What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Other চলচ্চিত্রে সৈয়দ শামসুল হক : তিনি যে তাঁহার তুলনা (1 Viewer)

Starling

Board Senior Member
Elite Leader
Joined
Mar 7, 2018
Threads
775
Messages
12,016
Credits
220,387
Recipe wine
Kaaba
Profile Music
Birthday Cake
2QuH79d.jpg


২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর এ বসুন্ধরা থেকে বিদায় নেয়া এ দেশের বরেণ্য সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের জীবন-প্রদীপ নিবে যাওয়ার ক্ষীণ আলো দেখা যাচ্ছিল মৃত্যুর কয়েকমাস আগ থেকেই। এরজন্য তিনি বিচলিত ছিলেন না একটুও, বরঞ্চ অবশিষ্ট সময়টুকু উদযাপন করতে চেয়েছিলেন সৃষ্টির মনোবাসনা নিয়ে।

সারাজীবন ধরেই তো নিজেকে সৃষ্টিকর্মে ব্যস্ত রেখেছিলেন-কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, সিনেমা, গান, ছবি আঁকায়। কিন্তু চিকিৎসাব্যর্থ হয়ে বিদেশফেরত হক সাহেব যে এতই তাড়াতাড়ি চলে যাবেন, কতশত ভাবনাকে কাগজে বিলিয়ে দেবার ইচ্ছার বাস্তবায়নকে অসম্পূর্ণ রেখে- সেটা কি কেউ ভেবেছিল? অবশ্যই না। অন্তত আরো কয়েক মাস নিজেকে উজাড় করে দিবেন সৃষ্টির আবিলতায় এই তো ভেবে রেখেছিল সবাই, নিজেও বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন সেটা। আসলে মানুষের ভাবনা কতসময়ই না নিয়তির ঢেউড়ীঘরের পথ খুঁজে পায় না। কত ভাবনাই তো পূরণ হওয়ার আগে বাঁক নেয় অন্য পথের সন্ধানে-সেটা কতটুকু সিঁধা কতটুকু বাঁকা তাঁর সামর্থ্য বোঝার উপলব্ধিও অনেক সময় মানুষের থাকে না। তবে সৈয়দ হকের রেখে যাওয়া বর্ণাঢ্য জীবন কিন্তু সেই উপলব্ধির শিকলকে অনেকখানিই লাগাম ধরে রাখতে পেরেছিলেন প্রস্থানের আগপর্যন্ত। কী রকম বর্ণাঢ্য সেই জীবন, সাহিত্যের আলোচনায় ঘুরেফিরেই আসবে তা ।

তবে বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি সেই বর্ণাঢ্য সৃষ্টির রঙে কিভাবে নিজেকে রাঙিয়েছিলে, সেটা একটু বিশদভাবে আলোচনার দাবি রাখে। শুধু নিজেকে রাঙানো নয়, কী মাধুর্য্য নিয়েই না সৌন্দর্য্যে প্রলেপ এঁকে দিয়েছেন চলচ্চিত্রের নানা অঙ্গে- কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ, গানে। ১৯৫৯ সালে মহিউদ্দিন পরিচালিত মাটির পাহাড় সিনেমার কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ, গীতিরচনা এবং সহকারি পরিচালনার মধ্য দিয়ে সৈয়দ শামসুল হকের চলচ্চিত্র জগতে যাত্রা। এরপর ১৯৬৬ সালে শেক্সপীয়রের ‘কমেডি অব এরর’ নাটক অবলম্বনে উর্দু ভাষায় নির্মাণ করেন ‘ফির মিলেঙ্গে হাম দোনো’। এর আগে ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে নির্মিত তাঁর আরো কয়েকটি সিনেমাকে আলোচনায় রেখে আমরা দেখব এ দেশের চলচ্চিত্র জগতের স্বর্ণালী যুগে সৈয়দ হক কিভাবে অপরিহার্য করে তুলেছেন নিজেকে।

নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে গ্রাম ছেড়ে শহরে উঠা আসা আমাদের। তখনো আমরা চলচ্চিত্রকে ‘বই’ বলতাম। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই যেটা নগর জীবনের স্পর্শ পেয়ে হয়ে গিয়েছিল-বাংলা সিনেমা। গ্রামে ঘর পালিয়ে অন্যপাড়ায় টিভি দেখা দুরন্ত কিশোর শহরে নতুন সাদাকালো টেলিভিশনে দেখে ‘পুরস্কার’ ছবি। প্রেম-রোমান্স, একশান, যৌথ সংসারের চোখের পানি জড়ানো ভাঙ্গাগড়ার কাহিনী ছাড়াও শিশুতোষ গল্প নিয়েও যে সিনেমা হতে পাওে সেটা আমাদের ভাবনার বাইরে ছিল। এর আগে অবশ্যই ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’র মত চলচ্চিত্র আমরা পেয়েছি। কিন্তু সৈয়দ হকের শিশুতোষ এ চলচ্চিত্রকে আমি আলাদাভাবে আলোচনায় রাখব। এই তো সেদিন যেন মনে হয়, গলির মুখে পাড়ার বন্ধুদের সাথে খেলতে গিয়ে খেলায় আর ঝগড়ায় হেরে মনে কত কষ্ট নিয়ে গেয়েছিলাম- “হার জিৎ চিরদিন থাকবে, তবুও সামনে এগিয়ে যেতে হবে”। বছর ছয়েক আগেও একজন থেকে চলচ্চিত্রখানা সংগ্রহ করে কতজনকে দেখিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে চকবাজারে এক ব্যাচেলার মেসে থাকতাম, পাশের রুমে জুতোর দোকানে সেলসম্যান হিসেবে চাকরি করতো কয়েকজন অল্পশিক্ষিত কিশোর-যুবক থাকতো একই বাসায়। তাঁদেরকেও দেখিয়েছি সিনেমাটা। সেটা দেখে শাজাহান নামের একজন বলল-“ভাই, এটা কি সিনেমা দেখাইলেন। কোন নায়ক নায়িকা গুন্ডা মারমারি ছাড়া এত সুন্দর সিনেমা কোনদিন দেখি নাই”। তখনও চলচ্চিত্র জগত আলোচিত কাটপিস প্রভাবিত সময় থেকে বেরোতো পারেনি। এরকম সিনেমা যে এক সময় এ দেশে হতো অবাক হয়েছিল সাধারণ এসব খেটে খাওয়া মানুষগুলো। অনেকবারই তারা সিনেমাটা দেখেছে। তাদের সাথে আমিও দেখেছি কতবার।

