সালাম সাহেব রাতের খাবার শেষ করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছিলেন। এ সময় হঠাৎ শুনতে পেলেন তার একমাত্র বেকার পুত্র নিজ রুমে বেসুরো গলায় চিৎকার করে গান করছে।
‘শিশুকাল ছিল ভালো
যৌবন কেন আসিল
বাগিচায় ফুল ফুটিল
কোকিল কেন ডাকিল।
শিশুকাল ছিল ভালো
যৌবন কেন আসিল
বাগিচায় ফুল ফুটিল
কোকিল কেন ডাকিল।
কুউউ, কুউউ, কুউউ, কুউউ...’
এমনিতেই রাতের বেলায় চিৎকার করে গান গাইছে দেখে সালাম সাহেবের মেজাজ গরম হচ্ছে, তার ওপর গানের অশ্লীল কথাগুলো শুনে তার মেজাজ আরও বেশি খারাপ হয়ে গেল। তিনি ভ্রু কুঁচকে পাশে বসা স্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন,
শিউলি বেগম, আপনি কি বলতে পারেন, আপনার ছেলের সমস্যা কী?
কই, তার তো কোনো সমস্যা নাই। এ প্রশ্ন করলে কেন?
শিউলি বেগম আমতা আমতা করে উত্তর দিলেন। তিনি বুঝতে পারছেন, তার স্বামী রেগে গেছেন। সালাম সাহেব সাধারণত রেগে গেলে ‘আপনি’ করে বলেন।
আমি বুঝি না, আপনার বলদ ছেলের মনে এত আনন্দ আসে কোথা থেকে?
খবরদার তুমি ওকে বলদ বলবে না! ওর একটা সুন্দর নাম আছে। আমি শাহরুখ খানের সিনেমা দেখে ওর নাম রেখেছি রাহুল।
আপনার কথা শুনে ওই নাম রেখে আমি ভুল করেছি। আমি ঠিক করেছি, এফিডেভিট করে ওর নাম পরিবর্তন করব। আমি নামও ঠিক করে ফেলেছি। তবে আপনি ওর মা হিসেবে আপনার মতামতের একটা গুরুত্ব অবশ্যই আছে। আপনাকে দুটো অপশন দিচ্ছি, এর মধ্যে একটি বেছে নিন। বলেন কোন নাম রাখবেন—বলদ, নাকি দামড়া।
আমি বুঝি না, তুমি আমার ছেলেটারে কেন সহ্য করতে পার না?
এর উত্তর আপনাকে আমি পরে দেব। তার আগে আপনি আমাকে বলেন আপনার ছেলে কেন গান গাইছে? সে কি শিল্পী?
কেন, শিল্পী না হলে গান গাওয়া যাবে না?
অবশ্যই যাবে। কিন্তু সে তো গান গাইছে না। সে চিৎকার করছে। আর আপনি খেয়াল করে দেখেন, কী অশ্লীল তার গানের কথা।
এটা অশ্লীল হবে কেন? এটা তো বাংলা সিনেমার একটি জনপ্রিয় গান।
তা বাংলা সিনেমায় আর ভালো কোনো গান নাই? তাকে এ গানটাই গাইতে হবে! আসল কথা কি জানেন, আপনার ছেলে বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গেছে। তাই সে এমন অশ্লীল গান গাইছে। আর আপনি খেয়াল করে দেখেন, গানের সাথে সাথে সে কোকিলের মতো কুউ কুউ করে আওয়াজও করছে। অথচ এ গানের মধ্যে কিন্তু কুউ কুউ ছিল না।
আপনি আপনার ছেলেকে বলে দিয়েন সে কু কু, মু মু যা–ই করুক না কেন, আমি তাকে বিবাহ করাব না।
কেন করাবে না। ওর বন্ধুবান্ধব সবাই বিয়ে করে ফেলেছে। শুধু তা–ই নয়, ওদের বাচ্চারা এখন স্কুলেও যায়।
ওর বন্ধুর বাচ্চারা স্কুলে যাক, কলেজে যাক, কিংবা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যাক, তাতে আমার কিছুই যায়–আসে না। আমি ওই দামড়াকে বেকার অবস্থায় বিয়ে করাব না। আপনি এখন যান আপনার পুত্রকে বলেন কু কু থামাইতে, না হইলে আমি তারে...।
আজব মানুষ, সারাক্ষণ আমার পোলাটার পেছনে লেগে থাকে। এ কেমন বাপ! এটা তো বাপ না, এজিদ।
বলেই শিউলি বেগম ছেলের রুমের দিকে চলে গেলেন।
