১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। সকাল ৯টা ৩০ মিনিট। স্থান: সিলেট নগরের মির্জাজাঙ্গাল এলাকা। ছোট্ট একটি টিনশেড ঘর। সেই ঘরের একটি কক্ষে চৌকির ঠিক মধ্যভাগে রাখা রেডিও বাজছিল। রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের খবর প্রচারিত হচ্ছিল। খবর শুনতে রেডিও ঘিরে কয়েকজন জড়ো ছিলেন। ঘরের গৃহিণীরা রান্নাঘরে সকালের নাশতা তৈরি করছিলেন। কেউ আবার ঘরদোর পরিষ্কার করছিলেন। ছোটরা ছিল খেলায় ব্যস্ত।
দীপ্তেন্দ্র কুমার এন্দ ও খনা এন্দ, ছবি: সংগৃহীত
নয় মাস রুদ্ধশ্বাস জীবন শেষে সবার মনে মুক্তির আনন্দ। হঠাৎ একটি মর্টার শেল লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ঘরের সেই কক্ষে গিয়ে পড়ে, যেখানে রেডিও বেজে চলেছে। মুহূর্তেই কালো ধোঁয়া কু্ন্ডলী পাকিয়ে পুরো ঘর অন্ধকার করে ফেলে। ঘরের মেঝে বেয়ে তাজা লাল রক্ত গলির রাস্তা পর্যন্ত গড়িয়ে আসে। চিত্কার-আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। আশপাশের প্রতিবেশীরা এসে আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। এ ঘটনায় মারা যান একই পরিবারের নয়জন সদস্য।
ততক্ষণে বিজয়ের খবর শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। পাড়া-মহল্লায় আনন্দ-উচ্ছ্বাস। বিজয়োল্লাসে মির্জাজাঙ্গালের ভয়াবহ সেই ঘটনা চাপা পড়ে যায়। কিন্তু এ পরিবারের জীবিত সদস্যরা এখনো ওই ঘটনার দুঃসহ স্মৃতি বহন করে চলেছেন। সেদিন বেঁচে যাওয়াদের একজন হচ্ছেন প্রতীক এন্দ, ডাকনাম টনি। প্রতীক বলেন, ওই দিন দেশ স্বাধীন হয়। তাই বিজয়ের আনন্দে সব হারানো এক পরিবারের জীবিত সদস্যদের কান্না মুক্তিপাগল মানুষের কানে পৌঁছেনি। আমার মা-বাবাও সেদিন আহত হয়েছিলেন। এরপর দীর্ঘ ২৮ বছর আমার বাবা এবং ৪৭ বছর আমার মা জীবিত ছিলেন। আমৃত্যু তাঁরা এই যন্ত্রণার স্মৃতি বহন করেছেন। পরিবারের এই বেদনার স্মৃতি আমাদের এখনো কুরে কুরে খাচ্ছে।
সেদিনের ঘটনায় গুরুতর আহত রণজিৎ কুমার এন্দর সঙ্গে মা–বাবা হারানো বাপ্পু এন্দ ও শম্পা এন্দ
যা ঘটেছিল সেদিন
মির্জাজাঙ্গালের যে পরিবারে বিজয়ের দিন এমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেল, সিলেটে সে পরিবারটি ‘এন্দ পরিবার’ নামেই সুপরিচিত। পরিবারের কর্তা দীগেন্দ্র চন্দ্র এন্দ। তিনি ছিলেন সিলেট পৌরসভার অবসরপ্রাপ্ত আবাসিক চিকিত্সক। বয়স ৬৬ বছরের বেশি। কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে স্বর্ণপদকসহ এমবি উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। চিকিত্সা পেশায় তাঁর ছিল ব্যাপক নামযশ। সেদিন বাসার ভেতরের দীগেন্দ্র তাঁর বেয়াই অর্থাৎ বড় ছেলে