এখনো মনে পড়ে- ছেলেবেলায় আলোচিত গানটার মাঝখানে অন্তরায় রতন, বাচ্চু, বাবুল, বাদশাদের নামের সিরিয়াল এলোমেলো হয়ে গেলে আম্মা ঠিক করে দিচ্ছেন, তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল দারুণ প্রখর। কিশোরদের জন্য অপরাধসংশোধনগার হিসেবে পরিচিত জেল স্কুলের কাহিনী নিয়েই এই সিনেমা। মামা-মামীর অন্যায় অত্যাচাওে শেষপর্যন্ত জেলস্কুলে স্থান হওয়া রতন নামের এক কিশোর আর স্কুলের আরেক ডানপিঠে ও দুষ্ট কিশোর বাদশা’র মধ্যে সম্পর্কেও দূরত্ব নিয়ে সিনেমাটার কাহিনী। একপাল শিশুকিশোর নিয়ে দারুণ সব ঘটনা, স্কুলের প্রত্যেকটির বন্দী কিশোরদের মনোযাতনা আর তাদের মধ্যকার সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে কী এক দারুণ সিনেমার গল্প হতে পাওে সেটা সৈয়দ হকই বুঝতে পেরেছিলেন একমাত্র। ১৯৮৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সৈয়দ শামসুল হকের কাহিনী, সংলাপ ও চিত্রনাট্যে চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন সি বি জামান। এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন মাস্টার সুমন, মাস্টার শাকিল, বুলবুল আহমেদ, জয়শ্রী কবির প্রমুখ। চলচ্চিত্রটি ১৯৮৩ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ পাঁচটি পুরস্কার অর্জন করে। যাদেরই সিনেমাটা দেখা আছে, আমার সাথে সহজে একমত হবেন যে, উপমহাদেশে শক্তিশালী শিশুতোষ সিনেমার মধ্যে নিঃসন্দেহে পুরস্কার অন্যতম মৌলিক সৃষ্টি। জেলস্কুলে দুইজন শিক্ষিক-শিক্ষিকার(বুলবুল আহমেদ-জয়শ্রী কবীর) আকার ইঙ্গিত রোমান্স কী দারুণভাবেই না দোলা দিয়ে যেত আমাদের কিশোর মনে, বুলবুলের বাঁকা চোখের চাহনী আর জয়শ্রী কবিরের গালের টোলপড়া হাসিহাসি সংলাপ দিয়ে শিশুতোষ সিনেমাতে কী পরিমিতিবোধের জায়গা থেকে কিছুটা রোমাঞ্চের রংতুলি বুলিয়ে দিয়েছেন, যখনই দেখি বারবার অবাক লাগে। শুধু এ সিনেমাতেই না, প্রেম আর রোমাঞ্চকর অনুভূতির দোলা দিয়ে যাওয়া সংলাপে দর্শক মাত্রই বিভোর হবেন- ‘সূতরাং’ চলচ্চিত্রখানা দেখে। এ দেশের চলচ্চিত্র জগতে অপরূপ গল্প বপন করে যাওয়া আরেক শিল্পী সুভাষ দত্ত। শহরের এক নাইটগার্ডের জীবনের সাধারণ এক গল্পকে কী সুনিপুণভাবেই না বর্ণনা করেছেন সুভাষ দত্ত সিনেমার ফিতায়। আসলেই দত্ত সাহেবের চিত্রনাট্য আর সৈয়দ হকের সংলাপ নির্মাণ ও গানের কথার প্রেমে পড়লে দর্শকতো সিনেমাকে আর সিনেমা বলে না, বলে-বই। যেটা নব্বই দশক পর্যন্ত সাধারণ দর্শক সিনেমার ক্ষেত্রে বলত। এ যেন সিনেমার রিলে মনোমুগ্ধকরভাবে পড়ে যাওয়া চলন্ত এক গ্রন্থ যেন, মানুষের সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার এক উপন্যাস। এ সিনেমার মাধ্যমেই নায়িকা কবরীর চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ। বাস্তবেই সদ্য এক কিশোরী কবরীকে গ্রামের এক তরুণের(যে তার স্বপ্নের কন্যাকে আপন কওে পেতে শহরে এসে নাইটগার্ডের চাকরি নেয়) স্বপ্নের নায়িকা কওে তোলার, সেইসাথে দর্শকদের মনেও প্রেমের পরশ বুলিয়ে দেয়ার যে খেলা খেলেছেন সুভাষ-হক দুইজনে মিলে সেটা বোঝার জন্য আপনাকে দেখতেই হবে পুরনো বাংলা চলচ্চিত্রখানা। বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালী যুগের রোমান্টিক গান কী সাবলীলভাবে না দর্শক এখনো মনে রেখেছে, এখনো স্মৃতি বিজড়িত হয় সে সময়ের সিনেমা অন্তঃপ্রাণ দর্শকরা। সূতরাং সিনেমাতে তেমনি এক অসাধারণ রোমান্টিক গান লিখে গিয়েছেন সৈয়দ হক। সত্য সাহার সুর আর ফেরদৌসী রহমানের কন্ঠে কিশোরী নায়িকা কবরী যখন খড়ের গম্বুজ পিছন থেকে গেয়ে উঠে “নদী বাঁকা জানি, চাঁদ বাঁকা জানি, তাহার চেয়ে আরো বাঁকা তোমার ছলনা” গানটি, অদ্ভুত এক আকর্ষণে আপনিও হাজির হয়ে যাবেন কবরী-বেবি জামানের খুনসুটি আর মান-অভিমানের সেই দৃশ্যের সামনে, নদীর পাড়ে পাড়ে দৌড়বে আপনার মন। পরে মনটা আপনার হুহু করে কেঁদেও উঠবে শেষের দিকে দুইজনের ব্যর্থ মিলনের জ্বালায়। গানটি ছিল দুই ভাইবোন ফেরদৌসী রহমান ও মুস্তাফা জামান আব্বাসীর, সিনেমাতে গাওয়া প্রথম কোন দ্বৈতগান। সৈয়দ শামসুল হকের সিনেমার গান নিয়ে আসলে আলাদাভাবে আলোচনা রাখা উচিত, তাঁর অনবদ্য সৃষ্টিই সেটা দাবী করে। অনেকে হয় তো জানেন না, এক সময়ের মানুষের মুখে মুখে ফেরা আরেক রোমান্টিক গান “যার ছায়া পড়েছে, মনের আয়নাতে, সেকি তুমি নও, ওগো তুমি নও” এটিও কিন্তু এ কবির লেখা। এটি সুভাষ দত্তের আরেক সিনেমা ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ সিনেমার গান। সম্ভবত সুর করেছেন সত্য সাহা। কন্ঠ দিয়েছেন সেই কোকিলকন্ঠী ফেরদৌসীর রহমান। ১৯৬৮ সালে কাজী জহির পরিচালিত রাজ্জাক-কবরী জুটির দারুন জনপ্রিয় ও আলোড়িত চলচ্চিত্র ‘ময়নামতি’তে কবরী যখন সরিষা ক্ষেতে ফুলের মালা হাতে দেহ দুলিয়ে দুলিয়ে বশির আহমেদের সুরে সাবিনা ইয়াসমিনের কন্ঠে গেয়ে চলেন “ফুলের মালা পড়িয়ে দিলে আমায় আপন হাতে” তখন কি কেউ ভাবেন বাংলা সিনেমার অসাধারণ এক রোমান্টিক গান লিখে গেছেন সৈয়দ হক। বলতে গেলে একই সাথে চিত্রনাট্য, সংলাপ, গানের কথা দিয়ে সত্তরের দশকের বাংলা চলচ্চিত্রে নিজের সৃষ্টিশীলতাকে উজাড় করে দিয়েছিলেন হক সাহেব। মূলত চলচ্চিত্রের প্রয়োজনেই তিনি গান লিখেছেন। কিছু গান মানুষের মুখে মুখে ঘুরে ফিরে আসলেও তাঁর লেখা গানের সংখ্যা প্রায় দুইশত’র মত। এসব গান সুর করেছেন সমর দাশ, সত্য সাহা, আলম খান, বশির আহমেদ, সুবল দাশ, আলো হোসেন, কাদের জামেরী, দেবু ভট্টাচার্যের মত নামকরা সুরকারগণ।

