ঢালিউডে ইতিহাস আলোকিত করা যে চলচ্চিত্রগুলো আছে ‘চাঁদনী’ (০৪/১০/১৯৯১) তার অন্যতম।
বাংলা চলচ্চিত্রে ৯০ দশকেও যখন চলছিল রাজ্জাক, আলমগীর, রুবেল, সোহেল রানা, জসিম, ইলিয়াস কাঞ্চন, শাবানা, সুচরিতা, সুনেত্রা, অঞ্জু, রোজিনা, দিতি, চম্পা ও ববিতাদের মতো অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দাপট, তাদের নতুন কোন ছবি মুক্তি পেলেও যেখানে হতো হিট-সুপার হিট, বইছিল চলচ্চিত্রে চারদিকে সুবাতাস। কিন্তু তার পরেও কোথায় যেন একটা শূন্যতা বিরাজ করছিল দর্শকদের মনে, কিসের যেন আকাঙ্ক্ষা ছিল তাদের।
ঠিক তখনই দর্শকদের মনের শূন্যতা বুঝতে পেরেছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ ক্যাপ্টেন এহতেশাম সাহেব। নতুন তারকা তৈরির এ কারিগর বাম্পার হিট ‘চাঁদনী’র মাধ্যমে দর্শকদের উপহার দিলেন একেবারেই নতুন দুটি মুখ নাঈম ও শাবনাজ। অল্প বয়সী দুই তরুণ-তরুণী জুটিকে পেয়ে কী জানি হলো সে সময় সিনেমা পাগল দর্শকদের, সবাই যেন হুমড়ি খেয়ে পড়লো সিনেমা হলের সামনে। একবার হলেও যেন দেখা চাই ‘চাঁদনী’।
দর্শকেরা যেন মনে মনে এ রকম একটি সুন্দর জুটির জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। অপেক্ষার পালা শেষ করে শুরু হলো ছবি দেখার পালা, বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো সবাই ছুটল সিনেমা হলের দিকে। আর আপন করে নিলো এই জুটিকে।
মূলত শাবনাজ-নাঈমের পথ ধরেই শুরু হলো বাংলা চলচ্চিত্রের নতুনদের রাজত্ব। যে রাজত্বে পরবর্তীতে আমরা পেয়েছিলাম চলচ্চিত্রের বরপুত্র সালমান শাহ, প্রিয়দর্শিনী মৌসুমী, ওমর সানি, আমিন খান, জাত অভিনেত্রী শাবনূর, শাহনাজ, অমিত হাসান, রিয়াজের মতো তারকাদের।
তখনকার সব সিনেমা পোকা দর্শকদের সঙ্গে আমার মতো আরও অনেকে যখন বাংলা এফডিসির চার দেয়ালের ভেতরের দৃশ্য দেখে দেখে বিরক্ত, ঠিক তখনই সিলেটের জাফলং-এর মনোমুগ্ধকর জায়গার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন এহতেশাম। স্নিগ্ধ পাহাড়ি পরিবেশে সম্পূর্ণ রোমান্টিক ধাঁচের ছবি ‘চাঁদনী’ সারা দেশে ঝড় তুলল। নতুন গল্প নতুন লোকেশন আর নতুন সব অভিনয়শিল্পীদের পেয়ে দর্শকেরা ছবিটিকে সাদরে গ্রহণ করলো।
দুর্দান্ত ব্যবসা করলো ছবিটি। বাংলা চলচ্চিত্রে যদি সেরা দশ ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র নির্বাচন করা হয় তাহলে এই ছবিটির নাম চলে আসবে অনায়াসে। ছবিটি যেমন পর্দায় ঝড় তুলেছিল ঠিক তেমনি সব কটি গানও শ্রোতামহলে জায়গা করে নিয়েছিল। বিশেষ করে ‘বন্ধুর বাঁশি বাজেরে আমার কানে কানে’, ‘ও আমার জান তোর বাঁশি যেন জাদু জানেরে’, ‘কত দিন পরে দেখা হলো দুজনাতে’ গানগুলো তখনকার রেডিও ও অডিও (অডিও স্বত্ব ছিল অনুপম রেকর্ডিং মিডিয়া)-তে সুরের ঝড় বইয়ে দিয়েছিল। গুণী সুরকার আনোয়ার পারভেজের সুরে ছবির সাতটি গানই পেয়েছিল সমান জনপ্রিয়তা। রেডিওর অনুরোধের আসরে প্রতিদিনই নিয়ম করে বাজানো হতো গানগুলো।