দীপ্তেন্দ্র কুমার এন্দের শ্বশুর প্রকৌশলী গোপেশ চন্দ্র দাসকে নিয়ে একটি কক্ষে বসে রেডিও শুনছিলেন। তখনই মর্টার শেল ঘরে এসে পড়ে। মুহূর্তেই বেয়াইসহ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন দীগেন্দ্র। ‘জল জল’ বলে চিত্কার করেন। মেঝ ছেলে পার্থ সখা এন্দের স্ত্রী গীতাঞ্জলি এন্দ তাঁর মুখে পানি দেন। কিন্তু পানি পান করতে না করতেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
দীগেন্দ্র চন্দ্র এন্দ ছিলেন সিলেট পৌরসভার অবসরপ্রাপ্ত আবাসিক চিকিৎসক
দীগেন্দ্র ও গোপেশ ছাড়াও সেদিন আরও সাতজন শহীদ হয়েছিলেন। তাঁরা হলেন: দীগেন্দ্রর স্ত্রী সুরুচি বালা এন্দ, ছেলে দীপ্তেন্দ্র কুমার এন্দ, দীপ্তেন্দ্রর স্ত্রী খনা এন্দ, দীপ্তেন্দ্র-খনার ছেলে অপু এন্দ ও মেয়ে পম্পা এন্দ এবং দীগেন্দ্রর দুই মেয়ে সিলেট মহিলা কলেজের তত্কালীন স্নাতক শ্রেণির ছাত্রী শিখা এন্দ ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী শিবানী এন্দ। তবে অন্য কক্ষে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান দীগেন্দ্রর আরেক ছেলে পার্থ সখা এন্দ এবং পার্থর স্ত্রী গীতাঞ্জলি এন্দ, পার্থ-গীতাঞ্জলির দুই ছেলে পরীক্ষিত এন্দ ও প্রতীক এন্দ। প্রতিবেশী আবদুর রহমান চৌধুরীর বাসায় ক্যারম বোর্ড খেলতে যাওয়া দীগেন্দ্রর দুই মেয়ে টুকটুক এন্দ এবং টুলটুল এন্দও বেঁচে যান। দুই পিসির সঙ্গে থাকায় দীপ্তেন্দ্রর সাড়ে চার বছর বয়সী ছেলে বাপ্পু এন্দ ও আড়াই বছর বয়সী মেয়ে শম্পা এন্দ প্রাণে বেঁচে যায়। পায়ে স্প্লিন্টার বিদ্ধ হলেও প্রাণে বেঁচে যান দীগেন্দ্রর ছোট ছেলে রণজিৎ কুমার এন্দও। দীগেন্দ্রর আরও দুই মেয়ে রয়েছেন। তাঁদের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন। ফলে তাঁদের দুঃসহ এ ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়নি।
বেঁচে যাওয়ার বয়ান
সেদিনের ২৯ দিন বয়সী প্রতীকের বয়সও এখন বাংলাদেশের সমান। তিনি এখন সিলেটের নামকরা রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী। জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ সিলেটের সাধারণ সম্পাদক। স্ত্রী ও এক মেয়েকে নিয়ে প্রতীক নগরের মাছুদিঘিরপাড় এলাকায় থাকেন। তিনি বলেন, ‘বয়সের কারণে আমার কিছুই মনে থাকার কথা নয়। তবে ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েও বেঁচে থাকা বাবা-মায়ের মুখে অসংখ্যবার সেই ঘটনা শুনেছি। সারা দেশে যখন বিজয়ের আনন্দ, তখন আমাদের পরিবারে মাতম চলছে।’
এন্দ পরিবারের বেঁচে যাওয়া চার সদস্য। পার্থ সখা এন্দ ও তাঁর স্ত্রী গীতাঞ্জলি এন্দর সঙ্গে পরীক্ষিত এন্দ ও প্রতীক এন্দ। ছবিটি ১৯৭৫ সালে তোলা