wO9ploj.jpg


যুদ্ধের পরপরই ১৯৭২ সালে ‘ওরা এগার জন’র পাশাপাশি রাজ্জাক-শাবানা জুটির আরেক সিনেমা ‘অবুঝ মন’ সারাদেশে অসম্ভব জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি লাভ কওে দেশে। বিখ্যাত পরিচালক কাজী জহিরের রোমান্টিক এ সিনেমার দুর্দান্ত সংলাপ লিখেছেন কিন্তু সৈয়দ হক। মাসুম (রাজ্জাক) তার বন্ধুর (বিজয়) সহযোগিতায় পড়াশোনা করে সদ্য ডাক্তারী পাস করে গ্রামে যাবে মানুষের সেবা করার জন্য। গ্রামের পথে ট্রেনে তার সাথে পরিচয় হয় জমিদারকন্যা ভিন্নধর্মী মাধবীর (শাবানা) সাথে এবং অনতিবিলম্বে প্রেম। মাধবীর পিতা মাসুমের গ্রামের জমিদার। কিন্তু এই প্রেমের বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাদের অসম সামাজিক ও ধর্মীয় পরিচয়। মাধবীর পিতার অনুরোধে মাসুম কাউকে না জানিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। মাধবীর পিতা মাধবীকে বিজয়ের সাথে বিয়ে দেয়। পরে বিজয় নিজের স্ত্রী আর বন্ধুর মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক বিষয়ে জানতে পেরে হৃদয়াহত শোকে দুর্ঘটনায় নিজের দু চোখ হারায় সে। মাসুম নিজের এক চোখ দান করে বন্ধুকে, মাধবী ফিরে যায় বিজয়ের কাছে, বিজয়ের চোখে মাসুমের চোখেই চোখে রেখে মেনে নেয় তাদের বিচ্ছেদের যন্ত্রণা। ব্যর্থ প্রেমিক মাসুম ফিরে যায় আরেক নায়িকা সুজাতার কাছে, যে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল মাসুমের অবুঝ মনে। আমি জানি অনেক পাঠক যারা সে সময়ের পুরনো সিনেমার দর্শক হয়তো উত্তম-সুচিত্রার কথা মনে করছেন। এ সিনেমার একটা গান অনেকেই এখনো গাই, কিন্তু জানে না সেটা যে অবুঝ মন সিনেমার- “শুধু গান গেয়ে পরিচয়, চলার পথে ক্ষণিক দেখা, একি শুধু অভিনয়”। যদিও এ গানটা সৈয়দ হকের না, পাঠকদের জানিয়ে রাখলাম মাত্র। ট্রেন যাত্রাপথে অচেনা নায়ক-নায়িকার মধ্যে মধুর মধুর সব খুনসুটি, টুকরো ঝগড়া দর্শকদের ভাললাগাকে পূরণ করবে অন্যমাত্রায়। যদিও গ্রামে গিয়ে নায়িক-নায়িকার মধ্যে প্রেমের সম্পর্কময় সংলাপগুলো অতিরিক্ত তারল্য মনে হয়েছে আমার। যেটা এখনকার ছেলেপিলেরা এক শব্দে বলে থাকে-হ্যাংলামো। তবে এই সিনেমার সংলাপ নির্মাণে সৈয়দ হক নিজেকে আরো মেলে দিয়েছেন অন্যভাবে-কমেডি দৃশ্য ফুটিয়ে তুলতে তাঁর সংলাপের যেন জুড়ি নেই। রেলস্টেশানে বুড়ি ডিমবিক্রেতা, মাসুমের চেম্বারের কম্পাউন্ডার আর বিজয়ের মামার চরিত্রগুলো দিয়ে পরিমিত কৌতুককর সংলাপে নিজেকে অন্যভাবে চিনিয়েছেন এ ছবিতে। যার হাত দিয়ে কবিতার মত একের পর এক মধুমাখা রোমান্টিক সংলাপ বের হয় তিনি যে পেট খিল করা হাসির রোমান্টিক সংলাপ লিখতেও পারেন- তাঁর অনেকগুলো সিনেমা দেখতে গিয়ে অবুঝ মনে এসে উপলব্ধি হল। যে কোন চলচ্চিত্রবোদ্ধা সেটা এককথায় মেনে নিবেন। আর এখনকার দর্শক যদি সেটা দেখে থাকে তাহলে আশ্চর্যই হবেন এ সময়ের অশ্লীল, অপ্রাসংগিক, সম্পর্কহীন, রুচিহীন ও নিম্নমানের কৌতুক দৃশ্যের বিপরীতে সৈয়দ হক দর্শকপ্রিয় মজার মজার সব হাসির দৃশ্যে অভিনেতাদের মুখে কী ওজনদার সংলাপ তুলে দিয়েছেন। সংলাপ ধরে ধরে আরেকটু বিশদভাবে বর্ণনা করতে পারলে সহজে বোঝানো যেত কেন এত প্রশংসা করছি সৈয়দ সাহেবের।

