হাজারো রংয়ে-রুপে সাজানো আমাদের প্রকৃতি। প্রকৃতির এই সৌন্দর্য আমাদের শুধু মুগ্ধই করে না, বরং মনকেও রাখে প্রফুল্ল। তবে প্রকৃতির পরতে পরতে সৌন্দর্যের পাশাপাশি লুকিয়ে আছে হাজারো রহস্য। এমন অনেক ভয়ংকর সুন্দর স্থান রয়েছে যার অস্তিত্ব আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। এসব স্থানের এই অপার সৌন্দর্যের পেছনে কি রহস্য লুকিয়ে আছে তা পৃথিবীর মানুষের কাছে আজও অজানা! ঠিক তেমনই একটি জায়গায় আজ আপনাদের বেড়াতে নিয়ে যাবো। চলুন ঘুরে আসি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নদী, রংধনু নদী নামে পরিচিত কানো ক্রিস্টেলস থেকে।
রংধনু নদী – কানো ক্রিস্টেলস
কলম্বিয়াতে অনেক নদী নালা রয়েছে। বেশির ভাগই নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর। কানো ক্রিস্টেলস তেমনই এক নদী। কিন্তু এটা আর দশটা নদীর মতো যেমন তেমন নদী নয়। এটাকে বলা হয়ে থাকে ‘স্বর্গ থেকে নেমে আসা নদী”, আবার কেউ কেউ বলেন, “তরল রংধনু নদী”। অনেক লেখক একে “পৃথিবীর সবচেয়ে রঙিন নদী’ বলেও আখ্যায়িত করেছি।
রংধনু নদী নামকরণ কেন হল?
কানো ক্রিস্টেলস নদিতে সারা বছর যেন রঙের মেলা বসে। এখানে কেবল একটি কিংবা দুটি রঙ নয়, পাঁচ-ছয়টি দর্শণীয় রঙে রঙিন হয়ে আছে নদির পানি। তাই নদীটিকে রঙের স্বর্গ বলা চলে। যেটাকে দেখলে মনে হবে সৃষ্টিকর্তা তার নিপুণ হাতে পৃথিবীর এক কোণে রঙ ঢেলে সাজিয়েছেন নদীটিকে। উপর থেকে দেখলে মনে হয় যেন নদীর বুকে ছড়িয়ে থাকা প্রকৃতির গুপ্তধন হাতছানি দিয়ে ডাকছে! নদীটি একই সাথে জীব-বৈচিত্রে ভরপুর আর সৌন্দর্য্যে পরিপূর্ণ। সব মিলিয়ে এমন অপূর্ব সুন্দর নদী পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি পাওয়া মুশকিল হবে! আপনাদের নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে কীভাবে এই নদীটি থেকে ৫টি রঙ দেখা যায়? এবার সেই রহস্যের কথাই বলছি।
যেভাবে সৃষ্টি হল রংধনু নদী
যে পাহাড় থেকে কানো ক্রিসটেলস নদীর উৎপত্তি তার নাম সেরিনিয়া ডেলা মাকারিনা। এই পাহাড়টির দৈর্ঘ্য ১২০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ৩০ কিলোমিটার। পাহাড়টি বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, উভয়চর প্রাণী, সরীসৃপ প্রাণী এবং অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের আবাসস্থল। নদীটি পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে ১০০ কিলোমিটার বয়ে গেছে। বছরের বেশিরভাগ সময় নদীটি স্বাভাবিক থাকে। তবে আর দশটি পাহাড়ি নদীর মতো ধূসর পাথরের তলদেশ, শান্ত পানি ও পরিস্কার স্রোত থাকে। কিন্তু শুষ্ক মৌসুম শেষে, বর্ষা মৌসুমে পাঁচটি রঙে রঙিন হয়ে ওঠে এই নদী। চলুন দেখে নেই কোন রঙটি কোন কারণে দেখা যায়-
লাল রঙ
কানো ক্রিস্টেলস নদীর তলদেশে পাথরের গায়ে জন্ম নেয় একধরনের লাল রঙের গুল্ম লতা। এই ছোট ছোট লতাগুলো নদীর স্রোতের সাথে দুলতে থাকে। তাই যেখানে স্রোত বেশি সেখানে লাল রঙের গুল্মলতা বেশি থাকে। ফলে সেই স্থানে নদীর পানির রঙ লালচে দেখায়।
সবুজ রঙ