প্রতীক আরও বলেন, মায়ের মুখে শুনেছি, যখন মর্টার শেল কক্ষে পড়ে, তখন আমি পাশের একটি কক্ষে ঘুমাচ্ছিলাম। কক্ষের ভেতর ওপর থেকে কাপড়ের গাঁট আর ট্রাঙ্ক আমার ছোট শরীরের পড়ে গিয়েছিল। এতে আমার পুরো শরীর নাকি নীল হয়ে গিয়েছিল। সবাই ভেবেছেন, আমিও বোধ হয় মারা গিয়েছি। এদিকে আমার বাবার বাঁ হাতে অসংখ্য স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়। তাঁর হাতের হাড় বের হয়ে এসেছিল। এ অবস্থাতেই তিনি আমার মুখে জল দিলে জ্ঞান ফেরে। আমাকে সুস্থ দেখার পরই তিনি হাসপাতালে গিয়েছিলেন। চিকিত্সকেরা প্রথমে বাবার হাত কেটে ফেলতে চেয়েছিলেন। পরে যদিও হাত না কেটে চিকিত্সকেরা তাঁর ঊরু থেকে মাংস নিয়ে হাতে অস্ত্রোপচার করে জোড়া লাগিয়ে দিয়েছিলেন। বাবা সেদিন বাঁ কানের শ্রবণশক্তিও হারিয়েছিলেন। আমার মায়ের বাঁ পায়েও স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়েছিল। স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়েছিলেন আমার কাকাও।
সেদিনের ঘটনা বলতে গিয়ে প্রতীক এন্দ বলেন, ‘আমাদের পরিবারের বিভীষিকাময় এই নিষ্ঠুর ঘটনার কথা বাবা খুব একটা বলতেন না। মূলত মা-ই এসব কথা বলতেন আর কাঁদতেন। আমার জেঠা দীপ্তেন্দ্র ও জেঠি খনা সেদিন মারা গিয়েছিলেন। মা-বাবাহীন দুই জেঠাতো ভাই-বোন বাপ্পু ও শম্পা কী করে যে বড় হয়েছেন, সেই স্মৃতি আর মনে করতে চাই না। সাত মাস বয়সী হওয়ায় পম্পার মরদেহ সুরমা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। খনা এন্দকে কেবল চালিবন্দর মহাশ্মশানে দাহ করা হয়েছিল। অপর সাতজন শহীদকে মির্জাজাঙ্গালে ঘটনাস্থলেই সমাধি দেওয়া হয়। মা বলেছেন, মেঝেতে লাশ পড়ে আছে, ছোপ ছোপ রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। কী বীভত্স দৃশ্য! এক মর্টার শেলে মুহূর্তেই আমাদের পরিবারে বিজয়ের আনন্দে বিষাদ নেমে আসে।’
গীতাঞ্জলি এন্দর সঙ্গে তাঁর দুই ছেলে পরীক্ষিত এন্দ ও প্রতীক এন্দ। ২০১৭ সালের ছবি
প্রতীকের বড় ভাই পরীক্ষিত এন্দ সিলেটে কর আইনজীবী হিসেবে সুপরিচিত। স্ত্রী ও এক ছেলেকে নিয়ে তিনি শিবগঞ্জ সাদীপুর এলাকায় বসবাস করছেন। পরীক্ষিত বলেন, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে আমার বয়স ছিল এক বছর। তবে মায়ের মুখে সেদিনের ঘটনা জেনেছি। ৫০ বছর আগের সেই ঘটনার পর আমার বাবা যত দিন জীবিত ছিলেন, তিনি আর স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ফিরে পাননি। আমৃত্যু তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে দুঃসহ সেই স্মৃতি। প্রায়ই আমার মা একই ঘটনার স্মৃতিচারণা করতেন আর কাঁদতেন। আমার জেঠা-জেঠিবিহীন জেঠাতো ভাইবোনদের কাটানো মা-বাবার আদর-মমতাহীন শৈশবের স্মৃতির কথা মনে পড়লেই কান্না পায়। বিজয়ের দিনটি সবার কাছে সব সময় আনন্দ-উচ্ছ্বাস হয়ে হাজির হলেও আমাদের কাছে দিনটি দুঃসহ এক বেদনার ইতিহাস।