পুরস্কার সিনেমার পর একই সাথে কাহিনী, সংলাপ, গীতরচনায় নিজেকে পরিপূর্ণভাবে ঢেলে দেয়া আরেক সিনেমা হচ্ছে-‘বড় ভাল লোক ছিল’। এই সিনেমাখানা নিয়ে আলোচনায় থাকবেন তিনি বরাবরই। গ্রাামের সাধারণ মুসলমান ও তাদের উপর সুফী-দরবেশের প্রভাব, সেই সাথে এই প্রভাব নিয়ে মনোজগতের ভেতর-বাহিরের নানা টানাপোড়েন নিয়ে এ সিনেমার কাহিনী বহুমাত্রায় আলোচনার দাবিদার। কারণ সৈয়দ শামসুল হক নিজেই ছিলেন পীর বংশের উত্তরসূরী। নিজের জ্যাঠা পর্যন্ত বংশ পরম্পরায় তাঁদের পিরালী কার্যক্রম ছিল। স¤্রাট আকবরের নানা ধর্ম মিশ্রিত দ্বীনে ইলাহী থেকে সাধারণ মুসলমানদের প্রভাবমুক্ত করতে সেই সময়ে কুড়িগ্রামের অত্র অঞ্চলে দরবেশ শাহ সৈয়দ আলী মাহমুদের আগমন। সেই থেকেই বংশগতভাবে পীর দরবেশের চরিত্রে কেউ না কেউ এ বংশের ঐতিহ্য টেনে নিয়ে গেছেন সৈয়দ হকের এক পূরুষপূর্ব পর্যন্ত। যার প্রভাব কিছুটা রহিত হতে থাকে তাঁর পিতা থেকে, পরবর্তীতে সৈয়দ হকের কাছে এসে যেটি পরিপূর্ণভাবে ধর্মের বাইরে গিয়ে এক মানুষের মধ্যে অন্য মানুষের মানসিক প্রভাব বিস্তার ছাড়া কিছুই থাকে না। নিজ বংশ-কর্মকান্ড-বিশ্বাসে অকপটে নিজেকে অবিশ্বাসী হিসেবে তুলে ধরেছেন আত্মজীবনী গ্রন্থ- ‘প্রণীত জীবন’এ। কিন্তু কয়েক শ বছর ধরে যে সিলসিলার রক্ত তাঁর মধ্যে বহমান সেটা অস্বীকার করেন কিভাবে। যার কারণে বড় ভাল লোক ছিল সিনেমার ঘটনাক্রমে বাবাপীরের আসনে বসতে বাধ্য হওয়া শহুরে শিক্ষিত যুবক সন্তান ইয়াছিনের (নায়ক রাজ্জাক) মধ্যে এই বিশ্বাসের দরুণ টানাপড়েন, তাতে সৃষ্ট হওয়া মানুষের জীবনে পীর দরবেশের অলৌকিক আচরণ ও কারামতির প্রভাব থেকে নিজেকে এড়াতে পারে না কিছুতেই। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কী এক দ্বন্দ্বই না খেলেছেন সৈয়দ হক এ সিনেমার পরতে পরতে- কি কাহিনীতে, কি সংলাপে, কি গানে। “তোরা দেখ দেখরে চাহিয়া, চোখ থাকিতে এমন কানা কেমন করিয়া……রাস্তা দিয়া হাইটা চলে রাস্তা হারাইয়া” গানটা দিয়ে সেই দোলাচলকে আরো গভীরে নিয়ে যান তিনি। সেই সাথে যেন নিজের বিশ্বাস নিয়ে নিজের মধ্যেই এক অন্তর্দহন। ইয়াছিনের মধ্যে স্রষ্টাপ্রেম ও নারীপ্রেমের বিপরীত দেয়াল খাঁড়া করে দিয়ে গল্পকে নিয়ে গেছেন ভিন্ন এক জায়গায়। সেই সাথে শেষের দিকে নারীপ্রেমে মোহিত যুবকপীর ইয়াছিনের ব্যর্থতা ও দেশের মুক্তিযুদ্ধকে সম্পর্কযুক্ত করে এ গল্পের ইতি ঘটলেও এ সিনেমায় সৃষ্ট দ্বন্দ্বগুলো দর্শকের মধ্যে নানা প্রশ্নের উদ্রেক করবে যদি সৈয়দ হকের টোটাল সৃষ্টিশীলতা ও সৃজনশীল কর্মকান্ডকে তাঁর ব্যক্তিচিন্তা দিয়ে বিশ্লেষণ করতে চান। অন্যকোন লেখায় হয়তো চেষ্টা করব বিষয়টা উপস্থাপন করতে। চলচ্চিত্রেই ফেরত আসি। সিনেমার কালজয়ী গান- “হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস”র কথা সিনেমাপ্রিয় দর্শকমাত্রই জানে। এটা না দেখলোও প্রখ্যাত সুরকার আলম খানের সুরে এন্ড্রু কিশোরের কন্ঠে এ গানটি নিয়মিতই শুনেন এখনো অনেকেই। এ ছাড়াও এ সিনেমাতে আরেকটি অসাধারণ ও সেইসাথে জনপ্রিয় গান-“আমি চক্ষু দিয়ে দেখতেছিলাম জগত রঙ্গিলা, মাওলা তোমার নূরানী তির হঠাৎ মারিলা, মাওলা আন্ধা করিলা”র মধ্যে স্রষ্টা আর সৃষ্টির সম্পর্কের মধ্যে প্রেম-ভাব-বিচ্ছেদেও যে কথা জুড়ে দিয়েছেন সেটা প্রমাণ করে নিজের পীরালী সিলসিলাকে ব্যক্তিজীবনে নানা যুক্তিতে অস্বীকার করে আসলেও তিনি অযাচিতভাবেই নিজ বংশরক্ত স্রোতধারা থেকে কখনোই পুরোপুরি আলাদা করতে পারেননি বা পরবর্তীতে পারবেনও না। ১৯৮২ সালে ‘বড় ভালো লোক ছিল’ সিনেমাটি মোট ৫টি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নেয়। সে সময়কার বাংলাদেশের নামকরা সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন। শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ পরিচালক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ পরিচালক পুরস্কার লাভ করেন। পুরস্কার বগলদাবা করেন সৈয়দ হক নিজেও।

