লিফট থেকে বেরিয়েই হালকা ঠান্ডা বাতাস টের পেল ইকবাল। বিল্ডিং থেকে বের হতেই বুঝতে পারল, আবহাওয়া শীতল। একটু ভেজা ভেজা পরিবেশ। এমন দিনে একটু ভাজাপোড়া খেলে মন্দ হয় না। এমনটা ভাবতে ভাবতেই ইকবাল পা চালাল মোড়ের দোকানের দিকে। সেখানে ভালো পুরি, সমুচা পাওয়া যায়। আজ খেতেই হবে।
দুটো পুরি, তিনটে সমুচা নিয়ে চায়ের দোকানের দিকে চোখ মেলল ইকবাল। পুরি চায়ে ডুবিয়ে খাবে কি না, তা নিয়ে একটু দোটানায় আছে সে। চায়ে ডোবানো যায়, কিন্তু তখন আবার একটু মিষ্টি মিষ্টি লাগবে। তাহলে পুরি কি আগে খাওয়া ঠিক হবে? নিজের কাছে উত্তর পেল ইকবাল। সে জানতে পারল, সমুচায় পেঁয়াজ আছে। সেদ্ধ ও আধা ভাজা সেই ঝাঁজে জিব ডোবাতে চাইলে, সমুচার রোল নম্বর এগিয়ে আনতেই হবে। আর দ্বিমত করল না ইকবাল। চায়ের দোকানে যাবে, ঠিক এমন সময় শুনতে পেল, ‘ভাই, কেমন আছেন?’
সমুচায় কামড় বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর, কামড়ের আগপর্যন্ত ঠিক সুস্থির থাকতে পারে না ইকবাল। ওই অস্থির সময়টায় কারও সঙ্গে কথা বলতেও ভালো লাগে না তার। তাই আপাত অযাচিত কুশল জিজ্ঞাসায় বেশ বিরক্ত লাগে ইকবালের। তবে তা ঘাড় ঘোরাতে মানা করেনি।
ক্লিষ্ট সেই চেহারা দেখে প্রথমেই ইকবালের মনে হলো, কোথায় যেন দেখেছে। কিন্তু ঠিকানা মনে করতে পারল না। চেহারাটা ঠিক দুই দিনের পুরোনো, জলের ছিটে না পাওয়া গাঁদা ফুলের মতো, চুপসে গেছে।
ক্ষণিকের আগন্তুক তা বুঝতে পারল। হয়তো পরিচিত অনেকের কাছে অচেনা হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা সে বোঝে, চেনে। তাই হাসি দিয়ে মনে করিয়ে দিল, ‘আরে, পান্থপথের অফিসে, আপনারে প্রতিদিন কলম আইনা দিতাম...’
এবার চিনতে পারে ইকবাল। ভুলে যাওয়া কিছু মনে পড়ায় একটু স্বস্তিও পায় সে।এমনিতেই প্রেমিকার অনেক কিছু সে ভুলে যায়, কটু কথাও শুনতে হয়। একটু সংকেতেই যে সে রশিদকে চিনতে পেরেছে, তাতে আত্মবিশ্বাস খানিকটা বেড়েছে। এ-ও ঠিক করে ফেলল, ফারহানাকে এ ব্যাপারে রাজি করানোর চেষ্টা করতে হবে। ঝড়ের আগে পালানোর সুযোগ যেন দেয়।
ইকবাল কথা বলে এবার, ঠিক পরিচিত চিনতে পারার ভঙ্গি নিয়ে শুরু করে সে।
এবার চিনতে পারে ইকবাল। ভুলে যাওয়া কিছু মনে পড়ায় একটু স্বস্তিও পায় সে। এমনিতেই প্রেমিকার অনেক কিছু সে ভুলে যায়, কটু কথাও শুনতে হয়। একটু সংকেতেই যে সে রশিদকে চিনতে পেরেছে, তাতে আত্মবিশ্বাস খানিকটা বেড়েছে। এ-ও ঠিক করে ফেলল, ফারহানাকে এ ব্যাপারে রাজি করানোর চেষ্টা করতে হবে। ঝড়ের আগে পালানোর সুযোগ যেন দেয়।
: কী অবস্থা আপনার? অনেক দিন পর দেখলাম আপনাকে...
: হ, বস। আপনি সে যে অন্য অফিস গেলেন, আর তো বেড়াইতেও পুরান অফিস আসলেন না।
: যাওয়ার সময় কি আর থাকে? তা, আছেন কেমন?
: আমি তো বস, ওই অফিসে নাই। ছয় মাস আগে ছাড়ছি।
: ও, এখন কই?
: এখন তো নাই, বেকার...