[FA]pen[/FA] লেখক: সুমনকুমার দাশ, সিলেট
দীপ্তেন্দ্র কুমার এন্দ ও খনা এন্দ, ছবি: সংগৃহীত
নয় মাস রুদ্ধশ্বাস জীবন শেষে সবার মনে মুক্তির আনন্দ। হঠাৎ একটি মর্টার শেল লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ঘরের সেই কক্ষে গিয়ে পড়ে, যেখানে রেডিও বেজে চলেছে। মুহূর্তেই কালো ধোঁয়া কু্ন্ডলী পাকিয়ে পুরো ঘর অন্ধকার করে ফেলে। ঘরের মেঝে বেয়ে তাজা লাল রক্ত গলির রাস্তা পর্যন্ত গড়িয়ে আসে। চিত্কার-আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। আশপাশের প্রতিবেশীরা এসে আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। এ ঘটনায় মারা যান একই পরিবারের নয়জন সদস্য।
ততক্ষণে বিজয়ের খবর শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। পাড়া-মহল্লায় আনন্দ-উচ্ছ্বাস। বিজয়োল্লাসে মির্জাজাঙ্গালের ভয়াবহ সেই ঘটনা চাপা পড়ে যায়। কিন্তু এ পরিবারের জীবিত সদস্যরা এখনো ওই ঘটনার দুঃসহ স্মৃতি বহন করে চলেছেন। সেদিন বেঁচে যাওয়াদের একজন হচ্ছেন প্রতীক এন্দ, ডাকনাম টনি। প্রতীক বলেন, ওই দিন দেশ স্বাধীন হয়। তাই বিজয়ের আনন্দে সব হারানো এক পরিবারের জীবিত সদস্যদের কান্না মুক্তিপাগল মানুষের কানে পৌঁছেনি। আমার মা-বাবাও সেদিন আহত হয়েছিলেন। এরপর দীর্ঘ ২৮ বছর আমার বাবা এবং ৪৭ বছর আমার মা জীবিত ছিলেন। আমৃত্যু তাঁরা এই যন্ত্রণার স্মৃতি বহন করেছেন। পরিবারের এই বেদনার স্মৃতি আমাদের এখনো কুরে কুরে খাচ্ছে।
সেদিনের ঘটনায় গুরুতর আহত রণজিৎ কুমার এন্দর সঙ্গে মা–বাবা হারানো বাপ্পু এন্দ ও শম্পা এন্দ
যা ঘটেছিল সেদিন
মির্জাজাঙ্গালের যে পরিবারে বিজয়ের দিন এমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেল, সিলেটে সে পরিবারটি ‘এন্দ পরিবার’ নামেই সুপরিচিত। পরিবারের কর্তা দীগেন্দ্র চন্দ্র এন্দ। তিনি ছিলেন সিলেট পৌরসভার অবসরপ্রাপ্ত আবাসিক চিকিত্সক। বয়স ৬৬ বছরের বেশি। কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে স্বর্ণপদকসহ এমবি উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। চিকিত্সা পেশায় তাঁর ছিল ব্যাপক নামযশ। সেদিন বাসার ভেতরের দীগেন্দ্র তাঁর বেয়াই অর্থাৎ বড় ছেলে দীপ্তেন্দ্র কুমার এন্দের শ্বশুর প্রকৌশলী গোপেশ চন্দ্র দাসকে নিয়ে একটি কক্ষে বসে রেডিও শুনছিলেন। তখনই মর্টার শেল ঘরে এসে পড়ে। মুহূর্তেই বেয়াইসহ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন দীগেন্দ্র। ‘জল জল’ বলে চিত্কার করেন। মেঝ ছেলে পার্থ সখা এন্দের স্ত্রী গীতাঞ্জলি এন্দ তাঁর মুখে পানি দেন। কিন্তু পানি পান করতে না করতেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