w3ZQoNY.jpg


সৃষ্টিশীলতার নানা শাখা শাখায় বিচরণ করছেন সৈয়দ শামসুল হক, সে কথা শুরুতেই বলেছি। এবং চলচ্চিত্র জগতে এত মাত্রায় নিজেকে সাফল্যের সাথে সংযুক্ত করে এই যে তাঁর সব্যসাচী পরিচয় তিনি বংশ পরম্পরায় ধারণ করেন সেটা একটু বলে রাখি। নিজে পিরালী পেশার সাথে যুক্ত না হলেও কি হবে, কিন্তু তাঁর দাদাপীর ও বংশের অন্যান্যদের যে কর্ম সুদক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন তিনি আত্মজীবনীতে -“রিফু, জামা পাজামা সেলাই, রান্নাঘরের কুটির নির্মাণ, ভোজের জন্য রান্না, বালকদের চুল কাটা, সাইকেল মেরামত, নৌকা বাওয়া, ঘর ছাওয়ার কাজ, এমনকি প্রয়োজনে সন্তান ধাত্রীর কাজ আমার বাবা, বড়বাবা, চাচা অবলীলায় সম্পন্ন করতে পারতেন” (প্রণীত জীবন, পৃষ্ঠা-৯২)। নিজ মেধা ও দক্ষতাকে স্বক্ষেত্রে নিজের পূর্বপুরুষের মতোই বৈচিত্র্যপূর্ণে দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি। জীবনের শেষ দিকে ২০১৬ এর ডিসেম্বরেই কথা ছিল আবু সাইয়ীদ পরিচালিত গণঅর্থায়নে নির্মিতব্য চলচ্চিত্র ‘সংযোগ’-এ একজন অধ্যাপকের চরিত্রে তাঁর অভিনয় করার। কিন্তু ডিসেম্বর আসার আগেই সেপ্টেম্বরের ২৭ তারিখ মৃত্যুই টেনে দিল যাবতীয় সমাপ্তির রেখা।