রাহুলের মন খুবই খারাপ। গতকাল তার সর্বশেষ বন্ধুটিও বিয়ে করে ফেলেছে। এমনকি মহল্লার অনেক জুনিয়র ছেলেরও বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু ওর বাবা কিছুতেই ওর বিয়ে দিতে রাজি হচ্ছেন না। অথচ এদিকে রাহুলের প্রেমিকা নিতু কিছুতেই আর তার বিয়ে ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না। কারণ, গত সপ্তাহে নিতুর কাজিন আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে এসেছে বিয়ে করার জন্য। সে নিতুকে বিয়ে করে আমেরিকায় নিয়ে যেতে চায়। রাহুল বুঝতে পেরেছে, বাবাকে চাপে ফেলতে না পারলে তার বিয়ে আর এ জন্মেও হবে না। তাই সে এখন ঠিক করেছে প্রতিদিন নিত্যনতুন পদ্ধতিতে বিয়ের জন্য বাবার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলবে। আর তার এ আন্দোলনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে, দুই দিন ধরে সে বাসায় উদ্ভট গান গাওয়া শুরু করেছে।
রাহুলের সঙ্গে নিতুর সম্পর্ক প্রায় তিন বছরের। নিতু খুব ছোটবেলায় একে একে মা–বাবাকে হারিয়েছে। এরপর থেকে সে তার মামার পরিবারে আশ্রিত। নিতুর মামা প্রচণ্ড রাগী মানুষ। তিনি নিতুকে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আগামী সাত দিনের মধ্যে যদি রাহুল নিতুকে বিয়ে করতে রাজি না হয়, তাহলে নিতুকে তার কাজিনের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হবে। আর দুই দিন পরই সেই সময়সীমা শেষ হবে। রাহুল অবশ্য নিতুকে বলেছিল, ওর জন্য অপেক্ষা না করে কাজিনকে বিয়ে করে ফেলতে। কিন্তু নিতু রাহুলকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে রাজি নয়।
পরদিন বিকেলে সালাম সাহেব অফিস শেষে বাসায় ফিরেই স্ত্রীকে বললেন,
একটু লেবু চা বানাও তো, গলাটা কেমন জানি ব্যথা করছে।
আমার মাথাব্যথা করছে। আমি পারব না।
ঠিক আছে, তুমি না পারলে ময়নাকে বলো চা বানাতে।
ময়নাও চা বানাতে পারবে না। ওর সমস্যা আছে। সে আজ সারা দিন কোনো কাজই করেনি। সকাল থেকেই বিছানায় শুয়ে আছে।
কেন?
তোমার ছেলের জন্য। তোমার ছেলে ওর সাথে এমন এক কাণ্ড করেছে যে সে আজ সারা দিন বিছানা থেকেও ওঠেনি।
বলো কী! শেষ পর্যন্ত হারামজাদা এমন একটা কাজ করতে পারল। আমার মানসম্মান...আমি আজ ওরে খুন করে ফেলব।
বলেই সালাম সাহেব রাহুলের রুমে উদ্দেশে রওনা দিলেন।
আরে কোথায় যাও? আগে পুরো ঘটনা তো শুনবে।
পেছন থেকে শিউলি বেগম ডাকলেন। কিন্তু সালাম সাহেব তা উপেক্ষা করেই ছেলের রুমে চলে গেলেন। রুমের সামনে যেতেই শুনলেন ছেলে উচ্চ স্বরে গান গাইছে,
‘আর কত রাত একা থাকব
আর কত রাত একা থাকব
চোখ মেলে দেখব না তোমাকে
স্বপ্নে শুধু ছবি আঁকব।
আর কত রাত একা থাকব
আর কত রাত একা থাকব।
কুউ, কুউ, কুউ......।’
সালাম সাহেব মনে মনে বললেন, এই গানেও তো কোকিলের কোনো ডাক ছিল না, তারপরও হারামজাদা ঠিকই এই গানের সাথে কুউ কুউ লাগিয়ে দিয়েছে। তিনি দরজায় টোকা দিয়ে ছেলের রুমে ঢুকে পড়লেন। দেখলেন ছেলে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে কুউ কুউ করছে। রুমে ঢুকেই সালাম সাহেব সুর করে বললেন,
আব্বাজান, আপনি কি ঠিক করেছেন দুনিয়ার সব গানের সাথেই আপনি কুউ কুউ লাগাবেন?