দীগেন্দ্র চন্দ্র এন্দ ছিলেন সিলেট পৌরসভার অবসরপ্রাপ্ত আবাসিক চিকিৎসক
দীগেন্দ্র ও গোপেশ ছাড়াও সেদিন আরও সাতজন শহীদ হয়েছিলেন। তাঁরা হলেন: দীগেন্দ্রর স্ত্রী সুরুচি বালা এন্দ, ছেলে দীপ্তেন্দ্র কুমার এন্দ, দীপ্তেন্দ্রর স্ত্রী খনা এন্দ, দীপ্তেন্দ্র-খনার ছেলে অপু এন্দ ও মেয়ে পম্পা এন্দ এবং দীগেন্দ্রর দুই মেয়ে সিলেট মহিলা কলেজের তত্কালীন স্নাতক শ্রেণির ছাত্রী শিখা এন্দ ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী শিবানী এন্দ। তবে অন্য কক্ষে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান দীগেন্দ্রর আরেক ছেলে পার্থ সখা এন্দ এবং পার্থর স্ত্রী গীতাঞ্জলি এন্দ, পার্থ-গীতাঞ্জলির দুই ছেলে পরীক্ষিত এন্দ ও প্রতীক এন্দ। প্রতিবেশী আবদুর রহমান চৌধুরীর বাসায় ক্যারম বোর্ড খেলতে যাওয়া দীগেন্দ্রর দুই মেয়ে টুকটুক এন্দ এবং টুলটুল এন্দও বেঁচে যান। দুই পিসির সঙ্গে থাকায় দীপ্তেন্দ্রর সাড়ে চার বছর বয়সী ছেলে বাপ্পু এন্দ ও আড়াই বছর বয়সী মেয়ে শম্পা এন্দ প্রাণে বেঁচে যায়। পায়ে স্প্লিন্টার বিদ্ধ হলেও প্রাণে বেঁচে যান দীগেন্দ্রর ছোট ছেলে রণজিৎ কুমার এন্দও। দীগেন্দ্রর আরও দুই মেয়ে রয়েছেন। তাঁদের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন। ফলে তাঁদের দুঃসহ এ ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়নি।
বেঁচে যাওয়ার বয়ান
সেদিনের ২৯ দিন বয়সী প্রতীকের বয়সও এখন বাংলাদেশের সমান। তিনি এখন সিলেটের নামকরা রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী। জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ সিলেটের সাধারণ সম্পাদক। স্ত্রী ও এক মেয়েকে নিয়ে প্রতীক নগরের মাছুদিঘিরপাড় এলাকায় থাকেন। তিনি বলেন, ‘বয়সের কারণে আমার কিছুই মনে থাকার কথা নয়। তবে ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েও বেঁচে থাকা বাবা-মায়ের মুখে অসংখ্যবার সেই ঘটনা শুনেছি। সারা দেশে যখন বিজয়ের আনন্দ, তখন আমাদের পরিবারে মাতম চলছে।’
এন্দ পরিবারের বেঁচে যাওয়া চার সদস্য। পার্থ সখা এন্দ ও তাঁর স্ত্রী গীতাঞ্জলি এন্দর সঙ্গে পরীক্ষিত এন্দ ও প্রতীক এন্দ। ছবিটি ১৯৭৫ সালে তোলা