শুনেই চট করে রশিদের পায়ের দিকে তাকায় ইকবাল। পিয়ন ক্যাটাগরির হলেও বেশ ফিটফাট থাকত রশিদ। তবে এখন পায়ে সেই কম দামি কিন্তু চকচকে শু জুতা নেই। আরও কম দামের দুই ফিতার স্যান্ডেল এখন পা বাঁচানোর দায়িত্ব নিয়েছে। ফরমাল প্যান্টের জায়গা নিয়েছে রংচটা জিনস। পুরোনো হয়েই রংটা চটে গেছে, ফ্যাশন নয়। শার্ট সাদা নয়, ইস্তিরিও নেই, স্রেফ শুকিয়েই গায়ে গলানো কোঁকড়ানো কাপড়।
এতটুকু দেখেই অজান্তে নিজের মানিব্যাগের কথা মনে পড়ল ইকবালের। ওই হয়। টাকা জমলেই, হারানোর ভয় চেপে ধরে।
তবে আর সময় নষ্ট করল না ইকবাল। সমুচা বের করে কামড় দিল। ঠোঙার দিকে একবার তাকিয়েই, চোখ ঘুরিয়ে নিল রশিদ। সেই সংকেত বুঝে অথবা না বুঝে ঠোঙা এগিয়ে দিল ইকবাল। দু-তিনবার ‘না-না’ শুনিয়ে তাতে হাত ঢুকাল রশিদ। তুলে নিল একটা পুরি। একটু স্বস্তি পেল ইকবাল। সমুচা তার পছন্দের।
কথা চলতে থাকল।
: বস, একটা চাকরি-বাকরি দেখেন না আমার লাইগ্যা। আর তো চলে না...ছয় মাস হইয়া গেল...
: হুম।
: কাজ কী পারি, তা তো জানেনই, একটু দেহেন।
: কোথাও সিভি দিছেন? ট্রাই করতে থাকেন।
: অহন আমার তো আপনাগোর মতো বড় বড় সার্টিফিকেট নাই। দেই কাগজপত্র। তিন-চারটা অফিসে দিছি। কিন্তু ডাকে না।
: হুম
: দেহেন একটু...
: হ্যাঁ, দেখি...আরেকটা নেন।
: আরে না বস। আমি খাইছি একটু আগেই।
: নেন নেন...
এবার একটা সমুচা তুলে নিল রশিদ। খুব আশাহত হলো ইকবাল। রাগও হলো কিছুটা। রাগ ও বিরক্তির যুগপৎ ক্রিয়ায় কথা শেষ করতে চাইল সে। বলল, চায়ের দোকানে যাবে। ভদ্রতা দেখিয়ে চা খাওয়ানোর প্রস্তাবও দিল। তবে সেই প্রস্তাবে আরও বিগলিত হলো রশিদ। জানাল, চা একটু আগেই খেয়েছে। তবে সঙ্গ দিতে তার আপত্তি নেই। বলল, ‘আপনি চা খান বস। আমি লগে দাঁড়াই।’
যদিও এই সমাধান ইকবালের কাঙ্ক্ষিত নয়, তবু সে মানা করল না। চূড়ান্ত অভদ্রতা সে করতে পারছে না। এ জন্য নিজের ওপর সে বিরক্ত হচ্ছে। কিন্তু না পারলে আর কী করার আছে? অগত্যা রাস্তা পার হয়ে দুজনে মিলে চায়ের দোকানেই গেল।
চায়ের অর্ডার দিয়ে একটি পুরি নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল ইকবাল। তার মন এখন চা আর পুরির মিলনের অপেক্ষায় আছে। রশিদ চুপ নেই। কোথায় কোথায় সিভি দিয়েছে, কেন কেউ ডাকছে না এবং কেন তাকে এভাবে খুঁজতে হচ্ছে চাকরি—তার বিস্তারিত বয়ান সে দিয়ে যাচ্ছিল। যদিও ‘হুম’ ছাড়া আর কোনো শব্দ উচ্চারণে আগ্রহী নয় ইকবাল।
এভাবেই একসময় চা-পুরির স্বল্পস্থায়ী প্রেম শেষ হলো। আসলে ইকবাল শেষ করে দিল। এক–চতুর্থাংশ পুরিকে অতি ভাজা বলে বিবেচনা করল সে। যদিও তা শোনার পর তীব্র প্রতিবাদ করেছিল রশিদ। মনে হচ্ছিল, পুরিটা সেই ভেজেছিল!
ইকবাল বিল মেটানো শুরু করল। হাসিমুখে ইয়ার বন্ধু নয় জেনেও রশিদ বলল, ‘বস, সিগারেট খাইবেন না?’
এই প্রথমবার কোনো অস্বস্তি ছাড়াই সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে বলে জানাল ইকবাল। মনের কোনো ঘুপচি থেকে এবার আর প্রতিবাদ এল না। কারণ, সিগারেট ছাড়ার পূর্বাপর ব্যাখ্যা করতে যায়নি সে।
রশিদকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়েই দিল ইকবাল। বাসার খোঁজ দিল না। হাত মিলিয়ে চাকরির চেষ্টা চালানোর আশ্বাসও দিল। ব্যস্ততার অজুহাত এবার কাজে লাগাল। তবে রশিদের ফোন নম্বরটা নিতেই হলো।
চলে আসার পথে শুনতে পেল, ‘বস, একটু দেইখেন...’
ঘাড় নাড়লেও, ঘোরাল না ইকবাল।
ঘোরালে দেখতে পেত, কী অনিমিষ নয়নে তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে ছিল রশিদ। ঠিক যেমনটা প্রেম ভেঙে যাওয়ার পর প্রিয়জনের যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে থাকে মানুষ।
ইকবাল অবশ্য তখন অতৃপ্তিতে ভুগতে ভুগতে হাঁটছিল জোরে। আজ যে তাকে একটা সমুচা কম খেতে হলো!