এ যেন একই স্ক্রিপ্টে একাধিক পরিচালকের নির্মাণ করা নাটক। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কুখ্যাত মাদক চোরাকারবারিকে ঘিরে ফেলেছে। এরপর তিনি পুলিশের উপর বন্দুক হামলা করলে পুলিশ পাল্টা গুলি ছোড়ে। আর তাতে সেই কুখ্যাত ব্যক্তি নিহত হন। অথবা গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে নিয়ে মাদকের আস্তানায় যেতেই গুলিবর্ষণ শুরু হয়। সে সুযোগে পালানোর সময় গুলিতে প্রাণ হারান অভিযুক্ত ব্যক্তি। প্রায় একই গল্প অনুযায়ী বিগত দেড় দশকে প্রাণ দিয়েছেন সাড়ে তিন হাজার মানুষ। এরমাঝে কজন আসলেই অপরাধী আর কজন কেবলমাত্র ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার তা নিয়ে বড় প্রশ্ন থেকেই যায়।
২০১৮ সালে টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরামুল হক র্যাবের সাথে ক্রসফায়ারে নিহত হন। “দূর্ভাগ্যবশত” সেই সময় তিনি তার মেয়ের সাথে ফোনে যুক্ত ছিলেন। ছোট্ট সেই মেয়ের কণ্ঠে কক্সবাজারের আঞ্চলিক টানে বলা, “আব্বু তুমি কাঁদতেছো যে!” আজো দেশের মানুষের গায়ে ভয়ের দাগ বসিয়ে যায়। প্রচুর প্রতিবাদ, নেটিজেনদের স্ট্যাটাস, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিন্দা, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিবৃতি! কোন কিছুর কমতি ছিল না। অথচ পরিস্থিতি বদলেনি একবিন্দু। বরং চলতি বছর, ঈদ-উল-আযহার আগের রাতে কক্সবাজারেই আবার আরেকটি ঘটনায় প্রাণ হারান সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ। এবারেও পুলিশের ভাষ্য, ইয়াবা নিয়ে ফেরার সময় বাঁধা দিলে মেজর সিনহা প্রথমে গুলি ছোঁড়েন তাদের দিকে। অথচ তদন্তে প্রকাশ পেয়েছে মেজর সিনহার হাতে তখন বন্দুকই ছিল না।
২০১৮ সালে নিহত একরামুল হকের স্ত্রী আয়শা বেগম অনেকটা আক্ষেপের সুরেই গণমাধ্যমে বলেছিলেন, তার স্বামী নিহত হওয়ার পর থানায় মামলা করতে গেলেও তা নেয়া হয়নি। উল্টো নানা ধরণের হুমকি-ধমকি দেয়া হয়েছে। তবে এই আক্ষেপ আয়েশা বেগমের একার নয়। এদেশে র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে ক্রসফায়ার, পাল্টাপাল্টি গুলি বর্ষণ কিংবা টকশোর মঞ্চে বিচার বহির্ভূত হত্যার কথা যতবার এসেছে আদতে ততবার বিচারিক কাজ পরিচালিত হয়নি।
দেশের শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা অধিকার তাদের এক জরিপে উল্লেখ করে, ২০০১ সাল থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত প্রায় বিশ বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ৪০০২ জন মানুষ। যার মাঝে অর্ধেকেরও বেশি অর্থাৎ ২ হাজার ১৬৩ জন পুলিশের হাতে এবং ১২শ ২৪ জন র্যাবের হাতে নিহত হন। ২০ বছরে ৪ হাজার, অর্থাৎ প্রতি বছর গড় হিসেবে দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ২০০ জন নিহত হন।
অধিকার তাদের গবেষণায় আরও উল্লেখ করে, ২০০২ সালে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে অপারেশন ক্লিনহার্ট নামে যে অভিযান চালানো হয়েছিল তাতে ৩৯ জন নিহত হয়। তবে তৎকালীন বিএনপি সরকার এ ঘটনাগুলোর দায়মুক্তি দিয়েছিল। তাদের ভাষায় সেটি ছিল শুদ্ধি অভিযান। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই ৪০০২টি বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে শুধু নারায়ণগঞ্জে র্যাবের হাতে ৭ খুন ঘটনার বিচারিক আদালতে বিচার হয়েছিল। কিন্তু সেই বিচারের রায় হলেও তা কার্যকর করা বা অন্য কোন অগ্রগতি দেখা যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের সেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে ২০১৪ সালে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর প্রকাশিত এক নথিতে উঠে আসে এই বিষয়ের ভয়াবহ চিত্র। যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার সমস্যা হল, বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং মানুষকে গুম করে ফেলা। বাংলাদেশের মানবাধিকার সমস্যার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতন ও হয়রানি, কর্মকর্তাদের ব্যাপক দুর্নীতি, নির্বিচারে গ্রেফতার ও নির্যাতন, বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং বিচার ছাড়াই দীর্ঘদিন আটক করে রাখা অন্যতম। তাদের অভিযোগ, শাসকগোষ্ঠী নাগরিকদের অধিকারের ওপর বিভিন্নভাবে অন্যায় হস্তক্ষেপ করেছে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বিভিন্ন সময়ে বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ন্যায়বিচার নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত এমন ঘটনায় সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের প্রথম আট মাসে র্যাব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে মোট ১১৩ জন বিচার-বহির্ভূত হত্যার শিকার হন। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের প্রথম নয় মাসে এই সংখ্যা ১৩৬ জন। এবং এর আগের বছর ২০১৩ সালে মোট ১৭৯ জন বিচার বহির্ভূত হত্যার শিকার হন। এসব হত্যাকাণ্ডকে বেশিরভাগ সময়েই সরকারের পক্ষ থেকে ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ও প্রতিপক্ষের হামলা বলে মন্তব্য করা হয়।
৫ বছর পর এখন সেই সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ার পথে। বৈশ্বিক মহামারির এই বছরেও শুধুমাত্র প্রথম সাত মাসে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে ২০৭টি, এমন তথ্যই দিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র। এর মধ্যে গ্রেফতারের আগে ক্রসফায়ারে ১৪৫ জন এবং গ্রেফতারের পরে ক্রসফায়ারে ৩৭ জন নিহত হয়। বছর শেষে এই সংখ্যা যে আরো বাড়বে তা একপ্রকার নিশ্চিত। সংস্থাটির সিনিয়র ডেপুটি ডিরেক্টর নিনা গোস্বামী বলেন, কোন ধরণের জবাবদিহিতা না থাকার কারণেই এ ধরণের হত্যাকাণ্ড বন্ধ হচ্ছে না।
রাজনৈতিক দিক থেকে বা সরকারের পক্ষ থেকে প্রচ্ছন্ন সমর্থন বাহিনীগুলোতে সাহস যোগায় এ সমস্ত অপরাধের ক্ষেত্রে। ক্রমাগত বিচারহীনতা সরকারি সেই প্রশ্রয় কিংবা বিচারিক দূর্বলতা দুই-ই নির্দেশ করে। অনেক সময় বাহিনীর অনেক সদস্য চাঁদাবাজি বা অর্থ আদায়ের জন্য ক্রসফায়ারকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে। যার সর্বশেষ উদাহরণ মেজর সিনহা হত্যায় অভিযুক্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাস। কক্সবাজার-টেকনাফ অঞ্চলে ক্রসফায়ারের হুমকিতে যিনি কয়েক কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।
দেশে মাদকবিরোধী অভিযানের জন্য মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থাকলেও তাদের নিষ্ক্রিয় মনোভাব এবং পুলিশের অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদর্শন অধিক হারে বিচার বহির্ভূত হত্যা বাড়াচ্ছে বলে মতামত একাধিক বিশ্লেষকের।