হায়া সোফিয়া ঘিরে সবচেয়ে বড় বিতর্কের কারণ চার্চ থেকে বর্তমানে একে পরিণত করা হয়েছে মসজিদে। রাতারাতি এই পরিবর্তন পশ্চিমা মিডিয়া, ক্যাথলিক চার্চ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহ সবখানেই তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানকে ফেলে দিয়েছে বিতর্কের মুখে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে হায়া সোফিয়া আসলে কাদের? উত্তরটা একবাক্যে দেয়া সম্ভব নয়। এটি স্বাভাবিক নিয়মেই ইসলাম বিজয় বা রাজ্য জয়ের কারণে এক ধর্ম থেকে আরেক ধর্মের কাছে গিয়েছে। কিছু সূত্র অনুযায়ী এটি বিক্রি হয়েছে। এক পর্যায়ে কামাল আতাতুর্ক একে জাদুঘর করেছেন।
বাজেন্টাইনদের হাতে
অনিন্দ্য সৌন্দর্যের হায়া সোফিয়া নির্মাণ করতে সময় লেগেছে মোটে ছয় বছর। এর নির্মাণকাজ শেষ হয় ৫৩৭ সালে। এর স্থপতি দুজনেই ছিলেন নিজ নিজ সময়ের শ্রেষ্ঠ স্থপতি। ‘অ্যানথামিউস অব থ্রালেস’ ও ‘ইসিদারুস অব মিলেথুস’ দুজনেই ছিলেন গ্রিক স্থপতি। প্রাচীন গ্রিসের অন্যান্যদের মতো তারাও গণিতে এবং স্থাপত্যবিদ্যায় অসামান্য দক্ষ ছিলেন। সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ান কনস্টানটিনোপোলে হায়া সোফিয়া ক্যাথেড্রালের পরিকল্পনা, নকশা ও বাস্তবায়নের মূল কারিগর।
হায়া সোফিয়ার মূল কেন্দ্রে রয়েছে ১০৫ ফিটের গম্বুজাকৃতির প্রাসাদ এবং তাকে ধরে রেখেছে চারকোনা আরো দুটি উপ-গম্বুজাকৃতি প্রাসাদ। গির্জায় প্রবেশের জন্য কলামের মধ্য দিয়ে আলাদা পথ আছে মোট ৩ টি। বিখ্যাত মর্মর পাথরগুলোর আলাদা কাঠামো আছে। গির্জার নিচের অংশ বা ভিত্তিতে আছে ছিদ্র করা জানালা। এই জানালা বা অকুলাস জিনিসটি খৃষ্টীয় স্থাপনার অনেক বড় নিদর্শন। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি থেকে অনেক বড় নকশাকার নিজেদের কাজে এই অকুলাস ব্যবহার করেছেন। এরপর প্রায় হাজার বছর ধরে বাজেন্টাইন শাসন তথা খ্রিস্টান শাসনের অন্তর্ভুক্ত থাকে হায়া সোফিয়া।
মুসলিম শাসনে
১৪৫৩ সালে বিধ্বংসী আক্রমণ করে ক্রুসেডারদের নিশ্চিহ্ন করে দেন অটোম্যান সম্রাজ্যের বিখ্যাত শাসক ‘সুলতান মাহমুদ’। আগের নাম ‘কনস্টানটিনোপোল’ বদলে নতুন নাম করা হয় ‘ইস্তাম্বুল’। বিজয়ের পর হায়া সোফিয়ার ভেতরেই শুক্রবারের নামাজ আদায় করা শুরু করেন মুসলিম সম্প্রদায়। দ্রুত এই গোটা ভবনকে মসজিদে পরিণত করে ফেলেন অটোমান শাসকেরা। নামাজের সুবিধার্থে খ্রিস্টানদের ছবি ও মূর্তিগুলোকে ঢেকে দেয়া হয়।
এছাড়া স্বর্ণের প্রলেপে আঁকা দেয়াল ও সিলিংয়ের শিল্পকর্মগুলো ক্যালিওগ্রাফি দিয়ে বদলানো হয়। ইসলামিক রীতি মেনে বাইরে চারটি মিনার তৈরি করা হয়। বাইরে আরেকটি কাঠের মিনারের গম্বুজ থেকে মুয়াজ্জিন নামাজের আহ্বান জানাতেন। এর সাথে যুক্ত হয় জাঁকজমকপূর্ণ ঝাড়বাতি, মিম্বর এবং আনুষাঙ্গিক সব কিছু।
অটোম্যান শিল্প ও স্থাপত্যকলার পরিচয় তুলে আনতে সম্রাট দ্বিতীয় সেলিম এবং তৃতীয় মুরাদ আরো দুটো মিনার গড়ে তোলেন পশ্চিম দিকে। এ সবই ১৫০০ সালের বানানো। এগুলোর স্থপতি বিখ্যাত অটোম্যান সিনান। তিনি সুলতান সুলেমানের সম্রাজ্যের প্রধান স্থপতি ছিলেন। তবে অটোম্যান রাজারা গ্রিকদের করা অসাধারণ সব কাঠামো দেখে আর ভেতরে বদলাননি। শতকের পর শতক ধরে এই গির্জা থেকে মসজিদে রূপ নেওয়া পরিবর্তিত পবিত্র স্থানটিই ছিল অটোম্যান রাজত্বের হৃৎপিণ্ড। তারপর আর কোনো ভাঙাগড়া হয়নি বিখ্যাত হায়া সোফিয়ার।
কামাল আতাতুর্কের সেক্যুলার নীতি
