মেয়ে সামিরাকে নিয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে
ছোটবেলা থেকেই আমার কাছে ঈদ হলো অন্য রকম এক আনন্দ উৎসব। সময়ের সঙ্গে আনন্দ উদ্যাপনের ধরন হয়তো বদলেছে। তবে এই বয়সে এসেও আমার জন্য ঈদের আনন্দটা ঠিক ছোটবেলার মতোই।
যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠার কারণে আমার কাছে ঈদ মানে পরিবার আর প্রিয়জনদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়া। আমার পরিবার আর বেশির ভাগ আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব ঢাকায় থাকে। তাই আমার কাছে ঢাকার ঈদই সর্বশ্রেষ্ঠ। অনেকেই দেশের বাইরে গিয়ে ঈদ উদ্যাপন করতে পছন্দ করেন। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে দেশের বাইরে তো নয়, এমনকি ঢাকার বাইরে গিয়েও ঈদ করতে মন টানে না।
তবে বছর চারেক আগে আমি পরিবার নিয়ে যুক্তরাজ্যে ঈদুল ফিতর উদ্যাপন করতে গিয়েছিলাম। আমার দুই মেয়ের আবদার মেটাতেই ওই বছর বিদেশের মাটিতে ঈদ করার সিদ্ধান্ত নিই। আমি, আমার স্ত্রী তানিয়া আর দুই মেয়ে নুজহাত ও নামিরা—সবাই ঘুরতে ভীষণ পছন্দ করি। ‘ভ্রমণপিপাসু পরিবার’ বলা যায়। সুযোগ পেলেই আমরা দেশে ও দেশের বাইরে ঘুরতে যাই। তবে ঈদ করতে কখনো পুরো পরিবার নিয়ে দেশের বাইরে যাওয়া হয়নি। তাই ওই বছর আর মেয়েদের আবদার ফেলতে পারিনি।
ঈদের সময় লন্ডনে সপরিবারে নায়ক ফেরদৌস
দেশের বাইরে এটা ছিল আমার দ্বিতীয় ঈদ। এর আগে ১৯৯৭ সালে ভারতে ঈদ করতে হয়েছিল। তখন হঠাৎ বৃষ্টি সিনেমার ডাবিংয়ের কাজে আটকা পড়েছিলাম। বাধ্য হয়েই সেখানে ঈদ করতে হয়েছিল। যা–ই হোক, বিলেতে ঈদ উদ্যাপনের গল্পে ফেরা যাক। সব মিলিয়ে প্রায় ১৮-২০ দিনের সফর ছিল। আমাদের চারজনের পরিবারের সঙ্গে সফরসঙ্গী ছিলেন আমার স্ত্রী তানিয়ার সহকর্মী ক্যাপ্টেন সাফা-নিতি দম্পতি। ঢাকায় ঈদ করতে পারব না বলে শুরুতে বেশ মন খারাপ হয়েছিল। তবে সেখানকার মানুষের আতিথেয়তা আর সন্তানদের আনন্দ দেখে মুহূর্তেই সব ভুলে গিয়েছি।
ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ ঘুরেছিলাম ওই সফরে। ফ্রান্স, স্পেন, ডেনমার্ক ঘুরে ঈদের একদিন আগে লন্ডনে যাই। লন্ডনে আমাদের অনেক বন্ধু থাকেন। তাই ঈদের দিনটা সেখানেই কাটাব বলে ঠিক করা ছিল। কোথাও ঘুরতে যাওয়ার আগে ট্যুরপ্ল্যান তৈরির দায়িত্ব তানিয়া নিজের কাঁধে তুলে নেয়। কোন কোন জায়গা ঘুরে দেখব, কী খাব, কোথায় থাকব—সেগুলোর তালিকা তৈরিতে দক্ষ তানিয়া। ইন্টারনেটের সুবিধা আর তাদের মায়ের দেখাদেখি আমার মেয়েরাও আজকাল এই তালিকা তৈরি করা শিখে গেছে।
লন্ডনে গিয়ে আমার বন্ধু পলাশের বাড়িতে উঠলাম। পলাশ নাছোড়বান্দা। হোটেলে কোনোভাবেই থাকতে দেবে না। কিন্তু লন্ডনে যাওয়ার পর থেকেই আমি শূন্যতা অনুভব করতে শুরু করলাম। ঈদের আগের দিন অথচ লন্ডনে কোনো ঈদের আমেজ নেই। ঢাকার কথা তখন খুব মনে পড়ল। আহা! ঈদের আগের দিন কত আয়োজন, কত ব্যস্ততা। কিন্তু এখানে কিছুই নেই। আমার অবস্থা টের পেয়ে পলাশ আমাদের সবাইকে নিয়ে গেল বাঙালি–অধ্যুষিত এলাকায়। সেখানে পা ফেলতেই বাংলাদেশের গন্ধ পেলাম। বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা হাতে মেহেদি লাগাচ্ছে। আমার মেয়েরাও ওদের সঙ্গে মেহেদি লাগানোর জন্য হাত এগিয়ে বসে পড়ল। কাপড়চোপড়, মেয়েদের গয়নাসহ নানান রকমের দেশি খাবারের দোকান বসেছে সেখানে। আমরাও কিছু কেনাকাটা করলাম সেখান থেকে।
