গভীর শ্রদ্ধায় রোববার জাতি স্মরণ করেছে একাত্তরে ২৫ মার্চের কালরাতে নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার অগণিত শহীদকে। নানা কর্মসুচির মধ্য দিয়ে এদিন দেশজুড়ে পালিত হয়েছে ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’। সভা-সেমিনার, মশাল প্রজ্জ্বালনসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে পাকিস্তান সেনা বাহিনীর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবিও উঠেছে অযুতকণ্ঠে। সেইসঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ়প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেছে সবাই।
মুক্তিযুদ্ধের ৪৭ বছর পর এবার নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো পালিত হলো ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’। তাই সারাদেশে সব আয়োজনেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ দেখা গেছে। জাতীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে সারা দেশে রাত ৯টা থেকে ৯টা এক মিনিট পর্যন্ত আলো নিভিয়ে সেই কালরাতে শহীদদের স্মরণ করা হয়। দিনভর বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের কর্মসূচিতে আলোক প্রজ্বালনের মাধ্যমে শহীদদের স্মরণ ছাড়াও ছিল আলোচনা সভা, সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গীতিনাট্য, কবিতা আবৃত্তি, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র, আলোকচিত্র প্রদর্শনী, স্থাপনাশিল্পের প্রদর্শন প্রভৃতি।
এদিন বাদ জোহর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে ২৫ মার্চের কালরাতে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় কোরআনখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও ছিল একই রকম আয়োজন।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণহত্যার স্মারক প্রদর্শন ও আলোচনা সভা : মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের স্মৃতিবিজড়িত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নানা অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। সেখানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত ‘রক্তাক্ত ২৫ মার্চ :গণহত্যা ইতিবৃত্ত’ শিরোনামে আলোকচিত্র প্রদর্শনী হয়েছে। প্রদর্শনীতে ২৫ মার্চের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের খণ্ডচিত্র উঠে এসেছে।
সকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভ-সংলগ্ন স্থানে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। পরে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
মন্ত্রণালয়ের সচিব অপরূপ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বিশেষ আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান। এ ছাড়াও মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দেশের সব জেলা-উপজেলায় আলোচনা সভা, গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গীতিনাট্য এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
বিকেল ৫টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ‘স্বাধীনতা চত্ত্বরে’ গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র প্রদশনীর মধ্যে দিয়ে শুরু হয় সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ৭১ এর অনুষ্ঠানমালা।
সকাল ১১টায় গণহত্যা দিবস উপলক্ষে সেমিনার আয়োজন করে জাতীয় প্রেস ক্লাব। অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচক ছিলেন শাহরিয়ার কবির।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি মুহম্মদ শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন জনকন্ঠের নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায়। ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্তের সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি সাইফুল আলম, কোষাধ্যক্ষ কার্তিক চ্যাটার্জী প্রমুখ।
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ গণবিচার আন্দোলন ও শ্রমিক-কর্মচারী- পেশাজীবী মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদ শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে গণহত্যার ছবি প্রদর্শন, গণসঙ্গীত, মোমবাতি প্রজ্জ্বালন ও গণহত্যার ওপর প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করেছে। সেখানে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য দেন খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার, এনামুল হক এনাম, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস, রোকেয়া প্রাচী, কামরুল ইসলাম সবজু প্রমুখ।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) সন্ধ্যায় পুরানা পল্টনের মুক্তি ভবনের সামনে থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তন পর্যন্ত আলোর মিছিল ও শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। শহীদদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নেতাকর্মীদের শপথ করান সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
এ ছাড়া ছাত্রলীগ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, জাতীয় গণতান্ত্রিক লীগ, ন্যাপ ভাসানী, বাম ফ্রন্ট,যুদ্ধ দলিল, জাতীয় জাদুঘর,এনডিএফসহ বিভিন্ন সংগঠন দিনব্যাপী কর্মসূচির আয়োজন করে।