প্রায় ৩০টিরও অধিক সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন সৈয়দ হক। প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন ১০টির মত। মুক্তিযুদ্ধের সাতজন বীরশ্রেষ্ঠকে নিয়ে নির্মাণ করেছেন সাতটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর আরেকটি চলচ্চিত্র ‘ভুলি নাই’ নির্মাণ করেন ১৯৭২ সালে। কখনো শুধু তাঁর কাহিনী থেকে অন্যরা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। যেমন, প্রখ্যাত পরিচালক সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী ইলিয়াস কাঞ্চন-অঞ্জু ঘোষ জুটি নিয়ে বানান ‘আয়না বিবির পালা’। গ্রামের নিতান্তই এক সাধারণ পরিচিত গল্প। কিন্তু সৈয়দ হকের কাহিনীর বদৌলতে আর জাকী সাহেবের নির্মাণে দর্শকপ্রিয়তা ও ব্যবসাসফলতা পায় সিনেমাখান। আর তাঁর উপন্যাস নিষিদ্ধ লোবান অবলম্বণে নাসির উদ্দিন ইউসুফের নির্মিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা ‘গেরিলা’র কথা বিশেষভাবে বলতে হবে না আশা করি। নগরে মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম, সে সময়কার কলুষিত রাজনীতি ও স্বাধীনতাবিরোধীদের মুখোশ উন্মোচন নিয়ে এ সময়কার দেশীয় রাজনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত করে সিনেমাখানাও বেশ আলোচিত ও প্রশংসিত। কখনো তিনি অন্যের কাহিনীতে সংলাপ বসিয়েছেন কিংবা চিত্রনাট্য প্রস্তুত করে দিয়েছেন, কখনো পেশাদার গীতিকারের মত লিখে দিয়েছেন শুধুমাত্র গানের কথা। যেমন, তমিজ উদ্দিন রিজভী পরিচালিত ‘আশীর্বাদ’ সিনেমার ‘চাঁদের সাথে আমি দিব না তুলনা’-এ অসাধারণ রোমান্টিক ও কাব্যিক উপমাপূর্ণ গানটি কিন্তু তাঁরই লেখা। সে সময়ের তরুণদেও ক্রেজ জাফর ইকবাল ও নায়িকা অঞ্জু ঘোষের অভিনয় খুরশীদ আলম ও রুনা লায়লার গাওয়া গানটি এখনো জনপ্রিয়। এ সময়ের তরুণরাও ভালবাসার অনুরণন খুঁজে নেয় গানটি থেকে। সিনেমাখানা দেখতে গিয়ে বারবার অবাক হচ্ছিলাম, নায়ক-নায়িকার হৃদয়ের আকুলতাকে কী নিবিড়ভাবেই তিনি প্রকাশ করেছেন এ গানের কথা মাধ্যমে। কয়েক বছর আগেও যখন শিল্পী পান্থ কানাই নতুনভাবে গানটিকে হাজির করেন দর্শকশ্রোতাদের সামনে, তখনো গানটিতে ‘তুমি যে তোমার তুলনা’ লাইনের এতটুকু রসের কমতি ছিল না পুরো গানটির সুর আর কথার আমেজে সাথে সাথে।

atfrNM3.jpg


ভেবে অবাক হই, এক সময়ে সিনেমা বানানোর নেশায় বোম্বে পালিয়ে যাওয়া পীর বংশের সৃষ্টিশীল তরুণ পরে সেখান থেকে ভাগ্যহারা হয়ে ফিরে এসে যে এক সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ঢুকে পড়বেন কে জানতো। একটুও বাড়িয়ে বলছি না, যারা সে সময়ে তাঁর মেধা ও কর্মে সৃজিত চলচ্চিত্রগুলো হলে গিয়ে উপভোগ করেছেন কিংবা আমার মতো অনেকেই টেলিভিশন আর ইউটিউবে দেখে প্রীত হয়েছেন, বলতে বাধ্য হবেন যে, সৈয়দ শামসুল হক ছাড়া বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণ নয় ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি সে সময়ের জনপ্রিয় পত্রিকা সাপ্তাহিক চিত্রালীতে চলচ্চিত্র সাংবাদিকতায় সহ সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছিলেন। এরপরে ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রাম থেকে চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতি বিষয়ক মাসিক পত্রিকা ‘অন্তরঙ্গ’ সম্পাদনা করতেন সুচরিত চৌধুরীসহ মিলে। সাহিত্যজগতের অন্য কেউ এভাবে চলচ্চিত্রের সাথে ঔতপ্রোতভাবে যুক্ত হতে পারেননি, যেভাবে পেরেছেন সৈয়দ শামসুল হক। এত কথার পর এক কথায় বলতে গেলে আসলেই – তিনি যে তাঁহার তুলনা।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top