পৃথিবীতে মহামারীর ইতিহাস নতুন নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে মহামারীর তান্ডব কতটা ভয়াবহ ছিল তা ইতিহাস ঘাটলে সহজেই জানা যায়। মহামারীর ইতিহাসে আলোচিত একটি মহামারী ছিল ব্ল্যাক ডেথ (Black Death) । এ রোগের সবচেয়ে পরিচিত নাম হলো প্লেগ রোগ।
ব্ল্যাক ডেথ কি?
ব্ল্যাক ডেথ প্লেগ একটি জীবনঘাতী রোগ। Yersinia pestis নামক ব্যাকটেরিয়া এই রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী। ফ্রান্স-সুইস ব্যাকটেরিওলজিস্ট আলেকজেন্ডার ইরসিন এই ব্যাক্টেরিয়া সম্পর্কে সর্বপ্রথম ধারনা দেন। উইকিপিডিয়া সূত্র অনুসারে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক এটি বিশ্বের ভয়ংকর প্রাণঘাতী তিনটি রোগের একটি হিসেবে চিহ্নিত ছিলো। প্লেগ অতি প্রাচীনকালীন এক ব্যাধি, প্রায় ৩০০০ বছর পূর্বে এর অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। ইতিহাস সূত্রে জানা যায় মধ্য যুগে বহু রাজ্য এ রোগ দ্বারা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
শিল্পীর তুলিতে ব্ল্যাক ডেথ এর ভয়াবহ রূপ
প্লেগ রোগীর শরীরে প্রথমে কালো ফোস্কা বা টিউমারের মতো হতো। এরপর এগুলো বড় হয়ে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়তো। অসহনীয় যন্ত্রণায় ভুগতে ভুগতে মাত্র তিন থেকে সাত দিনের মাথায় রোগী মারা যেত। ১৩৩০ থেকে ১৩৫০ সালের মধ্যকার সময়ে প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীর প্রায় ২০ কোটি মানুষ মারা যায়। ১৩৪০ এর শুরুর দিকে ব্ল্যাক ডেথ রোগটি চীন, ভারত, সিরিয়া ও মিশরে ছড়িয়ে পড়ে। ১৩৪৮ সালের দিকে ইউরোপে ভয়াবহ আকার ধারণ করে ব্ল্যাক ডেথ। ধারণা করা হয়, ‘ব্ল্যাক র্যাট’ নামে এক প্রজাতির ইঁদুরের মাধ্যমে প্লেগ রোগের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া ইউরোপে এসেছিল। সে সময় বাণিজ্যিক জাহাজগুলোতে এ ইঁদুরের প্রচণ্ড উপদ্রব ছিল। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ইউরোপের কয়েক কোটি মানুষ প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ইউরোপের তৎকালীন জনসংখ্যার ৩০ থেকে ৬০ শতাংশই সে সময় প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ইউরোপের জনসংখ্যা স্বাভাবিক হতে সময় লাগে প্রায় ১৫০ বছর। এসময় মোট ২০০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ব্ল্যাক ডেথে হয়েছিলো বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন।
কিভাবে ছড়ায় ব্ল্যাক ডেথ
প্রথমদিকে একজনের থেকে অন্যজনের শরীরে রোগটির কীভাবে সংক্রমণ হয়েছিল তা কেউ জানত না। কীভাবে এই রোগ প্রতিরোধ করা যায় বা চিকিৎসা করা যায় তাও কেউ জানত না। প্রচলিত ছিল অনেক গুজব। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় তখনকার একজন ডাক্তারের মতে, ‘যখন রোগীর মৃত্যুর সময় আত্মা চোখ দিয়ে বের হয়ে যায় তখন তা কাছে দাঁড়িয়ে থাকা সুস্থ মানুষকে আঘাত করে অসুস্থ করে তোলে।’ তবে ধারণা করা হয়, ইঁদুর থেকে ব্যাকটেরিয়াটির সংক্রমণ ঘটেছিলো। অনেকে আবার এর জন্য মাছিকেও দায়ি করে থাকে।
কুসংস্কারযুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি
মহামারী থেকে রক্ষার জন্য ডাক্তারদের নিরাপত্তা পোষাক
কালো টুপিওয়ালা এবং লম্বা মুখোশওয়ালা ছবি দেখে হয়ত ভাবছেন এগুলো কি? মজার তথ্য হচ্ছে সে সময়ের ডাক্তাররা সংক্রামক এড়ানোর জন্য ঐ ধরনের পোষাক পরতেন। সে সময়ে অনেক বিতর্কিত চিকিৎসা পদ্ধতির চালু হয়েছিল। এর মধ্যে একটি ছিল সুগন্ধী চিকিৎসা , এসময় সুগন্ধী ব্যাবহার করার পরামর্শ দেয়া হতো।
ইউরোপের খ্রিষ্টান কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম সমাজে বেশ বড় ধরণের একটি ধারণা ছিল ব্ল্যাক ডেথ তাদের উপর খোদার কোনো গজব কিংবা সৃষ্টিকর্তা তাদের পরীক্ষা করছেন। সেসময় ক্যাথলিকরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজের গায়ে নিজে চাবুক মেরে সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করার কথাও শোনা গেছে।
চুনি-পান্না অথবা মূল্যবান রত্নের গুড়ো অনেকে ঔষধ হিসেবে সেবন করত, কেউ কেউ মনে করত নর্দমার পরিবেশ এ রোগের জন্য উপকারী। সে সময় বাজারে ছড়িয়ে পড়া ভেজাল বেশকিছু ঔষধও ছিল মৃত্যুর কারন, আর্সেনিক , পারদ প্রভৃতি পদার্থের ঔষধেরও নজির রয়েছে । শোনা যায় ভয়াবহতা এতটাই মারাত্বক ছিল যে মানুষ মল মূত্র পর্যন্ত গায়ে মাখত সুস্থ হওয়ার জন্য। এসময় ইহুদীদের দায়ী করে অনেক ইহুদী হত্যা করা হয়।
পুরো পৃথিবীর ইতিহাস, সাহিত্য সংস্কৃতি, গবেষনা , বিজ্ঞানে প্লেগ বিশাল ছাপ ফেলে যায়। প্লেগে মধ্যযুগে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ইউরোপের পুরনো সমাজ কাঠামো ভেঙ্গে নতুন রুপ দিয়েছিলো। শিক্ষায় বিজ্ঞান চর্চার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। ক্যাথলিক চার্চ অনেকটাই তার প্রভাব হারায় এবং প্রটেস্ট্যান্টনিজম শুরু হয়। প্লেগ বা ব্ল্যাক ডেথ এর সময়কার অবস্থানিয়ে বিখ্যাত ঔপন্যাসিক আলবেয়ার কামু’র দা প্লেগ নামের বইটি পড়ে ফেলতে পারেন চট করে। গল্পের ছলে জানতে পারবেন সে সময়ের সামাজিক চিত্রগুলো ।