রাহুল কোনো কথা না বলে শোয়া থেকে বিছানায় উঠে বসল।
আপনার মা বলল আপনি নাকি ময়নার সাথে কী একটা ঘটনা ঘটিয়েছেন? আমি কি জানতে পারি, আপনি কী অঘটন ঘটিয়েছেন?
তেমন কিছু না। আমি শুধু ময়নাকে আমার খাটটি দিয়ে দিয়েছি। আর ওর চৌকিটা আমার রুমে নিয়ে এসেছি।
সালাম সাহেব এতক্ষণে খেয়াল করলেন, তার ছেলে আসলেই চৌকিতে বসে আছে। সালাম সাহেব মনে মনে লজ্জিত হলেন। কারণ, তিনি ভেবেছিলেন তার ছেলে হয়তো কাজের মেয়ের সঙ্গে খারাপ কিছু করেছে। তিনি অবাক হয়ে রাহুলকে প্রশ্ন করলেন,
আমি কি জানতে পারি, আপনার এই অদ্ভুত আচরণের কারণ কী?
বাবা, আমি একা মানুষ, এত বড় খাট দিয়ে আমি কী করব? এত বড় খাটে একা শুইলে নিজেরে এতিম এতিম মনে হয়।
সালাম সাহেব ছেলের উত্তর শুনে অবাক হলেন। তিনি মনে মনে বললেন, হারামজাদা কয় কী! মানুষ বাপ-মা না থাকলে নিজেকে এতিম মনে করে। আর এই হারামজাদা বউ নেই বলে নিজেকে এতিম মনে করছে।
শোনেন, আপনি এসব ধান্দা ছাড়েন। আপনি তাড়াতাড়ি ময়নার চৌকি ময়নাকে দিয়ে আপনার খাটটি নিয়ে আসেন।
না বাবা, সেটা সম্ভব না। আমি স্বত্ব ত্যাগ করে দিয়ে দিয়েছি।
হারামজাদা, তুই চৌকিতেই ঘুমা। আর যদি তারপরও তোর নিজেরে এতিম এতিম মনে হয় তো তুই ফ্লোরে ঘুমা। তবু আমি তোরে বিবাহ করাব না।
সালাম সাহেব রাগ করে নিজের রুমের উদ্দেশে রওনা হলেন।
ময়নার আজ আনন্দের সীমা নেই। সে এত বড় আরামদায়ক বিছানায় জীবনেও ঘুমায়নি। তাই সে এত বড় খাট পেয়ে আজ দিনের বেশির ভাগ সময় ঘুমিয়ে বা শুয়ে কাটিয়েছে। সে ঠিক করেছে, আগামী তিন দিন কোনো কাজ করবে না। এ তিন দিন তার ছুটি। এ তিন দিন তার আনন্দ দিবস।
পরদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরতে সালাম সাহেবের অনেক রাত হয়ে গেল। কারণ, সন্ধ্যা থেকে একটানা বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তায় যানবাহনে প্রচণ্ড ভিড়। তিনি যখন বাসায় ঢুকলেন, তখন রাত ১০টা। ঘরে ঢুকেই শুনলেন রাহুল এখনো বাসায় ফেরেনি। সালাম সাহেব সন্ধ্যার পর বাসার বাইরে থাকা একদমই পছন্দ করেন না। রাহুল সাধারণত রাত নয়টার মধ্যেই বাসায় ফেরে।
সালাম সাহেব রাতের খাবার শেষ করে টিভি দেখতে বসলেন। এরপর পাশে বসা স্ত্রীকে বললেন,
আপনি কি আপনার নবাবজাদাকে ফোন দিয়েছিলেন?