যাই হোক, ‘চাঁদনী’ বাম্পার হিট হওয়ার কারণে নতুন দুই মুখ শাবনাজ-নাঈমকে নিয়ে তখনকার পরিচালকেরা দারুণ আশাবাদী হলেন। রাজ্জাক, আলমগীর, ফারুক, জসিম, মান্না, ইলিয়াস কাঞ্চন, শাবানা, রোজিনা, সুচরিতা, ববিতা, দিতি, চম্পা, সুনেত্রাদের পাশাপাশি নাঈম-শাবনাজও সব শ্রেণির দর্শকদের কাছে দারুণ প্রিয় হয়ে গেলেন। তুমুল দর্শকপ্রিয় দুই তারকাকে জুটি করে একের পর এক ছবি নির্মাণ করতে লাগলেন গুণী পরিচালকেরা। তারই ধারাবাহিকতায় একে একে মুক্তি পেতে থাকলো এহতেশামের ‘চোখে চোখে’ সোহানুর রহমান সোহানের ‘দিল’, ’লাভ’, শিবলী সাদিকের ‘অনুতপ্ত’, আজিজুর রহমানের ‘জিদ’, হাফিজউদ্দিনের ‘টাকার অহংকার’, সাইফুল আজম কাশেমের ‘সাক্ষাৎ’, আফতাব খান টুলুর ‘ফুল আর কাঁটা’, মুস্তাফিজের ‘সোনিয়া’, মতিন রহমানের ‘আগুন জ্বলে’, ফজলে হকের ‘লড়াই’, ‘বিষের বাঁশি’-র মতো দারুণ ব্যবসাসফল ছবিগুলো। তবে এসব ছবির মধ্যে ‘আগুন জ্বলে’ ও ‘বিষের বাঁশি’ ব্যবসায়িকভাবে সফল হতে পারেনি। ‘আগুন জ্বলে’ ছিল নাঈমের প্রথম ও শেষ প্রযোজিত ছবি। তবে এ ছবিতে ব্যবহার করা বেবী নাজনীনের ‘এলোমেলো বাতাসে উড়িয়েছি শাড়ির আঁচল’ গানটি ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল।
পরিচালক এহতেশামের সঙ্গে নাঈম-শাবনাজ
তখনকার সময় রোমান্টিক ছবির সফল জুটি হিসেবে সবাই নাঈম-শাবনাজকেই চিনতো। তবে নাঈমকে ছাড়াও আমিন খানের সঙ্গে ‘জনম জনম’, ইলিয়াস কাঞ্চনের ‘বদসুরত’, মান্নার ‘দেশদ্রোহী’, সালমান শাহর ‘আঞ্জুমান’ ও ‘মায়ের অধিকার’, অমিত হাসান ও বাপ্পারাজের সঙ্গে ‘প্রেমের সমাধি’ ছবিতে অভিনয় করেন শাবনাজ। যার মধ্যে ‘বদসুরত’ ছাড়া বাকি সবগুলো ছবিই ছিল ব্যবসাসফল। ও দিকে নাঈম ‘মেয়েরাও মাস্তান’ ছবিতে মুনমুন, ‘সুখের আশায়’ ছবিতে অন্তরা ও ‘লড়াই’ ছবিতে মুক্তির সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন।
নাঈম-শাবনাজ জুটি হয়ে মোট এগারোটি ছবিতে অভিনয় করেছেন, যার বেশির ভাগই ছিল ব্যবসাসফল। একবার শোনা গিয়েছিল তারা প্রথম ছবি ‘চাঁদনী’ রিমেক করবেন। এ নিয়ে অনেকটা এগিয়েও ছিলেন তবে পরবর্তীতে এ ব্যাপারে আর তেমন কিছু জানা যায়নি। যদি সত্যিই ছবিটি পুনর্নির্মাণ হতো তাহলে নতুন দিনের দর্শকেরা একটি চমৎকার গল্পের চলচ্চিত্রের সাক্ষী থাকতে পারতো।
পর্দায় জুটি হয়ে অনেক ছবি করলেও নাঈম-শাবনাজ বাস্তবের জুটি হয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৯৬ সালে, বর্তমানে তারা দুটি কন্যা সন্তানের সফল পিতা-মাতা।
পরিচালক আজিজুর রহমানের সঙ্গে শাবনাজ-নাঈম
শেষে একটি কথা না বললেই নয়, আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রে তখন নতুনদের সাফল্যের যে জোয়ার এসেছিল তা কখনই সম্ভব হতো না যদি না সেদিন নাঈম-শাবনাজ জুটির এতটা সাফল্য না আসতো। তারা সফলতা দেখিয়েছিলেন বলেই তখনকার নির্মাতারা নতুন নতুন ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কাজ করার সাহস পেয়েছিলেন। সেই প্রেক্ষিতে বলতেই পারি, যতদিন বাংলা চলচ্চিত্র থাকবে তত দিন নতুনদের প্রেরণাদাতা হয়ে নাঈম-শাবনাজ জুটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
উল্লেখ্য, শাবনাজ-নাঈমের পাশাপাশি অভিনেতা সাদেক বাচ্চুরও চলচ্চিত্রে অভিষেক হয়েছিল ‘চাঁদনী’ ছবিটির মাধ্যমে৷
* লিখেছেন: আরিফুল হাসান