‘মোল্লা বাড়ীর বউ‘ ছবিটি নিয়ে বিভিন্ন মুভি গ্রুপে ছবিটি বিশ্লেষণের কিছু ধরাবাঁধা সমস্যা দেখেছি। সেসব সমস্যা মাথায় রেখেই ছবিটির বিশ্লেষণে সমাধানমূলক লেখা তৈরি করেছি দর্শকদের জন্য।
‘মোল্লাবাড়ীর বউ’ ২০০৫ সালে নির্মিত একটি সোশ্যাল ফ্যামিলি ড্রামা। পরিচালক সালাহউদ্দিন লাভলু। অভিনয়শিল্পীরা হচ্ছে এটিএম শামনুজ্জামান, মৌসুমী, শাবনূর, রিয়াজ, প্রাণ রায়, চিত্রলেখা গুহ, খায়রুল আলম সবুজ প্রমুখ। উল্লেখযোগ্য গান – ১. বান্ধিলাম পিরিতের ঘর ২. অন্তর দিলাম বিছাইয়া ৩. বনের কোকিল।
ছবিটি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কিছু টিপিক্যাল সমস্যা দেখেছি। সমস্যাটা মূলত ফ্যানবেজ থেকে আসা। যেমন –
* শাবনূরই মোল্লাবাড়ীর বউ
* শাবনূরই প্রধান চরিত্র
* শাবনূরকে ঘিরেই ঘটে সব ঘটনা
* শাবনূরকে কেন্দ্র করেই পরিচালক লাভলু ছবিটি নির্মাণ করেছেন
* শাবনূরই ছবির ফিনিশিং আনে
* মৌসুমীই ছবির প্রধান চরিত্র
* মৌসুমীকে ঘিরেই সব ঘটনা ঘটে
* মৌসুমীই ছবির ফিনিশিং টানে
এর পাশাপাশি আরো অনেকে ছবির প্রধান চরিত্র বিষয়ক জটিলতা তৈরি করে। এ বিষয়গুলোকে এই লেখায় বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
সমাধানমূলক বিশ্লেষণ :
* প্রধান চরিত্র – ছবিটির প্রধান চরিত্র মৌসুমী কিংবা শাবনূর কেউই এককভাবে নয়। প্রধান চরিত্র মৌসুমী ও শাবনূর দুজনই শুধু নয়। প্রধান চরিত্রই চারজন – এটিএম শামনুজ্জামান, মৌসুমী, শাবনূর, রিয়াজ।
মোল্লা > এটিএম শামসুজ্জামান
মৌসুমী, শাবনূর > মোল্লাবাড়ীর বউ
রিয়াজ > মোল্লার ছেলে, দুই বউয়ের স্বামী
চারজনকে ঘিরেই ছবির গল্প এগিয়েছে। এই চারজনের কাউকে বাদ দিয়েই ছবিটি পূর্ণতা পাবে না। মোল্লা না থাকলে তার বাড়ির কালচার তুলে ধরা যেত না, বউয়েরা না থাকলে মোল্লার অত্যাচার ও প্রতিবাদ তুলে ধরা যেত না, ছেলে না থাকলে বউ দেখানো যেত না বা গল্পই আসত না।
* ক্যারেক্টারাইজেশন – ক্যারেক্টারাইজেশনের জায়গায় চারজন চরিত্র চাররকম। আবার তাদের মধ্যে কারো কারো মিল বা সাদৃশ্যও আছে। বিশ্লেষণে পরিষ্কার হবে –
১. এটিএম শামসুজ্জামান – এই চরিত্রটি কাঠমোল্লার চরিত্র। ধর্মকর্ম ঠিকমতো না জেনেও যে গ্রামবাসীর উপর আধিপত্য রাখা যায় চরিত্রটি দেখিয়েছে। এটিএমের মাধ্যমে কাঠমোল্লাদের পরিবারে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় পরিবারের সদস্যরা সেটা অসাধারণভাবে দেখানো হয়েছে। পাশাপাশি অত্যাচারীর শাস্তির নমুনা দেখিয়ে সচেতন করা হয়েছে।
২. মৌসুমী – তার চরিত্রটি ছিল শোষিতের। কাঠমোল্লার সংসারে শক্তের ভক্ত নরমের যমের মতো মৌসুমীকে নরম মনের পেয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায়। ভিকটিমের চরিত্র। তার মধ্য দিয়ে সমাজের চরম বাস্তবতাকে দেখানো হয়েছে। পাশাপাশি ক্লাইমেক্সে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বৈশিষ্ট্য পাল্টে।
৩. শাবনূর – তার চরিত্রটি সাইলেন্ট কিলারের মতো। কমেডি রোলে ছবির এন্টারটেইনিং বিষয়টার অন্যতম পার্টিসিপেশন তার। কাউন্টার দেয়া ক্যারেক্টার। প্রতিবাদের জন্য মানসিকভাবে হেল্প করেছে মৌসুমী ও রিয়ায়াজকে।