দিয়েছিলাম। কিন্তু ও ফোন ধরছে না।
শিউলি বেগম, আপনার ছেলে কখন বের হয়েছে?
সকাল ১০টার দিকে।
কোথায় গেছে? কখন ফিরবে কিছু বলে যায়নি?
না, কিছু বলে যায়নি।
শিউলি বেগম এ সংসারে আপনার কাজটি কী? রান্নাবান্না সব তো ময়নাই করে। একটিমাত্র সন্তান, তাকেও দেখে রাখতে পারেন না। আপনি সারা দিন করেন কী? সারা দিন তো আছেন আপনার ওই টিভি সিরিয়াল নিয়ে।
ঠিক সে মুহূর্তে কল বেলটি বেজে উঠল। সালাম সাহেব পাশে বসা স্ত্রীকে বললেন,
যাও নবাব সাহেব এসেছেন, দরজা খুলে দাও।
স্ত্রী সোফা থেকে উঠতে যাবেন, সে সময় সালাম সাহেব বলে উঠলেন,
থাক, তোমার যেতে হবে না। জাহাঁপনাকে দরজা আমিই খুলে দিচ্ছি।
বলেই সালাম সাহেব দরজা খুলতে গেলেন। দরজা খুলেই দেখলেন পরির মতো একটি মেয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির পুরো শরীর বৃষ্টির পানিতে ভেজা।
ঠান্ডায় একটু একটু করে কাঁপছে। দরজা খুলতেই মেয়েটি সালাম সাহেবের পা ধরে কদমবুসি করল। মেয়েটির শরীর থেকে ঝরে পড়া কয়েক ফোঁটা পানি সালাম সাহেবের পায়ে পড়ল। সালাম সাহেব ভ্রু কুঁচকে মেয়েটিকে প্রশ্ন করলেন,
কে তুমি মা? এত রাতে, এমন আবহাওয়ার মধ্যে কোথা থেকে এলে?
মেয়েটি সরাসরি সালাম সাহেবের চোখের দিকে তাকাল। তারপর মিষ্টি করে বলল,
আপনি কেমন আছেন?
আমি ভালো আছি। কিন্তু তুমি কে? তোমাকে তো চিনলাম না।
আমার নাম নিতু। আজ বিকেলে রাহুল আমাকে বিয়ে করেছে। ও আমার সাথেই ছিল। আমাকে বলল, কল বেল বাজাতে। আমি কল বেল বাজাতেই আমাকে একা রেখে দৌড় দিয়ে পালিয়ে গেল।
সালাম সাহেব বিস্ফোরিত চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। অনেক কষ্টে নিজের রাগকে সংযত করলেন। শান্ত স্বরে বললেন,
মা, তুমি ভুল ঠিকানায় এসেছ। এখানে রাহুল নামের কেউ থাকে না। আমরা আসলে নিঃসন্তান। যে ছেলেটি তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে, সম্ভবত সে তোমাকে ধোঁকা দিয়েছে অথবা তোমার সাথে ফান করেছে।
না, সে ধোঁকাবাজ নয়, আর সে আমার সাথে ফানও করেনি।
শোনো, আমি তোমার সাথে তর্ক করতে চাচ্ছি না। আমি যা বলার বলে দিয়েছি। তুমি এখন যেতে পারো।
এ কথা বলেই তিনি মেয়েটির মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলেন। নিতু বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল। সে বুঝতে পারছে না, সে এখন কী করবে? কোথায় যাবে? তার স্বামী তো ফেরারি। বৃষ্টির ঠান্ডা পানি নিতুর মাথার চুল থেকে কপাল, কপাল থেকে গাল বেয়ে এখনো ঝরছে। নিতু হঠাৎ খেয়াল করল, গাল বেয়ে একটা গরম পানির ধারাও নামছে। নিতু হাতের পিঠ দিয়ে ওর বাঁ চোখ থেকে নামা গরম পানির ধারাটি মুছে ফেলল। নিতু চায় না ওর চোখের জল তার স্বামীর ঘরের দুয়ারে পড়ে অমঙ্গল ডেকে আনুক। কারণ, এটা তো ওর নিজেরও ঘর। ওর অনেক স্বপ্নের ঘর। (চলবে)
* লেখক: ইমদাদ বাবু, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র