প্রতীক আরও বলেন, মায়ের মুখে শুনেছি, যখন মর্টার শেল কক্ষে পড়ে, তখন আমি পাশের একটি কক্ষে ঘুমাচ্ছিলাম। কক্ষের ভেতর ওপর থেকে কাপড়ের গাঁট আর ট্রাঙ্ক আমার ছোট শরীরের পড়ে গিয়েছিল। এতে আমার পুরো শরীর নাকি নীল হয়ে গিয়েছিল। সবাই ভেবেছেন, আমিও বোধ হয় মারা গিয়েছি। এদিকে আমার বাবার বাঁ হাতে অসংখ্য স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়। তাঁর হাতের হাড় বের হয়ে এসেছিল। এ অবস্থাতেই তিনি আমার মুখে জল দিলে জ্ঞান ফেরে। আমাকে সুস্থ দেখার পরই তিনি হাসপাতালে গিয়েছিলেন। চিকিত্সকেরা প্রথমে বাবার হাত কেটে ফেলতে চেয়েছিলেন। পরে যদিও হাত না কেটে চিকিত্সকেরা তাঁর ঊরু থেকে মাংস নিয়ে হাতে অস্ত্রোপচার করে জোড়া লাগিয়ে দিয়েছিলেন। বাবা সেদিন বাঁ কানের শ্রবণশক্তিও হারিয়েছিলেন। আমার মায়ের বাঁ পায়েও স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়েছিল। স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়েছিলেন আমার কাকাও।
সেদিনের ঘটনা বলতে গিয়ে প্রতীক এন্দ বলেন, ‘আমাদের পরিবারের বিভীষিকাময় এই নিষ্ঠুর ঘটনার কথা বাবা খুব একটা বলতেন না। মূলত মা-ই এসব কথা বলতেন আর কাঁদতেন। আমার জেঠা দীপ্তেন্দ্র ও জেঠি খনা সেদিন মারা গিয়েছিলেন। মা-বাবাহীন দুই জেঠাতো ভাই-বোন বাপ্পু ও শম্পা কী করে যে বড় হয়েছেন, সেই স্মৃতি আর মনে করতে চাই না। সাত মাস বয়সী হওয়ায় পম্পার মরদেহ সুরমা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। খনা এন্দকে কেবল চালিবন্দর মহাশ্মশানে দাহ করা হয়েছিল। অপর সাতজন শহীদকে মির্জাজাঙ্গালে ঘটনাস্থলেই সমাধি দেওয়া হয়। মা বলেছেন, মেঝেতে লাশ পড়ে আছে, ছোপ ছোপ রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। কী বীভত্স দৃশ্য! এক মর্টার শেলে মুহূর্তেই আমাদের পরিবারে বিজয়ের আনন্দে বিষাদ নেমে আসে।’
গীতাঞ্জলি এন্দর সঙ্গে তাঁর দুই ছেলে পরীক্ষিত এন্দ ও প্রতীক এন্দ। ২০১৭ সালের ছবি
প্রতীকের বড় ভাই পরীক্ষিত এন্দ সিলেটে কর আইনজীবী হিসেবে সুপরিচিত। স্ত্রী ও এক ছেলেকে নিয়ে তিনি শিবগঞ্জ সাদীপুর এলাকায় বসবাস করছেন। পরীক্ষিত বলেন, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে আমার বয়স ছিল এক বছর। তবে মায়ের মুখে সেদিনের ঘটনা জেনেছি। ৫০ বছর আগের সেই ঘটনার পর আমার বাবা যত দিন জীবিত ছিলেন, তিনি আর স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ফিরে পাননি। আমৃত্যু তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে দুঃসহ সেই স্মৃতি। প্রায়ই আমার মা একই ঘটনার স্মৃতিচারণা করতেন আর কাঁদতেন। আমার জেঠা-জেঠিবিহীন জেঠাতো ভাইবোনদের কাটানো মা-বাবার আদর-মমতাহীন শৈশবের স্মৃতির কথা মনে পড়লেই কান্না পায়। বিজয়ের দিনটি সবার কাছে সব সময় আনন্দ-উচ্ছ্বাস হয়ে হাজির হলেও আমাদের কাছে দিনটি দুঃসহ এক বেদনার ইতিহাস।
[FA]pen[/FA] লেখক: সুমনকুমার দাশ, সিলেট