মায়ের সঙ্গে ঢাকার এক ঈদে ফেরদৌস পরিবার
পরদিন সকালে গেলাম ঈদের নামাজ পড়তে। বিশাল এক পার্কে ঈদের নামাজের আয়োজন করা হয়েছে। পুরুষ ও নারীদের জন্য রয়েছে আলাদা নামাজের ব্যবস্থা। পুরো আয়োজন দেখে আমার মন ভরে গেল। সেখানে অনেক বাঙালি নামাজ পড়তে এসেছেন। কয়েকজন বন্ধু আর চেনামুখের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আচমকা আমাকে ঈদের নামাজে পেয়ে তাঁরা সবাই বেশ অবাক হলেন। নামাজ শেষে ওই পার্কে গল্প-গুজব করে অনেকক্ষণ সময় কাটালাম। গ্রামের ঈদগাহ মাঠের পাশে যেমন খাবারের দোকান বসে, বিলেতের ওই পার্কের পাশেও ছিল ঠিক তেমনই আমেজ। সেখানে অস্থায়ী দোকানগুলোতে দেশীয় মিষ্টান্ন, আইসক্রিম, কফিসহ নানান খাবারের জমজমাট বেচাকেনা চলছিল।
নামাজের পর্ব শেষ করে বাসায় ফিরে দেখি এলাহি কাণ্ড। টেবিলভর্তি দেশীয় সব খাবারের আয়োজন করেছে পলাশের স্ত্রী রুম্মন। বিদেশে থাকলেও বাঙালি খাবারের ঐতিহ্য একটুও ভোলেনি তারা। আমার আরেক বন্ধু জায়েদের পরিবারও আমাদের সঙ্গে অংশ নিল। খাওয়াদাওয়া শেষে পলাশের মেয়ে রাইমা আর জায়েদের দুই মেয়ে আলেয়া ও হানিয়াকে সালামি দিলাম। ওদের কাছে সালামি বিষয়টি একেবারেই অচেনা। বাংলাদেশে ঈদের দিন ছোটদের সালামি দেওয়ার সংস্কৃতি ওদের বুঝিয়ে বললাম। সালামি পেয়ে বাচ্চারা ভীষণ খুশি হলো। ওদের দেওয়ার পর আমার মা আর শাশুড়ির কথা মনে পড়ে গেল। কারণ, এখন পর্যন্ত এই দুজন মানুষ আমাকে ঈদের দিন সালামি দেন।
বিকেলে আমরা ব্রিটেনের রানির বাসভবন বাকিংহাম প্যালেস এলাকায় ঘুরতে গেলাম। সেখানে গিয়ে আমার মেয়েরা দারুণ সময় কাটাল। রাতে খাবারের দাওয়াত ছিল জায়েদের বাসায়। জায়েদের স্ত্রী মারিয়াম বারবিকিউ পার্টির আয়োজন করেছিল। আরও অনেক বাঙালি পরিবারেরও নিমন্ত্রণ ছিল সেখানে। সবাই মিলে পেট ভরে খাওয়াদাওয়া আর মন ভরে আড্ডা হলো। ওই বছর লন্ডনে ঈদ না করলে বুঝতামই না যে প্রবাসী বাঙালিরা ঈদের সময় দেশকে কতটা মিস করেন।
সেবার লন্ডনে ঘুরেছেন দলেবলে
ঈদের পরদিন আরও বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখলাম আর কেনাকাটা করলাম। সব মিলিয়ে বেশ ভালো কেটেছিল লন্ডনের ঈদ। যদিও আমার মন পড়ে ছিল ঢাকায়। তাই ঈদের একদিন পরেই ঢাকায় উদ্দেশে রওনা দিই আমরা।
এবার ঈদে দেশের বাইরে কেন, বাড়ির বাইরে যাওয়ারও কোনো পরিকল্পনা নেই। আমাদের দেশে থেকে করোনা এখনো বিদায় নেয়নি। তাই এবারও ঘরে বসেই ঈদ উদ্যাপন করতে হবে। মহামারির কারণে গত বছরের দুই ঈদ বাড়িতেই কেটেছে। ঘরে বসে ঈদ উদ্যাপনের বিষয়টি হয়তো অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না।
এভাবে ঘরে ঈদ উদ্যাপনেরও কিন্তু ইতিবাচক দিক রয়েছে। অন্য বছরের ঈদগুলোর তুলনায় এবার আমরা পরিবারকে বেশি সময় দেওয়ার সুযোগ পাব। কাজকর্মের ব্যস্ততা আর যন্ত্রের মতো ছুটে চলা নগরজীবনে পারিবারকে আর কতটুকুই–বা সময় দেওয়া হয়? তাই ঘরবন্দী এই ঈদকে পারিবারিক বন্ধন মজবুতের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করলে নিশ্চয়ই মন্দ হবে না। আর ঘরে বসেও তো আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেওয়া যায়। আমার মতে, আনন্দ যত ভাগ করে নেওয়া যায়, আনন্দ ততই বাড়ে। আর ঈদের আগে মার্কেটে গিয়ে ঈদের কেনাকাটা না করার জন্য অনুরোধ করব। প্রয়োজনে ঘরে বসে অনলাইনে কেনাকাটা করুন। একান্ত কোনো কাজে বাইরে বের হলে অবশ্যই মাস্ক পরুন।
নিরাপদে থাকুন। ঈদ মোবারক।
(অনুলিখিত)