১৯৩১ সালে তুরস্কের ক্ষমতায় আসেন কামাল আতাতুর্ক। তিনি তুরস্ককে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। বিলুপ্ত করা হয় খিলাফত। যার প্রেক্ষিতে উপমহাদেশেও খিলাফত আন্দোলন হয়েছিল। যাহোক, সেই সময়ে ১৯৩৪ সালে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয় হায়া সোফিয়াতে আর কোন প্রকার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান চলবে না। এরপর এটি পরিণত হয় তুরস্কের একটি প্রধান জাদুঘরে এবং দেশটির সবচেয়ে বড় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে। সাম্প্রতিক রায়ের আগে পর্যন্ত এই ছিল হায়া সোফিয়ার বিবর্তন পর্ব। সবমিলিয়ে হায়া সোফিয়া ৯২১ বছর গির্জা, ৪৮২ বছর মসজিদ এবং ৮৫ বছর জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
প্রতিক্রিয়া
ইসলামপন্থী গোষ্ঠী এবং ধার্মিক মুসলমানদের দীর্ঘদিনের দাবী ছিল যে হায়া সোফিয়াকে আবার মসজিদে পরিণত করা হোক। বেশ অনেকবার তারা হায়া সোফিয়ার প্রাঙ্গণে নামাযও আদায় করেছেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান গত বছর স্থানীয় নির্বাচনের আগে এক প্রচার সভায় দেয়া বক্তৃতায় বলেন, হাইয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে পরিণত করা ছিল এক “বিরাট ভুল।“ তুরস্কের ইসলামি রাজনীতির ক্ষেত্রে এরদোয়ানের বড় অস্ত্র ছিল এই হায়া সোফিয়া।
আবার পূর্বাঞ্চলীয় অর্থডক্স চার্চের প্রধান দফতর এখন পর্যন্ত ইস্তাম্বুলে। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবাদ এসেছে সেখান থেকেও। অর্থডক্স চার্চের নেতা প্যাট্রিয়ার্ক প্রথম বার্থোলোমিউ সতর্ক করে বলেছেন, এই ভবনকে মসজিদে পরিণত করা হলে সারা পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ খ্রীষ্টান মর্মাহত হবে এবং দুই বিশ্বের মধ্যে ফাটল দেখা দেবে। একইভাবে বলেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। তিনি মনে করেন হাইয়া সোফিয়ায় কোন পরিবর্তন আনা হলে তা এখন যেভাবে দুই ধর্ম বিশ্বাস ও সংস্কৃতির সেতু হিসেবে কাজ করছে তা আর বর্তমান থাকবেনা।
মার্কিন এ্যাম্বাসাডর এ্যাট লার্জ স্যাম ব্রাউনব্যাক তুরস্কের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যেন হাইয়া সোফিয়া এখন যে অবস্থায় আছে তেমনি রাখা হয়। যদিও এসবে কর্ণপাত করেননি এরদোয়ান প্রশাসন। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু জোর দিয়ে বলেছেন, এই ভবনটির অবস্থান তুরস্কের ভূখন্ডে, তাই এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তুরস্কের সিদ্ধান্তই প্রধান।
আদালতের সিদ্ধান্তের পরপরই হায়া সোফিয়াকে মসজিদে পরিণত করতে ঘোষণা দিয়েছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। এক নির্বাহী আদেশও স্বাক্ষর করেন তিনি। তার এ আদেশের মাধ্যমে ৮৬ বছর পর হায়া সোফিয়ায় আযান শুনতে পেলো তুর্কিবাসী। এরদোয়ান বলেন, যখন শুনলাম হায়া সোফিয়াতে আবারও মুসলমান নামাজ আদায় করতে পারবেন। আমি সত্যিই খুব আনন্দিত এতে।
তবে মসজিদে রূপান্তরিত হলেও তুরস্কের অন্য সব মসজিদের মতোই হায়া সোফিয়া উন্মুক্ত থাকবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য। আর এতে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন নিদর্শন যেমন যীশু কোলে মাতা মেরির অবয়ব আঁকা মোজাইক চিত্র এসব অবিকৃত থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন এরদোয়ান।