৪. রিয়াজ – এ চরিত্রটিও ভিকটিম তবে অন্যভাবে। বাবার দেয়া অনুশাসনকে চোখ বুজে মেনে নিয়ে বাস করে। পরে শাবনূরের প্রভাবে ভেতরের প্রতিবাদী সত্তাটা জেগে ওঠে। কমেডি রোলের অংশীদারও সে।
* মেসেজ – ছবির মেসেজে সবগুলো চরিত্রই ভাগ বসিয়েছে। এটিএমের কাঠমোল্লার চরিত্রটি দর্শককে সচেতন করবে এজন্য দর্শক সমাজে এ ধরনের মানুষকে চিনতে পারবে।
মৌসুমীর চরিত্রটি মেসেজ দেবে শোষিত মানুষের প্রতিনিধি হয়ে এবং প্রতিবাদ করতে শেখানোর মাধ্যমে।
শাবনূরের চরিত্রটি মেসেজ দেবে কৌশলে নিজেকে রক্ষা করা এবং অন্যের মধ্যে প্রতিবাদের সত্তা জাগিয়ে দিতে।
রিয়াজের চরিত্রটি মেসেজ দেবে বোকা পেয়ে যাদেরকে স্বার্থের জন্য ব্যবহার করা হয় তারা যেন সচেতন থাকে সমাজে।
* ক্লাইমেক্সের শক্তি – ছবিতে সমাজের শত্রুর হাত থেকে সমাজকে রক্ষার জন্য প্রতিবাদের নমুনা দেখানো হয়েছে। নারীবিপ্লব বলা যেতে পারে একে। এটা ছবিতে দেখানো হয়েছে কৌশলে। জ্বিনে ধরার অজুহাতে মৌসুমীকে শারীরিকভাবে নির্যাতনের পর রিয়াজই তার হাতের বাঁধন খুলে দেয়। রিয়াজ বোকা থেকে সচেতন হয়ে ওঠে শাবনূরের মাধ্যমে কিন্তু শাবনূরকেই বাঁধন খুলতে ভয় পেতে দেখা যায়। পরিচালক এখানে নারী ও পুরুষের নিয়মতান্ত্রিক দূরত্বটা দারুণভাবে দেখিয়েছেন। রিয়াজ বাঁধন খোলার পর শাবনূর ও রিয়াজ দুজনই এটিএমের সাথে বাকযুদ্ধে লিপ্ত হয়। তারপর চলে এটিএমের জ্বিনের আঁচড়ের চিকিৎসা। এটিএম শাবনূরের সব কৌশল জানার পর তাকে খুন করতে যায়। ঠিক এ জায়গাতেই পরিচালক ছবির বিপ্লবী ভূমিকাটি রেখে দেন মৌসুমীর জন্য। ছবির ক্লাইমেক্সের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টা মৌসুমীর হাতেই ঘটে। এমনকি মৌসুমীর সংলাপটিও ছিল সবচেয়ে ধারালো-‘অনেকদিন থাইকা ফুল, পাখি, মেঘ, বৃষ্টি আমারে কানে কানে কইছে অরে মার।’ প্রতিবাদের পর পরিচালক সর্বশেষ চমকটা রেখেছেন শাবনূরকে দিয়ে। মৌসুমীর খুনের ভার নিজের কাঁধে নিয়ে স্যাক্রিফাইসিং রোলে চলে যায় শাবনূর তার লজিক্যাল ডায়লগে-‘ভালোবাসলে মানুষ সব পারে।’ প্যারালালি মোল্লাবাড়ির দুই বউ দুই প্রেক্ষাপটে ছবির গল্পের পরিণতি এনে দেয়। বাবা ও ছেলে সেখানে দুই বউয়ের পরিণতির ধারক। সবচেয়ে বড় কথা সামাজিক সমস্যা ও সমাধান ছবিটি দেখিয়েছে চার চরিত্রের মাধ্যমে। সমস্যা ছাড়া সমাধান দেখানো যায় না তাই দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। এটিএম শামসুজ্জামান, মৌসুমী, রিয়াজ তিনজনই সামাজিক সমস্যাটা দেখিয়েছে তিনভাবে এবং সমাজিক সমাধান দেখানো হয়েছে শাবনূর, মৌসুমী ও রিয়াজের মাধ্যমে তিনভাবে।
চারটি চরিত্রই ছবিতে তাদের ভূমিকাকে অনবদ্যভাবে তুলে ধরেছেন পেশাদার অভিনয়ে। কারো অভিনয়কে বাদ দিয়ে অন্য কারোটাকে বড় করে দেখা যাবে না, যদি কেউ দেখে তবে সে দর্শক/সমালোচক অন্য চরিত্রের প্রতি অবিচার করবে।
‘মোল্লাবাড়ির বউ’ অভিনয়সমৃদ্ধ সোশ্যাল ফ্যামিলি ড্রামা। বিষয়, চরিত্র, পরিণতিতে ফুল প্যাকেজ ছবি। নির্মাতা সালাহউদ্দিন লাভলু চরিত্রের সমান ভারসাম্য রেখে ছবিটি নির্মাণ করেছেন যা অনুসরণীয়।