন আমেরিকান রেড পালমার, সূর্যডিম আম, থাই নাম ডক মাই, থাই ব্যানানা আম, আপেল আম, তোতাপুরি আম, কাঁচামিঠা আম, মালয়েশিয়ান লুবনা, কিউজাই, পুনাই, ব্রুনাই কিং, কিং অব চাকপাত আম, চিয়াংমাই আম, কেইন্ট আমসহ নানা জাতের মধ্যে বেছে নিতে পারেন আপনার পছন্দেরটি।
যদি চান সারা বছর ধরে আম, তবে নিন বারোমাসি আমের চারা। বারোমাসি আমের মধ্যে নিতে পারেন বারি-১১, থাই কাটিমন, মালয়েশিয়ান পুনাই আম, মালয়েশিয়ান লুবনা আম। এর মধ্যে বারি–১১ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) কর্তৃক উদ্ভাবিত একটি জাত। এর এক ডালে মুকুল তো অন্য ডালে ছোট আম, আবার আরেক ডালে পাকা—এভাবেই সারা বছর ফল দেয় বারি–১১। একেক থোকায় পাঁচ-সাতটি পর্যন্ত আম হয়। সুমিষ্ট এ আম অন্যান্য বারোমাসি আমের তুলনায় আকারেও বড়, গড় ওজন ৩০০-৩৫০ গ্রাম।
আম ভালো রাখার আছে নানা কৌশল
কোথায় পাবেন চারা
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা শহরে রয়েছে হর্টিকালচার সেন্টার। খোঁজ নিন, পেয়ে যাবেন। সরকারি এই হর্টিকালচার সেন্টারের চারাগুলো দামে কম, কিন্তু মানে ভালো। সরকারি ছুটির দিন বাদে খোলা পাবেন রোববার থেকে বৃহস্পতিবার, সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। ঢাকায় যেতে পারেন ফলবীথি হর্টিকালচার সেন্টারে কিংবা গুলশান হর্টিকালচার সেন্টারে। অনেকেরই অভিযোগ থাকে যেনতেন নার্সারিতে চারা কিনতে গিয়ে ঠকেছেন। হয়তো চেয়েছেন এক আর দিয়ে দিয়েছে অন্য জাত। আর সেই প্রতারণা টের পেতে অপেক্ষা করতে হয় গাছে ফল ধরা পর্যন্ত। আর তাই এমন অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতারণা এড়াতে আপনার কাঙ্ক্ষিত জাতের চারাটি খুঁজতে প্রথমেই যান আপনার নিকটবর্তী হর্টিকালচার সেন্টারে। সেখানে না পেলে পা বাড়ান আপনার পরিচিত ও বিশ্বস্ত কোনো নার্সারিতে।
চারা কেনার সময় সতর্কতা
চারা কেনার সময় কয়েকটি বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন চট্টগ্রাম হাটহাজারী হর্টিকালচার সেন্টারের উদ্যানতত্ত্ববিদ ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. আল মামুন শিকদার। প্রথমত, চারা হবে কলম চারা। চারার কলম করা অংশটা যাচাই করে নেওয়া ভালো, যাতে বীজের চারা কলম করা বলে চালিয়ে না দেয়। চারা হবে ঝোপালো। চারার রুট স্টক, মানে কলমের নিচের অংশটি যেন মোটা গড়নের হয়। পাতার ওপরে–নিচে দেখে নিতে হবে, যাতে কোনো পোকা বা ছত্রাকের আক্রমণ না থাকে। অন্যথায় এ চারার সঙ্গে বয়ে আনা পোকামাকড় কিংবা রোগবালাই বাগানের অন্যান্য গাছেও ছড়িয়ে পড়বে। পলি ব্যাগের নিচ থেকে বেরিয়ে থাকা গাছের প্রধান শিকড় যাতে কাঁটা না থাকে। এমন চারা মরে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। চারা এনে অন্তত এক দিন ছায়ায় রেখে দেওয়া ভালো। রোপণের জন্য বিকেল বা সন্ধ্যাবেলা বেছে নেওয়া উত্তম।
রোপণ–পরবর্তী পরিচর্যা
রোপণের পর নিয়মিত পানি দেওয়া স্বাভাবিক পরিচর্যা। গাছ ছোট থাকতেই মুকুল এলে মুকুল ভেঙে দিয়ে গাছকে একটু বড় হতে দিতে হয়। চারা বেড়ে গাছে রূপ নেবে। কৃষিবিদ মো. আল মামুন শিকদার জানান, মুকুল আসার আগে থেকে গাছে সার দেওয়া বন্ধ, পানিও দেবেন আগের চেয়ে কম। কারণ এ সময়ে সার–পানি পেলে গাছ আশানুরূপ মুকুল না দিয়ে নতুন পাতা ছাড়তে শুরু করবে। মুকুল আসতে শুরু করলেই প্রথমবার সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক ও ম্যানকজেব–জাতীয় ছত্রাকনাশক গাছে স্প্রে করতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে এক মিলিলিটার কীটনাশক ও প্রতি লিটার পানিতে দুই গ্রাম ছত্রাকনাশক মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। গাছের মুকুল, পাতা, কাণ্ড ভালোভাবে ভিজিয়ে তাতে স্প্রে করতে হবে বিকেলবেলা। মুকুল যখন চার-ছয় ইঞ্চি লম্বা হয়, কিন্তু তখনো ফুল ফোটেনি, এ অবস্থায় একই অনুপাতে দ্বিতীয়বার স্প্রে করতে হবে। ফুল ফুটে গেলে কোনো রূপ কীটনাশক বা ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা যাবে না। তবে এ সময় থেকে স্বাভাবিক সার–পানি দেওয়া যাবে। সারের তালিকায় বোরন, সালফার ও জিপসাম যেন থাকে। ফুল শেষে ফল মটর দানা এবং পরে মার্বেল আকারের হলে তৃতীয় ও চতুর্থবারের মতো কীটনাশক বা ছত্রাকনাশক স্প্রে করা ভালো। আর সবশেষে ফল বড় হতে থাকলে ব্যাগিং করা যেতে পারে। এতে বাইরের পোকামাকড়ের হাত থেকে যেমন ফল রক্ষা পাবে, তেমনই ফল থাকবে দাগহীন ও পরিচ্ছন্ন।