আর দশটি নদীর মতো কানো ক্রিস্টেলস নদীর পাদদেশে ও পাথরের গায়ে জন্মে থাকে সবুজ গুল্ম ও শ্যাওলা পাতা। ফলে যে স্থানে স্রোত কম থাকে, সেখানে সবুজ রঙ দেখা যায়।
নীল রঙ
আকাশের ছায়া পড়ার কারণে যে কোন নদীর মতো কানো ক্রিস্টেলস এর পানিও নীলচে দেখা যায়। যে স্থানে অন্য কোন রঙ থাকে না, সেখানে তাই নীল দেখা যায় পানির রঙ।
হলুদ রঙ
এবার আসুন হলুদ রঙ প্রসঙ্গে। এই নদীর নিচের বালির স্তর অপেক্ষাকৃত হলুদ রঙের হয়ে থাকে। ফলে নদীর নিচের বালিময় স্থানগুলো উপর থেকে হলুদ রঙের দেখা যায়।
কালচে ও ধুসর রঙ
লাল, নীল, সবুজ, হলুদ ছাড়াও এই নদীর পানি অনেক স্থানে কালচে ও ধুসর রঙের দেখা যায়। এই নদীর নিচের পাথর গুলো প্রায় ১২০০ মিলিয়ন বছরের পুরনো। ফলে এই পাথরগুলো ধুসর রঙ ছেড়ে আস্তে আস্তে কালচে রঙ ধারন করেছে। স্বচ্ছ পানির ঝিলমিল স্রোতের নিচে এই পাথর দেখতে অসাধারণ লাগে।
এভাবে সব রঙ মিলে যেন স্বর্গীয় সৌন্দর্য্য এসে ধরা দিয়েছে এখানে। পাথর শ্যাওলা আর জলজ উদ্ভিদ তো আছেই। এই পানিতে লাল, হলুদ, কমলা, গলাপি রঙের অসাধারন এক সমারহ ভেসে ওঠে এই নদিতে। প্রতিটা ঋতু পরিবর্তনের সাথে এই নদীও সেজে ওঠে ভিন্ন ভিন্ন রঙে।
রংধনু নদীর নৈসর্গিক সৌন্দর্য
কানো ক্রিস্টেলস যে শুধু পাঁচটি রঙের কারণেই সুন্দর, তা কিন্তু নয়। পাশাপাশি এখানে রয়েছে ঝর্ণাধারা, সুইমিং পুলের মতো দেখতে বিরাট জলাশয় ও আন্ডার ওয়াটার গুহা। এই ধরণের ভূ-প্রকৃতি নদীটির সৌন্দর্য্য বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। পাশাপাশি নদীটিকে করেছে রহস্যময়ী। তবে সবচেয়ে আশ্চর্য্য বিষয় হল- এই নদীটিতে মাছ কিংবা অন্যান্য জলজ কোন প্রাণী নেই। ফলে এখানে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের নির্বিঘ্নে সাঁতার কাটা ও নিশ্চিন্ত মনে গোসল করার পরিবেশ দেয়।
ভ্রমন সুবিধা ও অন্যান্য
দুঃখের বিষয় হচ্ছে এই নদীটি কলম্বিয়ার এমন একটি দূর্গম স্থানে অবস্থিত, যেখানে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার ভালো কোনো উপায় নেই। এক সময় এটি সহজগম্যও ছিল না। তারপরও নানা ঝক্কি-ঝামেলা মাথায় নিয়ে দুঃসাহসিক ভ্রমণপিপাসু মানুষেরা সেখানে গিয়েছে। নয়নভরে উপভোগ করেছে কানো ক্রিসটেলসের স্বর্গীয় সৌন্দর্য্য। এখন অবশ্য পার্শ্ববর্তী শহর লা মাকারিনা থেকে আকাশপথে সেখানে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে ২০০৯ সাল থেকে এটি ভ্রমণের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ করেছে কলম্বিয়া। কানো ক্রিসটেলস নদী, এর জন্মদানকারী পাহাড় ও এই অঞ্চলটিকে সংরক্ষিত এলাকাভূক্ত করা হয়েছে। এখন কানো ক্রিসটেলসের পাশে রাতে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। আছে পরিবার পরিজন নিয়ে গিয়ে বন-বাদাড়ে রান্নাবান্না করে খাওয়ার সুব্যবস্থাও।
কানো ক্রিস্টেলস ভ্রমন সুবিধা সম্পর্কে জানতে পারেন ট্রিপ এডভাইজর সাইট থেকে।
প্রকৃতির আসল সৌন্দর্য যদি উপভোগ করতে চান তাহলে জীবনে একবার হলেও কানো নদী থেকে ঘুরে আসবেন। আজকের মত এ পর্যন্তই। ভালো থাকুন সবাই।